সাজ্জাদ সাকিব বাদশা
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বঞ্চিত-বিক্ষুব্ধ একটি জনপদের মানুষকে অধিকার এনে দিয়েছে নিজেদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার। মূলের সঙ্গে মিল রেখে যে রাষ্ট্রের নাম হয়েছে বাংলাদেশ। বয়স বিবেচনায় আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের চেয়েও জ্যেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান। সে হিসেবে আওয়ামী লীগের ঔরসে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশ জন্ম পরবর্তী সময়ে মননে-গড়নে বেড়েও উঠেছে আওয়ামী লীগের তত্ত্বাবধানে, সযত্ন পরিচর্যায়। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় রাষ্ট্র নিজেই যখন প্রধান কর্তা, সেই কর্তার ভিত্তি ও নিক্তি সহ আনুষাঙ্গিক সবকিছু প্রস্তুত করে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। রাষ্ট্রের গঠন, স্থায়িত্ব লাভ, রুটিন কার্যক্রম পরিচালনার প্রতিটি ক্ষেত্রেই আওয়ামী লীগ বাংলাদেশ রাষ্ট্রের হয়ে সময়ের প্রয়োজনে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে নিষ্ঠার সাথে, নির্মোহভাবে, লাভ-ক্ষতির বিচার না করেই। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তাই অনন্য, অতুলনীয়।
দু’শ বছরের শোষণ শেষে ১৯৪৭ সালে বিকলাঙ্গ রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম পাকিস্তানের। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য পূর্ব বাংলার মানুষের অবদান ও তৎপরতা সবদিক দিয়েই উল্লেখযোগ্য হওয়ার পরেও ‘অধিকারের বণ্টন ও স্বীকৃতি প্রাপ্তি’র ক্ষেত্রে পূর্ব বাংলা যখন বৈষম্যের স্বীকার শুরু থেকেই, তখন নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানে সর্বব্যাপী নতুনত্বের আহ্বান জানিয়ে জন্ম নেয় আওয়ামী লীগ। জন্মক্ষণ থেকে আজ অবধি আওয়ামী লীগ নতুনত্বের পূজারী। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচন, আওয়ামী মুসলীম লীগ থেকে ‘মুসলীম’ শব্দের শিরোচ্ছেদ, আইয়ুবের মৌলিক গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে জনগণতন্ত্রের ধারণা প্রবর্তন, পাকিস্তানিদের জন্য ভূমিকম্পন সৃষ্টি করা ‘মুক্তির সনদ ছয় দফা’ প্রণয়ন, মুক্তি সংগ্রামের শুরুতেই মুক্তিযুদ্ধের রীতি ও কৌশল প্রণয়ন করে জনগণকে তার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা, সত্তরের সাধারণ নির্বাচন, ৭ই মার্চের ভাষণ, মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা, স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র প্রণয়ন, অস্থায়ী সরকার গঠন, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা, যুদ্ধ বিজয় প্রক্রিয়ার প্রতিটি ক্ষেত্রেই আওয়ামী লীগ অভিনব পরিকল্পনা ও সময়োপযোগী যোগ্যতার পরিচয় দিয়ে সময়ের সেরা সিদ্ধান্তগুলো গ্রহণ করেছে। এই সিদ্ধান্তগুলো প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগকে যে পরিমাণ ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে, সেই ত্যাগগুলো বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের ক্ষেত্রে এক একটি ইটের শক্ত গাঁথুনি হিসেবে কাজ করেছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে মাত্র ১১ মাসে তৎকালীন বিশ্ব বাস্তবতায় সর্বোৎকৃষ্ট, ন্যায় ভিত্তিক সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশকে বিশ্বের বুকে নতুন উদীয়মান শক্তি হিসেবে পরিচিত করিয়ে দেয় আওয়ামী লীগ। পরবর্তীতে যুদ্ধ বিধ্বস্ত হয়েও দেশিয় অর্থনীতির কাঠামো নির্মাণ এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বীকৃতি-সম্মাননা প্রাপ্তিতে বাংলাদেশকে এক অতুলনীয় জায়গায় পৌঁছে দেয় আওয়ামী লীগের ডায়নামিক নেতৃত্ব, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে।
৬৮ বছরের পরিণত আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতৃত্বকে উপযুক্ত স্থানে রেখে আওয়ামী লীগের এই দীর্ঘ যাত্রাকে প্রধানত দুই পর্বে ভাগ করা যায়- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পর্ব এবং বঙ্গকন্যা শেখ হাসিনা পর্ব। বিবেচ্য বিষয়টি হলো, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অগ্রযাত্রাকে যদি ব্যবচ্ছেদ করা হয় তাহলে দেখা যাবে- জন্মকালীন সময়ে বঙ্গবন্ধু এবং বিকাশ পর্বে শেখ হাসিনা হাল ধরেছেন বাংলাদেশের। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব ও বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা সমান্তরাল। আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের হাত ধরেই বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে শুরু থেকে আজ অবধি। স্থল সীমানা নির্ধারণ, সমুদ্র সীমায় বৈধ মালিকানা প্রতিষ্ঠা, বিষফোঁড়া দূর করে পার্বত্য শান্তিচুক্তি প্রণয়ন, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, কৃষিতে অগ্রগতির পাশাপাশি শিল্পে উন্নতকরণ, ডিজিটাল বাংলাদেশের স্লোগান তোলা ও সে স্লোগানের বাস্তবায়ন করা, দেশের অবকাঠামো বিনির্মানে অভূতপূর্ব প্ররিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন, বিদ্যুৎ উৎপাদন, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু তৈরি, বৈশ্বিক পর্যায়ে দেশকে নেতৃত্ব ও সুনাম-সম্মানের স্থানে পৌঁছে দেওয়া ইত্যাদি প্রতিটি কাজই সম্পন্ন হয়েছে ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। এবং প্রতিটি কাজই বাংলাদেশকে রাষ্ট্র হিসেবে শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছে।
সন্তানের কাছে তার মায়ের অপমান, পিতা হত্যা ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের জন্য ন্যায়বিচার পাওয়া যেমন গুরুত্বপূর্ণ-অপরিহার্য, তেমনি ১৯৭১ সালের হত্যা-ধর্ষণ-লুটের মতো অন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত অপরাধ এবং ১৯৭৫ সালের বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যাকাণ্ডের বিচার কাজ সম্পন্ন করা কোনও নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা দলের নয় বরং রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের নিজস্ব দায় এবং দায়িত্ব, গুরুত্বপূর্ণ-অপরিহার্য। বাংলাদেশের হয়ে এই দায় মিটিয়ে কেউ বাংলাদেশকে ঋণমুক্ত করেনি। করেছে আওয়ামী লীগ। মানব জাতির ইতিহাসে জঘন্যতম এসব অপকর্মে বিচার নিশ্চিত করে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশকে পৃথিবীর সামনে নতুন পরিচয়ে তুলে ধরেছে- বাংলাদেশ বেঈমান রাষ্ট্র নয়, বাংলাদেশ তার পিতা হত্যার, সাধারণ জনগণ হত্যার, ধর্ষণের বিচার করে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করার সক্ষমতা, সাহস রাখে।
রাজনৈতিক দল হিসেবে রাজনীতিতে প্রচলিত এমন কোনও হীন ষড়যন্ত্র নাই যার সম্মুখীন হতে হয়নি আওয়ামী লীগকে। পরাধীন ব্যবস্থায় থেকে দীর্ঘ নির্যাতন সহ্য করে মনোবল ধরে রেখে দেশকে স্বাধীন করেছে আওয়ামী লীগ। স্বাধীন দেশে নতুনভাবে সব কিছু শুরু করার প্রারম্ভেই রাতের আঁধারে হত্যা করা হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে। বঙ্গবন্ধুহীন আওয়ামী লীগ দীর্ঘ ২১ বছর জিয়া-এরশাদের সামরিক শাসন ও খালেদা জিয়ার কুশাসন, অত্যাচার সহ্য করে ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশকে আবার ফিরিয়ে দিয়েছে তাঁর অস্তিত্বের ঠিকানা বঙ্গবন্ধুকে, মুক্তি সংগ্রামের চেতনা-বিশ্বাসকে। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালিয়ে বঙ্গকন্যা শেখ হাসিনা সহ দলের সিনিয়র নেতৃত্বকে এক সাথে হত্যা পরিকল্পনা থেকেও আওয়ামী লীগ ওঠে এসেছে। ২০০৭ সালের অবৈধ সামরিক-তত্ত্বাবধায়ক সরকার বহু ষড়যন্ত্র করে শেখ হাসিনাকে জেলে পুরেও আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করতে পারেনি। অধিক শক্তি সঞ্চয় করে আওয়ামী লীগ ফিরে এসেছে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর। বারবার জনগণের ভোটের রায় পরিবর্তন করে আওয়ামী লীগকে জনগণের সেবা করার পবিত্র অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। তবুও আওয়ামী লীগ থেমে থাকেনি। প্রতিবার ফিরে এসেছে পূর্বের থেকেও অধিক শক্তি নিয়ে। প্রতিবার গ্রহণ করেছে দেশের জন্য, মানুষের জন্য সময়ের সেরা সিদ্ধান্তটি। সময়ের প্রয়োজনেই আওয়ামী লীগ রক্ত দিয়েছে, দেশের শাসনভার গ্রহণ করেছে। সময়ের প্রয়োজনে প্রতিবার আওয়ামী লীগ রক্ত দিয়ে যাবে। বাংলাদেশ ও আওয়ামী লীগ সমার্থক। অতীতের মতো আওয়ামী লীগে সময়ের শ্রেষ্ঠ সব মেধাবীদের সমন্বয় ঘটাতে হবে, প্রস্তুত থাকতে হবে। সময় নিজেই ধরে রেখেছে, ধরে রাখবে আওয়ামী লীগকে, নিজের প্রয়োজনেই। আওয়ামী লীগ জনগণকে সাথে নিয়ে টিকে রাখবে বাংলাদেশকে; এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের প্রাণের বাংলাদেশকে।
শুভ জন্মদিন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
লেখক: সাবেক সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ এবং পরিচালক, সিআরআই