পনেরই আগস্ট: ব্যক্তি নয় রাষ্ট্রকেই হত্যার চেষ্টা

আবদুল মান্নান 
  
আবদুল মান্নানজাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৩তম শাহাদাত বার্ষিকীতে তার ও তার পরিবারের যে সতেরো জন সদস্যকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যা করা হয়েছিল, তাদের স্মৃতির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। অনেকে মনে করেন, ১৯৭৫ সালের পনেরই আগস্ট বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত শত্রুরা তাকে সপরিবারে হত্যা করেছিল। আসলে সেদিন শুধু ঘাতকরা একজন শেখ মুজিবকেই হত্যা করেনি তাদের লক্ষ্য ছিল, একটি রাষ্ট্র তথা বাংলাদেশকে হত্যা করা। তারা সাময়িকভাবে কিছুটা সফলও হয়েছিল। ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহার ছিল বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফাভিত্তিক। ছয় দফার মধ্যেই নিহিত ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। সেই নির্বাচন আওয়ামী লীগের তথা নৌকা মার্কার পক্ষে এক অভূতপূর্ব গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। সেই সময় সারা পাকিস্তানে কোনও বামপন্থী রাজনৈতিক দল প্রকাশ্যে রাজনীতি করতে পারতো না। যারা বামপন্থী রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাস করতেন তারা মওলানা ভাসানির ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) আর খান আবদুল ওয়ালী খান ন্যাপের আশ্রয়ে রাজনীতি করতেন। মওলানা ভাসানির ন্যাপ মূলত সমাজতন্ত্রের চীনা সংস্করণে বিশ্বাস করতো আর খান আবদুল ওয়ালী খানের ন্যাপ ছিল সমাজতন্ত্রের রুশ সংস্করণের সমর্থক। খান আবদুল ওয়ালী খান ছিলেন সীমান্ত গান্ধী খান আবদুল গাফ্ফার খানের পুত্র। গাফ্ফার খান কখনও জিন্নাহ দ্বিজাতি তত্ত্ব মেনে নেননি। প্রথমটিকে বলা হতো চীনপন্থী আর দ্বিতীয়টিকে মস্কোপন্থী কমিউনিস্টদের দল। পূর্ব বাংলায় মস্কোপন্থীদের নেতৃত্ব দিতেন অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ। এই দুই পন্থীর মধ্যে আওয়ামী লীগের পর মাওলানা ভাসানির ন্যাপ পূর্ব বাংলার দ্বিতীয় জনপ্রিয় দল ছিল। তার নির্বাচনি প্রতীক ছিল ধানের শীষ আর মস্কোপন্থীদের কুড়ে ঘর। মওলানা ভাসানি সত্তরের নির্বাচন বর্জন করেন। ‘ভোটের বাক্সে লাথি মারো’ বলে রাস্তায় নেমে পড়েন। মস্কোপন্থী ন্যাপের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার মতো তেমন শক্তি ছিল না। তবে তারা সত্তরের নির্বাচনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়নি। অন্যদিকে মওলানা ভাসানি নির্বাচন বর্জন করলেও নির্বাচনের পর তিনি নিজে বঙ্গবন্ধুকে সমর্থন করেন এবং মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে যোগ দেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হলে বঙ্গবন্ধু সরকার বামপন্থী সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রকাশ্যে রাজনীতি করার সুযোগ করে দেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরই কমিউনিস্ট পার্টির প্রকাশ্যে পথ চলা শুরু হয়। এই সত্যটা কদাচিৎ কোনও বামপন্থী নেতা উচ্চারণ করেন।

সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে মুসলীম লীগ (একাধিক অংশ), জামায়াতে ইসলাম, পাকিস্তান পিপলস পার্টি, নেজামে ইসলাম অংশ নেয়। সেই নির্বাচনে পাকিস্তানের গণপরিষদে আওয়ামী লীগ পূর্ববঙ্গের ১৬৯ টি আসনের ১৬৭টি আসনে জয় লাভ করে। ভোট পায় ৭৫ শতাংশ। অর্থাৎ ২৫ শতাংশ ভোটার নৌকা মার্কায় ভোট দেয়নি এবং ছয় দফাকে সমর্থন করেনি।

উল্লেখ্য, সেই নির্বাচনে পূর্ব বাংলায় মোট ভোটারের ৯৪.৪ শতাংশ ভোট দেয়। যে দুটি আসন আওয়ামী লীগ হারিয়েছিল তার একটি ছিল ময়মনসিংয়ে। সেখানে বিজয়ী হয়েছিল মুসলীম লীগের নূরুল আমিন আর অন্যটি পাবর্ত্য চট্টগ্রামে যেখানে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় বিজয়ী হয়। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে নূরুল আমিনকে হারিয়েছিল তরুণ ছাত্র নেতা যুক্তফ্রন্টের খালেক নেওয়াজ। তখন নূরুল আমিন শুধু মুসলীম লীগের একজন জাঁদরেল নেতাই ছিলেন না তিনি পূর্ববঙ্গের মূখ্যমন্ত্রীও ছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই নূরুল আমিন পাকিস্তানে পালিয়ে যান এবং ইয়াহিয়া খানের পদত্যাগের পর জুলফিকার আলি ভুট্টো পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি হলে তাকে উপ-রাষ্ট্রপতি করা হয়। মৃত্যুর পর নূরুল আমিনকে জিন্নাহ সমাধির অভ্যন্তরে কবর দেওয়া হয়। ঠিক একইভাবে রাজা ত্রিদিব রায়কে ভুট্টো পর্যটন মন্ত্রী করেন এবং বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী সময় জিয়া ক্ষমতা দখল করলে ত্রিদিব রায়ের স্ত্রী রাজমাতা বিনিতা রায়কে তাঁর উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য করে নেন। সত্তরের নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে এটি বলা যায় পূর্ব বাংলার সকল বাঙালি ছয় দফার পক্ষে সমর্থন দেয়নি এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হোক এটাও চায়নি। আর এটাও সত্য যারা আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করেছিল তাদেরও অনেকে পরবর্তীকালে তাদের ইমান ঠিক রাখতে পারেনি। যেমন খোন্দকার মুশতাক এবং বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তীকালে যারা মুশতাকের মন্ত্রী সভায় যোগ দিয়েছিলেন তাদের অনেকেই। অন্যদিকে যারা সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেনি তাদের অনেকেই আবার মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তাতে অংশগ্রহণ করে অথবা তাকে পরোক্ষভাবে সমর্থন করে।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে যখন এটি পরিষ্কার হয়ে যায় যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অনিবার্য তখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধীরা দেশটির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। তাদের প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করে পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। সহযোগিতা করে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ। এই ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যমণি হিসেবে বেছে নেওয়া হয় বঙ্গবন্ধুর একান্ত ঘনিষ্ঠজন খোন্দকার মোশতাককে। ষড়যন্ত্রকারীদের মধ্যে যেমন ছিল বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ তাঁর কিছু রাজনৈতিক সহচর ঠিক তেমনি ছিল কিছু চীনপন্থী বাম নেতা যাদের মধ্যে আবদুল হক, মোহাম্মদ তোহা, আলাউদ্দিন, আবদুল মাতিন অন্যতম। আবদুল হক তো ভুট্টোর কাছে বঙ্গবন্ধু সরকারকে উৎখাত করার জন্য অর্থ আর অস্ত্র সাহায্য দিয়ে চিঠি লিখেছিলেন। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় একটি দেশের অথবা তার গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের বিরুদ্ধে কোনও বড় ধরনের ষড়যন্ত্র কার্যকর করতে হলে সঙ্গে যদি অন্দর মহলের কেউ থাকে তা হলে কাজটি অনেক সহজ হয়। বঙ্গবন্ধু হত্যার পেছনে যে ফারুক রশীদ গং সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিল তারা সকলেই এসেছিল মুক্তিযুদ্ধের একবারে শেষ সময়ে। অক্টোবর আর নভেম্বর মাসে। তারা আইএসআই এর ব্রিফ নিয়ে এসেছিল বলে ধারণা করা হয় এবং তারা প্রায় সকলেই বঙ্গবন্ধু পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। তারা সকলেই চাকরি সূত্রে জিয়ার পূর্ব পরিচিত ছিল। জিয়া যদিও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন কিন্তু তার স্ত্রী সব সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আস্থাভাজন ছিলেন। বেগম জিয়াকে তাঁর স্বামী একাধিকবার ভারতে নিয়ে যেতে লোক পাঠানো সত্ত্বেও তিনি তাদের সঙ্গে ভারত যেতে অস্বীকার করেন। বলেন তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হেফাজতে ভালোই আছেন। বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন ও আমার বন্ধু মুক্তিযোদ্ধা মেজর (অব.) শওকত আলি (মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময় শওকত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ছিল) এই ঘটনার স্বাক্ষী। অক্টোবর নভেম্বর মাসের শেষ দিকে যে সব সেনা সদস্য পাকিস্তান হতে পালিয়ে ভারতে এসেছিল তারা কেউ সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি। 

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ষড়যন্ত্রের প্রথম আলামত দেখা যায় একাত্তরের সেপ্টেম্বর মাসে যখন খোন্দকার মোশতাক কুমিল্লা হতে নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্য জহুরুল কাইউমকে কলকাতায় নিযুক্ত মার্কিন কন্সাল জেনারেলের কাছে পাঠান এই সংবাদ দিয়ে পাকিস্তান যদি বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয় তা হলে তিনি মুক্তিযুদ্ধ বন্ধ করতে সব ধরনের ব্যবস্থা নেবেন। তবে মার্কিন কন্সাল জেনারেল জানতেন ইতোমধ্যে প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ মোশতাকের কুমতলব বুঝতে পেরে তাকে গুরুত্বহীন করে রেখেছিল। বিষয়টা যদিও কলকাতায় আর খুব বেশি অগ্রসর হয়নি। ষড়যন্ত্র কিন্তু থেমে থাকেনি। দেশ স্বাধীন হলে যড়যন্ত্রটা আরও গভীর হওয়া শুরু করে এবং মূল লক্ষ্য হচ্ছে স্বাধীন অসম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে একটি মিনি পাকিস্তানে রূপান্তর করা। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু যুদ্ধকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল ওসমানিকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করে নেন এবং শফিউল্লাহকে সেনা প্রধান করেন। শফিউল্লাহ ছিলেন জিয়ার জুনিয়ার। এতে জিয়া বঙ্গবন্ধুর ওপর ক্ষুব্ধ হন। বঙ্গবন্ধু জিয়াকে পূত্রবত স্নেহ করতেন এবং যখন যুদ্ধ শেষে জিয়ার ঘর ভেঙে যাওয়ার অবস্থা হয় তখন তা বঙ্গবন্ধুর সরাসরি হস্তক্ষেপে রক্ষা হয়। বঙ্গবন্ধু অনেকটা জিয়াকে খুশি করার জন্য তার জন্য সেনা বাহিনীতে ডেপুটি চিফ এর একটি পদ সৃষ্টি করেন। কিন্তু জিয়া মনে করতেন তাঁর প্রতি অবিচার করা হয়েছে। ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য জিয়াকে কাজে লাগান। পঁচাত্তরের মার্চ মাসে কর্নেল ফারুক রহমান জিয়ার কাছে গিয়ে বলে তারা সরকার পতনের একটি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে এবং তাতে তারা জিয়ার সমর্থন প্রত্যাশা করেন। জিয়া তাদের গ্রিন সিগনাল দেয় তবে বলেন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সময় তিনি মাঠে থাকবেন না। এরই মধ্যে ষড়যন্ত্রকারীরা মার্কিন সরকার ঘনিষ্ঠ আমলা মাহবুব আলম চাষী, বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার তথ্য প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুরসহ আরও কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে তাদের দলে অর্ন্তভূক্ত করে নিয়েছে। ফেব্রুয়ারি এপ্রিল মাস হতে যোগাযোগ স্থাপিত হয় ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের সঙ্গে। ষড়যন্ত্রকারীরা ঘন ঘন বৈঠক করেছে কুমিল্লার পল্লী উন্নয়ন একাডেমিতে। পনেরই আগস্টের আগেই রাষ্ট্রের সকল নিরাপত্তা সংস্থার কর্তা ব্যক্তিদের সরিয়ে সেখানে বসানো হয়েছে একাত্তরে পাকিস্তান সরকারের একান্ত আস্থাভাজন ব্যক্তিদের। বঙ্গবন্ধু ব্যক্তিগত নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সকলেই হয় পাকিস্তান ফেরত অথবা একাত্তরে পাকিস্তান সরকারের আস্থাভাজন ছিল। বঙ্গবন্ধুকে আসন্ন বিপদ সম্পর্কে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ আর সোভিয়েত ইউনিয়নের গোয়েন্দা সংস্থা ‘কেজিবি’ একাধিকবার সতর্ক করে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু কখনো তাদের কথায় বিশ্বাস করেননি। এটি ছিল তাঁর একটা ঐতিহাসিক ভুল। বাংলাদেশের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থাও বঙ্গবন্ধুকে সতর্ক করে চিরকুট পাঠায়। প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা মেজর জিয়াউদ্দিন (সুন্দর বন খ্যাত) তখন এই সংস্থায় কর্মরত ছিলেন। তিনি একাধিকবার তাঁর সাক্ষাৎকারে বলেছেন তাদের পাঠানো চিরকুট কখনও বঙ্গবন্ধুর হাতে পৌঁছায়নি। এই সবেরই প্রেক্ষাপটে ঘটে পনেরই আগস্টের হত্যাকাণ্ড। শুরু হয় বাংলাদেশের উল্টোপথের যাত্রা।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর যখন ঢাকা বেতার হতে সংবাদটি খুনি চক্রের অন্যতম সদস্য মেজর ডালিম ঘোষণা করে বিদেশে প্রথম সংবাদটি প্রচার করে পাকিস্তান রেডিও এবং বলে–‘শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে এবং বাংলাদেশকে ইসলামিক রিপাবলিক ঘোষণা করা হয়েছে’। খুনি মোশতাক সরকারকে প্রথম স্বীকৃতিটাও দেয় পাকিস্তান। ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ দ্রুত রূপান্তর হতে থাকে একটি ধর্মান্ধ রাষ্ট্রে। ‘বাংলাদেশ বেতার’ হয়ে যায় ‘রেডিও বাংলাদেশ’ আর ‘জয় বাংলা’  শ্লোগানের পরিবর্তে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ স্লোগান চালু হয়। মোশতাক ঘোষণা করেন বাংলাদেশের জাতীয় পোশাক হবে ‘সেরওয়ানি আর মোশতাক টুপি’। ছিয়াশি দিনের মাথায় জিয়া মোশতাককে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করলে সংবিধানের ‘মুসলমানিকরণ’ শুরু হয়। ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদের’ পরিবর্তে জিয়া প্রবর্তন করেন ‘বাংলাদেশি জাতিয়তাবাদ’। ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বাতিল করা হয়। বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রবর্তনের নামে জিয়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারী যে সব দল, যেমন জামায়াতে ইসলাম, মুসলীম লীগ, নেজামে ইসলাম ইত্যাদি সাংবিধানিকভাবে নিষিদ্ধ রাজনৈতিক দল গুলোকে প্রকাশ্যে রাজনীতির করার সুযোগ করে দেন এবং তাদের ওপর হতে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন। একাত্তরের ঘাতক গোলাম আযমকে বাংলাদেশে ফিরে এসে জামায়াতের রাজনীতি পুনর্গঠন করার সুযোগ করে দেন। অর্থাৎ দেশটা সম্পূর্ণ রূপে একটি মিনি পাকিস্তানের রূপ ধারণ করে যা বঙ্গবন্ধুর ঘাতকরা চেয়েছিল। 

১৯৭৫ সাল হতে শুরু করে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ বস্তুতপক্ষে একটি মিনি পাকিস্তান হিসেবে কার্যকর ছিল। এতে যেমন অবদান ছিল জিয়ার তেমনভাবে অবদান ছিল এরশাদ আর বেগম জিয়ার। তবে জিয়া আর তার স্ত্রীর অবদান ছিল সব চেয়ে বেশি। জিয়া শাহ আজিজের মতো একজন শীর্ষ স্থানীয় রাজাকারকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী আর আবদুল আলিমের মতো একজন কসাইকে মন্ত্রী বানিয়েছিলেন। অন্যদিকে এরশাদ মাওলানা মন্নান আর সাকা চৌধুরীর মতো ঘাতকদের তার মন্ত্রী সভায় ঠাঁই করে দিয়েছিলেন আর কর্নেল ফারুককে রাষ্ট্রপতি নির্বচান করতে সুযোগ করে দেন। আর বেগম জিয়া যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামী আর আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদকে তার মন্ত্রিসভায় গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত করেছিলেন। খুনি কর্নেল রশিদকে জাতীয় সংসদেও সদস্য করে নিয়ে আসেন (ফ্রিডম পার্টি)। এই সময়ের মধ্যে বাংলাদেশের সার্বিক চরিত্রটাই পাল্টে গিয়েছিল। এই সময়ে দেশে এমন একটি প্রজন্ম সৃষ্টি হয়েছিল যে প্রজন্মের তরুণরা পাকিস্তানি ক্রিকেটার শহীদ আফ্রিদিকে বিয়ে করার জন্য বাংলাদেশ পাকিস্তান ক্রিকেট খেলার সময় বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে ব্যানার নিয়ে বসে থাকতো। ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা তাঁর পিতার মৃত্যুর একুশ বছর পর সরকার গঠন করলে পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে। তবে তাঁকে যেতে হবে অনেক দূর এবং এটা এখন পরিষ্কার যে তাঁর পথে বাধা সৃষ্টি করতে দেশে নিরন্তর ষড়যন্ত্র চলমান। এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যারা জড়িত তারা সকলেই বাইরের মানুষ তা কিন্তু নয়। রাষ্ট্রের প্রশাসনে থাকুক বা দলের ভেতর তাদের যদি বঙ্গবন্ধু কন্যা চিনতে ভুল করে তা হলে আবারও একটি বিপর্যয় অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে। নাগালের মধ্যে যাদের অবস্থান তাদের অনেক সময় চেনা যায় না। বঙ্গবন্ধু চিনতে পারেননি বলে জাতিকে একুশ বছর খেসারত দিতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা পিতার ভুলের পুনরাবৃত্তি করবেন না বলে সকলের প্রত্যাশা। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ চিরজীবী হোক।

লেখক: বিশ্লেষক ও গবেষক 

SUMMARY

734-2.jpg