বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার সেই দিনগুলোতে বাদী মহিতুল

উদিসা ইসলাম 

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা চলাকালে ব্যস্ততার মধ্যে সময় কাটাতে হয়েছে মামলার বাদী ও ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের সময় ৩২ নম্বরে উপস্থিত মহিতুল ইসলামকে। দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থাকলেও ২১বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে সুযোগ পেয়েই মামলা করেছিলেন তিনি। ১৯৭৫ এ মামলা করতে গিয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার হাতের চড় জীবনের শেষদিন পর্যন্ত ভুলেননি। কেমন ছিল মামলা করার পরের এবং বিচারের সময়ের দিনগুলো। মহিতুল সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, পুরো বিচার প্রক্রিয়ায় যেন নিঃশ্বাস বন্ধ করে প্রহর গুনেছেন বিচারের আশায়। বাদী হিসেবে কেবল সাক্ষ্য দেওয়া না, অপেক্ষা করেছেন কখন দেখবেন হত্যাকারীদের দণ্ড কার্যকর হচ্ছে।

১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায়ে বিচারিক আদালত ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়। রায়ের বিরুদ্ধে আপিল হলে হাইকোর্ট প্রথমে বিভক্ত রায় দেয়, পরে তৃতীয় বেঞ্চ ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে। ২০০৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ আসামি হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় সুপ্রিম কোর্টে বিচারক সঙ্কটের কারণে দীর্ঘ সময় আপিল শুনানি ঝুলে ছিল। বিচারিক আদালতে ১২ জনের ফাঁসির আদেশ মামলার যখন আপিল শুরু হচ্ছিল তখন তিনি বলেছিলেন, ‘এ সংবাদ আমার আকাঙ্ক্ষা পূরণ করেছে। আমি শেষ দেখতে চাই।’

সেই শেষ পুরোটা দেখতে না পেলেও কিছু মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হতে দেখেছেন তিনি। তবে বিচার এবং রায় কার্যকর প্রক্রিয়া বিলম্বিত হলে আন্দোলনের ঘোষণা দেওয়া এই বাদী বলেছিলেন, ‘বিচার ও রায় কার্যকরের প্রক্রিয়া আর কতবার দীর্ঘায়িত করা হবে?। ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ যে লম্বা অপেক্ষার সময় পার করেছি, ২০০১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত কিন্তু ঠিক একই সময় পার করতে হয়েছে। সেই লুকিয়ে থাকা, সেই অত্যাচার সহ্য করা, সেই ভয়ে ভয়ে দিন যাপন করা...।’

এ এফ এম  ‍মুহিতুল ইসলাম
এ এফ এম  ‍মুহিতুল ইসলাম

বাদী হিসেবে আদালতে দীর্ঘ জবানবন্দিতে সেই কালো রাতের বর্ণনা দিয়েছেন তিনি। বঙ্গবন্ধুকে যেভাবে দেখেছেন, শেষ সময়ে বঙ্গবন্ধুকে যে দৃঢ়তার সঙ্গে শত্রুর মুখোমুখি হতে দেখেছেন দিয়েছেন তার অনন্য বিবরণ। মামলা চলাকালে আদালতে বলেন, ‘আমার ধারণা ছিল ঘাতকরা অন্তত শিশু রাসেলকে হত্যা করবে না, সেই ধারণাতেই আমি রাসেলকে বলি ‘না ভাইয়া তোমাকে মারবে না।’ বাদী হিসেবে আদালতে দাঁড়িয়ে মুহিতুল বলেছিলেন, ‘‘গেটে অবস্থানরত মেজর বজলুল হুদাকে মেজর ফারুক কী যেন জিজ্ঞাসা করেন, তখন মেজর বজলুল হুদা বলেন ‘অল আর ফিনিশড’।বঙ্গবন্ধুর ও তার পরিবার আমৃত্যু ত্যাগ ও নির্ভীকতার সঙ্গে মানুষের কল্যাণে কাজ করেছেন। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সময় বঙ্গবন্ধু পরিবারের কেউ খুনিদের কাছে প্রাণভিক্ষা চান নি, বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী সিঁড়িতে বঙ্গবন্ধুর লাশ পড়ে থাকতে দেখে খুনিদের বলেছেন ‘তোমরা এখানেই আমাকে মেরে ফেল।’’

বিচার চলাকালে এবং পরবর্তীতে প্রতিটা রায়ের আগে পরে তাকে ব্যস্ত সময় কাটাতে হয়েছে, স্মৃতিতে শাণ দিতে হয়েছে। তিনি মামলা চলাকালে সাক্ষাতকার দিতে গিয়ে বারবারই দুটো ঘটনার কথা বলতেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে শেষ ফোন আমিই ধরিয়ে দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু ওপার থেকে কেউ রিসিভ করেনি। আর রাসেল মায়ের কাছে যেতে চেয়েছিল, আমি ভেবেছিলাম আর যাই হোক ঘাতকরা এই শিশুকে হত্যা করবে না। ভুল ভেবেছিলাম।’

উল্লেখ্য, ১৯ নভেম্বর ২০০৯, হাইকোর্টের দেওয়া রায় বহাল রেখে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া পাঁচ আসামির আপিল আবেদন খারিজ করে দেয় আপিল বিভাগ। আদালতের চূড়ান্ত রায়ে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার আসামিদের মধ্যে ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে। ২০১০ সালে ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশীদ, মুহিউদ্দিন আহমদ, বজলুল হুদা এবং একেএম মহিউদ্দিনের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।

SUMMARY

741-1.jpg