এমরান হোসাইন শেখ
খ্যাত কবি অন্নদা শংকর রায় তার কবিতায় লিখেছেন—‘নরহত্যা মহাপাপ, তার চেয়ে পাপ আরো বড়ো/করে যদি তাঁর পুত্রসম বিশ্বাসভাজন/জাতির জনক যিনি অতর্কিতে তাঁরেই নিধন।/নিধন সবংশে হলে সেই পাপ আরো গুরুতর।’ ‘হ্যাঁ’ বাঙালি সেই গুরুতর পাপই করেছে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। এদিন সন্তানসম বিপথগামী কিছু বাঙালির হাতে নির্মমভাবে নিহত হন জাতির জনক বঙ্গবন্ধ শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি ও স্বাধীনতাসংগ্রামের মহানায়ককে কতিপয় চক্রান্তকারী সেনাসদস্য এ দিন নৃশংসভাবে সপরিবারে হত্যা করে। তাদের বর্বরতা থেকে শিশু ও নারীরাও রেহাই পাননি। ইতিহাসের নৃশংস ও মর্মস্পর্শী সেই রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ৪১তম বার্ষিকী। বাঙালির জনক হারানোর দিন। জাতির শোকের দিন-কান্নার দিন। গভীর ও বিনম্র শ্রদ্ধায় জাতি আজ তার শ্রেষ্ঠ সন্তান বঙ্গবন্ধুসহ সেদিনের শহীদদের স্মরণ করছে। দিনটি রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হচ্ছে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে। এ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়াও ঘাতকের বুলেটে নিহত হন তার স্ত্রী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, ১০ বছরের শিশু স্কুলছাত্র শেখ রাসেল, পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর সহোদর শেখ নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত, ভাগনে শেখ ফজলুল হক মণি ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি, বেবী সেরনিয়াবাত, সুকান্ত বাবু, আরিফ, আব্দুল নঈম খান রিন্টুসহ পরিবারের ১৮ জন সদস্য। বঙ্গবন্ধুর সামরিক সচিব কর্নেল জামিলও খুন হন তার ‘সহকর্মী’ সেনা সদস্যদের হাতে। ঘাতকদের কামানের গোলার আঘাতে মোহাম্মদপুরে একটি পরিবারের বেশ কয়েকজন হতাহত হন। তবে সেই সময় দেশের বাইরে থাকায় ঘাতক চক্রের হাত থেকে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।
সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে সেদিন বাঙালির ইতিহাসে এক কালিমালিপ্ত অধ্যায় রচিত হয়েছিল। এই বর্বর হত্যাযজ্ঞ ছিল বাঙালি জাতির ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কজনক অধ্যায়। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত একটি দেশের আত্মবিকাশকে রুদ্ধ করে দেওয়াই ছিলো এই বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের মূল উদ্দেশ্য। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড জাতির অস্তিত্ব ও মননে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করে। তবে সে ক্ষতের কিছুটা উপশম হয়েছে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে খুনিদের বিচারের মাধমে। অনেক বাধা-বিপত্তির পর বিলম্বে হলেও ইতিহাসের জঘন্যতম এই হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছে। এই বিচার এবং বিচারের রায় কার্যকর করার মধ্য দিয়ে জাতি তার কলঙ্কের দায় লাঘব করতে সমর্থ হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত এইসব খুনি দীর্ঘদিন ছিল বিচারের আওতাবহির্ভূত। দীর্ঘ ২১ বছর পর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করলে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা সচল হয়। ২০০১ সালের পর ওই বিচার প্রক্রিয়া আবারও অনিশ্চয়তার মধ্যে চলে যায়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ আবারও ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারকে তরান্বিত করে। পরে ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি আদালতের চূড়ান্ত রায় কার্যকর হয়। খুনিদের পাঁচজনের ফাঁসি কার্যকর হয়। ছয়জন এখনেও পলাতক রয়েছে।