আনিস আলমগীর
১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়ন করলে সুদীর্ঘ ২৩ বছর বিড়ম্বনার শিকার হতে হতো না। কিন্তু ১৯৪৬ সালে দিল্লি কনভেনশনের সংশোধনী মেনে নিয়ে বাঙালি নেতৃবৃন্দ নিজেরা নিজেদের পায়ে শিকল পরালেন। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সুচতুর ছিলেন। তিনি দিল্লি কনভেনশনে সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করালেন বাংলার প্রিমিয়ার হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে দিয়ে। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবও উত্থাপন করেছিলেন অবিভক্ত বাংলার আরেক প্রিমিয়ার শেরেবাংলা এ. কে ফজলুল হক।
লাহোর প্রস্তাবে বলা হয়েছিলো, ভারত উপমহাদেশের পূর্ব ও পশ্চিম প্রান্তে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে দু’টি মুসলিম রাষ্ট্র গঠিত হবে। যা ছিল বাস্তবতার নিরিখে বলা কথা। পরস্পর পরস্পর থেকে ১২ শত মাইল দূরে অবস্থান, এমন বিচিত্র রাষ্ট্র টিকে থাকা তো সম্ভব নয়। দিল্লি কনভেনশনের প্রস্তাবটি ছিল অবাস্তব, কল্পনাবিলাসী প্রস্তাব। তখনই মাওলানা আবুল কালাম আজাদ বলেছিলেন ২৩ বছরের ওপরে এ রাষ্ট্রটি টিকবে না। জওহরলাল নেহরু বলেছিলেন বড় জোর ১৭ বছর টিকবে। তারপর আর্থিক কারণে পূর্বের অংশটি আবেদন করে ভারতের সঙ্গে মিশে যাবে।
নেহরু এ ধারণার বশীভূত হয়ে হিন্দু মহাসভার সভাপতি এবং তার মন্ত্রিসভার মন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির লোক বিনিময়ের প্রস্তাবে সম্মত হননি। শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি বলেছিলেন পূর্ব বাংলার সমগ্র হিন্দু ভারতে আসবে আর সমপরিমাণ মুসলমান ভারত থেকে পূর্ব বাংলায় চলে যাবে। আর শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিকে নেহরু বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, লোকবিনিময় খুবই কঠিন কাজ। যেখানে ১৬/১৭ বছরের মাঝে আর্থিক কারণে পূর্ব বাংলা ভারতের সঙ্গে একত্রিত হওয়ার আবেদন জানাবে সেখানে লোকবিনিময়ের মতো এত বড় কঠিন কাজ মাথায় নেওয়া ঠিক হবে না।
নেহরুর কথায় সম্মত হননি শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি। তিনি নেহরুর সঙ্গে এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করে তার মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ছিলেন সাধক পুরুষ, তার কথাই সঠিক হলো। ২৩ বছরের অধিক সময় পাকিস্তান আর অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারলো না। তবে নেহরুর ধারণা মোতাবেক পূর্ব বাংলার মানুষেরা ভারতের সঙ্গে মিশে যাওয়ার কোনও আবেদন পেশ করেনি বরং দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করে তারা পশ্চিম পাকিস্তানিদের দখলদারিত্বের অবসান ঘটিয়ে নিজেদের ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জন করেছিলেন। অবশ্য এই মুক্তিতে ভারত আমাদের সাহায্য করেছিলো অকাতরে।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত মধ্যরাতে বাঙালিদের নির্বাচিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। ২৫ মার্চই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে তার আলোচনা ব্যর্থ হয়। তিনি সেদিনই অবগত হলেন ইয়াহিয়া খান অপারেশনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বঙ্গবন্ধু তার সহকর্মীদের নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন কিন্তু তিনি নিজে তার ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাসায় বসে রইলেন, কোথাও পালিয়ে গেলেন না।
তাজউদ্দীন সাহেবরা বঙ্গবন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি এ বলে গেলেন না যে তারা আমাকে না পেলে আমার সব মানুষ খুন করবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লেখক রবার্ট পেইন তার ‘ম্যাসাকার’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘মধ্যরাতে তিনি বুঝতে পারলেন ঘটনা দ্রুত বদলে যাচ্ছে। আর দূর থেকে চিৎকারের আওয়াজ ভেসে আসছে। তখনও তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি জানতেন না। কিন্তু তিনি জানতেন যে পূর্ব-পাকিস্তান রাইফেলসের ব্যারাকগুলো ও রাজারবাগ পুলিশ সদর দফতর আক্রান্ত হয়েছে। এর একমাত্র কারণ হচ্ছে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী দেশের বিভিন্ন অংশে বাঙালি সশস্ত্র বাহিনীর ঘাঁটিগুলো ধ্বংস করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তাই সে রাতেই ২৬ মার্চ দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিলেন। সর্বত্র বেতারযোগে পাঠাবার জন্য তিনি নিচের বাণীটি টেলিগ্রাফ অফিসের জনৈক বন্ধুকে ডিক্টেশন দেন।’
রবার্ট পেইন লিখেছেন, তার বার্তাটা ছিলো ‘পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী মাঝরাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইন এবং পিলখানায় পূর্ব-পাকিস্তান রাইফেলসের হেড কোয়ার্টার আক্রমণ করেছে। প্রতিরোধ করার জন্য এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য শক্তি সঞ্চয় করুন।’ মধ্যরাতেই বঙ্গবন্ধু তার বাণীটি তার সহকর্মীদের কাছে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে পৌঁছে দিতে সক্ষম হন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সালিক তার বইয়ে লিখেছেন, তিনি টিক্কা খানের সঙ্গে বসা অবস্থায় ওয়্যারলেসে শেখ মুজিবের স্বাধীনতার ঘোষণা ভেসে আসছিলো। ওই রাতেই পাকিস্তানি বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে নিয়ে যায়। তিনি ৯ মাস পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালী জেলে কারারুদ্ধ ছিলেন। দেশ ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর মুক্ত হওয়ার পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি তিনি দেশে ফিরে আসেন।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর করাচিতে রাজধানী প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিলো। তারপর রাজধানী স্থানান্তরিত হয় রাওয়ালপিন্ডিতে। আবার রাজধানী নিয়ে গেলো ইসলামাবাদে। এভাবে তিনবার রাজধানী গড়তে কোটি কোটি
টাকা খরচ হয়েছিলো তার কোনও উপকারিতা বাঙালিরা পায়নি। সরকারের খরচ জনসাধারণের আয়। সরকার রাজধানীর জন্য খরচ করেছে আর তার থেকে লাভবান হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ। বিচ্ছিন্নতার কারণে পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণ কিছুই পায়নি। অথচ তখন পাকিস্তানের সিংহভাগ বিদেশি মুদ্রা আসতো পাট খাত থেকে। পাট পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ।
অবিভক্ত বাংলার শেষ ব্রিটিশ গভর্নর স্যার ফ্রেডরিক জন বারোজ বলতেন পূর্ব বাংলা হচ্ছে হতদরিদ্র কৃষকের বস্তি। বাংলার পূর্ব অংশে ব্রিটিশের সময়ে কোনও উন্নয়ন হয়নি। তারা পাট উৎপাদন করতো অথচ সব পাটকল গড়ে উঠেছিলো কলকাতার আশপাশে। সিরাজগঞ্জে একটা পাটকল হয়েছিলো, কিন্তু ১৯০৫ সালে আসামের ভূমিকম্পে তা ধ্বংস হয়ে যায়। সে থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত পূর্ব বাংলার লোকের চাকরির আর কোনও অবলম্বন গড়ে ওঠেনি। পূর্ব বাংলায় সবাই ছিলো কৃষিক্ষেত্রের শ্রমিক। বছরে ৩/৪ মাস কাজ থাকতো আর অবশিষ্ট সময় বেকার। তখন ইরি চাষের কোনও ব্যবস্থা ছিলো না। আর প্রতিবছর বন্যা হতো। বন্যা ছিলো পূর্ব বাংলার মানুষের ললাটের লিখন।
সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী হয়ে পূর্ব বাংলার বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য ক্রুক-মিশন গঠন করেছিলেন। কিন্তু তিনি ১৩ মাস পর ক্ষমতাচ্যুত হওয়ায় ক্রুক মিশনের পরিকল্পনা আর বাস্তবায়িত হয়নি। কিন্তু ভাগ্যের ফেরে ভারত থেকে আগত ধনী ব্যবসায়ীরা পাটের পর্যাপ্ততার কারণে পূর্ব বাংলায় রাতারাতি ৭২টি পাটকল প্রতিষ্ঠা করলে পূর্ব বাংলার মানুষের জন্য বিরাট এক চাকরির ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়ে যায়। এবং চাষির ছেলেরা কাঁচা পাটের ব্যবসা করারও একটা সুযোগ পায় আবার।
১৯৫৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় গেলে নদীতে পাম্প বসিয়ে পানি সেচের ব্যবস্থা করে শীত মৌসুমে চাষের ব্যবস্থা করে দেয়। সব মিলিয়ে অর্থনীতির এ কর্মকাণ্ডে বিরাট এক মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব হয়। এ মধ্যবিত্ত শ্রেণিটাই ছিলো শেখ মুজিবের সংগ্রামের হাতের লাঠি।
কোরিয়ার যুদ্ধের সময় পাটের বস্তা রফতানি করে পাকিস্তান কোটি কোটি টাকা আয় করে, আর সে টাকাটা ব্যয় করা হয়েছিলো পশ্চিম পাকিস্তানের রেললাইন সংস্কারের কাজে। পাকিস্তানের সময় বাজেটের ৬০ শতাংশ বরাদ্দ থাকতো কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য আর সে বরাদ্দ থেকে কিছু পেত না পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ। কেননা তিন বাহিনীর হেড কোয়ার্টার ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে, রাজধানী ছিলো পশ্চিম পাকিস্তানে, কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মকর্তা কর্মচারীর মাঝে ৮০ শতাংশ ছিলো পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষ। সুতরাং দিনে দিনে বিরাট এক বৈষম্য গড়ে উঠেছিলো এবং ওই বৈষম্য ব্রিটিশ উপনিবেশের চেয়েও নির্মম ছিলো।
আওয়ামী লীগ জন্মলগ্ন থেকে এ বৈষম্যের কথা বলে আন্দোলন সংগ্রাম করেছে। কিন্তু যেহেতু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিলেন কেন্দ্রীয় সভাপতি, সেহেতু অন্যকিছু চিন্তা করা কারও পক্ষে সম্ভব ছিলো না। কারণ, সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের অখণ্ডতায় বিশ্বাস করতেন। সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য বাংলাকে নিয়ে পৃথক রাষ্ট্র গঠনের চিন্তা করার অবকাশ সৃষ্টি হয় এবং তিনি ১৯৬৬ সালে ৬ দফা প্রদান করে জনমত সংগঠিত করার কাজ শুরু করেছিলেন। ৬ দফা ঘোষণার পর প্রেসিডেন্ট আইয়ুব শেখ মুজিবের আসল উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছিলেন। তাই তিনি ঘোষণা করলেন, ৬ দফা নিয়ে শেখ মুজিব বেশি বাড়াবাড়ি করলে আমরা ‘অস্ত্রের ভাষায় কথা বলবো’।
সোহরাওয়ার্দীবিহীন শেখ মুজিব সফল হবে না ব্যর্থ হবে তা চিন্তা করার অবকাশ ছিল না। কারণ, তার প্রতিজ্ঞাব্যঞ্জক মুখমণ্ডল এবং দৃঢ়চিত্ত পদক্ষেপ ও মানুষ কুড়াবার ক্ষমতা সোহরাওয়ার্দীর অভাবকে বিস্মৃত করে দিয়েছিলো। আইয়ুব খান তার বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দিয়ে মনে করেছিলো তাকে জনসাধারণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া যাবে। কিন্তু মানুষ শেখ মুজিবকে ভারতের পুতুল মনে না করে দেশপ্রেমিক মহান জাতীয়তাবাদী নেতা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। শেখ মুজিব হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু।
আইয়ুবের পরে ইয়াহিয়া খান ক্ষমতায় এসেছিলেন এবং তিনি এলএফও প্রণয়ন করে নির্বাচন দিয়েছিলেন। এলএফও প্রণয়ন করার সময় শেখ মুজিব সংখ্যাসাম্য ভেঙে দিয়ে সংখ্যানুপাতে প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা করার দাবি উত্থাপন করেছিলেন। ইয়াহিয়া তা মেনে নিয়েছিলো। এখান থেকে শেখ মুজিবের বিজয়ের সূচনা। ১৯৭০ সালে শেখ মুজিব এলএফও মেনে নির্বাচন করলেন আর তিনি এ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধু মানুষের কাজে এ নির্বাচনে ৬ দফার ওপর ম্যান্ডেট চেয়েছিলেন। বিপুল ভোটে জিতিয়ে দিয়ে মানুষ তার ছয় দফার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের ১৭ই মার্চ থেকে ২৫শে মার্চ পর্যন্ত ইয়াহিয়াসহ পশ্চিম পাকিস্তানি নেতাদের সঙ্গে শাসনতন্ত্র তৈরির রূপরেখা নিয়া দীর্ঘ আলোচনা হয়েছিলো কিন্তু ফলপ্রসূ হয়নি। ২৫শে মার্চ এ আলোচনা স্থগিত হয়ে যায় এবং ২৫শে মার্চ মধ্যরাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করেন আর ইয়াহিয়া খান অপারেশন চালানোর হুকুম দেন। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়। নেহরু যে বলেছিলেন পূর্ব বাংলার মানুষ আর্থিক কারণে ১৭ বছরের মাঝে আবেদন করে ভারতে যোগদান করবে সে পরিস্থিতির উদ্ভব হয়নি। বরং শেখ মুজিব স্বতন্ত্র স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সফল উদ্যোগ নিয়ে জাতির জনক হয়েছেন। আজ ২৬শে মার্চ বাংলাদেশের ৪৮তম স্বাধীনতা দিবস। বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।