মিজানুর রহমান ও নুসরাত টিসা
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে ১৯৭১ সালের মার্চ মাস ছিল উত্তাল ঘটনাবহুল মাস। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ হঠাৎ এক হটকারী সিদ্ধান্তে পাকিস্তানের তৎকালীন সামরিক স্বৈরশাসক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করলে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে বাংলার আপামর জনতা। অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এরপর ২৫ মার্চ পর্যন্ত নানান ঘটনার মধ্য দিয়ে ধীরে ধীরে বাংলার স্বাধিকার আন্দোলন রূপ নেয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের প্রতিদিনের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে বাংলা ট্রিবিউন গবেষণা বিভাগ এই টাইমলাইনটি তৈরি করেছে। এই টাইমলাইন তৈরিতে দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত খবর পর্যালোচনা করা হয়েছে।
১ মার্চ, ১৯৭১
> পশ্চিম পাকিস্তানের পিপলস পার্টিসহ আরও কয়েকটি দল ৩রা মার্চের জাতীয় পরিষদে যোগদানের অস্বীকৃতি জানানোর প্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন।
ছবি: ২ মার্চ, ১৯৭১
> জবাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ‘শুধু সংখ্যালঘিষ্ঠ দলের সেন্টিমেন্টের জন্য অধিবেশন স্থগিত রাখা হইয়াছে এবং আমরা উহা নীরবে সহ্য করতে পারি না। ইহার দ্বারা গণতান্ত্রিক পদ্ধতি প্রায় ব্যর্থ হইয়াছে। পরিষদ অধিবেশনের জন্য সারা বাংলাদেশের সকল সদস্যই ঢাকায় ছিলেন। জনাব ভুট্টো ও জনাব কাউয়ুম খানের দল ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানি সকল সদস্যই অধিবেশনে যোগ দিতে রাজি ছিলেন।’
> অধিবেশন স্থগিতের প্রতিবাদে আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২ মার্চ, ঢাকায় এবং ৩ মার্চ সারাদেশে সর্বাত্মক হরতালের ডাক দেন।
> জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করার প্রতিবাদে রাজধানীতে প্রচণ্ড বিক্ষোভ হয়। রেডিওতে ইয়াহিয়া খানের ভাষণের পরেই বিক্ষোভে ফেটে পড়ে ঢাকা।
> সামরিক আইন পরিচালক লে. জে. সাহেবজাদা এম ইয়াকুব খান ১ মার্চ গভীর রাতে ১১০নং সামরিক আইন আদেশ জারি করে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পাকিস্তানের সংহতি বা সার্বভৌমত্বের পরিপন্থী খবর, মতামত বা চিত্র প্রকাশের ব্যাপারে সংবাদপত্রসমূহের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। আইন ভঙ্গ করলে ২৫নং সামরিক আইনবিধি মোতাবেক সর্বোচ্চ ১০ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হবে।
সূত্র: মার্চ ২, ১৯৭১, ইত্তেফাক
২ মার্চ, ১৯৭১
> সন্ধ্যা ৭টা হতে সকাল ৭টা পর্যন্ত ঢাকায় অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি। কারফিউ ভেঙে বিক্ষুব্ধ নগরীর ভয়াল গর্জন। বিভিন্ন স্থানে মিছিল সমাবেশ, গুলিবর্ষণ। পল্টনে জনসভা ও গণমিছিলের ডাক, ভাষণ দেবেন শেখ মুজিবুর রহমান।
> সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য জনগণের প্রতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশ
১. ৩রা মার্চ থেকে ৬ই মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত সমগ্র প্রদেশে হরতাল পালন করুন।
২. ৩রা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন হওয়ার কথা ছিল। এই দিনটিকে জাতীয় শোকদিবস হিসেবে পালন করতে হবে।
৩. রেডিও, টেলিভশন ও সংবাদপত্রে আমাদের কর্মতৎপরতার বিবরণী বা আমাদের বিবৃতি প্রকাশ করতে দেওয়া না হলে এসব প্রতিষ্ঠানের বাঙালি কর্মচারীদের বাংলাদেশের ৭ কোটি মানুষের কণ্ঠরোধের প্রচেষ্টা নাকচ করে দিতে হবে।
৪. আগামী ৭ই মার্চ বিকাল ২টায় রেসকোর্স ময়দানে আমি এক গণসমাবেশে ভাষণদান করবো। সেখানে আমি পরবর্তী নির্দেশ প্রদান করবো।
৫. সংগ্রাম সুশৃঙ্খল ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে চালাতে হবে। উচ্ছৃঙ্খলতা আমাদের আন্দোলনের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করবে এবং গণবিরোধী শক্তি ও তাদের ভাড়াটিয়া চরদেরই স্বার্থোদ্ধার করবে।
ছবি: ৩ মার্চ, ১৯৭১
সূত্র: মার্চ ৩, ১৯৭১, ইত্তেফাক
৩ মার্চ, ১৯৭১
> বিভিন্ন স্থানে মিছিলে গুলিবর্ষণ, ঢাকায় ২৩ জন নিহত, চট্টগ্রামে ৭৫ জন। ঢাকা, সিলেট ও রংপুরে কারফিউ জারি।
ছবি: ৪ মার্চ, ১৯৭১
> ১০ মার্চ, ইয়াহিয়ার নেতৃত্বে সম্মেলনের আমন্ত্রণ। এই সম্মেলনের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছেন বঙ্গবন্ধু। এদিকে, পল্টনে ছাত্রলীগ ও জাতীয় শ্রমিক লীগ আয়োজিত বিশাল জনসভায় শেখ মুজিব কর-খাজনা দেওয়া বন্ধ করার নির্দেশ দেন। জনসভায় তিনি বলেন, ‘বাংলার মানুষ খাজনা দেয়, ট্যাক্স দেয় রাষ্ট্র চালানোর জন্য, গুলি খাওয়ার জন্য নয়।’
> বঙ্গবন্ধু তাঁর অনুপস্থিতিতে আন্দোলন চালানোর রূপরেখা দেন
ওই ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর অনুপস্থিতিতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান করেন। তিনি বলেন, ‘হয়তো ইহাই আপনাদের সামনে আমার শেষ ভাষণ। আগামী রবিবার রেসকোর্সে আমার বক্তৃতা করার কথা। কিন্তু কে জানে, সে সুযোগ আমাকে নাও দেওয়া হইতে পারে। তাই আজ আপনাদের কাছে আর আপনাদের মাধ্যমে বাংলার জনগণের কাছে আমি বলিয়া যাইতেছি, আমি যদি নাও থাকি আন্দোলন যেন না থামে।’
বঙ্গবন্ধু আরও বলেন, ‘বাংলার ভাইয়েরা আমার- আমি বলছি, আমি থাকি আর না থাকি- বাংলার স্বাধিকার আন্দোলন যেন না থামে, বাঙালির রক্ত যেন বৃথা না যায়। আমি যদি নাও থাকি, আমার সহকর্মীরা আছেন। তাঁরাই নেতৃত্ব দিবেন। আর যদি কেউই না থাকে, তবু আন্দোলন চালাইয়া যাইতে হইবে। বাংলার ঘরে ঘরে প্রতিটি বাঙালিকে নেতা হয়ে নির্ভয়ে আন্দোলন চালাইয়া যাইতে হইবে- যে কোনও মূল্যে বাংলার স্বাধিকার ছিনাইয়া আনিতে হইবে।’
ছবি: ৪ মার্চ, ১৯৭১
> প্রাদেশিক সাংবাদিক ইউনিয়নের কার্যকরী সংসদের এক বর্ধিত জরুরি সভার ডাক দিয়েছে সাংবাদিক ইউনিয়ন।
> ৯ মার্চ পল্টনে জনসভার ডাক দিয়েছেন ভাসানী।
সূত্র: মার্চ ৪, ১৯৭১, ইত্তেফাক
৪ মার্চ, ১৯৭১
> চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলাগুলোতে ১১৩নং সামরিক আইন আদেশ জারি। চট্টগ্রামে নিহতের সংখ্যা ১২১, খুলনায় নিহত ৬। ঢাকায় কারফিউ প্রত্যাহার।
> সাংবাদিক ও শিল্পীদের একাত্মতা: জনগণের মুক্তি আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার ডাক দিয়েছেন সাংবাদিক ইউনিয়ন, মিছিল ও জনসভার সিদ্ধান্ত। সংবাদপত্রের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবি। স্বাধিকার আন্দোলনকে সফল করতে নিউজপেপার প্রেস ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভার প্রস্তাব, যে কোনও ত্যাগ স্বীকারের সংকল্প গ্রহণ। ২০ জন বিশিষ্ট শিল্পীর যুক্তবিবৃতি, বেতার টেলিভিশন বর্জনের সিদ্ধান্ত।
> ছাত্রলীগ ও ডাকসুর আবেদন, ৬ মার্চের মধ্যে ঢাকা শহরে এবং ৭ মার্চের মধ্যে সারাদেশে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন শেষ করতে হবে। প্রতিটি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে ১ জন আহ্বায়ক ও ১০ জন সদস্য থাকবে।
ছবি: ৫ মার্চ, ১৯৭১
সূত্র: মার্চ ৫, ১৯৭১, ইত্তেফাক
৫ মার্চ, ১৯৭১
> টঙ্গীতে গুলিবর্ষণ, ৪ জন নিহত ২৫ জন আহত। চট্টগ্রামে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ১৩৮। রাজশাহী রংপুরে আবার কারফিউ।
> ভুট্টোর সাথে ইয়াহিয়ার ৫ ঘণ্টা বৈঠক। গভীর রাতে পাওয়া এক খবরে জানা যায়, জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে রাওয়ালপিন্ডির প্রেসিডেন্ট ভবনে পাঁচ ঘণ্টা ম্যারাথন বৈঠক করেন।
ছবি: ৬ মার্চ, ১৯৭১
> স্বাধিকার আন্দোলনে শামিল হলন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা: চলমান দমন-পীড়নকে গণহত্যা বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতির বিবৃতি।
> বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আন্দোলনে পূর্ণ সমর্থন প্রকাশ ও যে কোনও ত্যাগ স্বীকারের ঘোষণা দেন ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটির শিক্ষকরা।
সূত্র: মার্চ ৬, ১৯৭১, ইত্তেফাক ও সংবাদ
৬ মার্চ ১৯৭১
> জাতির উদ্দেশে ইয়াহিয়ার ভাষণ, ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের ডাক। জরুরি বৈঠকে আওয়ামী লীগ।
> টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিয়োগ।
> ভারতের ওপর দিয়ে পাকিস্তানের বিমান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত থাকবে, ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম।
ছবি: ৭ মার্চ, ১৯৭১
> রাজশাহীতে মিছিলকারীদের ওপর সশস্ত্র বাহিনীর গুলি ১ জন নিহত ও ১৪ জন আহত, সান্ধ্য আইন অব্যাহত। খুলনায় দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও গুলিবর্ষণ- ১৮ জন নিহত ও ৮৬ জন আহত।
> ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের গেট ভেঙে সাড়ে তিনশ কয়েদির পলায়ন। গুলিতে ৭ জন নিহত ও ৩০ জন আহত।
সূত্র: মার্চ ৭, ১৯৭১, ইত্তেফাক
৭ মার্চ, ১৯৭১
> সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণদান। জনগণের প্রতি নতুন নির্দেশ ও অধিবেশনে যোগদানের চারটি শর্ত প্রদান।
ছবি: ৮ মার্চ, ১৯৭১
অধিবেশনে যোগদানে বঙ্গবন্ধুর চার শর্ত:
১. অবিলম্বে সামরিক শাসন প্রত্যাহার করতে হবে
২. সমস্ত সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে
৩. নিরস্ত্র গণহত্যার তদন্ত করতে হবে
৪. নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।
আজ থেকে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ
১. বাংলার মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত খাজনা ট্যাক্স বন্ধ রাখুন
২. সমগ্র বাংলাদেশের সেক্রেটারিয়েট- সরকারি ও আধা সরকারি অফিস, সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্ট এবং অন্যান্য কোর্টে হরতাল করুন। কোথাও শিথিল করা হইলে জানানো হবে।
৩. রিকশা, বেবি, বাস-ট্যাক্সি প্রভৃতি এবং রেলগাড়ি ও বন্দরসমূহ চালু রাখুন। কিন্তু জনগণের ওপর জুলুম চালাবার উদ্দেশ্যে সশস্ত্র বাহিনীর চলাচলের কাজে রেলওয়ে ও বন্দর কর্মচারীগণ সহযোগিতা করবেন না এবং সেক্ষেত্রে তাদের চলাচলের ব্যাপারে কোনও কিছু ঘটলে আমি দায়ী হবো না।
৪. বেতার, টেলিভিশন ও সংবাদপত্রসেবীরা আমাদের বিবৃতি-বক্তৃতার পূর্ণ বিবরণ প্রদান করবেন এবং গণআন্দোলনের কোনও খবর গায়েব করবেন না। যদি তাতে বাধা দেওয়া হয়, তাহলে এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বাঙালিরা কাজে যোগ দিবেন না।
৫. শুধু লোকাল এবং আন্তঃজেলা ট্রাঙ্ক-টেলিফোন যোগাযোগ অব্যাহত রাখুন।
৬. স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখুন।
৭. সকল গৃহশীর্ষে প্রতিদিন কালো পতাকা উড্ডয়মান রাখুন।
৮. ব্যাংকগুলো প্রতিদিন দুই ঘণ্টা খোলা রাখুন, কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও যেন পাচার না হয়।
৯. অন্যান্য ক্ষেত্রে আজ থেকে হরতাল প্রত্যাহার করা হইলো। কিন্তু অবস্থার প্রেক্ষিতে যে কোনও সময় আবার অংশিক বা সর্বাত্মক হরতাল ঘোষণা হতে পারে, তার জন্য প্রস্তুত থাকুন।
১০. স্থানীয় আওয়ামী লীগ শাখার নেতৃত্বে অবিলম্বে বাংলার প্রত্যেকটি ইউনিয়ন, মহল্লা, থানা, মহকুমা ও জেলা পর্যায়ে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করুন।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রিলে না করার প্রতিবাদে ঢাকা বেতারের বাঙালি কর্মীদের অসহযোগিতার কারণে বিকালে বন্ধ হয়ে যায় ঢাকা বেতার। সন্ধ্যা ৭টায় বেতার ভবনের সামনে বোমা নিক্ষেপ।
> নিয়াজিসহ পাঁচজনকে সহকারী সামরিক শাসনকর্তা নিযুক্ত করা হয়।
সূত্র: মার্চ ৮, ১৯৭১, ইত্তেফাক
৮ মার্চ, ১৯৭১
> বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের সঙ্গে ছাত্রনেতাদের একাত্মতা ঘোষণা। ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সংসদ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী ও সাধারণ সম্পাদক জনাব শাজাহান সিরাজ, ডাকসুর সহ-সভাপতি জনাব আ স ম আবদুর রব ও সাধারণ সম্পাদক জনাব আব্দুল কুদ্দুস মাখন এক যুক্তবিবৃতিতে বলেন, “বাংলার বর্তমান মুক্তি আন্দোলনকে ‘স্বাধীনতা আন্দোলন’ ঘোষণা করিয়া স্বাধীন বাংলার জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ঐতিহাসিক জনসভায় যে প্রত্যক্ষ কর্মসূচি ঘোষণা করিয়াছেন আমরা উহার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করিয়া স্বাধীনতার আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধভাবে ঝাঁপাইয়া পড়িবার জন্য বাংলার সংগ্রামী জনতার প্রতি আহ্বান জানাইতেছি এবং বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ঘোষিত সকল নির্দেশকে যথাযথ কার্যকরী করিবার জন্য সমগ্র দেশবাসীকে বিনা দ্বিধায় বাস্তবায়িত করিবার আহ্বান জানাইতেছি এবং কোনও মহল এই কর্মসূচির অন্তরায় সৃষ্টি করিলে তাহাকে অবশ্যই প্রতিহত করিবার জন্য আবেদন জানাইতেছি।”
> অস্থানীয়দের ঢাকা ত্যাগের হিড়িক। অপরদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থানরত বাঙালিদের দেশত্যাগের জন্য কোনও বিমান টিকিট দেওয়া হচ্ছে না।
ছবি: ৯ মার্চ, ১৯৭১
> সরকারি কর্মচারীরা জীবন দিয়ে হলেও বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ পালন করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। শিল্পীদের সিদ্ধান্ত, ঢাকা বেতার ও টেলিভিশনের সকল অনুষ্ঠান বর্তমান গণআন্দোলনের অনুকূল হইবে। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ রিলে করার শর্তে বেতারকর্মীদের কাজে যোগদান।
সূত্র: মার্চ ৯, ১৯৭১, ইত্তেফাক
৯ মার্চ, ১৯৭১
> বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী সকল সরকারি অফিস অচল।
> মার্শাল ল’ এডমিনিস্ট্রেটর সংশ্লিষ্ট সামরিক বিধি পরিবর্তন করে সামরিক শাসন পরিচালক পদে লে জে টিক্কা খানের নিয়োগ। উল্লেখ্য, ৬ মার্চ টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিয়োগ দেওয়া হয়েছিলো।
> ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সংসদের জরুরি সভায় ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’ ঘোষণার প্রস্তাব অনুমোদন। এই সভায় আরেকটি প্রস্তাবে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বাংলাদেশে জাতীয় সরকার’ গঠনের জন্য অনুরোধ করা হয়।
ছবি: ১০ মার্চ, ১৯৭১
> পল্টনে জনসভায় মওলানা ভাসানী ঘোষণা করেন ২৫ মার্চের পর শেখ মুজিবের সাথে আন্দোলন করবেন। টেলিফোনে মুজিব ভাসানী আলোচনা হয়।
> ঢাকা থেকে বিদেশি নাগরিকদের সরিয়ে নিতে স্ব-স্ব দেশ থেকে বিমানের ঢাকায় অবতরণ। ‘প্রয়োজনবোধে’ জাতিসংঘের স্টাফ ও তাদের পরিবারকে অপসারণের নির্দেশ দিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব।
> রাজশাহীতে কারফিউ জারি, প্রতিবাদ।
সূত্র: মার্চ ১০, ১৯৭১, ইত্তেফাক ও সংবাদ
১০ মার্চ, ১৯৭১
> বাংলাদেশের সিভিল সার্ভিসের দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মচারীরা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মেনে চলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
> স্বাধীন বাংলাদেশ সংগ্রাম পরিষদের যুক্তবিবৃতি, বাংলাদেশের প্রতিটি দেশপ্রেমিক নাগরিককে স্বাধীনতা সংগ্রামে নিয়োজিত প্রতিটি মুক্তিসেনাকে সকল প্রকার সাহায্য করার অনুরোধ। পাকিস্তান থেকে বাঙালিদের আসতে না দিলে বিমানবন্দরে চেকপোস্ট বসিয়ে অবাঙালিকে দেশত্যাগ করতে না দেওয়ার হুমকি।
সূত্র: মার্চ ১১, ১৯৭১, ইত্তেফাক
১১ মার্চ, ১৯৭১
> বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নিকট ভুট্টোর তারবার্তা। ঢাকায় আসতে রাজি আছেন বলে জানান।
> পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যবসায়ীদের ইয়াহিয়ার প্রতি বার্তা, অবিলম্বে প্রতিকার না করা গেলে পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এদিকে, নিউজপ্রিন্টের অভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের সংবাদপত্রের কলেবর হ্রাস। করাচি ডনসহ পশ্চিম পাকিস্তানের পত্রিকাগুলোর কলেবর ১৪ পৃষ্ঠার পরিবর্তে মাত্র ৪ পৃষ্ঠা ছাপা হয়েছে। এসব পত্রিকা খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলের কাগজ ব্যবহার করে। গত ১ মার্চ থেকে খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিল থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে চালান বন্ধ করা হয়েছে।
> ৩২ হাজার টন গমভর্তি জাহাজ ভিনটেজ হরিজন ১৩ মার্চ চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছানোর কথা থাকলেও গতিপথ পরিবর্তন করে করাচি অভিমুখে যাত্রা করেছে।
সূত্র: মার্চ ১২, ১৯৭১, ইত্তেফাক
১২ মার্চ, ১৯৭১
> লন্ডনের প্রভাবশালী পত্রিকা ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ এক প্রতিবেদনে বলেছে শক্তি প্রয়োগ নিষ্ফল ও বিপজ্জনক হবে। প্রতিবেদনের উল্লেখ করা হয় যে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বল প্রয়োগ করতে ইচ্ছুক।
> জাতিসংঘ কর্মকর্তাদের পরিবারবর্গকে স্বদেশে প্রেরণ।
> সুফিয়া কামালের সভাপতিত্বে সারা আলীর তোপখানা রোডের বাসায় অনুষ্ঠিত মহিলা পরিষদের এক সভায় পাড়ায় পাড়ায় মহিলা সংগ্রাম পরিষদ গঠনের আহ্বান জানানো হয়।
ছবি: ১৩ মার্চ, ১৯৭১
সূত্র: মার্চ ১৩, ১৯৭১, ইত্তেফাক ও সংবাদ
১৩ মার্চ, ১৯৭১
> সামরিক কর্তৃপক্ষের ১১৫নং মার্শাল ল’ আদেশ জারি। সকল বেসামরিক কর্মচারী যাদের প্রতিরক্ষা খাত থেকে বেতন দেওয়া হয় তাদের ১৫ মার্চ সকালে কাজে যোগ দেওয়ার নির্দেশ। অন্যথায় চাকরি থেকে বরখাস্তের হুমকি। এ ধরনের নির্দেশকে উসকানিমূলক বলে অভিহিত করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
> পশ্চিম জার্মানির ৬০ জন, জাতিসংঘের ৪৫ জন, ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা ও ফ্রান্সের ৪০ জনসহ মোট ২৬৫ বিদেশিকে ঢাকা থেকে অপসারণ করা হয়েছে।
সূত্র: মার্চ ১৪, ১৯৭১, ইত্তেফাক ও সংবাদ
১৪ মার্চ, ১৯৭১
> দুই পাকিস্তানে দুই দলের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের ফর্মুলা ভুট্টোর।
> জনগণের সার্বিক স্বাধীনতা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চলছে, চলবে। অসহযোগ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ।
> বাংলার অসহযোগে পশ্চিমা শিল্পপতিদের নাভিশ্বাস। সামরিক সরকারের প্রতি স্মরকলিপি প্রদান। বঙ্গবন্ধুর চার দফা মেনে নেওয়ার আহ্বান। হরতালের কারণে ফল চালান করতে না পারায় লাহোরে শত শত মণ ফল নষ্ট। করাচিতে প্রতি সের পান ১৫০ টাকা হয়েছে। ঢাকার পান না পেয়ে করাচিতে পান বিরল হয়ে পড়েছে।
ছবি: ১৫ মার্চ, ১৯৭১
> ১১৫ নং নির্দেশের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ।
সূত্র: মার্চ ১৫, ১৯৭১, ইত্তেফাক
১৫ মার্চ, ১৯৭১
> ইয়াহিয়ার ঢাকা আগমন। বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের কোনও ব্যবস্থা ছিল না। সফরসূচিতেও গোপনীয়তা।
> বঙ্গবন্ধুর নতুন নির্দেশ।
ছবি: ১৬ মার্চ, ১৯৭১
> ভুট্টোর দুই পার্টি সমাধানে পশ্চিম পাকিস্তানেই ব্যাপক ক্ষোভ। সর্বমহলে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ। ভুট্টোর সমাধানকে অগণতান্ত্রিক বলে উল্লেখ করেন পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ।
> চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রে সকল কাজে বাংলা প্রচলনের সিদ্ধান্ত। স্থানীয় শিল্পী, সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিসেবীদের এক সভায় চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের গণবিরোধী ভূমিকার নিন্দা করা হয়। বেতার কেন্দ্রে সংগ্রাম কমিটি গঠন।
সূত্র: মার্চ ১৬, ১৯৭১, ইত্তেফাক
১৬ মার্চ, ১৯৭১
> মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক শুরু। বঙ্গবন্ধু একটি সাদা গাড়িতে চড়ে বৈঠকে যান। গাড়ির সামনে ছিল একটি কালো পতাকা এবং উইন্ডো সিল্ডে বাংলাদেশের মানচিত্র, একটি পতাকার প্রতিকৃতি লাগানো ছিল। প্রেসিডেন্ট ভবনের উদ্দেশে বের হওয়ার পূর্বে তিনি স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনায় মিলিত হন।
ছবি: ১৭ মার্চ, ১৯৭১
> নিউজউইকের পর্যালোচনা প্রতিবেদন প্রকাশ। প্রতিবেদনে বলা হয়, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু কার্যত স্বাধীনতার ঘোষণাই করলেন। জনৈক এক পাশ্চাত্য কূটনীতিবিদের বরাত দিয়ে প্রতিবেদক লোরেন জেনকিনসে লিখেন, ‘পূর্ব এবং পশ্চিমাঞ্চল বিচ্ছিন্ন হইয়া যাইবে ইহা কোনও প্রশ্ন নয়, বরং পরিস্থিতি হঠাৎ এতদূর গড়াইয়াছে যে, পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চল কি পরবর্তী সপ্তাহে কিংবা আগামী মাসে অথবা দুই বৎসর পর বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িবে ইহাই প্রশ্ন।’
> জামালপুরে হাজার হাজার লোকের লাঠি ও নানান রকম দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মিছিল।
সূত্র: মার্চ ১৭, ১৯৭১, সংবাদ
১৭ মার্চ, ১৯৭১
> মুজিব-ইয়াহিয়া দ্বিতীয় দফা বৈঠক সম্পন্ন। লক্ষ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা। জনগণকে ত্যাগ স্বীকারের জন্য প্রস্তুত থাকতে আহ্বান।
> ভারতের ওপর দিয়ে বাংলাদেশগামী সকল বিদেশি বিমানের চলাচল নিষিদ্ধ। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানগামী সকল বিমানকে ভারতে একবার অবতরণ করতে বলা হয়েছে। বিদেশি বিমানযোগে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সেনা বহন করে পূর্ব পাকিস্তান নেওয়া রোধ করতে ভারত সরকার এমন ব্যবস্থা নিয়েছে।
ছবি: ১৮ মার্চ, ১৯৭১
সূত্র: মার্চ ১৮, ১৯৭১, সংবাদ
১৮ মার্চ, ১৯৭১
> ১৭ মার্চ পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিশন গঠন। আওয়ামী লীগের তদন্ত কমিটি বর্জন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, এই তদন্ত কমিশন চাই নাই। সেই সঙ্গে বাংলাদেশের জনগণকে এই তদন্ত কমিশনের সাথে কোনও সহযোগিতা না করতে আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
ছবি: ১৯ মার্চ, ১৯৭১
> শাসনতন্ত্রের প্রশ্নে ইয়াহিয়ার ঢাকায় আসার আমন্ত্রণ নাকচ করে দিয়েছেন ভুট্টো।
সূত্র: মার্চ ১৯, ১৯৭১, ইত্তেফাক
১৯ মার্চ, ১৯৭১
> জয়দেবপুরে জনতায়-সেনাবাহিনী সশস্ত্র সংঘর্ষ হয়েছে। বিক্ষুব্ধ জনতার ওপর উসকানিমূলক হামলায় এই সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। এলাকায় কারফিউ জারি করা হয়। সেনাবাহিনীর এমন কর্মকাণ্ডকে উসকানিমূলক বলে অভিহিত করেছেন শেখ মুজিবুর রহমান।
> মুজিব-ইয়াহিয়া তৃতীয় দফায় বৈঠক অনুষ্ঠিত। ৯০ মিনিটের বৈঠকে ইয়াহিয়া ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া অন্য কেউ উপস্থিত ছিলেন না।
> ভারতের সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ বলেন, মুজিবকে সমর্থন দেওয়া গণতন্ত্রে বিশ্বাসী বিশ্ববাসীর অবশ্য কর্তব্য। চলমান অসহযোগ আন্দোলনের প্রশংসা করে তিনি বলেন, ‘গান্ধিজীর পরে শেখ মুজিবুর রহমানই এতখানি বিশাল আয়তনে অহিংস শক্তি প্রদর্শনের ক্ষমতা লাভ করিলেন’। তিনি বলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান যেরূপ সাফল্যের সহিত জনসাধারণকে সর্বাত্মক ঐক্যে তাহার পশ্চাতে কাতারবদ্ধ করিতে সক্ষম হইয়াছেন, সমগ্র ইতিহাসে অন্য কোনও নেতার জীবনে এরূপ দৃষ্টান্ত খুঁজিয়া বাহির করা খুবই দুষ্কর।’
ছবি: ২০ মার্চ, ১৯৭১
সূত্র: মার্চ ২০, ১৯৭১, ইত্তেফাক
২০ মার্চ, ১৯৭১
> মুজিব-ইয়াহিয়া চতুর্থ দফায় বৈঠক। সোয়া দুই ঘণ্টা স্থায়ী এই বৈঠকে আলোচনায় কিছু অগ্রগতি হয়েছে বলে অনুমান করা হয়েছে। এদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আন্দোলনকে শান্তিপূর্ণভাবে চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
> জয়দেবপুরে সান্ধ্য আইন অব্যাহত।
সূত্র: মার্চ ২১, ১৯৭১, ইত্তেফাক
২১ মার্চ, ১৯৭১
> ইয়াহিয়া-মুজিব অনির্ধারিত বৈঠক। ৭০ মিনিটের এই বৈঠকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ।
> প্রতিরোধ দিবসের কর্মসূচি প্রদান করেছে স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। কর্মসূচির মধ্যে আছে ভোর ছয়টায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন। সাড়ে ছয়টায় প্রভাত ফেরি সহকারে শহীদদের মাজারে পুষ্পমাল্য অর্পণ। সকাল ৯টায় পল্টনে জয়বাংলা বাহিনীর কুচকাওয়াজ। বেলা ১১টায় বায়তুল মোকাররমে ছাত্র জনসভা।
> জয়দেবপুরে কারফিউ প্রত্যাহার। ৪২ ঘণ্টা কারফিউ অব্যাহত রাখার পর প্রত্যাহার করা হয়।
> কঠোর সামরিক প্রহরায় ১২ জন সহচরসহ ঢাকায় ভুট্টো। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। সাংবাদিকদের ভুট্টোর আশপাশে যাওয়ার কোনও ব্যবস্থা রাখা হয়নি।
সূত্র: মার্চ ২২, ১৯৭১, ইত্তেফাক
২২ মার্চ, ১৯৭১
> ভুট্টোর উপস্থিতিতে মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক। ইত্তেফাকের প্রতিবেদনে আশা প্রকাশ করা হয়, শেষ মুহূর্তে যদি অতি নাটকীয় কিছু না ঘটে তবে অচিরেই সামরিক আইন প্রত্যাহার হতে যাচ্ছে। ২৩ মার্চ ইত্তেফাকের প্রতিবেদনের ভাষায়, ‘এদিকে গতকাল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং জনাব ভুট্টো আলোচনার অগ্রগতি হইতেছে বলিয়া মন্তব্য করিয়াছেন। চারি দফা পূর্বশর্ত পূরণ করা না হইলে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিবে না বলিয়া ঘোষণা করিয়া এ ব্যাপারে শেখ সাহেব যে আপোষহীন ভূমিকা গ্রহণ করিয়াছেন, ইয়াহিয়া-ভুট্টো উভয়েই উহার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হইয়াছেন বলিয়া অনুমিত হইতেছে। সম্ভাবত সেই কারণেই অর্থাৎ সামরিক আইন প্রত্যাহার ও গণপ্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরসহ বঙ্গবন্ধুর দাবি পূরণের ব্যবস্থা গ্রহণের নিমিত্তেই ভুট্টোর উপস্থিতিতে শেখ সাহেবের সঙ্গে বৈঠক চলাকালেই গতকাল প্রেসিডেন্ট জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আবার স্থগিত ঘোষণা করিয়াছেন। যদি শেষ মুহূর্তে ব্যক্তিবিশেষের কারণে অতি নাটকীয় কিছু না ঘটে তবে অচিরেই সামরিক আইন প্রত্যাহৃত এবং সংশ্লিষ্ট অপরাপর ব্যবস্থা গৃহীত হইতে যাইতেছে।’
> এদিকে লক্ষ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ডাক বঙ্গবন্ধুর। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত।
> পত্রিকায় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ পরিকল্পিত বাংলাদেশের পতাকার মাপ ও বিবরণ প্রকাশ।
ছবি: ২৩ মার্চ, ১৯৭১
> পাকিস্তানি বিমান ও জাহাজকে মালদ্বীপে ব্রিটিশ ঘাঁটি ব্যবহারের অনুমোদন। ভারতের ওপর দিয়ে বাংলাদেশগামী বিমান চলাচলের ওপর নিষেধাজ্ঞা চলকালে ব্রিটেন এমন একটি সিদ্ধান্ত নিলো।
ছবি: ২৩ মার্চ, ১৯৭১
সূত্র: মার্চ ২৩, ১৯৭১, ইত্তেফাক
২৩ মার্চ, ১৯৭১
> দেশব্যাপী প্রতিরোধ দিবস পালন। রাজধানীর সরকারি-বেসরকারি ভবনসমূহে, বাড়িতে, গাড়িতে কালো পতাকার পাশাপাশি বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘জয় বাংলা’ বাহিনীর অভিবাদন গ্রহণ। কড়া নিরাপত্তা বেষ্টনীর ছত্রছায়ায় থাকা বিমানবন্দর ভবন, প্রেসিডেন্ট ভবন ও লাটভবন ছাড়া অন্য কোথাও পাকিস্তানের পতাকা দেখা যায়নি।
ছবি: ২৪ মার্চ, ১৯৭১
সূত্র: মার্চ ২৪, ১৯৭১, ইত্তেফাক
২৪ মার্চ, ১৯৭১
> শেখ মুজিবের সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের বৈঠক। কোনও প্রকার নতিস্বীকার না করার সংকল্প পুনর্ব্যক্ত করেন বঙ্গবন্ধু।
> সারাদেশে শান্তিপূর্ণভাবে পতাকা উত্তোলন হলেও মিরপুরের ১০নং সেক্টরে একটি বাড়ির ওপর থেকে ভয়ভীতি দেখিয়ে পতাকা সরানো হয়েছে। বোমা হামলা করা হয়েছে। বাংলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক জনাব কাইউমকে ছুরিকাহত করে তার বাড়িতে অগুন দেওয়া হয়েছে। শামীম আখতার নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। যদিও তাকে ছেড়ে দিতে সেনাবাহিনীর তরফ থেকে পুলিশকে চাপ দেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। মিরপুরে অবস্থানরত অবাঙালিরা এ সম্পর্কে কিছুই জানে না বলে জানিয়েছেন।
> আওয়ামী লীগ নেতা তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, আওয়ামী লীগের বক্তব্য শেষ। অবিলম্বে প্রেসিডেন্টের ঘোষণার দাবি। তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, অনির্দিষ্টকাল অপেক্ষা চলে না।
ছবি: ২৫ মার্চ, ১৯৭১
> সামরিক প্রহরায় পশ্চিম পাকিস্তানি ছোট দলগুলোর নেতৃবৃন্দ ঢাকা ত্যাগ করেছেন।
ছবি: ২৫ মার্চ, ১৯৭১
> ঢাকা টেলিভিশন কেন্দ্রে নিয়োজিত সামরিক বাহিনীর সৈনিকদের টেলিভিশন অনুষ্ঠানে হস্তক্ষেপের প্রতিবাদে ঢাকা টেলিভিশন কেন্দ্রের কর্মচারীরা ধর্মঘট পালন করেছে।
> সেনাবাহিনী ও জনতার মধ্যে সংঘর্ষ, রংপুরে কারফিউ।
> নিজ বাসভবনের সামনে জনসমাবেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বক্তৃতা। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টির অপচেষ্টার বিরুদ্ধে সতর্ক থাকার জন্য দেশবাসীকে আহ্বান।
> নির্বিচারে গণহত্যার প্রতিবাদে কবি মোজাম্মেল হকের সামরিক সরকার প্রদত্ত ‘সিতারায়ে খেদমত’ খেতাব বর্জন।
সূত্র: মার্চ ২৫, ১৯৭১, ইত্তেফাক ও সংবাদ
২৫ মার্চ, ১৯৭১
> এদিন রাতে ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা শুরু করে পাকিস্তান সেনাবাহিনী।
তথ্য সংগ্রহ: বাংলা ট্রিবিউন গবেষণা বিভাগ