এরশাদুল আলম প্রিন্স
১৫ আগস্ট, ১৯৭৫। আমাদের জীবনে এক মর্মান্তিক ট্র্যাজেডির দিন। লজ্জা ও বেদনার দিন। পৃথিবীর ইতিহাসে এরকম নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড আর একটিও হয়নি। হত্যা, ক্যু আর ষড়যন্ত্র আমাদের রাজনীতিতে নতুন কিছু নয়। কিন্তু এই হত্যাকাণ্ড থেকে ১০ বছরের শিশুও রেহাই পায়নি। বাদ যায়নি অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীও।কাজেই এ হত্যাকাণ্ডের ভয়াবহতা ও ব্যাপকতা থেকে বোঝাই যায় যে এটি নিছক একটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড বা জাতির জনককে বা শুধু একজন রাজনৈতিক নেতাকে হত্যার জন্যই এ হত্যাযজ্ঞ সাধিত হয়নি। জাতিরাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের সূচনার প্রায় প্রথম পর্বেই সংঘটিত হয় এ হত্যাকাণ্ড।
জাতিরাষ্ট্র হিসেবে আত্মপরিচয় উপলব্ধি ও সেই মতো বেড়ে ওঠার সূচনালগ্নেই সংঘটিত হয় এ হত্যাকাণ্ড। বঙ্গবন্ধু আমাদের সেই আত্মপরিচয়ের মূর্ত প্রতীক । তিনি বাঙালি জাতীয়বাদের গতিধারার নিয়ন্ত্রক ও দিশারি। ফলে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালিত্বের যে চেতনা ও আদর্শের উন্মেষ হয়েছে সে গতিধারার ক্রমবিকাশ যাতে বাধাগ্রস্ত ও ধ্বংস হয় ও সেই সঙ্গে কোনোভাবেই যাতে ভবিষ্যতে এর পুনঃবিকাশ হতে না পারে সে জন্যে শুধু বঙ্গবন্ধুকে নয়, তার পরিবারকেও নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছেছিল হত্যাকারীরা। ফলে, এ হত্যাকারীরা শুধু একজন জাতির জনক, রাষ্ট্রপতি বা একজন রাজনীতিবিদের হত্যাকারী নয়, তারা একটি জাতিসত্তার হত্যাকারী ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের চিহ্নিত শত্রু।
আগেই বলেছি, বঙ্গবন্ধু আমাদের জাতিসত্তার দিকপাল। তাই আক্রমণটি তাঁর ও তাঁর পরিবারের ওপরই আসে। কিন্তু ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্টেই যে তাঁর ওপর প্রথম আঘাত হানা হয়েছে বিষয়টি এমন নয়। তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র হয়েছে আগেও। তিনি যখন জাতির জনক হয়ে ওঠেননি তখনও তাঁকে হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। কারণ, বাঙালি বিরোধী শক্তি আগে থেকেই উপলব্ধি করেছিল যে আগামী দিনে বঙ্গবন্ধুই হবেন তাদের প্রধান শত্রু, কেননা বাঙালি জাতিসত্তার ও জাতীয়তাবাদের বিকাশমান স্রোতধারার তিনিই পথনির্দেশক। একথা বাঙালিরা যেমন বুঝতে পেরেছিল, পাকিস্তানিরাও বুঝতে পেরেছিল।
দুইশ’ বছরের ঔপনিবেশিক শাসন ও ২৪ বছরের সামন্তবাদী, সাম্প্রদায়িক ও স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের মাধ্যমে বাঙালি জাতিসত্তার ম্রিয়মাণ অবস্থা থেকে বঙ্গবন্ধুই একে জাগ্রত করেন। আমাদের পাকিস্তানি বানানোর ষড়যন্ত্র ও নীলনকশা হয়েছে পাকিস্তান সৃষ্টির প্রথমভাগেই। ১৯৪৭-এর দেশভাগের এক বছর পরেই জিন্নাহ ঘোষণা দেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। শুধু তাই নয়, বাংলাকে উর্দু হরফে পড়িয়ে মুসলমান করার পাঁয়তারাও হয়েছে। বাঙালিকে ‘পাক্কা মুসলমান’ মনে করা হতো না। আসলে এটি ছিল বাঙালি মুসলমানদের ওপর সাংস্কৃতিক আগ্রাসন। ওরা ভেবেছিল, সংস্কৃতির ওপর সংস্কৃতি চাপিয়ে দিলেই ঢাকাইয়ারা সব পাঞ্জাবি হয়ে যাবে। অর্থাৎ বাঙালি জাতীয়তাবোধ আর মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারবে না। পাকিস্তানিরা সে চেষ্টা নানাভাবেই করেছে, শেষ পর্যন্ত করেছে।
বাংলা ভাষার পাশাপাশি পাকিস্তানিরা আমাদের ‘বাংলাদেশ’, বা ‘পূর্ব বাংলা’ বা ‘পূর্ববঙ্গ’ পরিচয়ও মুছে ফেলতে চেয়েছে। নাম দিয়েছে পূর্ব পাকিস্তান। বঙ্গবন্ধু তাদের এসব ষড়যন্ত্র আগেই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। ফলে, তার সকল রাজনৈতিক কার্যক্রম ও আন্দোলনের এজেন্ডা ছিল মূলত আমাদের জাতীয়তাবাদের নির্বিঘ্ন চর্চা নিশ্চিত করা। ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন রূপরেখা ছিল মূলত নাগরিক অধিকার রক্ষা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন।১৯৬৬ থেকে আমরা আমাদের রাজনৈতিক অধিকার রক্ষার আন্দোলনও জোরদার করতে শুরু করি। এটিই আমাদের স্বাধিকার থেকে স্বায়ত্তশাসনের রূপরেখা।
১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক জনসভায় শেখ মুজিব ঘোষণা করেন, এখন থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে "বাংলাদেশ" নামে অভিহিত করা হবে। তিনি আরও বলেন, “একটা সময় ছিল যখন এই মাটি আর মানচিত্র থেকে "বাংলা" শব্দটি মুছে ফেলার সব ধরনের প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল। "বাংলা" শব্দটির অস্তিত্ব শুধু বঙ্গোপসাগর ছাড়া আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যেত না। আমি পাকিস্তানের পক্ষ থেকে আজ ঘোষণা করছি, এখন থেকে এই দেশকে 'পূর্ব পাকিস্তানে' বদলে 'বাংলাদেশ' ডাকা হবে”।
পাকিস্তানিরা দেখলো, বাঙালিরা ধীরে ধীরে তার ‘নিজস্বতার’ দিকে অগ্রসর হচ্ছে। অর্থাৎ, বাঙালিরা একটি ভূ-রাজনৈতিক মানচিত্রে স্বায়ত্তশাসন চাচ্ছে, যার ফলে সেখানে তাদের জাতীয়তাবাদের বিকাশ হবে, যার নিশ্চিত ফলাফল হচ্ছে ‘পাকিস্তান’ বিচ্যুতি বা পাকিস্তান দুই টুকরা। যেহেতু এ সবকিছুর মূলে শেখ মুজিব, তাই তাকেই হত্যা করতে হবে।
১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বরের ওই ঘোষণার পর বেশি দিন যায়নি। ২০ ডিসেম্বরই বঙ্গবন্ধু জানতে পারেন তাকে হত্যার জন্য দুজন আততায়ীকে পূর্ব পাকিস্তানে পাঠানো হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রকাশিত নথিতে এসব তথ্য বের হয়ে এসেছে। প্রকাশিত মার্কিন নথিটি এরকম: “২৯ ডিসেম্বর ১৯৬৯, প্রেরক মার্কিন কনস্যুলেট, ঢাকা। প্রাপক: পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ওয়াশিংটন ডিসি। অনুলিপি: আমেরিকান কনসাল, করাচি, লাহোর, পেশোয়ার। কনফিডেনসিয়াল ঢাকা। বিষয়: পূর্ব পাকিস্তানে শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে হত্যার চক্রান্ত।” ঢাকা থেকে এ বার্তাটি পাঠানো হয় ওয়াশিংটন ও অনুলিপি দেয়া হয় করাচি, লাহোর ও পেশোয়ারের মার্কিন দূতাবাসকে।
বঙ্গবন্ধু ২০ ডিসেম্বর এ ঘটনা জানতে পারেন। এরপর তিনি এ ঘটনার সত্যতা যাচাই-বাছাই করেন। পরে ২৩ ডিসেম্বর শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করেন ডেপুটি চিফ অব মিশন সিডনি সোবার (১৯৭২-১৯৭৫ সালে তিনি পাকিস্তানে মার্কিন দূতাবাসের অস্থায়ী চার্জ দ্য আফেয়ার্স ছিলেন) ও কনসাল ইনচার্জ। শেখ মুজিব তাদের বলেন, ২০ ডিসেম্বর তিনি বিষয়টি জানতে পারেন। ২২ ডিসেম্বর তিনি এ বিষয়ে যাচাইকৃত সাক্ষ্য-প্রমাণ লাভ করেন। ফলে, তার মনে আর কোনও সন্দেহ নেই যে তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র চলছে।
কথোপকথনে শেখ মুজিব বলেন, 'তিনি বিশ্বাস করেন, ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মধ্যকার পাঞ্জাবিদের একটি ক্ষুদ্র চক্র রয়েছে। ওই পাঞ্জাবি সেনাচক্র পূর্ব পাকিস্তানের জন্য একটি বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসনের ধারণা মেনে নিতে পারছে না'। তাদের সাথে কথোপকথনে শেখ মুজিব আরও বলেন, 'ষড়যন্ত্রকারীরা যদি মনে করে থাকে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষায় তাকে সরিয়ে দেওয়াই সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ উপায়, তবে পাগল ছাড়া তারা আর কিছুই নয়'। তিনি আরও বলেন, 'তাঁর দৃঢ় প্রত্যয় রয়েছে যে পশ্চিম পাকিস্তানিদের উসকানিতে যদি তাকে হত্যা করা হয়, অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষার শেষ সুযোগও হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে'। (তথ্যসূত্র: মার্কিন দলিলে মুজিব হত্যাকাণ্ড, মিজানুর রহমান খান)।
শেখ মুজিব পাঞ্জাবিদের ওই ক্ষুদ্র চক্রের কথা বলেছেন। কিন্তু ওই ক্ষুদ্র চক্র কার পরামর্শে তাঁকে হত্যার চক্রান্তে মেতে উঠেছিল তা আজও আমাদের অজানা। কারণ, সেনাবাহিনীর কোনও অংশই কোনও রাজনৈতিক ছত্রছায়া ও আশ্রয়-প্রশ্রয় ছাড়া কোনও রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডে জড়িত হয় না। পাকিস্তানি শাসকচক্র ও তাদের দোসর-যারা বাঙালি জাতীয়তাবাদ মেনে নিতে পারেনি তারাই ওই ষড়যন্ত্রকারী। কাজেই অবিভক্ত পাকিস্তানে যারা শেখ মুজিবকে মারতে চেয়েছিল, বিভক্ত পাকিস্তানে তারাই বঙ্গবন্ধু বা জাতির জনককে মেনে নিতে পারেনি বলেই এই হত্যাকাণ্ড। অর্থাৎ পাকিস্তানের ওই দোসর বা উত্তরাধিকারীরাই এ হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে।
১৯৬৯ সালের ওই ঘটনার তিন বছরের মধ্যে অনেক কিছুই পরিবর্তন হয়েছে। পাকিস্তানিরা চলে গেছে, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু বাঙালি চেতনার শত্রু ও পাকিস্তানবাদের দোসররা তখনও রয়ে গেছে ছদ্মবেশে, মুখোশের আড়ালে।
২০০৫ সালে প্রকাশিত মার্কিন দলিলের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর অগোচরে মেজর সৈয়দ ফারুক রহমান ঢাকার মার্কিন দূতাবাসে গিয়েছিলেন অস্ত্র সংগ্রহের ব্যাপারে আলোচনা করতে। ১৯৭৩ সালের ১১ জুলাই তারই ভায়রা ভাই মেজর আবদুর রশিদও অস্ত্র সংগ্রহের জন্য মার্কিন দূতাবাসে গিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, ‘ডকুমেন্ট নং সিক্রেট ঢাকা ২১৫৮’ শিরোনামে ঢাকা থেকে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরে প্রেরিত একটি তারবার্তা থেকে জানা যায়, ১৩ মে ১৯৭৪ সালে ওই সৈয়দ ফারুক রহমানই ‘উচ্চতম পর্যায়ের বাংলাদেশ সেনা কর্মকর্তার নির্দেশে শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারকে উৎখাতে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চেয়েছিলেন। ১৯৭৪ সালের মে থেকে ১৯৭৫ সালের মধ্য আগস্ট পনের মাসের ব্যবধান। ফারুক-রশিদ হয়তো ১৫ মাস ধরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছিল। কিন্তু তাকে হত্যার ষড়যন্ত্র তো শুরু হয়েছে আরও আগে। ফারুক-রশিদসহ হত্যাকারী যাদের আমরা চিহ্নিত করতে পেরেছি তারা মূলত ঔপনিবেশিক পাকিস্তানের ষড়যন্ত্রীদেরই উত্তরাধিকারী।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায়ে সেনাবাহিনীর ক্ষুদ্র একটি অংশের কথা এসেছে। কিন্তু এ হত্যাকাণ্ডের মূল ষড়যন্ত্রকারীদের আমরা চিহ্নিত করতে পারিনি। আমরা জানি, জন এফ কেনেডির হত্যারহস্য আজও উদ্ঘাটিত হয়নি। মহাত্মা গান্ধীর হত্যাকারী কি শুধু নথুরামই? ইন্দিরা গান্ধীকে কি শুধু তার দেহরক্ষীই হত্যা করেছিল? অথবা আব্রাহাম লিংকনকে কি একটি পাগলই হত্যা করেছিল? ইতিহাস বলে, রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের আসল অপরাধীদের বিচার হয় না। যারা সরাসরি হত্যা করে বা বড়জোর এর এক ধাপ উপরের ষড়যন্ত্রকারীদের সম্পর্কে আমরা জানতে পারি। কিন্তু মূলহোতারা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু ইতিহাস তো কাউকে ক্ষমা করে না।
দেখা শত্রুর চেয়ে অদেখা শত্রু আরও ভয়ঙ্কর। আদালতের মাধ্যমে হত্যা মামলার রায় হয়েছে, বিচার হয়েছে। কিন্তু ইতিহাসের বিচার এখনও চলমান, সেখানে এখনও শুনানি চলছে, চলবে; যতদিন পর্যন্ত না আমরা জানতে পারি পর্দার ওপারে কে বা কারা সুতাটি নাড়ছিল। পুতুল নাচের ইতিবৃত্ত জানা ইতিহাসের পূর্ণ পাঠের জন্যই জরুরি। ইতিহাসের পুনঃপাঠ চলবেই। কারণ, মুজিব বহমান-প্রজন্মের চির বহমান রক্তস্রোতে।
লেখক: আইনজীবী ও কলামিস্ট