‘আমি একজন মানুষ, আমার আবার জন্মদিবস!


এমরান হোসাইন শেখ 

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৫৫ বছরের জীবনে বিভিন্ন দফায় প্রায় ১৩ বছরই কেটেছে জেলে। কারাগারে কেটেছে তার ৮টি জন্মদিন। বঙ্গবন্ধুর জেল জীবনের ডায়েরি নিয়ে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী‘ ও ‘কারাগারের রোজনামচা‘- বই দুটি প্রকাশিত হলেও তাতে জেলে কাটানো ৮টি জন্মদিনের সবগুলোর বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়নি।  গত বছর বাংলা একাডেমি প্রকাশিত ‘কারাগারের রোজনামচা‘ বইয়ে জেলখানায় বঙ্গবন্ধুর একটি জন্মদিন কাটানোর বিবরণ পাওয়া গেছে। ১৯৬৭ সালের ১৭ মার্চ তাঁর ৪৮তম জন্মদিনটা কেমন কেটেছিল বা জন্মদিনে তার দল আওয়ামী লীগ কী কর্মসূচি পালন করেছিল, জাতির পিতা  তা তুলে ধরেছেন।  ডায়েরির পাতায় জন্মদিন উপলক্ষে  তিনি এমনও লিখেছেন, ‘আমি একজন মানুষ, আমার আবার জন্মদিবস!’

কারাগারের রোজনামচা বইয়ে উঠে এসেছে যে, জন্মদিনের তিন দিন আগে স্ত্রী ও সন্তানেরা তাঁর সঙ্গে জেলগেটে দেখা করে যেতেন। ফলে এত অল্প সময়ের ব্যবধানে জন্মদিনে আবার দেখা হওয়ার সুযোগ হবে কিনা,  সেই সংশয় ছিল জাতির পিতার মনে। তবে পরিবারের সদস্যরা আবারও আসবে বলে আত্মবিশ্বাসও ছিল তাঁর মনে। অবশ্য ওইদিন তার আত্মবিশ্বাসেরই জয় হয়েছিল। জন্মদিনের দিন বিকাল পাঁচটার দিকে ছেলেমেয়েদের নিয়ে স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব (বঙ্গবন্ধু ডাকতেন রেনু নামে) কারাগারে তার সঙ্গে দেখা করতে আসেন। তাকে অন্য একজনের দেওয়া জন্মদিনের কেকও নিয়ে আসেন বেগম মুজিব।

নিজের হাতে গড়া দল আওয়ামী লীগ  বঙ্গবন্ধুর মুক্ত জীবনের জন্মদিনগুলো ঘটা করে পালন না করলেও ১৯৬৭ সালের জন্মদিনটা কিছুটা আওয়াজ দিয়েই পালন করেছিল।  বঙ্গবন্ধুর মতে, ‘জেলে থাকার কারণেই ওই বছর এমনটি হয়েছিল।’

৪৭তম জন্ম বার্ষিকীর দিনে  (১৯৬৭ সালের ১৭ মার্চ) ডায়েরিতে তিনি লিখেছিলেন, জন্মবার্ষিকী তিনি কোনও দিনই নিজে পালন করেননি। বেশি হলে তাঁর স্ত্রী ওই দিনটাতে তাঁকে ছোট্ট একটি উপহার দিয়ে থাকতেন। বঙ্গবন্ধু চেষ্টা করতেন জন্মদিনের দিনটিতে বাড়িতে থাকতে। ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকী পালন করছে বলে খবরের কাগজের মাধ্যমে জানতে পেরেছেন বলে ডায়রিতে উল্লেখ করে করেন। বঙ্গবন্ধুর ধারণা, তিনি জেলে বন্দি বলেই দল থেকে জন্মদিন পালন করা হয়েছে। দল জন্মদিন পালন করেছে দেখে তিনি হেসেছিলেন বলেও ডায়রিতে উল্লেখ করেন। জন্মদিন পালনের বিষয়টিকে তিনি ডায়রিতে উল্লেখ করেছিলেন এমনভাবে যে, ‘আমি একজন মানুষ, আমার আবার জন্মদিবস!’

ওইদিন জেলখানায় আটক তাঁর দলের নেতারা জন্মদিন উপলক্ষে তাকে গোলাপ, ডালিয়াসহ নানা ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান বলেও উল্লেখ করেন। এছাড়া বিকালে স্ত্রী ও সন্তানেরা ফুলের মালা ও অন্য একজনের (বদরুন) পাঠানো কেক নিয়ে আসেন। এছাড়া ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগও বঙ্গবন্ধুর জন্য একটা বিরাট কেক ওইদিন পাঠিয়েছিল বলে ডায়রিতে উল্লেখ করেন।

বঙ্গবন্ধু জেলে কাটান ৮টি জন্মদিন

পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন সময় চার হাজার ৬৮২ দিন জেলে কাটিয়েছেন।  পাকিস্তান আমলের ২৪ বছরের প্রায় ১৩ বছরই বঙ্গবন্ধুকে জেলে কাটাতে হয়েছে। এসময় অন্তত ৮টি জন্মদিন তাঁর কেটেছে কারাগারে।

জানা গেছে, বঙ্গবন্ধু সর্বপ্রথম ১৯৫০ সালে তাঁর ৩১তম জন্মদিন কারাগারে কাটান। পাকিস্তান সরকার তাঁকে ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি বন্দি করে। টানা ৭৮৭ দিন কারাগারে কাটিয়ে তিনি মুক্তি পান ১৯৫২ সালে। ওই একই দফায় বন্দিদশায় ১৯৫১ সালে তার ৩২তম জন্মদিনও কাটে জেলে। এরপর আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারি করলে ১৯৫৮ সালের ১১ অক্টোবর গ্রেফতার হয়ে টানা  ১১৫৩ দিন বঙ্গবন্ধুকে কারাগারে কাটাতে হয়। গ্রেফতারের ১৪ মাসের মাথায় তিনি মুক্তি পেলেও সেদিনই কারা ফটকে আবারও গ্রেফতার হন। এ সময় তার ৪০তম (১৯৫৯ সাল), ৪১তম (১৯৬০) ও ৪২তম (১৯৬১) জন্মদিন কাটে জেলখানায়। ওই দফায় ১৯৬১ সালের শেষ দিকে মুক্তি পাওয়ার কয়েক মাসের মাথায় ১৯৬২ সালের ৬ জানুয়ারি তিনি ফের গ্রেফতার হন এবং মুক্তি পান একই বছরের ১৮ জুন। এ কারণে ৪৩তম (১৯৬২) জন্মদিন তাকে জেলে কাটাতে হয়। এরপর ১৯৬৭ সালে ৪৮তম এবং ১৯৬৮ সালে ৪৯তম জন্মদিনও  জেলখানায় কাটে বঙ্গবন্ধুর।

SUMMARY

738-1.jpg