বিভুরঞ্জন সরকার
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কথা চেষ্টা করেও ভুলে থাকা যায় না। এমন একটি দুঃখের দিন, বেদনার দিন, কষ্টের দিন বাঙালির জাতীয় জীবনে দ্বিতীয়টি নেই। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে একদল কুলাঙ্গার বাঙালি সেনাসদস্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের চাকা পেছনের দিকে ঘোরানোর যাত্রা শুরু করেছিল। পাকিস্তানি শাসকচক্র শেখ মুজিবকে হত্যা করতে চেয়েছিল, বিচারের নামে প্রহসন করে তাকে ফাঁসিতে ঝোলাতে চেয়েছিল কিন্তু পারেনি। অথচ স্বাধীন দেশে তাকে জীবন দিতে হলো তার প্রিয় বাঙালির হাতেই। বঙ্গবন্ধুকে তার জীবনের ঝুঁকি সম্পর্কে কেউ কেউ সতর্ক করেছেন, তাকে তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা জোরদার করার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি সেসব আমলে নেননি। ঘাতকের বুলেট যে তার বক্ষ লক্ষ্য করে আছে–সেটা তিনি বিশ্বাস করতে চাইতেন না। তিনি প্রবল আত্মবিশ্বাসের সঙ্গেই বলতেন, ‘কোনও বাঙালি আমাকে মারতে পারে না, মারবে না’। তিনি আমৃত্যু রাজনীতি করেছেন মানুষকে নিয়ে, মানুষের জন্য। মানুষের প্রতি ছিল তার অপরিসীম দরদ ও ভালোবাসা।
একজন বিদেশি সাংবাদিক শেখ মুজিবকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আপনার যোগ্যতা (qualification) কী?’ তিনি জবাব দিয়েছিলেন, ‘আমি আমার দেশের মানুষকে ভালোবাসি’। সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন ছিল, ‘আপনার অযোগ্যতা কি’? তিনি তাৎক্ষণিকভাবেই জবাব দিয়েছিলেন, ‘আমি তাদের বড্ড বেশি ভালোবাসি’। মানুষের প্রতি এই অতিরিক্ত ভালোবাসা তার এতটাই দুর্বল করেছিল যে শাসক হিসেবে তিনি সবার প্রতি সমান উদারতা ও মানবিকতা দেখিয়ে কার্যত নিজের মৃত্যুফাঁদ নিজেই তৈরি করেছেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব স্বাধীনতা লাভের পর পর এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘এদেশের মানুষ আমার জীবনের জন্য অজস্র রক্তপাত করেছে। আমি তাদের স্বার্থের প্রশ্নে বেইমানি করতে পারি না। দরকার পড়লে আমি আমার দেশের মানুষের রক্তের ঋণ নিজের রক্ত দিয়ে পরিশোধ করবো’। বঙ্গবন্ধু তার কথা রেখেছেন। কিন্তু এতে বাঙালির রাজনৈতিক জীবনে নেমে এসেছে ঘোর দুর্দিন।
দুই.
বিবিসির জরিপে যখন শেখ মুজিবুর রহমানকে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে নির্বাচিত করা হয়, তখন কারও কারও মধ্যে যে বিস্ময় দেখা দেয়নি, তা নয়। রাজনীতি, সাহিত্য, শিল্প, অর্থনীতি, বিজ্ঞান, সমাজ, সংস্কৃতি, শিক্ষা, সংস্কারের শত শত বছরের ইতিহাসে সব বাঙালিকে ছাড়িয়ে শেখ মুজিব কীভাবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে এগিয়ে থাকলেন–এ প্রশ্নের উত্তর অত্যন্ত সহজ। তিনি বাঙালির ইতিহাসে প্রথম স্বাধীন জাতি রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা, জনক। শেখ মুজিব একদিকে যেমন ইতিহাসের নায়ক, বরপুত্র আবার অন্যদিকে তিনি ইতিহাস-স্রষ্টা। তার চেয়ে পুঁথিগত বিদ্যায়-বুদ্ধিমত্তায়-সৃজনশীলতায় সেরা বাঙালি হয়তো আরও এক বা একাধিক পাওয়া যাবে, কিন্তু তার মতো অসম সাহসী, দূরদর্শী এবং তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে পারদর্শী রাজনৈতিক নেতা বাঙালিদের মধ্যে আর নেই। তিনি জীবনের পাঠশালা থেকে ক্রমাগত শিক্ষা নিয়ে নিজেকে অতিক্রম করেছেন, অতিক্রম করেছেন তাদের, যাদের কাছ থেকে তিনি রাজনীতির পাঠ গ্রহণ করেছেন।
শেখ মুজিব উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া নেতা ছিলেন না। তিনি ধাপে ধাপে, ধীরে ধীরে উপরে উঠেছেন। কারও তৈরি করা সিঁড়ি বেয়ে নয়, নিজের তৈরি করা সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠেছেন।
এ তথ্য আমাদের অজানা নয় যে শেখ মুজিব গ্রামের সন্তান। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার মতো অজপাড়াগাঁয়ে তার জন্ম। গ্রামের কাদা-পানিতে তার গড়ে ওঠা, বেড়ে ওঠা। নিজে খুব দরিদ্র পরিবারের সন্তান না হলেও তিনি তৎকালীন গ্রামীণ দারিদ্র্য দেখেছেন কাছ থেকে। মানুষের দুঃখ-কষ্ট তিনি সইতে পারতেন না। তার মন ছিল দরদী ও সংবেদনশীল। বালকবেলাতেই নিজেদের গোলার ধান চুপিসারে বিলিয়ে দিতেন গরিবদের মধ্যে। গায়ের চাদরও খুলে দিয়েছেন শীতে কষ্ট পাওয়া গ্রামবাসীকে। কোনও কিছু থাকা এবং না-থাকার বিষয়টি ছোটবেলা থেকেই তাকে ভাবিত ও তাড়িত করেছে। তার মধ্যে একটি সহজাত নেতৃত্বগুণও ছিল। সবার মধ্যে থেকেও তিনি ছিলেন সবার থেকে একটু আলাদা। ফুটবল খেলতেন, ছিলেন ফুটবল দলের ক্যাপ্টেন। তিনি ছেলেবেলা থেকেই যেমন হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদ মানতেন না, তিনি বেড়ে উঠেছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনায়, তেমনি একশ্রেণির হিন্দুর ধর্মীয় অহমিকা, দম্ভ, গরিবের প্রতি জুলুমবাজিরও বিরুদ্ধে ছিলেন।
শেখ মুজিব তার জীবনের লক্ষ্য ও আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন ‘গরিবের মুখে হাসি ফোটানো’। তিনি কখনও এই আদর্শ ত্যাগ করেননি। গরিবের পক্ষ ত্যাগ করার কথা কখনও ভাবেননি। গরিব মুসলমান তাদের ভাগ্য ফেরানোর আশা নিয়ে পাকিস্তান চেয়েছে, শেখ মুজিব সম্মুখে থেকে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে শামিল হয়েছেন। আবার পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই যখন তিনি পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর বাঙালির স্বার্থবিরোধী মনোভাব বুঝতে পারলেন, তখন কালবিলম্ব না করে গরিব বাঙালির পক্ষেই অবস্থান বেছে নিলেন। শুরু হয় তার বিরুদ্ধে জেল-জুলুম।
‘কারাগারের রোজনামচা’-য় তিনি লিখেছেন: ‘পাকিস্তান কায়েম হওয়ার পরই ১৯৪৮-এ যখন আমাকে বাংলাভাষা আন্দোলনের সময় গ্রেফতার করলো, আবার ১৯৪৯ সালে গ্রেফতার করে ১৯৫২ সালে ছাড়লো, তখন আমার মা আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, বাবা, তুই তো পাকিস্তান পাকিস্তান করে চিৎকার করেছিস, কত টাকা নিয়ে খরচ করেছিস- এ দেশের মানুষ তো তোর কাছ থেকেই পাকিস্তানের নাম শুনেছিল, আজ তোকেই সেই পাকিস্তানের জেলে কেন নেয়?’ ( পৃষ্ঠা ৭৯) সহজ-সরল মাকে এই প্রশ্নের সঠিক জবাব তখন তিনি দেননি বা দিতে চাননি। তার গরিবমুখী, বাঙালিমুখী অবস্থানের কারণেই তাকে শাসকদের রোষানলে পড়তে হয়েছিল, এটা এখন অনেকেরই জানা।
একাধিকবার তাকে ফাঁসির মঞ্চের মুখোমুখি করা হলেও তিনি আপস করেননি। নিজের মধ্যে যে অপরিমেয় সাহস তিনি ধারণ করতেন তা তিনি বাঙালি জাতির মধ্যে সংক্রমিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তার ডাকে বাঙালি অকাতরে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছে, মরণকে বরণ করেছেন হাসিমুখে। তাই ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তার জীবনের সেরা ভাষণে শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না’। বাঙালিকে আসলেই আর কেউ দাবায়ে রাখতে পারেনি। পাকিস্তানের শাসন-শোষণের জিঞ্জির ভেঙে বাঙালি জাতি স্বাধীনতার রক্তপতাকা ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে!
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কখনও প্রতিহিংসার রাজনীতি করেননি। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের জন্যও তার হৃদয়ে ছিল সহানুভূতি ও ভালোবাসা। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকার কারণে চট্টগ্রামের ফজলুল কাদের চৌধুরী, খুলনার আব্দুস সবুর খান স্বাধীনতার পর জেলে গেলেও বঙ্গবন্ধু তাদের প্রতি সদয় ছিলেন, খোঁজ-খবর নিতেন। বঙ্গবন্ধুর বাড়ি থেকে তাদের জন্য কারাগারে খাবার পাঠানো হতো বলেও শোনা যায়। আত্মগোপনে থাকা রাজনৈতিকভাবে বিরুদ্ধ মতের মোহাম্মদ তোয়াহাকেও বঙ্গবন্ধু আনুকূল্য দেখিয়েছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে দেশে যে প্রতিহিংসার রাজনীতি শুরু হয় তা আর বন্ধ হচ্ছে না। উদারতা ও কঠোরতার সমন্বয় না হলে রাজনীতি করা যায় না। অথচ কঠোরতা দেখাতে পারতেন না বঙ্গবন্ধু, তিনি ছিলেন কেবলই উদার, মানবিক ও সংবেদনশীল।
তিন.
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বলা হয় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভাবশিষ্য। তিনি ছিলেন সোহরাওয়ার্দীর গুণমুগ্ধ ও অনুসারী। সোহরাওয়ার্দীর আদর্শই তাকে রাজনীতিতে আকৃষ্ট করেছিল। তার নেতৃত্বগুণ ও সাংগঠনিক দক্ষতা শেখ মুজিবকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। সোহরাওয়ার্দী সাহেবও শেখ মুজিবকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে শেখ মুজিবুর রহমান লিখেছেন–‘জীবনে প্রত্যেকটা দিনই তার স্নেহ পেয়েছি। এই দীর্ঘদিন আমাকে তার কাছ থেকে কেউই ছিনিয়ে নিতে পারে নাই এবং তার স্নেহ থেকে কেউই আমাকে বঞ্চিত করতে পারে নাই’। ( পৃ-২৯)
সোহরাওয়ার্দী সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু আরো লিখেছেন–‘শহীদ সাহেব ছিলেন উদার, নীচতা ছিল না, দল-মত দেখতেন না। কোটারি করতে জানতেন না, গ্রুপ করারও চেষ্টা করতেন না। উপযুক্ত হলেই তাকে পছন্দ করতেন এবং বিশ্বাস করতেন। কারণ, তার আত্মবিশ্বাস ছিল অসীম। তার সাধুতা, নীতি, কর্মশক্তি ও দক্ষতা দিয়ে মানুষের মন জয় করতে চাইতেন’। (পৃ-৪৭)
আজ যারা নিজেদের বঙ্গবন্ধুর অনুসারী বলে দাবি করেন, তাদের উচিত হবে মানুষের মন জয় করার রাজনীতিতে মনোযোগী হওয়া। ব্যক্তিস্বার্থের চেয়ে দলীয় স্বার্থ এবং দলীয় স্বার্থের চেয়ে দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থকে বড় করে দেখতে না পারলে বঙ্গবন্ধুর প্রতি ভালোবাসা মেকি বলেই প্রতিভাত হবে।
চার.
রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট আব্দুল হামিদ তার একটি লেখায় বলেছেন–‘বঙ্গবন্ধু কোনো দলের নয়, সবার’– এটা আমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে। যারা তাকে মানতে চায়নি, তারা বাংলাদেশকেও মানতে পারেনি। তাদের সংখ্যা কিন্তু একেবারে কম নয়। একাত্তরের পরাজিত শক্তিই পঁচাত্তরে জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা করে দেশকে পেছনের দিকে ঘুরিয়ে দিতে চেয়েছে। সেই জায়গা থেকে আবার ফিরেছি প্রগতির পথে। আমরা এখন মধ্যম আয়ের দেশ। আমরা এগিয়ে যাচ্ছি, আরও এগিয়ে যাবো। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই আমাদের অগ্রযাত্রার মূলশক্তি। এটাকে আমরা যত ছড়িয়ে দিতে পারবো, ততই আমাদের বিভাজন কমবে’।
বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া দল এখন ক্ষমতায়। তারই কন্যা শেখ হাসিনা দেশের প্রধানমন্ত্রী। এখন দেশে বঙ্গবন্ধুর ভক্ত ও অনুসারীর সংখ্যাও অনেক। কিন্তু দেশ কী বঙ্গবন্ধুর আদর্শের ধারায় পরিচালিত হচ্ছে? লন্ডন প্রবাসী প্রবীণ সাংবাদিক-লেখক আব্দুল গাফফার চৌধুরী তার একটি নিবন্ধে লিখেছেন–‘বর্তমান আওয়ামী লীগ শুধু বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্নের তাবিজ বিক্রি করছে, নিজেরা ধারণ করছে না। শুধু মুজিব কোট গায়ে চাপালেই মুজিবপন্থী হওয়া যায় না। মুজিবের স্বপ্ন ও আদর্শ রূপায়ণে একাত্তরের মতো সংগ্রামের শপথ নিতে হবে। বঙ্গবন্ধুর বর্তমান অনুসারীরা কী জানেন তার লক্ষ্য ও আদর্শ কি ছিল? তার অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তা, গণতান্ত্রিক রাজনীতি, সমাজতন্ত্র ঘেঁষা অর্থনীতি (মিশ্র অর্থনীতি নামে যা পরিচিত), সাম্রাজ্যবাদ ও ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আপসহীন অবস্থান’–এর কোনোটাতেই কি তাদের দৃঢ় আস্থা ও আনুগত্য রয়েছে? যদি না থাকে তাহলে বিশ্বাসের এই শিকড়ে তাদের ফিরতে হবে। আর যদি থাকে তাহলে দেশের সব মানুষের মধ্যে এই আস্থা ও আনুগত্য ছড়িয়ে দিয়ে দেশে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, ধর্মান্ধ জঙ্গিগোষ্ঠীর অশুভ জোট ও তাদের বিদেশি অভিভাবকদের সম্মিলিত চক্রান্তের বিরুদ্ধে অবিরাম সংগ্রামের শপথ গ্রহণ করতে হবে। সেই শপথ গ্রহণের মাস এই আগস্ট। দুর্নীতি ও সন্ত্রাসকে রুখে দাঁড়ানোর মাস এই আগস্ট’।
আত্মপ্রতারণা পরিহার করে আমাদের সবারই আত্মশুদ্ধি করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে আত্মজিজ্ঞাসারও মুখোমুখি হওয়া উচিত। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও নীতিতে ফিরে যাওয়ার প্রতিজ্ঞা উচ্চারণ করেই এবার পালিত হোক জাতীয় শোক দিবস।
লেখক: কলামিস্ট