ঐতিহাসিক সেই ভাষণের যে অংশ শুনতে পাই না


উদিসা ইসলাম 
  
৭ই মার্চের ভাষণ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ। ঢাকার রমনায় অবস্থিত রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) অনুষ্ঠিত জনসভায় লাখো মানুষের উপস্থিতি। সেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার দিকনির্দেশনাপূর্ণ ভাষণ দেন। বিকেল ২টা ৪৫ মিনিটে শুরু করে বিকেল ৩টা ৩ মিনিটে ভাষণ শেষ করেন জাতির জনক। মোট ১৮ মিনিটের কিছু বেশি সময় স্থায়ী এই ভাষণে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হওয়ার আহ্বান জানান। সচরাচর ভাষণের যে অংশ শুনতে পাওয়া যায় সেটি ১৮ মিনিটের অডিও টেপ থেকে নেওয়া না। সংবিধানেও পুরোটা লিপিবদ্ধ নেই বলে জানাচ্ছেন গবেষকরা। তারা বলছেন, যেহেতু গুরুত্বপূর্ণ কোনও অংশ বাদ পড়েনি এবং বাদ পড়া অংশে বেশকিছু বক্তব্যর ক্ষেত্রে পুনরাবৃত্তি ঘটেছে সেকারণে পুর্ণাঙ্গটা না দিয়ে ‘বিতর্ক’ এড়াতে শুনতে অভ্যস্ত অংশই প্রচারের সিদ্ধান্ত হয়।

২০১৭ সালের অক্টোবরের শেষে ইউনেস্কো ৭ মার্চের ভাষণকে ‘ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’ (বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য) হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এই ভাষণটিসহ মোট ৭৭টি গুরুত্বপূর্ণ নথিকে একইসঙ্গে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে গবেষণা করেন মমতাজুল ফেরদৌস জোয়ার্দার। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ভাষণটা ছিল ১৮-১৯ মিনিটের মতো। যদি আরও সঠিকভাবে বলা হয় তাহলে এটা ছিল ১৮ মিনিট ৩৯ সেকেন্ডের। কিন্তু বিভিন্ন পত্রিকা-বইয়ের লেখকরা যে অংশটুকু লিপিবদ্ধ করেছেন সেটা হল ১১ মিনিটের মতো। এমনকি বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ২০১১ সালে সংবিধানে যে সংশোধনী বা সংযোজন করে (পঞ্চদশ সংশোধন, ২০১১ সনের ১৪ নং আইনের ৫৫ ধারা বলে),  সেখানে সংবিধানের পঁচাত্তর পৃষ্ঠায় গেলে দেখা যাবে পঞ্চম তফসিলে (১৫০ (২) অনুচ্ছেদ) সেটা আছে। এই পঞ্চম তফসিলটাই হলো ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে জাতির জনকের দেওয়া ঐতিহাসিক ভাষণ। সংবিধানে মুদ্রিত অংশটুকু নিশ্চিতভাবেই পুরো ভাষণ না।’

যে অংশগুলো শোনা যায় না তার মধ্যে আছে বঙ্গবন্ধু একদম শেষে বলছেন, ‘যেভাবে আপনাদের, আপনারা ঠাণ্ডা হবেন না, ঠাণ্ডা হয়ে গেলে জালেম আত্মা আরম্ভ করবে আক্রমণ করতে। আপনারা হুঁশিয়ার থাকবেন এবং প্রস্তুত থাকবেন। পজিশন চলবে। কিন্তু মনে রাখবেন, ডিসিপ্লিন ছাড়া কোনও জাতি জিততে পারে না। আপনারা আমার ওপরে বিশ্বাস নিশ্চয়ই রাখেন। জীবনে আমার রক্তের বিনিময়েও আপনাদের সঙ্গে বেঈমানি করি নাই।  প্রধানমন্ত্রীত্ব দিয়ে আমাকে নিতে পারে নাই, ফাঁসি কাষ্ঠের আসামি দিয়ে আমাকে নিতে পারে নাই। যে রক্ত দিয়ে আপনারা একদিন আমাকে জেল থেকে বার করে নিয়ে এসেছিলেন, সেই রেসকোর্স ময়দানে আমি বলেছিলাম, আমার রক্ত দিয়ে আমি রক্তের ঋণ শোধ করবো। মনে আছে? আমি রক্ত দেবার জন্য প্রস্তুত। আমাদের মিটিং এখানেই শেষ। আসসালামোয়ালাইকুম।’
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ

বক্তৃতা রেডিওতে সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যাওয়ার খবরের প্রতিক্রিয়ায় বঙ্গবন্ধু কী বলছেন সেটি সাধারণত পাওয়া যায় না। সেখানে তিনি বলছেন, ‘এখনই শুনলাম আমার এই বক্তৃতা রিলে করা বন্ধ করে দিয়েছে। আমি, আপনারা আমার প্লেয়ার চালায়ে দেন, কারও হুকুম মানতে পারবেন না। তবে আমি অনুরোধ করছি আপনারা আমাদের ভাই, আপনারা দেশকে একেবারে জাহান্নামে ধ্বংস করে দিয়েন না। জীবনে আর কোনোদিন আপনাদের মুখ দেখাদেখি হবে না। যদি আমরা শান্তিপূর্ণভাবে আমাদের ফায়সালা করতে পারি তাহলে অন্ততপক্ষে ভাই ভাই হিসেবে বাস করার সম্ভাবনা আছে। সেই জন্য আপনাদের অনুরোধ করছি, আমার এই দেশে আপনারা মিলিটারি শাসন চালাবার চেষ্টা আর করবেন না।’

এছাড়া পুরো বক্তৃতার বিভিন্ন অংশ পাওয়া যায় না। নিচে কোট আনকোট করা অংশগুলো গবেষকরা বের করলেও এই মূল বক্তৃতার অংশ সচরাচর পাওয়া যায় না। যেমন বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘তারপর বিবেচনা করে দেখবো,  আমরা অ্যাসেম্বলিতে বসতে পারবো কি পারবো না।’ এর আগে ‘অ্যাসেম্বলিতে বসা, আমরা অ্যাসেম্বলিতে বসতে আমরা পারি না। জনগণ সে অধিকার আমাকে দ্যায় নাই’ এই অংশগুলো ভাষণে পাওয়া যায় না।  

আরেক জায়গায় বঙ্গবন্ধু বলছেন, ‘আমরা বাঙালিরা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করেছি, যখনই এ দেশের মালিক হবার চেষ্টা করেছি তখনই তারা আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। তারা আমাদের ভাই, আমি বলেছি তাদের কাছে একথা যে আপনারা কেন আপনার ভায়ের বুকে গুলি মারবেন? আপনাদের রাখা হয়েছে যদি বহিশত্রু আক্রমণ করে তা থেকে দেশটাকে রক্ষা করার জন্য। তারপর উনি বললেন যে আমার নামে বলেছেন আমি নাকি বলে স্বীকার করেছি যে ১০ তারিখে রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স হবে। আমি উনাকে একথা বলে দিবার চাই আমি তারে তা বলি নাই।’

সংবিধানের সংযোজিত ভাষণ এখন প্রকৃত বক্তব্য হিসেবে ধরে নিতে হবে উল্লেখ করে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবীর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘মূল বক্তব্য প্রায় ১৯ মিনিটের। যে বক্তব্যটি শুনতে পাওয়া যায় সেটি আরও কম এবং সংবিধানে যেটা আছে সেটাই প্রকৃত বলে এখন ধরে নিতে হবে। ঐতিহাসিকভাবে সত্য বলে ধরে নেওয়া হয় যেসব তথ্য সেসবের ক্ষেত্রে সন্দেহ করার সুযোগ নেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদ হয়েছেন, কিন্তু তার তালিকা আমাদের কাছে নেই। যেহেতু এটি এখন ঐতিহাসিকভাবে প্রতিষ্ঠিত তথ্য, ফলে এটিই এখন অফিশিয়াল তথ্য। এধরনের তথ্য নিয়ে দ্বিধা প্রকাশ করলে শাস্তির বিধান অন্যান্য দেশে আছে। এই ধরনের ঐতিহাসিক বিষয়ে অফিশিয়ালি যেটি উল্লেখ করা হয় সেটিই প্রতিষ্ঠিত। এর বাইরে বিতর্ক তৈরির সুযোগ নেই।’

৭ মার্চের ভাষণের পুরো অংশ সংবিধানে নেই বলে গবেষকদের দাবির সঙ্গে একমত প্রকাশ করে আওয়ামী লীগের সভাপতি মণ্ডলীর সাবেক সদস্য নূহ উল আলম লেনিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর পূর্ণাঙ্গ ভাষণ পুনরুদ্ধার করা হয়। সেটিরও কিছু জায়গা শোনা যায় না, কিছু জায়গায় পুনরাবৃত্তি আছে। এসব যোগ করলে আমরা যে বক্তব্য শুনতে অভ্যস্ত তার সঙ্গে আরও পাঁচ সাত মিনিট যুক্ত হয়। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী অনুমোদন করা হয় যখন তখন সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের সভাপতিত্বে যে কমিটি হয়েছিল তারা সিদ্ধান্ত নেন, আমরা যে বক্তৃতা শুনে অভ্যস্ত, যেটা সবার কাছে পরিচিত সেটিই রাখা হবে। পূর্ণাঙ্গটির সঙ্গে মিলিয়ে দেখা গেছে বিশেষ কোনও বিশেষ অংশ বাদ পড়েনি। ফলে অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক এড়াতে শুনতে অভ্যস্ত অংশটিই অন্তর্ভুক্ত করা হয়।’

বঙ্গবন্ধুর পূর্ণাঙ্গ ভাষণ না ছাপা হলেও সেটি উল্লেখ করতে হবে দাবি করে প্রবাসী গবেষক মমতাজুল ফেরদৌস জোয়ার্দার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “আমি বেতারের এক কর্মকর্তার কাছ থেকে বেসরকারিভাবে ভাষণের পূর্ণাঙ্গ কপি জোগাড় করি এবং  ভাষণটা ছিল ১৮ মিনিট ৩৯ সেকেন্ডের। সংবিধান থেকে শুরু করে যেখানেই আংশিক প্রকাশ হোক না কেন সেখানে ‘এটি পূর্ণাঙ্গ ভাষণ না’ বিষয়টি উল্লেখ থাকা জরুরি।”

SUMMARY

786-1.jpg