সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল
শিল্প-সাহিত্যের প্রতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের যেমন গভীর ভালোবাসা ছিলো, তেমনি শিল্পী-সাহিত্যিকদের প্রতি ছিলো তাঁর অত্যন্ত শ্রদ্ধা। তাঁর আত্মজীবনীতে সেই স্বাক্ষর পাওয়া যাবে। তিনি তাঁর বিভিন্ন বক্তৃতাতেও প্রাসঙ্গিকভাবে রবীন্দ্র-নজরুলের কবিতা তুলে ধরে বক্ত্যবকে আরো প্রাণবন্ত করে তুলতেন।
‘আমার সোনার বাংলা’... গানটিকেই আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের মর্যাদা দেন। স্বাধীনতার পর বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ঢাকায় এনে ‘জাতীয় কবির’ সন্মান দেন। ১৯৯১ সালে ‘শিল্প সাহিত্যে শেখ মুজিব’ বইটি নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে এ ধরণের অজস্র দৃষ্টান্ত দেখতে পাই।
সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে নানামুখী সংকট-সমস্যা সত্ত্বেও নজর দিয়েছেন সাংস্কৃতিক জগতে। এক প্রতিবেদনে যৎসামান্য চিত্র তুলে ধরছি। মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে থাকা স্বত্ত্বেও অভাব-অনটনে থেকে কবি ফররুখ আহমদকে ব্যাগভর্তি টাকা পাঠিয়েছিলেন লেখক মাহবুব তালুকদারের মাধ্যমে। যুদ্ধোত্তর দেশে শিল্পী কমল দাশগুপ্তকে রেডিওতে, পল্লীকবি জসীম উদদীনকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেন। অসুস্থ কবি হুমায়ূন কবির, আবুল হাসান, মহাদেব সাহা এঁদেরকে সুচিকিৎসার জন্য বার্লিন-মস্কো-লন্ডন পাঠান। একটি কবিতা লেখার ‘অপরাধে’ দাউদ হায়দারকে মৌলবাদীদের হাত থেকে রক্ষা করে নিরাপত্তা দিয়ে কলকাতা পাঠান। সে নিয়ে দাউদ লিখেছেন- ‘তুমি আছো বলে অমোঘ পুরস্কার নিয়ে/ বেঁচে আছে কবি ও কবিতার দাউদ হায়দার।’
১৯৭৪ সালে জেলখানা থেকে মুক্তি দিয়ে ম্যাট্রিকপাশ কবি আল মাহমুদকে শিল্পকলা একাডেমীর মতো প্রতিষ্ঠানের সহকারী পরিচালক পদে নিয়োগ দেন। তা নিয়ে আল মাহমুদের স্বীকারোক্তি- ‘আমার মত একজন নগণ্য কবির জন্য একটি যোগ্য প্রশাসন ও পদের অনুসন্ধান করে কেবিনেটের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রীকে আমার সাক্ষাতেই টেলিফোনে ডেকে পাঠিয়েছেন।’ এবং সাথে সাথেই তার চাকরি হয়ে যায়!
বঙ্গবন্ধু বিটিভি পরিদর্শনে গিয়ে আব্দুল্লাহ আল মামুনের কাছে জানতে পারেন, সেন্সরশীপ আর প্রমোদ করের জন্য নাটক প্রায় বন্ধ হবার উপক্রম। পরদিন গণভবনে সংশ্লিষ্ট সচিবকে ডেকে এই প্রশাসনিক জটিলতা দূর করার নির্দেশ জারির আদেশ দেন।
ছাপান্ন সালে আতাউর রহমানের নেতৃতে আওয়ামী লীগ স্বল্পকালীন সময় ক্ষমতায় ছিল। তখন মন্ত্রী ছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি সেই সময় শহীদ মিনারের ভিত্তি ও মঞ্চ নির্মাণের কাজে বিরল ভূমিকা রাখেন। এবং সাতান্ন সালের ৩ এপ্রিল আইন সভায় ‘বাংলা একাডেমী এ্যাক্ট ১৯৫৭’ পাশ হয়েছিলো। মাত্র ১৪ মাসের মন্ত্রী সভার সদস্য হয়ে বঙ্গবন্ধু অনেক কাজ করেছেন। যেমন- বাদল রহমানের লেখা থেকে জানা যায়, ‘পূর্ব বাংলার চলচ্চিত্র নির্মাণে পৃষ্ঠপোষকতা করতে এগিয়ে এলেন তৎকালীন আওয়ামী লীগের প্রাদেশিক আইন পরিষদের মন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি প্রাদেশিক আইন পরিষদে বাংলা ও বাঙালি সংস্কৃতি চর্চার সহায়তায় ‘চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থা’ বিল উপস্থাপন করেন। এবং এই সংস্থা গঠনের মাত্র দেড় মাসের মধ্যে ফতেহ লোহানী শুরু করলেন ‘আছিয়া’ নির্মাণ।
বঙ্গবন্ধু প্রেরণায় ১৯৭৪ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমীতে যে আন্তরিক সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলনে বহু বিদেশি কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী আমন্ত্রিত হয়ে আসেন। সম্মেলন উদ্বোধনকালে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- ‘আমরা সাহিত্য সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের দিক থেকে দরিদ্র নই। আমাদের ভাষার দু’হাজার বছরের একটি গৌরবময় ইতিহাস আছে। আমাদের সাহিত্যের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ। আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিজস্ব বৈশিষ্টে ভাস্কর’।
বঙ্গবন্ধুর যোগ্য উত্তরসূরী শেখ হাসিনাও সেই ধারা বহন করে যাচ্ছেন। তিনিও এ দেশের কবি-সাহিত্যিক-শিল্পী-সাংবাদিকদের আপনজন হয়ে আছেন। তাঁদের সব সময় পাশে রাখছেন। অসুস্থ হুমায়ূন আহমেদকে দেখতে গিয়ে তাঁর হাতে তুলে দেন চিৎকিসার জন্য সামান্য অর্থ। তাঁকে বানান জাতিসংঘ মিশনের উপদেষ্টা। এভাবেই কবি মহাদেব সাহার সুচিৎকিসার ব্যবস্থা করেন। লন্ডনে চিকিৎসাধীন সৈয়দ হককে দেখতে যান। অভিনেতা খলিলের হাতে তুলে দেন দশ লাখ টাকা। যা পেয়ে আপ্লুত হয়ে খলিল বলেন, ‘আমি ত একদিনেই ধনী হয়ে গেলাম।’ এ রকম দৃষ্টান্তের শেষ নেই। হাসিনার সংসদের দিকে তাকালেও দেখা যায়- অনেক শিল্পী-সাহিত্যিককে মর্যাদা দিয়েছেন। যেমন- অভিনেতা ও মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, কবরী, তারানা হালিম, শিল্পী মমতাজ বেগম, সদ্য প্রয়াত লেখক-সাংবাদিক বেবী মওদুদ, কবি রুবী রহমান, কাজী রোজী প্রমুখ।