লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) এম এ হামিদ
তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত:
সারা রাত ভূতের মতো এখানে-ওখানে ছুটাছুটি করে আমার মাথা বনবন করছিল। বনানীতে শেখ পরিবার, শেখ মণি ও সেরনিয়াবাত পরিবারের দাফন সম্পন্ন হয়ে গিয়েছিল। যদিও সৈনিকদের সূর্য ওঠার কিছু পরও কাজ করতে হয়েছিল। আমি ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডে অফিসারকে নির্দেশ দিলাম তাড়াতাড়ি কজন মালী পাঠিয়ে যেন কবরগুলো সুন্দরভাবে ড্রেসিং করে দেয়।
আমি আমার অফিসে বসে এক কাপ চা পান করছিলাম। বঙ্গভবন থেকে টেলিফোনে আবার মেসেজ পাঠানো হলো, শেখ সাহেবের ডেডবডি টুঙ্গিপাড়া পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। একটি এয়ারফোর্স হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতিকে টুঙ্গিপাড়া দাফনের যাবতীয় ব্যবস্থা করা হয়েছিল বঙ্গভবন থেকে। আমাকে বঙ্গভবনের টেলিফোন-ভীতি পেয়ে বসল। আমি জিপ নিয়ে অফিস থেকে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লাম এবং খামাকাই এখানে-ওখানে ঘুরাফেরা করে সময় কাটাতে লাগলাম।
আর্মি অর্ডিন্যান্সের একটি প্লাটুন মেজর মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে প্রস্তুত রাখা হলো। প্রয়াত রাষ্ট্রপতির হেলিকপ্টারে পাইলট ছিলেন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামসের আলী । তারা তেজগাঁও এয়ারপোর্ট থেকে বেলা আড়াইটা নাগাদ শেখ সাহেবের লাশ নিয়ে টুঙ্গিপাড়ার উদ্দেশে আকাশে পাড়ি জমালো। হামলার আশঙ্কায় হেলিকপ্টার অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত ছিল। আকাশযানটি টুঙ্গিপাড়ার আকাশে পৌঁছুলে আশপাশের লোকজন ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়। ওখানে আগেই পুলিশ পাঠানোর জন্য সংবাদ দেওয়া হয়েছিল। মেজর মহিউদ্দিন পুলিশের সহায়তায় কোনোক্রমে ১৫-২০ জন লোক জানাজার জন্য জড়ো করতে সক্ষম হয়েছিল। একজন স্থানীয় মৌলভীকে ডেকে এনে শেখ সাহেবের লাশ গোসল করানো হয়। তাঁর গায়ে ১৮টি বুলেটের দাগ দেখতে পাওয়া যায়। গোসল শেষে পিতার কবরের পাশেই তাঁকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়।
সূর্যিমামা পশ্চিম গগনে হেলে গিয়ে বিদায়ের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তার আগেই দাফনকার্য শেষ করে শামসের হেলিকপ্টার নিয়ে আকাশে উড়ল।
জাতির জনককে শেষবিদায় জানাতে যেকোনো কারণেই হোক, টুঙ্গিপাড়ার লোকজন সেদিন ভিড় করেনি। যে ব্যক্তি সারা জীবন বাঙালি জাতির স্বাধীন সত্তার জন্য সংগ্রাম করে গেলেন, তাঁকে শেষবিদায় জানানো হলো অতি নীরবে, নিঃশব্দে, সুদূর টুঙ্গিপাড়ার একটি গ্রামে।
লেখাটি বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জীবন ও রাজনীতি দ্বিতীয় খণ্ড থেকে নেওয়া