সাঈদ উল আবেদীন ও আজমল হোসেন
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ একটি দিন। এদিন রাতে পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠী ও সামরিক জান্তার নির্দেশে আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তান সেনাবাহিনী নির্মমভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাংলার মুক্তিকামী নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষের ওপর। ঘটে ইতিহাসের অন্যতম ঘৃণ্য, ভয়ঙ্কর ও বর্বর হত্যাকাণ্ড।
২৫ মার্চের কালরাতকে ২০১৭ সাল থেকে বাংলাদেশ গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করে আসছে।
বর্তমানে এই কালরাতের বিবরণ সংবাদপত্রগুলো অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করলেও সবসময়ে চিত্রটা এমন ছিল না। বিশেষ করে সামরিক স্বৈরশাসক জিয়া ও এরশাদের শাসনামলে সংবাদপত্রে ২৫ মার্চ কালরাতের বিবরণ ছিল বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আংশিক ও অসম্পূর্ণ।
এই দুই শাসকের আমলে গুরুত্বপূর্ণ এই দিনটির প্রতিবেদন পত্রিকার প্রথম পাতায় যেভাবে প্রকাশ করা হয়েছে, তা পর্যালোচনা করেছে বাংলা ট্রিবিউন। চারটি পত্রিকা (দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংবাদ, দৈনিক বাংলা ও দৈনিক আজাদ) এই দিনটি কেন্দ্র করে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করতো সেগুলোই পর্যালোচনা করা হয়েছে।
জিয়ার আমল
১৯৭৬: গুরুত্ব পেয়েছিলো সেনাবাহিনী দিবসের খবর, এক কোণে ২৫ মার্চ
এ বছর দৈনিক সংবাদ ও দৈনিক আজাদে প্রথম পাতায় ২৫ মার্চ বিষয়ক কোনও খবর ছাপা হয়নি। বরং গুরুত্বের সঙ্গে ছাপা হয়েছিলো সেনাবাহিনী দিবসের খবর।
দৈনিক বাংলায় প্রথম পাতার এক কোণায় ছোট করে ছাপা হলেও সেই প্রতিবেদনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কথা হামলাকারী হিসেবে কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। খবরের সঙ্গে কোনও ছবিও যুক্ত করেনি পত্রিকাটি। উল্লেখ্য, দৈনিক বাংলাও এদিন প্রথম পাতায় সেনাবাহিনী দিবসের খবর ছেপেছিল।
দৈনিক বাংলা ১৯৭৬
১৯৭৬ সালের ২৫ মার্চ তারিখের দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকা পাওয়া যায়নি।
১৯৭৭: যুক্ত হলো ‘হানাদার বাহিনী’, উল্লেখ নেই ‘পাকিস্তান’ শব্দ
এ বছরে দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক আজাদ প্রথম পাতায় ২৫ মার্চ সংক্রান্ত কোনও প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি।
১৯৭৭ সালের দৈনিক বাংলায় ২৫ মার্চের ভয়াবহতা নিয়ে প্রতিবেদন ছবিসহ বড় করে প্রকাশ হয়। হামলাকারী বাহিনী হিসেবে ‘হানাদার বাহিনীর’ নাম উল্লেখ করা হয়েছে কয়েকবার, তবে কোথাও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বা পাকিস্তান সেনাবাহিনী শব্দগুলো ছিল না।
দৈনিক বাংলা ১৯৭৭
দৈনিক সংবাদেও প্রথম পাতায় ২৫ মার্চ নিয়ে একটি ছবি এবং ক্যাপশন প্রকাশ করে। আলাদা করে কোনও প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি।
দৈনিক সংবাদ ১৯৭৭
১৯৭৮: প্রথম পাতায় ছোট করে ছাপা হয় ২৫ মার্চের খবর
১৯৭৮ সালের দৈনিক সংবাদ ও দৈনিক বাংলায় প্রথম পাতায় ২৫ মার্চ সংক্রান্ত কোনও খবর ছাপা হয়নি।
১৯৭৮ সালের দৈনিক ইত্তেফাকে প্রথম পাতায় ২৫ মার্চের নৃশংস হামলার খবর ছোট করে প্রকাশ করা হয়। হামলার নৃশংসতার বর্ণনা থাকলেও কারা হামলা করলো এ বিষয়ে কিছুই বলেনি পত্রিকাটি।
দৈনিক ইত্তেফাক ১৯৭৮
১৯৭৮ সালের ২৫ মার্চের দৈনিক আজাদ পত্রিকা পাওয়া যায়নি।
১৯৭৯: পরোক্ষভাবে বলা হয়েছে বঙ্গবন্ধুর কথা
১৯৭৯ সালের দৈনিক সংবাদের ২৫ মার্চের আক্রমণের খবরে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর নাম উল্লেখ করা হয় এবং বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হওয়ার পূর্বে সশস্ত্র মুক্তি-সংগ্রামের ঘোষণা দিয়ে যান, তা উল্লেখ করা হয় এভাবে, ‘স্বাধীনতার মূল সেনাধ্যক্ষ সশস্ত্র মুক্তি-সংগ্রামের ঘোষণা দেয়ার কিছুক্ষণ পরেই তাঁকে বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হয় পাকিস্তানের জিন্দানখানায়।’
দৈনিক সংবাদ ১৯৭৯
দৈনিক বাংলাও গুরুত্ব সহকারে ছবিসহ ২৫ মার্চের খবর ছাপে প্রথম পাতায়।
দৈনিক বাংলা ১৯৭৯
তবে দৈনিক আজাদ ও দৈনিক ইত্তেফাক ১৯৭৯ সালের ওই সংখ্যায় প্রথম পাতায় ২৫ মার্চ সংক্রান্ত কোনও প্রতিবেদন ছাপেনি।
১৯৮০: গুরুত্ব ফিরে পেতে শুরু করেছে ২৫ মার্চ
১৯৮০ সালের দৈনিক সংবাদ ও দৈনিক বাংলায় ২৫ মার্চের নৃশংসতার ইতিহাস নিয়ে ছবিসহ বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তবে এ বছর সশস্ত্র মুক্তি-সংগ্রামের ঘোষণার বিষয়টি এড়িয়ে যায় পত্রিকা দুটি।
দৈনিক বাংলা ১৯৮০
দৈনিক সংবাদ ১৯৮০
১৯৮০ সালের দৈনিক ইত্তেফাকের এই দিনের সংখ্যার প্রথম পাতায় ২৫ মার্চ নিয়ে কোনও প্রতিবেদন প্রকাশ হয়নি।
১৯৮০ সালের দৈনিক আজাদ পত্রিকা পাওয়া যায়নি।
১৯৮১: পত্রিকার প্রথম পাতায় আবার গুরুত্ব হারায় ২৫ মার্চ
১৯৮১ সালের দৈনিক আজাদ ও দৈনিক সংবাদ ২৫ মার্চ নিয়ে প্রথম পাতায় কোনও প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি।
দৈনিক ইত্তেফাক ছোট করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে প্রথম পাতায়, সঙ্গে কোনও ছবি দেয়নি পত্রিকাটি।
দৈনিক ইত্তেফাক ১৯৮১
দৈনিক বাংলাও ছবিসহ প্রথম পাতায় ২৫ মার্চের খবর ছোট করে প্রকাশ করে।
এরশাদের আমল
১৯৮২: সামরিক আইনের খবরের নিচে চাপা পড়লো ২৫ মার্চের খবর
১৯৮২ সালের এই দিনে পত্রিকাগুলোর প্রথম পাতাজুড়ে প্রধান খবর ছিল সামরিক আইনের খবর।
২৫ মার্চের নৃশংসতার ইতিহাস ছোট করে প্রকাশ করেছিল দৈনিক ইত্তেফাক, যদিও খবরের সঙ্গে কোনও ছবি দেওয়া হয়নি। দৈনিক সংবাদও ছবিসহ ২৫ মার্চের নৃশংস ইতিহাস প্রথম পাতায় প্রকাশ করেছিল।
দৈনিক ইত্তেফাক ১৯৮২
১৯৮২ সালের অন্য দু’টি পত্রিকা পাওয়া যায়নি।
১৯৮৩: পত্রিকার প্রথম পাতায় আবার গুরুত্ব দিয়ে ছাপানো শুরু হয় ২৫ মার্চের ইতিহাস
দৈনিক সংবাদে প্রথম পাতায় ছবিসহ বড় করে প্রকাশ হয় ২৫ মার্চের ইতিহাস; দৈনিক বাংলাও ২৫ মার্চের ইতিহাস প্রকাশ করে, তবে দৈনিক বাংলা কোনও ছবি প্রকাশ করেনি প্রতিবেদনের সঙ্গে।
দৈনিক বাংলা ১৯৮৩
দৈনিক সংবাদ ১৯৮৩
১৯৮৩ সালের দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক আজাদ পত্রিকার ২৫ মার্চের কপি পাওয়া যায়নি।
১৯৮৪, ১৯৮৫ ও ১৯৮৬:
সংগৃহীত পত্রিকাগুলোর মধ্যে ১৯৮৫ সালের দৈনিক আজাদের প্রথম পাতায় ২৫ মার্চের কোনও প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়নি।
এই তিন বছর (১৯৮৪, ১৯৮৫, ১৯৮৬) প্রায় একই রকমভাবে গুরুত্বসহ ২৫ মার্চের ইতিহাসের খবর ফিরতে শুরু করে পত্রিকাগুলোর প্রথম পাতায়।
দৈনিক ইত্তেফাক ১৯৮৪
দৈনিক সংবাদ ১৯৮৪
দৈনিক বাংলা ১৯৮৫
দৈনিক সংবাদ ১৯৮৫
দৈনিক আজাদ ১৯৮৬
১৯৮৭: সরাসরি বলা হয় ‘গ্রেফতার হওয়ার পূর্বে স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণা দিয়ে যান বঙ্গবন্ধু’
১৯৮৭ সালের দৈনিক ইত্তেফাক প্রথম পাতায় ছবিসহ ২৫ মার্চের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘ঐদিন রাত্রে বাঙ্গালী জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসভবনেও হামলা চালায় এবং বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে। ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে গ্রেফতার হওয়ার পূর্বে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতাযুদ্ধ ঘোষণা করেন।’
দৈনিক ইত্তেফাক ১৯৮৭
দৈনিক সংবাদ ১৯৮৭
দৈনিক সংবাদ পত্রিকাও অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে প্রথম পাতায় ২৫ মার্চ সংক্রান্ত খবর ছাপে। যদিও বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণা দিয়েছেন এই রকম কোনও তথ্য পত্রিকাটি ওই দিনের সংখ্যায় উল্লেখ করেনি।
১৯৮৭ সালের দৈনিক বাংলা ও দৈনিক আজাদ পত্রিকার ২৫ মার্চের কপি পাওয়া যায়নি।
১৯৮৮: গুরুত্ব পেতে শুরু করেছিল ২৫ মার্চ
১৯৮৮ সালে দৈনিক আজাদ, দৈনিক সংবাদ ও দৈনিক বাংলা অর্থাৎ তিনটি পত্রিকাই প্রথম পাতায় গুরুত্ব সহকারে ২৫ মার্চ বিষয়ক প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
দৈনিক আজাদ ১৯৮৮
দৈনিক বাংলা ১৯৮৮
দৈনিক সংবাদ ১৯৮৮
১৯৮৯: দৈনিক সংবাদ এ বছরও গুরুত্ব দিয়ে ২৫ মার্চের প্রতিবেদন প্রকাশ করে। দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক বাংলা ছবি ছাড়া প্রথম পাতায় ২৫ মার্চের প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
দৈনিক ইত্তেফাক ১৯৮৯
দৈনিক সংবাদ ১৯৮৯
১৯৮৯ সালের দৈনিক আজাদ পত্রিকার ২৫ মার্চ সংখ্যার কপি পাওয়া যায়নি।
১৯৯০: দৈনিক সংবাদ এ বছরও গুরুত্ব দিয়ে ২৫ মার্চের খবর ছাপে। দৈনিক বাংলা ছবি ছাড়া প্রথম পাতায় ২৫ মার্চের প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
দৈনিক বাংলা ১৯৯০
দৈনিক সংবাদ ১৯৯০
এ বছরের দৈনিক আজাদ ও দৈনিক ইত্তেফাক ২৫ মার্চের পত্রিকা পাওয়া যায়নি।