শেরিফ আল সায়ার
ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে বাঙালি জাতি ধীরে ধীরে স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকে পথ চলেছে। মাঝে ছিল ছয় দফা, গণঅভ্যুত্থান ও ৭০’র নির্বাচন। এভাবেই বাঙালি বারবার পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ-নিপীড়নের জবাব দিয়েছে। এর নেতৃত্বে ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর বাঙালি জাতি একটি স্বাধীন দেশ নির্মাণের প্রস্তুতি নিয়েছে। সেই স্বপ্নকে ভূলুণ্ঠিত করতেই ২৫ মার্চ গভীর রাতে ঘুমন্ত বাঙালির ওপর হামলে পড়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। এরপর সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে নয় মাসে ৩০ লাখ শহীদ ও তিন লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে নির্মিত হয়েছে বাংলাদেশ।
১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে বিজয় অর্জনের পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি জাতির জনক স্বাধীন বাংলাদেশে পা রাখেন। সেখান থেকেই একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে গড়ার অভিপ্রায়ে কাজে নেমে পড়েন তিনি। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীদের ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু পুরো পরিবারসহ নিহত হন।
এরপর থেকেই বাঙালি জাতিকে নিয়ে শুরু হয় এক নতুন চক্রান্ত। শুরু হয় ইতিহাসকে ভিন্নভাবে লেখা। এরই অংশ হিসেবে তৎকালীন সংবাদপত্রগুলোকে ব্যবহার করেছে ক্ষমতার গদিতে থাকা সামরিক শাসকরা। সেই অপতৎপরতাগুলো খুঁজে বের করতেই কাজ করেছে বাংলা ট্রিবিউনের গবেষণা বিভাগ। এক্ষেত্রে ১৯৭৬-১৯৯০ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত চারটি পত্রিকার ‘কনটেন্ট অ্যানালাইসিস’ করা হয়েছে। গবেষণার জন্য নেওয়া হয় চারটি পত্রিকা। এগুলো হলো- দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংবাদ, দৈনিক বাংলা, দৈনিক আজাদ। গবেষণায় শুধু এ চারটি পত্রিকায় ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস নিয়ে প্রকাশিত মূল প্রতিবেদনগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা হয়েছে।
হতবাক করার মতো ব্যাপার হলো, ’৭৬ সাল থেকেই ইতিহাসের প্রেক্ষাপট বদলে যেতে থাকে পত্রিকার পাতায়। তাতে বঙ্গবন্ধুর নাম বলা হতো না। এমনকি দৈনিক আজাদ পত্রিকা ১৯৭৬ সাল থেকে স্বাধীনতা দিবসকে ‘আজাদী দিবস’ হিসেবে উল্লেখ করতো।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, সত্যি ইতিহাস অনেকটা সাহস করে বলা শুরু করেছিল দৈনিক সংবাদ। তারই ধারাবাহিকতায় ইত্তেফাকও যখনই সুযোগ পেয়েছে তখনই সত্যি ইতিহাস প্রকাশ করেছে। তাও এই কাজটি করতে সময় লেগেছে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত।
দুই স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আমলে কীভাবে স্বাধীনতা দিবসের খবর প্রকাশ হতো তা নিয়েই বাংলা ট্রিবিউনের এই প্রতিবেদন।
জিয়ার আমল
প্রথম বছর
১৯৭৬ সালে তৎকালীন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ছিলেন সেনাবাহিনী প্রধান ও উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। অন্যদিকে রাষ্ট্রপতি ছিলেন বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম। তবে পত্রিকার পাতা উল্টালে রাষ্ট্র পরিচালনায় জিয়ার প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ চোখে পড়বে। শিরোনামগুলোতে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সায়েমের পাশাপাশি সমান গুরুত্ব পেতেন জিয়াউর রহমান। ১৯৭৬ সালের ২৬ মার্চ প্রকাশিত ‘আজ স্বাধীনতা দিবস’ শিরোনামে সংবাদগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, দৈনিক সংবাদের প্রতিবেদনে মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ থাকলেও কোথাও পাকিস্তানের বর্বর হামলার বিষয়ে কিছুই উল্লেখ নেই। এমনকি পাকিস্তান শব্দটিও প্রতিবেদনের কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। নেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামও।
দৈনিক সংবাদ ১৯৭৬
দৈনিক আজাদ পত্রিকা পর্যালোচনা করলে বিস্ময়করভাবে দেখা যায়, ১৯৭৬ সালে পত্রিকাটি স্বাধীনতা দিবসকে ‘আজাদী দিবস’ হিসেবে উল্লেখ করে। পত্রিকার প্রথম পাতায় ‘আজ আজাদী দিবস’ শিরোনামে প্রতিবেদনটির শুরুতে বলা হয়, ‘আজ ২৬ মার্চ। আমাদের ৬ষ্ঠ আজাদী দিবস। ১৯৭১ সালের ঠিক এই দিনে বাংলাদেশের আজাদী ঘোষণা করা হয়। সেনাবাহিনীর স্টাফ প্রধান ও উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে দীর্ঘ নয় মাসের সশস্ত্র সংগ্রামের পর অর্জিত হয় আমাদের বহু প্রতীক্ষিত আজাদীর লাল সূর্য।’
দৈনিক আজাদ ১৯৭৬
দৈনিক আজাদের পুরো প্রতিবেদনের কোথাও ‘পাকিস্তান’ শব্দটির উল্লেখ নেই। বঙ্গবন্ধুর নামও কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। ১৯৭২- ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত ২৬ মার্চের প্রতিবেদনে পত্রিকাটি ঠিকই স্বাধীনতা দিবসই উল্লেখ করেছিল। কিন্তু ’৭৬ সালে এসে রহস্যজনক কারণে তা হয়ে যায় ‘আজাদী দিবস’।
একইভাবে দৈনিক বাংলা পত্রিকায় ‘আজ স্বাধীনতা দিবস’ প্রতিবেদনেও পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কিংবা পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের কোনও উল্লেখ ছিল না। বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গেও কোনও শব্দ ব্যবহার করেনি পত্রিকাটি।
দৈনিক বাংলা ১৯৭৬
দ্বিতীয় বছর
১৯৭৭ সালের মার্চে জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ওই বছর দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার ২৬ মার্চের ‘আজ স্বাধীনতা দিবস’ প্রতিবেদনে আগের বছরের মতোই কোথাও পাকিস্তান, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু শব্দগুলো উল্লেখ করা হয়নি। উল্টো সংবাদের ভাষায় বোঝানো হয়, জিয়াউর রহমানের ডাকে দেশে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল জনতা। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, ‘...২৬শে মার্চ তৎকালীন মেজর জিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণা শ্রবণের সাথে সাথে চোখের তারায় জ্বলিয়া উঠিয়াছিল প্রতিঘাতের আগুন– প্রসারিত অঙ্গুলি ক্রমশঃ মুষ্টিবদ্ধ হইয়া পরিণত হইয়া ছিল মৃত্যুবাণে। পচাগড় হইতে টেকনাফ পর্যন্ত প্রতিটি গ্রাম-শহর-বন্দর, প্রতিটি জনপদ, রাজপথ, প্রতিটি গৃহ...কুটিরে ছড়াইয়া পড়িয়াছিল একটি মধুর শব্দ, সঙ্গীতের মতো অনুরণিত হইয়াছিল প্রতিটি হৃদয়ের তন্ত্রে একটি দুর্জয় শব্দ– স্বাধীনতা।’
দৈনিক ইত্তেফাক ১৯৭৭
দৈনিক সংবাদের শিরোনাম ছিল, ‘আজ শহীদের রক্তে অর্জিত মহান স্বাধীনতা দিবস’। এই প্রতিবেদনে কোথাও ‘পাকিস্তান’ শব্দ ব্যবহার হয়নি, ছিল না বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের কথা। তবে ‘হানাদার বাহিনী’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে এতে।
১৯৭৭ সালে দৈনিক আজাদ পত্রিকা আগের বছরের মতোই স্বাধীনতা দিবসকে ‘আজাদী দিবস’ হিসেবে উল্লেখ করে। স্বাধীনতা দিবস নিয়ে ইতিহাসের কোনও অংশই এই প্রতিবেদনে ছিল না। এর শুরুতে বলা হয়, ‘আজ সারাদেশে যথোপযুক্ত মর্যাদার সহিত আজাদী দিবস পালিত হইতেছে। এই মহান দিবস উপলক্ষে সমগ্র জাতি জাতীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের শত্রুদের নিশ্চিহ্ন করিয়া জাতীয় সংহতিকে দৃঢ় করার পবিত্র শপথ গ্রহণ করিবে এবং জাতিকে বাঞ্ছিত লক্ষ্যে উপনীত করার আদর্শে নুতন করিয়া উদ্বুদ্ধ করিতে হইবে।’ সব বাক্যের পরই আজাদীর প্রতিবেদনে জানানো হয় কীভাবে দিবসটি পালন করা হবে।
দৈনিক আজাদ ১৯৭৭
দৈনিক বাংলার প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘স্বাধীনতা প্রিয় স্বাধীনতা’। এতেও ইতিহাসের পূর্ণ সত্যকে চাপা দিয়ে রাখা হয়েছিল। প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়, ‘দীর্ঘ শোষণ-নির্যাতনে জর্জরিত হয়ে এদেশের অধিকারহারা মানুষ সেদিন উত্তাল হয়ে উঠেছিল।’ তবে কার বিরুদ্ধে উত্তাল হয়েছিল, কারা এদেশের ওপর শোষণ-নির্যাতন চালিয়েছে, কার নেতৃত্বে এ দেশের মানুষ ফুঁসে উঠেছিল; সেসব এড়িয়ে যাওয়া হয়।
১৯৭৭ সালের দৈনিক বাংলা প্রথমবারের মতো তৎকালীন মেজর জিয়াকে নিয়ে আলাদা আয়োজন করে। সেই প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, ‘আমি মেজর জিয়া বলছি’। এর প্রথম বাক্যই ছিল, ‘আমি মেজর জিয়া বলছি। বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর অস্থায়ী প্রধান সেনাপতি হিসেবে আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি।’ এর মাধ্যমে ইতিহাসের সত্য আড়াল করে প্রচার করা হয়েছে অসত্য তথ্য।
তৃতীয় বছর
১৯৭৮ সালের স্বাধীনতা দিবসের সময় রাষ্ট্রপতি ছিলেন তৎকালীন মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান। ওই ২৬ মার্চ দৈনিক সংবাদ পত্রিকার শিরোনাম ছিল, ‘আজ মহান স্বাধীনতা দিবস’। ওইবারই প্রথম কোনও পত্রিকায় ‘পাকিস্তান’ শব্দটি আসে খানিকটা। তবে সেখানেও ছিল বিভ্রান্তি। এই প্রতিবেদনে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে উল্লেখ করা হয়, ‘পাক-হানাদার জঙ্গী বাহিনী’ হিসেবে। এছাড়া নেই মুক্তিযুদ্ধ শব্দ ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে নেই কোনও কথা।
দৈনিক সংবাদ ১৯৭৮
একইভাবে দৈনিক ইত্তেফাকের শিরোনাম ছিল, ‘আজ স্বাধীনতা দিবস’। এই প্রতিবেদনেও একই পদ্ধতি অবলম্বন করে চেপে যাওয়া হয়েছে ইতিহাসের সব তথ্য। এই প্রতিবেদনের একটি জায়গায় বলা হয়, ‘... একটি সংঘবদ্ধ জাতির স্বাধীনতা স্পৃহাকে চিরতরে দমন করার ঘৃণ্য উদ্দেশ্যে পঁচিশে মার্চের কালরাত্রিতে আসিয়া ছিল ইতিহাসের ঘৃণ্যতম হামলা।’ এই হামলা কারা করেছে সেই তথ্য বরাবরের মতোই চেপে গেছে পত্রিকাটি। দৈনিক আজাদ এ বছরও স্বাধীনতা দিবসকে ‘আজাদী দিবস’ হিসেবে উল্লেখ করে গৌরবময় ইতিহাস নিয়ে কোনও আলোচনাই করেনি। দিবসটি উপলক্ষে কী কী আয়োজন রয়েছে দেশে প্রতিবেদন জুড়ে কেবল সেই তথ্য।
দৈনিক ইত্তেফাক ১৯৭৮
দৈনিক বাংলার শিরোনাম ছিল, ‘আজ স্বাধীনতা দিবস’। এই সংবাদ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ইতিহাসের একটি তথ্য তুলে আনা হয়েছে। যেমন, ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে স্বাধীন বাংলাদেশের পথে এগিয়েছে আন্দোলন-সংগ্রাম। এই বিষয়টি তুলে ধরা হলেও একইভাবে চেপে যাওয়া হয়েছে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের ইতিহাস। দৈনিক বাংলা প্রথমবারের মতো পাকিস্তান শব্দটি বললেও উঠে আসেনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বর হত্যাযজ্ঞের কথা। প্রতিবেদনে তাদের বলা হয়েছে, ‘তৎকালীন পাকিস্তানের দখলদার বাহিনী’।
এছাড়া এ বছরও জিয়ার ঘোষণা পাঠের বিষয় তুলে ধরে আলাদা আয়োজন সাজায় পত্রিকাটি। এর শিরোনাম ছিল ‘স্বাধীন বাংলা বেতারে সেই ঘোষণা’। ঠিক একইভাবে আগের বছরের মতোই দৈনিক বাংলা জিয়ার ঘোষণা পাঠের বক্তব্য অসত্যভাবে প্রকাশ করে। জিয়ার ঘোষণা পাঠের বিষয়ে ১৯৮০ সালে দৈনিক সংবাদের প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে।
চতুর্থ বছর
১৯৭৯ সালের ২৬ মার্চ দৈনিক সংবাদের শিরোনাম ছিল, ‘আজ মহান স্বাধীনতা দিবস’। এই প্রতিবেদনে প্রথমবারের মতো পাকিস্তানি বাহিনীর নারকীয় হত্যাযজ্ঞের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। এছাড়া ৩০ লাখ শহীদের প্রসঙ্গও উঠে আসে। তবে এ বছরও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব প্রসঙ্গে কোনও ধরনের বাক্য লেখা হয়নি।
দৈনিক সংবাদ ১৯৭৯
দৈনিক ইত্তেফাকের শিরোনাম ছিল ‘রক্তে ভেজা অশ্রু ধোয়া স্বাধীনতা দিবস’। এই সংবাদে প্রথমবারের মতো গণহত্যার একটি ছবি ও মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি প্রকাশিত হয়। যদিও প্রতিবেদনটিতে তেমন উল্লেখযোগ্যভাবে ইতিহাস উঠে আসেনি। এ বছরও ইত্তেফাক ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনী’ শব্দটি উচ্চারণ করেনি। তারা বলেছে, ‘বিদেশি হানাদার বাহিনী’।
দৈনিক ইত্তেফাক ১৯৭৯
১৯৭৯ সালেও দৈনিক আজাদ পত্রিকা স্বাধীনতা দিবসকে উল্লেখ করেছে ‘আজাদী দিবস’। এবারও আজাদ পত্রিকা ‘আজ আজাদী দিবস’ শিরোনামের প্রতিবেদনে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে কোনও কিছু তুলে ধরেনি। তাদের প্রতিবেদনে রয়েছে শুধু এই দিবসকে কেন্দ্র করে কী কী আয়োজন রয়েছে সেই তথ্য।
দৈনিক বাংলা তাদের প্রতিবেদনে আগের বছরের চেয়ে কিছু পরিবর্তন নিয়ে আসে। এতে প্রথমবারের মতো ‘পাকিস্তান দখলদার বাহিনী’ শব্দটি উচ্চারণ করেছে তারা।
পঞ্চম বছর
এবার সাহস দেখায় দৈনিক সংবাদ। ১৯৮০ সালে দৈনিক সংবাদ তাদের প্রধান শিরোনাম করে, ‘আজ দশম স্বাধীনতা দিবস’। প্রথমবারের মতো ’৭৫ পরবর্তী সময়ে স্বাধীনতা দিবসে কোনও পত্রিকা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি প্রকাশ করে। যদিও বক্স করে এই প্রতিবেদনে বঙ্গবন্ধুর পাশাপাশি জিয়াউর রহমানের ছবিও প্রকাশিত হয়। তবে পুরো প্রতিবেদনে স্বচ্ছ সত্য ইতিহাস সাহসের সঙ্গে তুলে ধরে দৈনিক সংবাদ। শুধু তা-ই নয়, ’৭৫ পরবর্তী সময়ে ইতিহাসকে মুছে ফেলার যে চক্রান্ত সেই বিষয়ও কিছুটা উঠে এসেছে এতে। এই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘...যারা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বকে শিরোধার্য করে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, তারাও ইচ্ছে করেই আত্মবিস্মৃত হতে চান। সারাবিশ্বের সকল সংগ্রামী শান্তিকামী মানুষ জানে কোন সে মহান নেতা, কার সেই বজ্রকণ্ঠ বাঙ্গালী জাতিকে অস্ত্র হাতে শত্রু হননের দুর্বার আকাঙ্ক্ষায় উদ্দীপ্ত করেছে...।’
দৈনিক সংবাদ ১৯৮০
এছাড়া বঙ্গবন্ধুর নাম এড়িয়ে যখন বারবার বোঝানো হচ্ছিল জিয়ার নেতৃত্বেই মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, সেই শৃঙ্খল ভেঙে জিয়ার শাসনামলেই সত্য ইতিহাস তুলে ধরে দৈনিক সংবাদ। তাদের এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, “...ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে তার ধানমণ্ডির বত্রিশ নম্বর রোডের বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে। এর আগে রাত সাড়ে এগারটায় বঙ্গবন্ধু ওয়ারলেসযোগে চট্টগ্রামে প্রেরিত এক বাণীতে বলেন, ‘পাকিস্তান বাহিনী ঢাকা নগরীর নিরীহ মানুষ বিডিআর, সেনাবাহিনী ও রাজারবাগ পুলিশ লাইনে হামলা চালিয়েছে। এর প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হলো। আপনারা যুদ্ধ চালিয়ে যান। আমরা অবশ্যই জয়লাভ করব। আল্লাহ আমাদের সহায়। জয় বাংলা।”
এরপর জিয়ার বক্তব্যটির প্রসঙ্গে উল্লেখ করা হয়– ‘১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ সকালে চট্টগ্রামের সেনানিবাসের তদানীন্তন মেজর বর্তমানে দেশের রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে দেয়া ঘোষণায় বলেন, ‘আমি মেজর জিয়া বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর অস্থায়ী সেনাপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি যে, আমরা ইতিমধ্যেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আইননানুগ সরকার গঠন করেছি যা সংবিধান ও আইন অনুসারে কাজ চালাতে প্রতিশ্রুত। সুতরাং বিশ্বের সকল গণতান্ত্রিক ও শান্তিকামী দেশের প্রতি আইনসঙ্গত ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ সরকারের প্রতি অবিলম্বে স্বীকৃতি প্রদানের আহবান জানাচ্ছি। আজ নানা অপপ্রচার আর বিভ্রান্তির মাঝে এ দু’টি ঐতিহাসিক বিবৃতি নিশ্চয়ই জাতির আত্মবিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যায়নি।”
১৯৮০ সালেও দৈনিক ইত্তেফাক গণহত্যায় শহীদদের ছবিসহ বক্স করে ‘আজ স্বাধীনতা দিবস’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ করে। এবারও পত্রিকাটি পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে ‘বিদেশি হানাদার বাহিনী’ হিসেবে উল্লেখ করে। এছাড়াও কোথাও বঙ্গবন্ধুর নাম নেওয়া হয়নি।
দৈনিক ইত্তেফাক ১৯৮০
দৈনিক বাংলা পত্রিকার শিরোনাম হয়, ‘আজ মহান স্বাধীনতা দিবস’। পত্রিকাটি তাদের প্রতিবেদনে ‘পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর’ হামলার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনতা ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা উল্লেখ করে। তবে এতে মুক্তিযুদ্ধকে বলা হয়েছে ‘সশস্ত্র সংগ্রাম’। যদিও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রসঙ্গে এবারও আলোকপাত করেনি পত্রিকাটি।
ওই বছরও দৈনিক আজাদ পত্রিকা ‘আজ আজাদী দিবস’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তবে এই প্রতিবেদনে প্রথমবারের মতো মুক্তিযুদ্ধের কিছুটা ইতিহাস তুলে ধরা হয়। যদিও স্বাধীনতা দিবসকে বারবার তারা আজাদী দিবস হিসেবে উল্লেখ করে এসেছে। এছাড়া প্রথমবারের মতো পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলা হয় ‘হানাদার পাক বাহিনী’। এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘... জাতির সার্বিক মুক্তির জন্য ১৯৭১ সালের এই দিনে দেশের আজাদী ঘোষণা করা হয়। ৯ মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর জাতি ছিনাইয়া আনে আজাদীর সূর্য। ...১৯৭১ সালের এই দিনে হানাদার পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে সমগ্র জাতি যে সংগ্রামে লিপ্ত হয় বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে উহার পরিসমাপ্তি ঘটে।’
দৈনিক আজাদ ১৯৮০
ষষ্ঠ বছর
স্বাধীনতা দিবস হলো ‘স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস’। ১৯৮১ সালের ২৬ মার্চ দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় মূল শিরোনাম ছিল, ‘আজ মহান স্বাধীনতা দিবস’। এই প্রতিবেদনের শুরুতেই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রসঙ্গ আনা হয়। যেখানে বলা হয়, তাঁর স্বাধীনতা ঘোষণার পরই দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ হয়। এদিন দৈনিক সংবাদে আরেকটি খবরের শিরোনাম ছিল, ‘স্বাধীনতা দিবস, না স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস’। প্রতিবেদনটি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার একটি বৈঠকে স্বাধীনতা দিবস পালনের পরিবর্তে জাতীয় দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয়। পরে স্বাধীনতা দিবসের নাম বাদ দেওয়া নিয়ে সর্বমহলে প্রতিবাদ হলে সংশোধন করে বলা হয় ‘স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস’। যদিও এই প্রতিবেদনে বলা হয়, ২৫ মার্চ জাতির উদ্দেশে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান যে ভাষণটি দেন সেখানে কোথাও ‘জাতীয় দিবস’ কথাটি যোগ করেননি। তিনি মহান স্বাধীনতা দিবসই উল্লেখ করে ভাষণ দিয়েছেন।
একই বছর দৈনিক ইত্তেফাক ‘আজ স্বাধীনতা দিবস’ শিরোনামে গণহত্যায় শহীদদের ছবিসহ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। প্রথমবারের মতো ইত্তেফাক ‘বিদেশি হানাদার বাহিনী’ শব্দগুলো ব্যবহার না করে শুধু বলেছে ‘হানাদার বাহিনী’। এছাড়া পূর্ববর্তী বছরগুলোর মতোই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ইত্তেফাক।
১৯৭৫ পরবর্তী সময় থেকেই দৈনিক আজাদ স্বাধীনতা দিবসকে বলে আসছিল ‘আজাদী দিবস’। কিন্তু ১৯৮১ সালে এসে পত্রিকাটি ২৬ মার্চকে স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উল্লেখ করে। তবে দৈনিক আজাদে ওই বছরের ২৬ মার্চের প্রতিবেদনে আবারও পাকিস্তানি কিংবা পাক হানাদার বাহিনীর কথা এড়িয়ে গিয়ে বলা হয়েছে ‘তৎকালীন সামরিক সরকার’। এতে বলা হয়, ‘...সেই কারণে ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের রাত্রে তৎকালীন সামরিক সরকারের সশস্ত্র হামলার মুখে জাতি সেইদিন দিশেহারা হয় নাই।’
দৈনিক আজাদ ১৯৮১
দৈনিক বাংলাও তাদের শিরোনাম করেছিল, ‘আজ মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস’। এই প্রতিবেদনে তারা ‘পাকিস্তান দখলদার বাহিনী’ শব্দগুলো ব্যবহার করলেও ‘মুক্তিযুদ্ধ’ শব্দটি কোথাও উল্লেখ ছিল না। ছিল না বঙ্গবন্ধুর কথাও।
দৈনিক বাংলা ১৯৮১
এরশাদের আমল
১৯৮১ সালের ৩০ মে জিয়াউর রহমান নিহত হন। এরপর আবারও দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বদলে যায়। পরিস্থিতির সুযোগে তৎকালীন সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারের নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণের সুযোগ একধাপ এগিয়ে নেন। পরে ২৭ মার্চ বিচারপতি এ.এফ.এম আহসানুদ্দিন চৌধুরীকে রাষ্ট্রপতি পদে বসান। ১৯৮৩ সালের ১১ ডিসেম্বর তিনি প্রধান সামরিক প্রশাসক হিসেবে দেশ শাসন করেন। ওইদিনই রাষ্ট্রপতি বিচারপতি এএফএম আহসানুদ্দিন চৌধুরীর কাছ থেকে রাষ্ট্রক্ষমতা নেন তিনি।
প্রথম বছর
১৯৮২ সালের ২৬ মার্চ দৈনিক সংবাদের শিরোনাম ছিল, ‘আজ মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস’। পত্রিকাটি তাদের এই প্রতিবেদনে বঙ্গবন্ধুর ছবি প্রকাশের সঙ্গে ইতিহাস তুলে ধরে। পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার প্রসঙ্গও উল্লেখ রয়েছে এতে।
দৈনিক সংবাদ ১৯৮২
দৈনিক আজাদের শিরোনাম ছিল, ‘আজ স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস’। দৈনিক আজাদ পত্রিকার প্রতিবেদনে ‘পাকিস্তান’ শব্দ ব্যবহার না করে বলা হয় ‘তৎকালীন হানাদার বাহিনী’। এছাড়াও আরেকটি জায়গায় বলা হয়েছে ‘...৭১-এর ২৫শে মার্চের সুপরিকল্পিত সামরিক হামলায় জাতিকে স্তব্ধ করিয়া দেওয়ার পরিবর্তে অটল প্রতিরোধ সংগ্রামে উজ্জীবিত করিয়া তোলে।’
দৈনিক আজাদ ১৯৮২
১৯৮২ সালের ২৬ মার্চের দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক বাংলার কপি পাওয়া যায়নি বলে পত্রিকা দুটি পর্যালোচনার আওতায় আনা সম্ভব হয়নি।
দ্বিতীয় বছর
বরাবরের মতোই ইতিহাসের সত্য প্রকাশে পিছপা হয়নি দৈনিক সংবাদ। ১৯৮৩ সালের ২৬ মার্চ তাদের শিরোনাম ছিল ‘আজ স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস’। এর প্রথম বাক্যে বলা হয়, ‘আজ ছাব্বিশে মার্চ স্বাধীনতা দিবস। এক যুগ আগে এ দিনেই উচ্চারিত হয়েছিল আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণা।’ এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বাঙালির ৬৬’র ছয় দফা, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থানের কথা। এমনকি বঙ্গবন্ধুর ডাকে সারাদেশের মানুষের ঐক্যবদ্ধ সশস্ত্র প্রতিরোধের কথাও বলা হয়েছে।
জিয়ার আমলে গৃহীত সিদ্ধান্ত ‘স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস’ হিসেবে উল্লেখ না করে দৈনিক ইত্তেফাক ’৮৩’র ২৬ মার্চ শিরোনাম করে ‘আজ মহান স্বাধীনতা দিবস’। এই প্রতিবেদনে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে সব সংগ্রামের সাল উল্লেখ করা হয়। ১৯৭১’র ৭ মার্চের প্রসঙ্গও বলা হয়। তবে ৭ মার্চ কার নির্দেশে ঘরে ঘরে প্রস্তুতি শুরু হয় তা এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে ‘পাকিস্তান’ শব্দের পরিবর্তে উল্লেখ রয়েছে ‘হানাদার বাহিনী’।
v
দৈনিক ইত্তেফাক ১৯৮৩
দৈনিক আজাদ প্রতি বছরের মতোই নিজেদের প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যথারীতি শিরোনামসহ কোথাও পাকিস্তান আর মুক্তিযুদ্ধ শব্দগুলো উল্লেখ করা হয়নি।
দৈনিক বাংলা শিরোনাম করে ‘আজ মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস’। তাদের সংবাদে পাকিস্তান শব্দ ব্যবহার না করে বলা হয়, ‘...বিদেশি শাসন ও শোষণের নিষ্পেষণ থেকে মুক্তির জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিল স্বাধীনতা যুদ্ধে।’ এতে বঙ্গবন্ধুর নাম বলা হয়নি। ইতিহাসের পূর্ণাঙ্গ চিত্রও উঠে আসেনি।
দৈনিক বাংলা ১৯৮৩
তৃতীয় বছর
দৈনিক সংবাদ আগের মতোই সাহসের সঙ্গে ইতিহাস তুলে ধরতে ‘আজ মহান স্বাধীনতা দিবস’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে ছিল স্মৃতিসৌধের ছবি।
১৯৭৫ সালের পর থেকে ১৯৮৪ সালে এসে দৈনিক ইত্তেফাক (১৯৭৬ ও ১৯৮২ সালের দৈনিক ইত্তেফাকের ২৬ মার্চের কপি না পাওয়ায় পর্যালোচনা করা যায়নি) প্রথমবারের মতো স্বাধীনতা দিবসের প্রতিবেদনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম উল্লেখ করে। শুধু তা-ই নয়, ৭ মার্চের ভাষণের ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ অংশটিও উল্লেখ করা হয়। এর এক অংশে বলা হয়, ‘...২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে বন্দি হওয়ার পূর্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। চট্টগ্রাম বেতার হইতে মেজর জিয়ার কণ্ঠে পুনরায় ধ্বনিত হয় এই ঘোষণা। এই ঘোষণা মানুষকে উদ্দীপ্ত করে এবং শুরু হয় হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ।’ এই অংশটুকু পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ইত্তেফাক বঙ্গবন্ধুর কথা প্রথমবারের মতো উল্লেখ করলেও ‘পাকিস্তানি সেনাবাহিনী’ শব্দ দুটি এড়িয়ে গেছে। এমনকি জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে যে ঘোষণাটি পাঠ করেন সেটিও বলা হয়নি সরাসরি।
দৈনিক আজাদ শিরোনাম করে ‘আজ স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস’। ১৯৭৬ সালের পর এবারই প্রথম পত্রিকাটি তাদের প্রতিবেদনে ‘পাকিস্তান’ শব্দ ব্যবহার করেছে। এতে বলা হয়, ‘...পাকিস্তানের সশস্ত্র সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘ ৯ মাস প্রতিরোধ সংগ্রামের মধ্য দিয়া স্বাধীনতার রক্ত গোলাপ ছিনাইয়া আনে।’
দৈনিক বাংলা এদিন আগের মতোই সংবাদ পরিবেশন করেছে। বঙ্গবন্ধুর নাম একবার প্রতিবেদনে থাকলেও তা ঐতিহাসিক কোনও প্রেক্ষাপটে বলা হয়নি। আওয়ামী লীগের কর্মসূচির প্রসঙ্গে তার নামটি উল্লেখ করা হয়।
দৈনিক বাংলা ১৯৮৪
চতুর্থ বছর
১৯৮৫ সালের ২৬ মার্চ দৈনিক সংবাদের শিরোনাম ছিল ‘আজ মহান স্বাধীনতা দিবস’। এবারও সত্য ইতিহাস প্রকাশিত হয়েছে তাদের প্রতিবেদনে। এটি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়— বঙ্গবন্ধু শব্দটি বলা হয়েছে চারবার, জাতির জনক একবার। শেখ মুজিবুর রহমান নামটিরও উল্লেখ রয়েছে। এছাড়া পাকিস্তান শব্দটি বলা হয়েছে পাঁচবার।
দৈনিক সংবাদ ১৯৮৫
দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার শিরোনাম ছিল, ‘আজ স্বাধীনতা দিবস’। এই প্রতিবেদনে ইতিহাস তুলে ধরতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু ও ৭ মার্চের ভাষণ প্রসঙ্গ এলেও ‘পাকিস্তান’ শব্দটিকে বরাবরের মতো এড়িয়ে যাওয়া হয়।
দৈনিক ইত্তেফাক ১৯৮৫
দৈনিক আজাদ আগের বছরের মতোই ‘আজ স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। দৈনিক বাংলার ১৯৮৫ সালের ২৬ মার্চের প্রতিবেদনে ইতিহাসের পূর্ণচিত্র উঠে আসেনি।
দৈনিক আজাদ ১৯৮৫
পঞ্চম বছর
১৯৮৬ সালের ২৬ মার্চ দৈনিক সংবাদ ‘আজ মহান স্বাধীনতা দিবস’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে আগের মতোই ইতিহাসের সত্য চিত্র উঠে আসে। বঙ্গবন্ধুর নাম, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ, পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যাসহ সব প্রসঙ্গই উঠে এসেছে এই প্রতিবেদনে।
দৈনিক ইত্তেফাকের এদিনের শিরোনাম ছিল, ‘আজ মহান স্বাধীনতা দিবস’। আগের বছরের মতোই পত্রিকাটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
দৈনিক ইত্তেফাক ১৯৮৬
দৈনিক আজাদ পত্রিকা শিরোনাম করে ‘আজ স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস’। এই প্রতিবেদনে ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে সব সংগ্রামের সালগুলো উল্লেখ রয়েছে। তবে কোথাও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রসঙ্গ উঠে আসেনি।
একই বছরের ২৬ মার্চ দৈনিক বাংলার প্রতিবেদনের দ্বিতীয় অংশ পাওয়া যায়নি। তবে প্রথম পাতায় প্রথম অংশ দেখে বলা যায়, আগের বছরগুলোর মতোই ছিল তাদের খবরের ধরন।
ষষ্ঠ বছর
১৯৮৭ সালের ২৬ মার্চ দৈনিক সংবাদের ‘আজ মহান স্বাধীনতা দিবস’ প্রতিবেদনটি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এ বছর তারা সর্বোচ্চবার ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি উল্লেখ করেছে। এতে ১২ বার ‘বঙ্গবন্ধু’ উল্লেখ রয়েছে। এছাড়া শেখ মুজিবুর রহমানের পূর্ণ নামসহ মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটের কথাও আছে।
দৈনিক ইত্তেফাকের একই দিনের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করলে দেখা যায়— বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, জাতির জনক, শেখ মুজিবুর রহমান শব্দগুলো রয়েছে। তবে আবারও ইত্তেফাক ‘পাকিস্তান’ শব্দটি উল্লেখ না করে ‘হানাদার বাহিনী’র মধ্যেই রয়ে যায়।
দৈনিক বাংলার এদিনের পত্রিকা আগের বছরগুলোর প্রতিবেদনের মতোই ধারাবাহিকতা রক্ষা করেছে। এতে কেবল একবার ‘পাকিস্তান’ শব্দটি রয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামও কোথাও নেই। ১৯৮৭ সালের ২৬ মার্চের দৈনিক আজাদ পত্রিকা পাওয়া যায়নি।
দৈনিক বাংলা ১৯৮৭
সপ্তম বছর
১৯৮৮ সালের দৈনিক সংবাদ পত্রিকা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়— প্রতিবেদনে তিনবার বঙ্গবন্ধুর নাম, একবার তাকে জাতির জনক উল্লেখ করে দুইবার শেখ মুজিবুর রহমানের নাম রয়েছে। এছাড়া ‘পাকিস্তান’ শব্দটি তারা ছয়বার বলেছে। তাদের এই প্রতিবেদনেও রয়েছে ইতিহাসের চিত্র।
দৈনিক ইত্তেফাকের শিরোনাম ছিল, ‘আজ মহান স্বাধীনতা দিবস’। এই প্রতিবেদনে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের উল্লেখ থাকলেও আবারও এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে ‘পাকিস্তান’ শব্দটি। এক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে ‘হানাদার সৈন্য’।
দৈনিক আজাদের ১৯৮৮ সালের ২৬ মার্চের ‘আজ স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস’ প্রতিবেদনে বলা হয়নি বঙ্গবন্ধুর নাম, ছিল না পাকিস্তান শব্দটিও। তবে ‘পাক হানাদার’ শব্দটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে একবার।
দৈনিক আজাদ ১৯৮৮
অন্যদিকে দৈনিক বাংলা এদিনের প্রতিবেদনের কোথাও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধুর অবদানের বিষয়ে উল্লেখ করেনি। যদিও আওয়ামী লীগের কর্মসূচিতে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে মাল্যদানের তথ্য জানাতে গিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম বলা হয়।
অষ্টম বছর
১৯৮৯ সালের ২৬ মার্চ ‘আজ মহান স্বাধীনতা দিবস’ শিরোনামে প্রতিবেদন করে দৈনিক সংবাদ। এতে তিনবার বঙ্গবন্ধুর নাম ও একবার তাঁকে জাতির জনক হিসেবে উদ্ধৃতি দিয়ে দুইবার শেখ মুজিবুর রহমানের নাম বলা হয়। এই প্রতিবেদনে ‘পাকিস্তান’ শব্দটি বলা হয় ছয়বার।
দৈনিক সংবাদ ১৯৮৯
দৈনিক ইত্তেফাক এ বছর ‘আজ মহান স্বাধীনতা দিবস’ শিরোনামের প্রতিবেদনে পূর্ণাঙ্গভাবে ইতিহাস তুলে ধরে। এতে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ অংশটুকুও প্রকাশ করে। একইসঙ্গে গ্রেফতারের আগেই বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার প্রসঙ্গও তুলে ধরে পত্রিকাটি।
দৈনিক ইত্তেফাক ১৯৮৯
দৈনিক বাংলা আগের ধারাবাহিকতাই বজায় রেখে শিরোনাম দিয়েছিল ‘আজ মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস’। এ প্রতিবেদনে আবারও তারা ‘পাকিস্তান’ শব্দ ব্যবহার করেনি। এছাড়া নেই বঙ্গবন্ধুর নাম। ১৯৮৯ ও ১৯৯০ সালের ২৬ মার্চের দৈনিক আজাদ পত্রিকা পাওয়া যায়নি।
দৈনিক বাংলা ১৯৮৯
নবম বছর
১৯৯০ সাল ছিল এরশাদের শাসনের শেষ বছর। এ বছরের ২৬ মার্চ দৈনিক সংবাদ আবারও বঙ্গবন্ধুর ছবিসহ স্বাধীনতা দিবসের প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর নাম দু’বার ও জাতির জনক একবার উল্লেখ করে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম রয়েছে দুইবার। ‘পাকিস্তান’ শব্দটি তারা বলেছে ছয়বার আর ‘পাকিস্তানি সেনাবাহিনী’ উল্লেখ আছে একবার।
দৈনিক সংবাদ ১৯৯০
দৈনিক ইত্তেফাকও আগের বছরের মতো ১৯৯০ সালে সত্য ইতিহাস প্রকাশ করে। এই প্রতিবেদনে ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি চারবার উল্লেখ রয়েছে। এতে জাতির জনক না বললেও শেখ মুজিবুর রহমান নামটি এসেছে একবার।
দৈনিক ইত্তেফাক ১৯৯০
দৈনিক বাংলা পূর্বের ধারাবাহিকতায় ১৯৯০ সালে এসেও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম কোথাও উল্লেখ করেনি। যদিও আওয়ামী লীগের কর্মসূচির তথ্য জানাতে গিয়ে তারা বঙ্গবন্ধুর নাম উল্লেখ করে।