আনিস আলমগীর
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। ওই বছরে কোনও এক সময় ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী স্যার অ্যাডওয়ার্ড হিথ বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন- কারারুদ্ধ নেতার একটা ভাষণ একটা জাতিকে তার অনুপস্থিতিতে ঐক্যবদ্ধ রেখে দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করার অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে এবং লক্ষ লক্ষ যুবককে প্রাণ বিসর্জন দিয়ে দেশকে স্বাধীন করতে উদ্বুদ্ধ করেছে এমন বিরল ঘটনা ইতিহাসে দুর্লভ। অথচ নেপোলিয়নের মতো লোকের গ্রেফতারের পর নেপোলিয়নের জন্য ফরাসি জাতি অনুতাপ পর্যন্ত করেনি। বঙ্গবন্ধু হিথকে বলেছিলেন, ‘ইউর এক্সেলেন্সি নান ইজ কমপেয়ারএবল উইথ নেপোলিয়ন বোনাপার্ট।’
বীরের প্রতি এক বীর সম্মান দেখাবেন এটাই স্বাভাবিক। বঙ্গবন্ধুও বীর নেপোলিয়ান বোনাপার্টের প্রতি সে সম্মান দেখিয়েছিলেন সত্য কিন্তু বাস্তবতা তো ছিল হিথের কথায়। নেপোলিয়ান বোনাপার্ট যখন ওয়াটার লুর যুদ্ধে পরাজিত হয়ে সেন্ট হেলেনায় ইংরেজদের কারাগারে মৃত্যুর প্রহর গুনছিলেন তখন কিন্তু ফরাসি জাতির উদাসীনতা ছিল মর্মান্তিকভাবে উপলব্ধি করার মতো। ফরাসি জাতি সেদিন তার এ বীর সন্তানটির জন্য কোনও অনুতাপ করেনি। এমনকি তার স্ত্রী পর্যন্ত সেদিন তাকে পরিত্যাগ করেছিলো। ফরাসি জাতির ইতিহাস বলে সমগ্র ফ্রান্সে সেদিন নেপোলিয়নের মা ছাড়া অনুতাপ করার কোনও লোক ছিল না।
স্যার অ্যাডওয়ার্ড হিথ বঙ্গবন্ধুর যে ভাষণটির কথা উল্লেখ করেছিলেন সে ভাষণটি প্রদানের দিন ছিল ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ। বাঙালি জাতির ইসিহাসে এক অসাধারণ দিন। লিংকনের গেটিসবার্গ অ্যাড্রেস, ফিল্ডমার্শাল মন্টোকুমারির, আল-আমিনের অ্যাড্রেস ইত্যাদি নিয়ে দুনিয়ার বিখ্যাত বক্তৃতামালার যে বইতে লিপিবদ্ধ হয়েছে সে বইতে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের রেসকোর্স অ্যাড্রেসও স্থান করে নিয়েছে আর বিশ্বের পরাধীন আর নির্যাতিত মানুষকে অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে।
বাংলাদেশের মানুষের কাছে তো এ ভাষণটি এখনও অম্লান হয়ে আছে। বাঙালি তার সব প্রেরণা, উদ্দীপনা পায় এ ভাষণটি বাজিয়ে। যে অফুরন্ত প্রেরণা ছিল এ ভাষণটিতে তা স্বাধীনতা প্রাপ্তির পাঁচ দশকের মাঝেও নিঃশেষ হয়নি।
১৯৭১ সালের মার্চ মাস বাঙালির জাতির ক্রান্তিকাল।। ৫ ও ৬ মার্চ পর্যন্ত আওয়ামী লীগ নেতারা দীর্ঘ সময়ব্যাপী নাকি সভা করে আলোচনা করেছিলেন কী বক্তব্য দেবেন বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ রেসকোর্সে। আওয়ামী লীগ নেতাদের কথা এক রকম আর ছাত্রনেতাদের কথা ছিল সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে হবে। আবার পাকিস্তানিদের কাছ থেকে হুমকি আসছিলো স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া হলে জনসভায় বোম্বিং করা হবে। তিন দিন আগে থেকে সামরিক হেলিকপ্টার টহল দিচ্ছিলো রেসকোর্স ময়দানের ওপর। সবার ধারণা ছিল ময়দানে লোকসমাগম হবে ১৫ থেকে ২০ লক্ষ। যদি কোনওভাবে পাকিস্তানি সেনারা বোম্বিং করে তবে মারা যাবে কয়েক লক্ষ লোক। জালিয়ানওয়ালাবাগের চেয়েও ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হবে। যে কোনও মহাবীরেরও শরীর শীতল হয়ে যাবে এরূপ পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখে শুনেছি তখন বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব নাকি বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন- 'তোমার মুখে যা আসে তাই বলে দিও'। যে লোক আজন্ম স্বজাতির মুক্তির সাধনা করেছেন, সে সাধক পুরুষটিকে কখনও কি কৌশলি কথা শিখিয়ে দিতে হয়!
কৌশলি রাজনীতির মহাসাধক ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আর তার পদপ্রান্তে বসে তিনি কৌশলি রাজনীতির পাঠ নিয়েছেন দীর্ঘ সময়ব্যাপী। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে তিনি মঞ্চে উঠে যথা নিয়মে এক নাতিদীর্ঘ ভাষণ দিলেন। সামরিক হেলিকপ্টার যথা নিয়মে ময়দানের ওপরে টহলও দিয়েছিলো। কিন্তু গুলিও করলো না বোম্বিংও করলো না। কেউই এ ভাষণে অসন্তুষ্টও হলো না। ভাষণটা ছিল গীতা ভাষ্যের মতো- যে যেদিকে তফসির করেছে সে তার উত্তর পেয়েছে। সমবেত ১৫ লক্ষ মানুষের প্রাণে নতুনভাবে স্বাধীনতার জন্য নবীন প্রেরণার জন্ম দিল এ ভাষণটি। সবার কানে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হলো ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
যে জাতি স্বাধীনতা অর্জন করবে বলে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়, তার জন্য ন্যায্যমূল্য দিতেও প্রস্তুত- তার স্বাধীনতা রুখে কে? বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে দীর্ঘ সময়ব্যাপী পরিশ্রম করে ধীরে ধীরে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করেছিলেন। বাঙালি জাতি সেদিন বঙ্গবন্ধুর দিক নির্দেশনার বাইরে এক পাও রাখেনি। পঙ্গপালের মতো আত্মহুতি দিয়েছে, পিছু হঠেনি। একজন নেতার কথায় এভাবে একটা জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংকট মোকাবিলা করা বিশ্ব ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনা। এটা আবার বাঙালি জাতির বাহাদুরীর ব্যাপারও।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের অভ্যূদয় আর বাঙালির বিজয় বিশ্ব ইতিহাসের এক প্রেরণাদায়ক ঘটনা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে যখন হত্যা করা হলো তখন থেকে বাংলাদেশটাকে নিয়ে এক আন্তর্জাতিক খেলার শুরু। কোনও জাতির স্বাধীনতা লাভ করা যেমন কঠিন বিষয় আবার স্বাধীনতা রক্ষা করা কখনও কখনও কঠিনতর বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। আয়ারল্যান্ড- এর মানুষ ৭ শত বছর যুদ্ধ করেছে ইংরেজদের বিরুদ্ধে। কোনও দেশের পাশের রাষ্ট্র যদি শক্তিশালী হয় আর চতুর বুদ্ধিতে যদি ছোট দেশটাকে অধিকার করতে চায় তখন ছোট দেশটার ভাগ্য এরূপ দুর্যোগ নেমে আসে। আয়ারল্যান্ডেরও অবস্থা হয়েছিলো তাই। কিন্তু আয়ারল্যান্ড এ অবস্থা মোকাবিলা করেছিল রক্ত ঢেলে ঢেলে।
ঐতিহাসিকেরা বলেন রোম সাম্রাজ্য টেকেনি, টেকার ইচ্ছা ছিল না বলে। কিন্তু আয়ারল্যান্ডের টেকার ইচ্ছায় ৭ শত বছরব্যাপী রক্ত ঢেলেছে আর টিকে গেছে। অনেককে বলতে শুনেছি বাঙালি জাতি টিকতে পারবে না কারণ তার পক্ষে অর্থনীতি দাঁড় করানো নাকি সম্ভব হবে না। আমি অর্থনীতির ছাত্র ছিলাম না। অর্থনীতির হিসাব নিকাশ বুঝি না। তারা বলতেন ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রতিযোগিতায় টিকবে না। শেষ পর্যন্ত ভারতের অর্থনীতি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে গিলে খাবে। অথচ গত পাঁচ দশকের মাঝে ভারতের অর্থনীতি বাংলাদেশের অর্থনীতিকে গিলে খেতে পারেনি বরং বাংলাদেশের অর্থনীতির জৌলুস বেড়েছে। সম্ভবতো টিকে থাকার ইচ্ছে নিয়ে বাংলাদেশ লড়ছে বলে টিকে গেছে।
রোমান সাম্রাজ্যের মতো টিকে থাকার ইচ্ছে না থাকলে বিলীন হয়ে যেত। বারে বারে বাংলাদেশ ক্রান্তিলগ্নের মোকাবিলা করে আগামীতেও আমাদের ক্রান্তিকালীন সময়