শুভ কিবরিয়া
স্বাধীন বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর একদল সশস্ত্র সদস্য জেলখানার ভেতর ঢুকে আওয়ামী লীগের চার প্রভাবশালী নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এএইচএম কামারুজ্জামান, এম মনসুর আলী ও তাজউদ্দীন আহমদকে হত্যা করে ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর। যা আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে কুখ্যাত ‘জেলহত্যা’ নামে পরিচিত।
সমসাময়িক আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিশ্ব রাজনীতিতে এরকম জেল হত্যার ঘটনা বিরল। জেলখানা তুলনামূলক নিরাপদ ও সংরক্ষিত এলাকা। এখানে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সহায়তায় জেল প্রশাসনের প্রত্যক্ষ উদ্যোগে বন্দুকের নলের মুখে জেলখানায় বন্দি রাজনৈতিক নেতাদের হত্যাকাণ্ড ঘটানো খুবই অদ্ভুত ও ব্যতিক্রমী ঘটনা।
এখানে যে চার আওয়ামী লীগ নেতা নিহত হন, তাদের প্রত্যেকেই বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে ১৯৭১ সালে ভারতে অবস্থানকালীন প্রবাসী সরকারের কর্তাব্যক্তি ছিলেন। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকা অবস্থায় তার নামে গঠিত এই প্রবাসী সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। এএইচএম কামারুজ্জামান এবং এম মনসুর আলী ছিলেন ওই সরকারের দুই প্রভাবশালী মন্ত্রী। তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এই যুদ্ধের রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেন সাফল্যের সঙ্গে। যুদ্ধ শেষে স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধু ফিরে এলে, পরবর্তীতে অর্থমন্ত্রী হন তাজউদ্দীন আহমদ।
১৯৭৪ সালের ২৬ অক্টোবর তিনি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে কথিত ‘জাতির বৃহত্তর স্বার্থে’ পদত্যাগ করেন মন্ত্রিসভা থেকে।
১৯৬৬ থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ যখন মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন, তখন দলের একজন সাধারণ সদস্য এবং সংসদ সদস্য ছিলেন। দলে এবং সরকারের দায়িত্বশীল কোনও পদে না থাকা সত্ত্বেও ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর জেলখানায় তাকে হত্যা করা হয়।
‘কর্তৃপক্ষের ভাষ্য’
১৯৭৫ সালের নভেম্বরে কারগারের প্রধান কর্মকর্তা ছিলেন আইজি, প্রিজনস- নূরুজ্জামান। তার উপস্থিতিতেই কেন্দ্রীয় কারগারে এই হত্যাকাণ্ড ঘটে। এই হত্যাকাণ্ড এবং সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে তার ভাষ্যটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। তার ভাষ্য আমাদের সেসময়ের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা এবং রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে বুঝতে সাহায্য করে। আইজি প্রিজনস, নূরুজ্জামান বলছেন-
‘সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নির্দেশেই ২ নভেম্বর (১৯৭৫) রাতে আমরা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে একত্রিত হই। আমাদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছিল। সম্ভবত সে কারণেই পাগলা ঘণ্টা (সতর্ক ঘণ্টা) বাজিয়ে দেওয়া হয়। আমরা ধারণা করছিলাম রাজনৈতিক কোনও আলাপ-আলোচনার জন্যই বোধহয় কেউ আসবে।
কিন্তু যখন দেখলাম সম্পূর্ণ মাতাল অবস্থায় রক্তবর্ণ চোখ আর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে সামরিক বাহিনীর তিন সেপাই আর এক সুবেদার এসেছে তখন অবস্থাটাই পাল্টে গেল। ওদের নির্দেশ মতো ভেতরে চার নেতাকে অন্য সবার মাঝ থেকে আলাদা করে এক রুমে আনা হলো। ওরা যখন বলল, চার নেতাকে মেরে ফেলতেই ওরা এসেছে তখন আমরা ওই মাতাল অস্ত্রধারীদের সামনে জমে বরফ হয়ে গিয়েছিলাম।
কিন্তু এদিকে আশ্চর্য ব্যাপার হলো, পাগলা ঘণ্টা বাজান সত্ত্বেও নিয়ম মোতাবেক বিডিআর অথবা পুলিশ কেউই সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসেনি। যাই হোক এই সময় সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে ফোনে নির্দেশ আসে ওই অস্ত্রধারী চারজন যা করতে চায় তাই করতে দেওয়া হোক। ওদের বাধা দিলে যেটা হতে পারত আমরা জেল কর্তৃপক্ষ মরতে পারতাম। আমাদের চোখের সামনে জাতীয় সম্পদ চার নেতাকে ওরা গুলি করে হত্যা করল।’
অনিশ্চিত যাত্রা!
১৫ আগস্ট ১৯৭৫ বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পরপরই তাজউদ্দীন আহমদকে গৃহবন্দি করে তখনকার সরকার। ২৩ আগস্ট ১৯৭৫ তাকে কারগারে বন্দি করা হয়। সেই সময়ের স্মৃতি ‘আমার ছোটবেলা ১৯৭১ এবং বাবা তাজউদ্দীন আহমদ’ নামের বইয়ে লিখেছেন তার কন্যা সিমিন হোসেন রিমি। বয়ানটা এরকম–
‘২৩ তারিখ সকালবেলা বাসার সামনে পুলিশের দু’টো জিপ এসে থামল। ঊর্ধ্বতন কোনও অফিসার দোতলায় এসে আব্বুকে জানালেন, এখনই ওদের সঙ্গে যেতে হবে। আব্বু বললেন, তিনি গোসল করবেন, নাস্তা করবেন, তারপর যাবেন। তার আগে তিনি যাবেন না। জানতে চাইলেন সঙ্গে কাপড় নিতে হবে কিনা।
উত্তর এলো: নিলে ভালো হয়।
আব্বু ছোট একটা স্যুটকেসে প্রয়োজনীয় জিনিসসহ কাপড় গুছিয়ে নিলেন। আব্বু যখন ঘর থেকে বের হয়ে এলেন, আমরা চার ভাইবোন তখন ঘরের সামনের বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলাম। আব্বু খুব আলতো করে আমাদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
আম্মা পাশ থেকে জিজ্ঞাসা করলেন: কী মনে হয়, কবে ছাড়বে-টাড়বে?
আব্বু সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললেন: Take it forever, ধরে নাও চিরজীবনের জন্য যাচ্ছি।’
পূর্ব-আশঙ্কা
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে ঘটে গেছে অনেক ঘটনা। খন্দকার মোশতাকের ডাকে আওয়ামী নেতাদের অনেকেই দেখা করেছে তার সঙ্গে। নতুন সরকারে যোগ দিয়েছে আওয়ামী লীগের লোকজন। সেনাবাহিনীতে চলছে নানা উথাল-পাথাল ঘটনা। বিশ্বাস-অবিশ্বাস, সন্দেহ, ভয়, আদর্শহীন আত্মসমর্পণ চলছে। বাইরে এই ঘটনা ঘটছে, তার আঁচ জেলখানায় বসে টের পাচ্ছেন তাজউদ্দীন আহমদ। তার কন্যা নিজের লেখা বইয়ে লিখছেন সেই সময়ের ঘটনা-
‘নভেম্বরের ১ তারিখ (১৯৭৫) শনিবার আম্মা আব্বুর জন্য সঙ্গে খাবারও নিয়ে গেলেন।
সন্ধ্যায় আম্মা বাসায় ফিরলেন। আম্মার মুখ তখন অস্বাভাবিক করুণ।
আম্মা বারবার বলছিলেন, কিছু ভালো লাগছে না।
বাসায় ফেরার আগে উদ্ভ্রান্তের মতো আম্মা ঢাকা-টঙ্গী রাস্তায় ঘুরেছেন অনেকক্ষণ।
আম্মা বললেন: তোমাদের আব্বুকে আজ অন্য রকম লাগছিল। বারবার সে কালো বর্ডার দেয়া লাল ডায়েরির কথা বলছিল। বলছিল, আজ রাতে ডায়েরির শেষ পাতা লেখা হবে, সেই সঙ্গে শেষ হবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস রচনা। বলছিল– ‘আর বোধহয় বাঁচব না।’
আম্মা বললেন: আজ জেল কর্তৃপক্ষ খুব রুক্ষ ব্যবহার করেছে। জেলের মূল গেটের ভেতরে-বাইরে মনে হচ্ছিল যেন সাদা পোশাকে বিশেষ কোনো সংস্থার অতিরিক্ত লোকজন।’’
শত্রু পক্ষের ভয়
বঙ্গবন্ধুকে যখন হত্যা করা হয়, সে সময় তাজউদ্দীন আহমদ সরকার বা দলে কোনও গুরুত্বপূর্ণ মানুষ ছিলেন না। দল বা সরকারের প্রভাবশালী বলয়ের বাইরে ছিটকে পড়েছেন তিনি এই বিয়োগান্তক ঘটনার বহু আগেই। তবুও তাজউদ্দীন আহমদকে কেন টার্গেট করা হলো? তাকে কেন জেলখানার অভ্যন্তরে খুন করা হলো?
প্রশ্নটা তোলা যায় সহজেই, তাজউদ্দীন আহমদ এত গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হলেন কেন যে, বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তাকেও হত্যা করতে হবে? ইতিহাসের দায় হিসেবে এই ঐতিহাসিক রাজনৈতিক প্রশ্নটির কোনো নিশ্চিত উত্তর পাওয়া যায়নি।
তবে অনুমান করা যায়, তাজউদ্দীন আহমদ শত্রুপক্ষের কাছে খুব প্রয়োজনীয় প্রতিপক্ষ ছিলেন। শত্রুপক্ষ হয়তো অনুমান করেছে তাজউদ্দীন আহমদ জীবিত থাকলে এই রাজনৈতিক অনাচারের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে যেতে পারেন তিনি। হয়তো শত্রুরা ভেবেছে এই অন্যায় খুনের রাজনৈতিক প্রতিরোধের নেতৃত্ব কোনও না কোনোভাবে হাতে তুলে নিতে পারেন এই প্রত্যয়ী, আদর্শবান, সাহসী মানুষটি।
তাজউদ্দীন আহমদের সেই ঘরাণার অতীত রেকর্ড ছিল। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে গ্রেফতার হলে, তাজউদ্দীন আহমদ তার সহকর্মীদের নিয়ে গড়ে তোলেন রাজনৈতিক ও সশস্ত্র প্রতিরোধ। বঙ্গবন্ধুর নামে পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে যুদ্ধদিনের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদের অসাধারণ নেতৃত্বেই আসে বাংলাদেশের বিজয়। সেই ইতিহাস সন্ত্রস্ত করেছিল শত্রুপক্ষকে ১৯৭৫ সালের সেই দিনগুলোতেও।
তথ্যসূত্র : আমার ছোটবেলা ১৯৭১ এবং বাবা তাজউদ্দীন আহমদ, লেখক- সিমিন হোসেন রিমি, প্রতিভাস, ফেব্রুয়ারি ২০০১
লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক