জাতির জনকের স্মৃতি ও সংগ্রামমুখর দিনগুলো


তোফায়েল আহমেদ 
  
তোফায়েল আহমেদপনেরোই আগস্টের কালরাত্রিতে শাহাদত বরণকারী সকলের প্রতি আমার শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। এইদিনে জাতির জনককে সপরিবারে নির্মম ও নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল। ঘাতক খুনি-চক্র স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছিল দেশের অগ্রগতিকে। ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিল জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের সকল অর্জনকে। এদিন শুধু জাতির জনককেই হত্যা করা হয়নি, মহান মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ও লক্ষ্যকে ভিত্তি করে অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে এগিয়ে যাওয়া একটি জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্ন পূরণের নেতৃত্বকে হত্যা করা হয়েছিল। ঘাতকদের লক্ষ্য ছিল বঙ্গবন্ধুর রক্তের কোনও উত্তরাধিকার যেন বেঁচে না থাকে। আর সেজন্যই ঘাতকের দল বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ পুত্র দশ বছরের শিশু রাসেলকেও রেহাই দেয়নি। আমাদের পরম সৌভাগ্য যে, পরম করুণাময়ের অশেষ কৃপায় বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা বিদেশ থাকায় সেদিন ঘাতকের হাত থেকে প্রাণে রক্ষা পান। আজ গর্ব করে বলতে পারি ষড়যন্ত্রকারী খুনিচক্রের সেই আশা সফল হয় নাই। কারণ বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের স্বপ্ন ছিল তাঁর প্রিয় মাতৃভূমি স্বাধীন হবেই এবং স্বাধীন বাংলাদেশ হবে সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা সোনার বাংলা। আমি বিশ্বাস করি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণ করে বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করতে তাঁর কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ এগিয়ে চলেছে দৃপ্ত পদক্ষেপে।
বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে কত কথা কত স্মৃতি আজ মনের চারপাশে ভীড় করে আসে। মনে পড়ে ১৯৭১-এর রক্তঝরা মার্চের ১৭ তারিখের কথা। সেদিন ছিল বঙ্গবন্ধুর ৫২-তম জন্মদিন। ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনা শেষে দুপুরে ধানমণ্ডির বাসভবনে বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে ঘরোয়া আলোচনাকালে একজন সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেন, ‘আপনার ৫২-তম জন্মদিনে আপনার সবচাইতে বড় ও পবিত্র কামনা কী?’ উত্তরে বঞ্চিত বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা স্বভাবসিদ্ধ কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘জনগণের সার্বিক মুক্তি’। এরপর সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে তাঁকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জ্ঞাপনকালে তিনি ব্যথাভারাতুর কণ্ঠে বেদনার্ত স্বরে বলেছিলেন, ‘আমি জন্মদিন পালন করি না-আমার জন্মদিনে মোমের বাতি জ্বালি না, কেকও কাটি না। এদেশে মানুষের নিরাপত্তা নাই। আপনারা আমাদের জনগণের অবস্থা জানেন। অন্যের খেয়ালে যেকোনও মুহূর্তে তাদের মৃত্যু হতে পারে। আমি জনগণেরই একজন, আমার জন্মদিনই কী, আর মৃত্যুদিনই কী? আমার জনগণের জন্য আমার জীবন ও মৃত্যু।’ কত বিশাল হৃদয়ের মহৎ মনের অধিকারী মানুষ ছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরিচিতি হওয়ার পর থেকে আমি তাঁর অপার স্নেহ-ভালোবাসায় ধন্য। তিনি সবসময় আমাকে কাছে রাখার চেষ্টা করতেন। প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব হওয়ার সুবাদে শুধু দেশে নয়, বিদেশেও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি রয়েছে। আজ স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে সেইসব দিনগুলির দৃশ্য। স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশ বিশ্বের অনেক দেশের স্বীকৃতি লাভ করেছে। বিশ্বসভায় বঙ্গবন্ধু মুজিব ইতিহাসের মহানায়ক হিসেবে শ্রদ্ধার আসনে সমাসীন হয়েছেন। সে-সময় বাংলাদেশ যে-সব আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ করেছে- ‘কমনওয়েলথ অব নেশনস্’, ‘জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন’, ‘ইসলামিক সম্মেলন সংস্থা’ ও ‘জাতিসংঘ’। এই সম্মেলন ও অধিবেশনগুলোতে বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী হওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। প্রতিটি সম্মেলন ও অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু ছিলেন আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। ১৯৭২-এর ৬ ফেব্রুয়ারি ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রথম বিদেশ সফর। মুক্তিযুদ্ধের পরমমিত্র প্রতিবেশী ভারতের কলকাতা মহানগরীর ব্রিগেড ময়দানে ২০ লক্ষাধিক মানুষের গণমহাসমুদ্রে তিনি বক্তৃতা করেছিলেন। সেকি বক্তৃতা!

কলকাতার মানুষ সেদিন বাড়ি-ঘর ছেড়ে জনসভায় ছুটে এসেছিল। সভাশেষে রাজভবনে যখন দ্বি-পাক্ষিক আলোচনা হয়, তখন শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমার জন্মদিন ১৭ মার্চ। আপনি সেদিন বাংলাদেশ সফরে আসবেন। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার সফরের আগেই আমি চাই আপনার সেনাবাহিনী বাংলাদেশ থেকে ফিরিয়ে নেবেন। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী সম্মতি জানিয়েছিলেন। ১৭ মার্চ ইন্দিরা গান্ধী বাংলার মাটি স্পর্শ করার আগেই ১২ মার্চ বিদায়ী কুচকাওয়াজের মধ্যদিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনী বাংলাদেশ ত্যাগ করেছিল। তারপর ৬ মার্চ ছিল মুক্তিযুদ্ধের আরেক মিত্রদেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর। মহান মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের সার্বিক সমর্থন যুগিয়েছিল। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে ‘ভেটো’ ক্ষমতা প্রয়োগ করেছিল। সেদিন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী আলেক্সেই কোসিগিন বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন এবং ক্রেমলিনে সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি জেনারেল লিওনিদ ইলিচ ব্রেজনেভ ও সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট মি. পদগর্নি বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। ১৯৭৩-এর ৩ আগস্ট কানাডার রাজধানী অটোয়াতে ৩২টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয়েছিল কমনওয়েলথ সম্মেলন। কিন্তু সকল নেতার মাঝে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সেদিনের সেই সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেছিলেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ট্রুডো। বঙ্গবন্ধু সেদিন বক্তৃতায় বৃহৎশক্তিবর্গের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘হোয়েন এলিফ্যান্ট প্লেস গ্রাস সাফারস।’ তাঁর এই বক্তৃতা উপস্থিত সকলকে মুগ্ধ করেছিল। সেই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডোয়ার্ড হিথ্, অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী মি. হুইটলাম, তাঞ্জানিয়ার প্রেসিডেন্ট জুলিয়াস নায়ারে, জাম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট কেনেথ কাউন্ডা, কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট জমু কেনিয়াত্তা, সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী মি. লি কুয়ান, শ্রীলঙ্কার শ্রীমাভো বন্দরনায়েকে সহ বিশ্বের বরেণ্য সব নেতৃবৃন্দ। ১৯৭৩-এর ৯ সেপ্টেম্বর আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে সর্বমোট ৬ জন নেতার নামে তোরণ নির্মিত হয়েছিল। তন্মধ্যে জীবিত দু’নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অন্যজন মার্শাল জোসেফ ব্রোঞ্জ টিটো। আর প্রয়াত ৪ জন নেতা ছিলেন মিশরের জামাল আব্দুল নাসের, ইন্দোনেশিয়ার ড. সুকর্ণ, ঘানার প্রেসিডেন্ট কাউমি নক্রুমা এবং ভারতের  জওহরলাল নেহরু। আলজেরিয়ার মঞ্চে দাঁড়িয়েই বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন, ‘বিশ্ব আজ দু’ভাগে বিভক্ত। শোষক আর শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে।’ ১৯৭৪-এর ২২ ফেব্রুয়ারি যেদিন তিনি ইসলামিক সম্মেলনে যান সেদিন লাহোর বিমানবন্দরে দেখেছি, যে-দেশ মুক্তিযুদ্ধে আমার দেশের নিরীহ-নিরপরাধ মানুষের ওপর গণহত্যা চালিয়ে ৩০ লক্ষাধিক মানুষ শহীদ করেছে, সেই দেশের মানুষ রাস্তার দু-পার্শ্বে দাঁড়িয়ে শ্লোগান তুলেছে ‘জিয়ে মুজিব জিয়ে মুজিব’, অর্থাৎ মুজিব জিন্দাবাদ মুজিব জিন্দাবাদ। তখন অবাক হয়েছি। লাহোরে এই সম্মেলনের মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। এমনকি যতক্ষণ তিনি লাহোরে না পৌঁছেছেন, ততক্ষণ সম্মেলন শুরুই হয় নাই। বঙ্গবন্ধুর জন্য একদিন সম্মেলন স্থগিত হয়েছিল। সালিমার গার্ডেনে যখন বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের গণসংবর্ধনা দেওয়া হয় সেখানেও সকলের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

বঙ্গবন্ধু এমন আত্মমর্যাদাবান নেতা ছিলেন যে, সেদিন সৌদি বাদশাহের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে বলেছিলেন, ‘ইউর ম্যাজেস্টি, আপনি আমাকে স্বীকৃতি না দিয়েও আমার দেশের মানুষকে হজব্রত পালনের সুযোগ দিয়েছিলেন বলে আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।’ যুগোশ্লাভিয়ায় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে রাষ্ট্রীয় সফরে গিয়েছিলাম। যুগোশ্লাভিয়ার রাষ্ট্রনায়ক মার্শাল টিটো বিমানবন্দরে তাঁকে বীরোচিত অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন। সেকি দৃশ্য! আমার চোখের সামনে আজও ভেসে ওঠে। জাপান সফরে দেখেছি দেশটির তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কাকুই তানাকা বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন। মিশরের রাষ্ট্রপতি আনোয়ার সাদাত বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন। বিশেষভাবে মনে পড়ে ১৯৭৪-এর ২৫ সেপ্টেম্বরের কথা। যেদিন জাতির জনক জাতিসংঘে মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এক অনন্য ও মহত্তর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।

বঙ্গবন্ধুকে প্রথমেই অনুরোধ করা হয়েছিল ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি ইংরেজিতে বক্তৃতা করবেন।’ কিন্তু প্রিয় মাতৃভাষা বাংলার প্রতি সুগভীর দরদ ও মমত্ববোধ থেকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করতে চাই।’ যখন বক্তৃতা প্রদানের জন্য বঙ্গবন্ধুর নাম ঘোষিত হয়, তখন বিশ্ব নেতৃবৃন্দের করতালিতে চারদিক মুখরিত হয়ে ওঠে। মঞ্চে দাঁড়িয়ে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে চতুর্দিকে তাকিয়ে পরিষদে সমাগত বিশ্বনেতৃবৃন্দকে বিনম্র সম্বোধন জ্ঞাপন করে আন্তর্জাতিক রাজনীতির সর্বোচ্চ সংস্থা জাতিসংঘকে ‘মানব জাতির মহান পার্লামেন্ট’ উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তৃতা শুরু করেন।

জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুই প্রথম রাষ্ট্রনায়ক যিনি মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করেন। বঙ্গবন্ধু বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘শান্তি ও ন্যায়ের জন্য পৃথিবীর সকল মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা বিমূর্ত হয়ে উঠবে এমন এক নয়া বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলতে বাংলাদেশ আজ পূর্ণ অঙ্গীকারবদ্ধ। জাতিসংঘের সনদে যেসব মহান আদর্শ উৎকীর্ণ রয়েছে তারই জন্যে আমাদের দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ চরম ত্যাগ স্বীকার করেছে।’ পিনপতন নিস্তব্ধতার মধ্যে বঙ্গবন্ধু ৪৫ মিনিট বক্তৃতা করেন। বক্তৃতার শেষে সভাপতি নিজেই যখন দাঁড়িয়ে করতালি দিচ্ছেন, তখন স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়ক ও প্রতিনিধি দলের সদস্যবৃন্দ বিপুলভাবে করতালি দিয়ে আলিঙ্গন করে অভিনন্দিত করেছেন বঙ্গবন্ধুকে। অভাবনীয় সেই দৃশ্য। নিজ চোখে না দেখলে লিখে বোঝানো সম্ভব নয়। বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিশ্ব নেতৃবৃন্দের ছিল গভীর শ্রদ্ধা। আন্তর্জাতিক রাজনীতির হিমালয়সম উচ্চতায় আসীন ছিলেন তিনি।

আমার মনে পড়ে, অধিবেশনে আগত বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি দলের সদস্যগণ আমাদের কাছে এসে বলেছিলেন, ‘সত্যিই তোমরা গর্বিত জাতি। তোমরা এমন এক নেতার জন্ম দিয়েছো, যিনি শুধুমাত্র বাংলাদেশের নেতা নন-এশিয়ার নেতা নন, তিনি সমগ্র বিশ্বের নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নেতা।’ জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে কিউবার রাষ্ট্রনায়ক ফিডেল ক্যাস্ট্রো বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি।’ বঙ্গবন্ধুর মতো ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ বিশ্বে বিরল। যেখানেই গিয়েছেন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছেন। আমি মহাসৌভাগ্যবান যে, মহান নেতার সান্নিধ্যলাভ করেছিলাম।

বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার শেষ দেখা হয় ‘৭৫-এর ১৪ আগস্ট। আমার বাসা ছিল ধানমণ্ডিতে- এখন যেখানে আওয়ামী লীগ সভাপতির কার্যালয়, তার পাশেই বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যানের বাসভবন- সেটিই তখন প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিবের বাসভবন। প্রতিদিনের মতো সকাল বেলা ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে যাই। সেখান থেকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে গণভবনে গিয়েছিলাম। দিনের কাজ শেষে দুপুরবেলা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একই টেবিলে বসে একসাথে খেয়েছি। বাসা থেকে বঙ্গবন্ধুর খাবার যেত। পরম শ্রদ্ধেয় বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব- যিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের সঙ্গী। সুখে-দুঃখে, আপদে-বিপদে যিনি বঙ্গবন্ধুকে যত্ন করে রাখতেন। নিজ হাতে রান্না করে বঙ্গবন্ধুকে খাওয়াতেন। খাবার শেষে বঙ্গবন্ধু বিশ্রাম নিলেন। এরপর এসে গণভবনে নিজ কক্ষে বসলেন। বঙ্গবন্ধু প্রায় প্রতিদিন বিকেলে মন্ত্রিসভার সহকর্মীদের সঙ্গে দৈনন্দিন রাজনৈতিক বিষয়াদি নিয়ে আলোচনা করতেন। একসাথে চা পান করতেন। এরপর রাত ৮টায় স্বীয় বাসভবনে ফিরতেন। বঙ্গবন্ধুকে পৌঁছে দিয়ে আমি বাসায় ফিরতাম। যেতামও একসঙ্গে ফিরতামও একসঙ্গে। গণভবনে যেখানে বঙ্গবন্ধুর অফিস ছিল সেখানে তিনি দুপুর ২টা পর্যন্ত অফিস করতেন। গণভবনের পাশে এখন যেখানে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অফিস সেটি ছিল বঙ্গবন্ধুর অফিস। সেদিন বঙ্গবন্ধুর যুগ্ম সচিব জনাব মনোয়ারুল ইসলাম এবং ব্যক্তিগত সচিব জনাব ফরাসউদ্দীন এই দু’জন পিএইচডি করতে বিদেশ যাবেন এই উপলক্ষে কর্মকর্তাদের নৈশভোজ। নৈশভোজ শেষে তাদেরকে বিদায় করে আমি আবার ৩২ নম্বরে এলাম। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু তখন খাবার টেবিলে। বঙ্গবন্ধুর অফিস কক্ষের পাশেই আমার দফতর। সেদিন কাজ শেষে সকলকে বিদায় করে আমি ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরে এলাম।

পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু তখন খাবার টেবিলে। আমাকে কাছে ডেকে বললেন, ‘কাল সকালে আমার বাসায় আসবি। আমার সাথে তোর প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যাবি।’ আমার আর প্রিয় নেতার সঙ্গে প্রিয় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যাওয়া হয়নি।

পরদিন ১৫ আগস্ট দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রকারীদের এদেশীয় এজেন্ট সেনাবাহিনীর কতিপয় উচ্ছৃঙ্খল সদস্য জাতির জনককে সপরিবারে ১৭ জন সদস্যসহ নৃশংসভাবে হত্যা করে। দেশের নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধানকে পরিবারের সদস্যসহ এরূপ ভয়াবহভাবে হত্যার ঘটনা দুনিয়ার ইতিহাসে বিরল। ভোর থেকেই দিনটি ছিল বিভীষিকাময়। হত্যাকাণ্ডের পরপরই আমাকে প্রথমে গ্রেফতার করে গৃহবন্দী করা হয়। ধানমণ্ডির যে বাসায় আমি থাকতাম- সরকারিভাবে বরাদ্দকৃত সেই বাসাটি সম্পূর্ণ অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। বাসায় কাউকে ঢুকতে বা বেরুতে দেওয়া হয়নি। দু’দিন পর ১৭ তারিখ খুনিচক্রের অন্যতম ক্যাপ্টেন মাজেদের নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনীর একদল উচ্ছৃঙ্খল সদস্য আমার বাসভবন তছনছ করে। ঘরের দেওয়ালে সংরক্ষিত বঙ্গবন্ধুর ছবিগুলো ভেঙে ফেলে। মায়ের সামনেই হাত-চোখ বেঁধে আমায় রেডিও স্টেশনে নিয়ে যায়। সেখানে খুনিচক্রের সমর্থনে সম্মতি আদায়ে উপর্যুপরি নির্যাতন চালায়। তখনও জেনারেল শফিউল্লাহ সেনাপ্রধান এবং কর্নেল শাফায়াত জামিল ব্রিগেড কমান্ডার। তাদের হস্তক্ষেপে আমাকে মায়ের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। এরপর ২৩ তারিখ ই. এ. চৌধুরীর নেতৃত্বে একদল পুলিশ আমাকে এবং জনাব জিল্লুর রহমানকে (প্রয়াত রাষ্ট্রপতি) বঙ্গভবনে নিয়ে যায়। বঙ্গভবনে খুনি মোশতাক তার অবৈধ সরকারকে সমর্থন করার জন্য আমাদের দু’জনকে প্রস্তাব দেয়। আমরা খুনি মোশতাকের প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করি। এরপর আমাকে গৃহবন্দী করা হয়। সেপ্টেম্বরের ৬ তারিখ জিল্লুর রহমান, আমাকে ও আবদুর রাজ্জাককে একই দিনে গ্রেফতার করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কোনে অবস্থিত পুলিশ কন্ট্রোলরুমে ৬ দিন বন্দী রেখে অমানুষিক নির্যাতন চালায়। আমাদের সাথে আর একজন বন্দী ছিলেন। তিনি ‘দি পিপল’ পত্রিকার সম্পাদক প্রখ্যাত সাংবাদিক জনাব আবিদুর রহমান। পুলিশ কন্ট্রোল রুমের একটি ছোট্ট ঘরের মধ্যে পাশাপাশি দু’টি চৌকির একটিতে ঘুমাতাম আমি ও রাজ্জাক ভাই এবং অপরটিতে জিল্লুর ভাই ও আবিদুর রহমান। এমনি একদিন রমজান মাসের তিন তারিখ রোজা রেখে নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। শেষ রাতের দিকে সেনাবাহিনীর একদল লোক কক্ষে প্রবেশ করে উচ্চস্বরে চিৎকার করে বলতে থাকে ‘হু ইজ তোফায়েল’ ‘হু ইজ তোফায়েল!’ রাজ্জাক ভাই জেগে উঠে আমাকে ডেকে তোলেন। চোখ মেলে দেখি আমার বুকের ওপরে স্টেনগান তাক করা। আমি ওজু করতে চাইলে অনুমতি দেওয়া হয়। কক্ষের সাথেই সংযুক্ত বাথরুম। ওজু করে আসার সাথে সাথেই জিল্লুর ভাই, রাজ্জাক ভাই এবং আবিদুর রহমানের সামনেই আমার চোখ বেঁধে বারান্দায় নিয়ে হাত বেঁধে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়। আমি অনুভব করি আমাকে রেডিও স্টেশনে আনা হয়েছে। এরপর হাত-চোখ বাঁধা অবস্থায়ই চেয়ারের সাথে বেঁধে অমানুষিক নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের এক পর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। জ্ঞান ফিরলে অনেকগুলো প্রশ্ন করা হয়। বঙ্গবন্ধু কী করেছেন, তাঁর কোথায় কী আছে এরকম বহু প্রশ্ন। এসব প্রশ্নের উত্তর না দেওয়াতে ভীতি প্রদর্শন করে খুনিরা বলে, ইতিমধ্যে আমার এপিএস শফিকুল আলম মিন্টুকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং সে আমার বিরুদ্ধে ৬০ পৃষ্ঠার এক বিবৃতি দিয়েছে। সেই বিবৃতিতে আমার বিরুদ্ধে বহু অভিযোগ রয়েছে। তথাপি আমি নিরুত্তর থাকি। শুধু একটি কথাই বলেছিলাম, ‘বঙ্গবন্ধু যা ভালো করেছেন আমি তার সাথে ছিলাম, যদি কোনও ভুল করে থাকেন তার সাথেও ছিলাম। এর বেশি কিছুই আমি বলতে পারবো না।’ তখন তারা চরম অসন্তুষ্ট হয়ে পুনরায় আমার ওপর নির্মম নির্যাতন শুরু করে। ভয়াবহ সেই নির্যাতনের ক্ষত এখনও বয়ে বেড়াচ্ছি। এরপর অর্ধমৃত অবস্থায় পুলিশ কন্ট্রোল রুমে নিয়ে আসা হয়। সেখানে পুনরায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদকারীদের মধ্যে খুনি ডালিমের কণ্ঠস্বর স্পষ্ট চিনতে পেরেছিলাম। আমাকে রুমের মধ্যে একা রেখে তারা মিটিং করছিল আমাকে নিয়ে কী করবে। এখনও মনে আছে অজ্ঞাত একজন আমার মাথায় হাত রেখে শুধু বলছিলেন, ‘আল্লাহ্ আল্লাহ্ করেন, আল্লাহ্ আল্লাহ্ করেন।’ কারণ, তার ধারণা হয়েছিল ঘাতকের দল আমাকে মেরে ফেলবে। শেষপর্যন্ত ঘাতকেরা এসে বললো, ‘আমরা যে প্রশ্নগুলো করেছি তার উত্তর দিতে হবে; উত্তর না দিলে আপনাকে আমরা রাখবো না।’ নিরুত্তর থাকায় পুনরায় তারা আমাকে নির্যাতন করতে থাকে এবং একপর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। তখন ঘাতক দল পুলিশ কন্ট্রোল রুমের যে কক্ষে আমরা অবস্থান করছিলাম সেই কক্ষে রাজ্জাক ভাই ও জিল্লুর ভাইয়ের কাছে আমাকে অজ্ঞানাবস্থায় রেখে আসে। জ্ঞান ফিরলে যন্ত্রণায় চিৎকার করতে থাকি। শারীরিক অসহ্য ব্যথা নিয়ে যখন আর্তনাদ করছি তখন জিল্লুর ভাই ও রাজ্জাক ভাই আমার এ-অবস্থা দেখে ব্যাকুল হয়ে ওঠেন এবং তাঁরা দু’জনেই সেবা-শুশ্রুষা করেন। এরপর সিটি এসপি সালাম সাহেব ডাক্তার নিয়ে আসেন। এ অবস্থার মধ্যেই রাতে মেজর শাহরিয়ার আমার কাছ থেকে বিবৃতি নিতে আসে। তিনি আমাকে বলেন, ‘যে প্রশ্নগুলো করা হয়েছে তার লিখিত উত্তর দিতে হবে।’ আমি মেজর শাহরিয়ারকে বললাম, ‘আপনারা আমাকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলেন দিতে পারেন; আমি কোনও কিছু লিখতেও পারবো না, বলতেও পারবো না।’ ওরা যখন দেখলো আমার কাছ থেকে কোন বিবৃতি আদায় করা সম্ভবপর নয়; তখন তারা উপায়ান্তর না দেখে চলে যায়। পরদিন অর্থাৎ ১২ সেপ্টেম্বর আমাকে ও আবিদুর রহমানকে ময়মনসিংহ কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ফাঁসির আসামীকে অন্ধকার নির্জন প্রকোষ্ঠে যেভাবে রাখা হয় ময়মনসিংহ কারাগারে আমাকেও সেইভাবে বন্দী করে কনডেম সেলে রাখা হয়। তিন মাস আমি সূর্যের আলো দেখি নাই। আমার সঙ্গে তখন কারাগারে বন্দী ছিলেন বর্তমান রাষ্ট্রপতি জনাব আবদুল হামিদ, ধর্মমন্ত্রী মতিউর রহমান সহ অনেকে। সে দিনগুলোর কথা যখন স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে তখন চিন্তা করি কী করে সে-সব দিন অতিক্রম করেছি। এরপর ২০ মাস ময়মনসিংহ কারাগারে অবস্থানের পর ‘৭৭-এর ২৬ এপ্রিল আমাকে কুষ্টিয়া কারাগারে স্থানান্তর করা হয়।
কুষ্টিয়া কারাগারে আটকাবস্থায় ‘৭৭-এর ২৭ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনৈক সেকশন অফিসার কর্তৃক ব্যাকডেটে স্বাক্ষরিত অর্থাৎ ‘৭৫-এর ১০ সেপ্টেম্বর তারিখে জারি করা আটকাদেশের সত্যায়িত কপি আমার নিকট প্রেরণ করা হয়। আটকাদেশের সত্যায়িত কপি প্রাপ্তির পর আমার স্ত্রী আনোয়ারা আহমেদের আবেদনের প্রেক্ষিতে আটকাদেশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আমার পক্ষের আইনজীবীগণ-সর্বজনাব সিরাজুল হক, এএইচ খোন্দকার, সোহরাব হোসেন, সালাহউদ্দীন আহমেদ এবং শ্রী সুরঞ্জিৎ সেনগুপ্ত- আদালতে বলেন, ‘তাঁর আটক সম্পূর্ণ অন্যায় এবং ১৯৭৫ সালের জরুরি ক্ষমতা আইনের আওতায় তার আটকাদেশের যৌক্তিকতা প্রতিপন্ন করার মতো কোন তথ্য-প্রমাণ সরকারের হাতে নেই। ফলে উক্ত আটকাদেশ অবৈধ ও আইনের এখতিয়ার বহির্ভূত।’ বিচারপতি জনাব কে এম সোবহান এবং বিচারপতি জনাব আবদুল মুমিত চৌধুরী’র সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনের একটি ডিভিশন বেঞ্চ ‘৭৮-এর ৯ জানুয়ারি এক রুল জারি করেন। রুলে বলা হয়, ‘কারাগারে আটক জনাব তোফায়েল আহমেদকে কেন আদালতের সামনে হাজির করা হবে না এবং কেন তাকে মুক্তি দেওয়া হবে না’ সে বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার ও অন্যদের কারণ দর্শাতে বলা হচ্ছে। রাজ্জাক ভাই এবং আমার একসাথে রিট হয়। রাজ্জাক ভাই হাইকোর্ট থেকে মুক্তি পেলেও আমি মুক্তি পাইনি। অবশেষে সুপ্রীম কোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চের রায়ে মুক্তি পেলাম ৪ মাস পর অর্থাৎ ১৯৭৮-এর ১২ এপ্রিল। কুষ্টিয়া কারাগারে ১৩ মাস সহ সর্বমোট ৩৩ মাস বন্দী থাকার পর মুক্তি লাভ করি। কুষ্টিয়া কারাগারে যখন বন্দী তখন আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয় এবং কারাগারে আটকাবস্থায় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পদে নির্বাচিত হই।

কারামুক্তির পর দেখলাম জেনারেল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি। আমরা তার সামরিক শাসনের মধ্যেই আন্দোলন-সংগ্রাম করেছি। ঢাকায় ১৯৮০ সনে রাজশাহী কারাগারে জেলহত্যার বিরুদ্ধে আমরা যে হরতাল কর্মসূচি দিয়েছিলাম, সেই মিছিলে আমি আর রাজ্জাক ভাই নেতৃত্ব দিয়েছি। সামরিক সরকার মিছিলের ওপর ট্রাক চালিয়ে দিয়েছিল। সৌভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলাম। জিয়াউর রহমান ছিলেন নীতিহীন স্বৈরশাসক। তিনি প্রকাশ্যে জনসভায় ঘোষণা দিয়েছিলেন, 'I will make politics difficult for politicians' এবং এই নীতিহীন প্রচেষ্টায় সফল হয়েছেন। ক্ষমতা এবং নীতিহীনতা একত্রিত হলে যে কী হয়, সেদিন জিয়াউর রহমান তা হাড়ে হাড়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন! এরপর ‘৭৯-এর যে নির্বাচন হলো, আমি সেই নির্বাচনের বিরুদ্ধে ছিলাম। ‘হ্যাঁ’ ‘না’ ভোটের মাধ্যমে সেনাশাসক জিয়াউর রহমান যখন ৯৯% ভোট পক্ষে নিলেন তখন আমরা শহীদ মিনারে শপথ নিয়েছিলাম, ‘সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের শাসনে নির্বাচন করবো না।’ কারণ, আমরা ইঙ্গিত পেয়েছিলাম এই নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে না। সামরিক শাসনকে বৈধতা দিতে জেনারেল জিয়ার প্রয়োজন একটি রাবারস্ট্যাম্প পার্লামেন্ট। এই ঘৃণ্য উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে রাজনীতিবিদদের বেচা-কেনার সামগ্রীতে পরিণত করে রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে কলুষিত করতে জিয়াউর রহমান আরও ঘোষণা করেছিলেন, 'Money is no problem' এবং রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে দু’হাতে অর্থ ছড়িয়ে বহু রাজনীতিককে ক্রয় করে রাতারাতি ‘বিএনপি’ নামক দল খাড়া করলেন।

অর্থ দিয়ে রাজনীতিকদের ক্রয় করার অসাধু প্রক্রিয়ায় জিয়াউর রহমানের কাছ থেকে আমার নিকট বিভিন্নরকম অস্বস্তিকর প্রস্তাব আসতে লাগলো। সেগুলি ছিল হীন স্বার্থ-সম্বলিত প্রস্তাব। সে-সব প্রস্তাব আমি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছি। আমাকে বঙ্গবভনে নেওয়ার জন্য জিয়াউর রহমান বহু চেষ্টা করেছেন। আমি তার সঙ্গে কখনও দেখা করি নাই। দেখা না করার বহু কারণ ছিল। আমি যখন বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সচিব তখন তিনি আমার সঙ্গে একরকম ব্যবহার করতেন। এখন তিনি রাষ্ট্রপতি আর আমি একজন সাধারণ মানুষ। এখন তিনি আমার সাথে আরেক রকম ব্যবহার করবেন। এই আরেক রকম ব্যবহার আমার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। আমার ভালো লাগবে না বলেই আমি যাই নাই। এমনকি বাজিতপুরস্থ আমাদের দলের কয়েকজনের ফাঁসির আদেশ হয়েছিল। জিয়াউর রহমানের কাছে যেতে হবে ফাঁসির দণ্ডাদেশ মওকুফের জন্য। রাজ্জাক ভাই সহ অন্যরা গেলেন, আমি যাই নাই। রাজ্জাক ভাই জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি যাবা না কেন?’ আমি বললাম, আমি যাবো না। জিয়াউর রহমানের সাথে দেখা করলে বদনাম হয়। বন্ধুত্ব করলে ফাঁসি হয়। এর কোনটাই আমার নিকট গ্রহণযোগ্য নয়। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর জিয়াউর রহমানের সঙ্গে আমার কখনও দেখা হয় নাই। আমি যখন বঙ্গবন্ধুর পলিটিক্যাল সেক্রেটারি তখন উনি প্রায়ই আমার দফতরে আসতেন। এমনকি বঙ্গবন্ধু হত্যার একমাস আগে তিনি আমাকে অনুরোধ করলেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়ে দেওয়ার জন্য। আমি বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করিয়ে দিলাম। বঙ্গবন্ধুর সামনে কোরআন শরীফ ছুঁয়ে শপথ নিলেন ভবিষ্যতে তিনি বেঈমানী করবেন না। তারপরে কী হয়েছে বাংলার মানুষ জানে। তাকে বিদেশে দূতাবাসে চাকরি দেওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। এটা যাতে না করা হয় সেজন্য বঙ্গবন্ধুর কাছে এসে সেই চেষ্টাই তিনি করেছেন। বঙ্গবন্ধুর মতো ব্যক্তিত্বসম্পন্ন দয়ালু মানুষের সামনে যখন কোরআন শরীফ ছুঁয়ে শপথ করে বললেন, ‘আমি কোনোদিন আপনার সাথে বেঈমানী করবো না। আমাকে বিদেশে পাঠাবেন না। আমি আপনার এখানে আপনার সাথে থাকতে চাই।’ বঙ্গবন্ধু সাথে সাথে সেই আদেশ ক্যান্সেল করে দিলেন। আমিই সেদিন বঙ্গবন্ধুর সাথে তাকে দেখা করিয়ে দিয়েছিলাম। সেদিনের সেসব কথা মনে করে আমি কোনোদিন এই বিশ্বাসহন্তারক ঘৃণিত লোকটির সঙ্গে দেখা করি নাই।
জিয়াউর রহমানের আমলে আমাদের ওপর অনেক নির্যাতন হয়েছে। আমাদের মিছিল-মিটিংয়ে আক্রমণ হয়েছে। সে-সব উপেক্ষা করে প্রাণান্ত পরিশ্রম করে দলকে সংগঠিত করেছি, নেতা-কর্মীদের পাশে দাঁড়িয়েছি। সামরিক শাসনের মধ্যেও মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে আমরা সাংগঠনিক তৎপরতা চালিয়েছি। ‘৭৫-এর পর চরম দুঃসময়। তখন তো একটা করুণ অবস্থা। সারা দেশজুড়ে কারফিউ, হত্যা, গুম, গ্রেফতার আর ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলা।  করুণ অবস্থায় দিনের পর দিন, মাসের পর মাস আমাদের কেটেছে। নিজের বাড়িতে থাকতে পারি নাই। আমি যখন কারাগারে, আমার স্ত্রীকে কেউ বাড়ি ভাড়া দেয় নাই। তোফায়েল আহমেদের স্ত্রীকে বাড়ি ভাড়া দিলে আর্মি ধরে নিয়ে যাবে। আমার ভাগ্নি-জামাই নজরুলের নামে বাড়ি ভাড়া নিয়ে পরিচয় গোপন করে মাসিক দেড় হাজার টাকা ভাড়ায় সেই বাড়িতে আমার স্ত্রী থেকেছেন। তিনি একবছর ছিলেন কলাবাগানে। সেই বাসায় কোনও ফ্যান ছিল না। পরে বরিশালের সাবেক এডিসি জনাব এম এ রবের কল্যাণে তার আজিমপুরের বাসার দোতলায় আমার পরিবারের ঠাঁই হয়। কারামুক্ত হয়ে ফিরে সেই বাসায় থেকেছি। আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ। সেই সময় করুণ অবস্থা গেছে আমার পরিবারের। আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে মাত্র ২১,০০০ টাকা, স্ত্রীর নামে ৮,০০০ আর মেয়ের নামে ৪,০০০ টাকা। জিয়াউর রহমান এগুলো ফ্রিজ করেছেন। আমরা ওই টাকা তুলতে পারতাম না। আমার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা দেওয়ার বহুরকম চেষ্টা করেছেন। কোনও দুর্নীতি আবিষ্কার করতে পারে নাই। কোনও মামলা দিতে পারে নাই। কেরানিগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা বোরহানউদ্দীন গগনকে দলের সাংগঠনিক কাজ করার জন্য আমি সাধারণ একটা গাড়ি দিয়েছিলাম। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তিনি সেই গাড়ি ফেরৎ দিয়েছিলেন। অথচ সেই গাড়ির জন্য আমার বিরুদ্ধে মামলা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। আমার এই বনানীর বাড়ি, এই বাড়ির জমি বঙ্গবন্ধু আমাকে দিয়েছিলেন।

‘৭৫-এর ৩০ জুলাই বরাদ্দ করে দিলেন আমার স্ত্রীর নামে। ১৫ আগস্টের পর আমি কারাগারে। ‘৭৬-এ আমার স্ত্রী চিঠি পেলেন বরাদ্দকৃত প্লটের জন্য টাকা জমা দিতে হবে। আমার স্ত্রীর নিকট কোনও টাকা নাই। তখন তার ২৮ ভরি স্বর্ণ, যার থেকে ইতিমধ্যে ৪ ভরি বিক্রি করেছেন। আর ২৪ ভরি বন্ধক দিয়ে ভোলার সোনালী ব্যাংক থেকে ১৩ হাজার টাকা নিয়েছেন। কিন্তু প্রথম কিস্তি পরিশোধে লাগবে ১৭ হাজার টাকা। বাকি টাকা দিয়ে সাহায্য করেছিলেন রফিকুল্লাহ চৌধুরী। আজকে যিনি জাতীয় সংসদের স্পীকার শিরিন শারমীন চৌধুরীর পিতা। আমার এপিএস ছিল শফিকুল ইসলাম মিন্টু। আমি তাকে চাকরি দিয়েছিলাম ১৯৭৩ সনে। ১৫ আগস্টের পর আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য খুনিচক্রের ক্যাপ্টেন মাজেদের নেতৃত্বে কতিপয় সেনাসদস্য তাকে ধরে নিয়ে যায়। কিন্তু মিথ্যা সাক্ষ্য দিতে রাজি না হওয়ায় মিন্টুকে হত্যা করে বুড়িগঙ্গা নদীতে ফেলে দেয়। তার মৃতদেহটি পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।

আমার বড় ভাই ‘৭৫-এর ১১ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন। আমার মেজো ভাইকে ‘৭৫-এর ৫ অক্টোবর গুলি করে হত্যা করা হয়। গ্রামের বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে তাকে হত্যা করে সর্বহারা পার্টির লোকেরা। আমি তখন ময়মনসিংহ কারাগারে। এক ছেলে কারাগারে, দুই ছেলে নাই। আমার মায়ের তখন কী ভয়াবহ আর করুণ অবস্থা! আমার ঢাকার বাসায় বড় ভাইয়ের ছেলে এবং মেয়ে, সেজো ভাইয়ের দুই ছেলে, মেজো ভাইয়ের মেয়ে থাকে। তারা কেউ পড়ে স্কুলে কেউ-বা কলেজে। আমি যখন বঙ্গবন্ধুর পলিটিক্যাল সেক্রেটারি তখন দুই ভাইয়ের দুই মেয়ে ও এক বোনের মেয়ে এই তিনজনকে আমি ইডেন কলেজে ভর্তি করি। ওরা আমার বাড়িতে থেকেই ম্যাট্রিক পাস করে। এরা তিনজন আমার বাসায় থাকে। মেজো ভাইয়ের ছেলে রেসিডেনসিয়াল মডেল স্কুলে পড়ে সে আমার বাসায় থাকে। তার আরেক ভাই ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরিতে পড়ে। মেজো ভাইয়ের মেয়ে উদয়নে পড়ে, স্ত্রীর ভাই আমার বাসায় থাকে। এতোগুলো ছেলে-মেয়ে আর সদস্য নিয়ে আমার স্ত্রীর একার পক্ষে সংসার পরিচালনা করার সামর্থ্য ছিল না। আমার শ্বশুর প্রতি মাসে টাকা পাঠাতেন। এক শুভাকাঙ্ক্ষী মজু ভাই প্রতিমাসে কিছু টাকা দিতেন। তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। তার বেহেশত কামনা করি। এক বন্ধু হামিদ যে তার বেতনের টাকা থেকে আমাকে সাহায্য করতেন। বাসায় তেমন কোনও আসবাবপত্র ছিল না। আমি তো সরকারি বাসভবনে ছিলাম।

গ্রেফতারের পর যেদিন আমার স্ত্রী সরকারি বাসভবন থেকে বেরিয়ে যান সেদিন তো তার কিছুই নাই, কপর্দক শূন্য। একটা খাট আর আলমিরা ছিল। ছেলেমেয়েগুলো সবাই ফ্লোরিং করতো। আমি যে বাড়িতে ছিলাম সেটা পরিত্যক্ত বাড়ি।

গভর্নমেন্টের বাড়ি। এই বাড়ি প্রথমে বরাদ্দ দিয়েছিল ‘তোফায়েল আহমেদ, পলিটিকাল সেক্রেটারি টু প্রাইম মিনিস্টার’ অর্থাৎ আমার নামে। তখন আমার বয়স বত্রিশ। এই অল্প বয়সে আমি চিন্তা করি আমার নামে বরাদ্দপত্র দেবে কেন? তাহলে তো এটা মনে করার অবকাশ থাকবে যে এটা আমার বাড়ি। তখন আমার নাম বাদ দিয়ে বরাদ্দপত্র সংশোধন করে ‘অ্যালোটেড টু পলিটিকাল সেক্রেটারি টু দ্য প্রাইম মিনিস্টার’ লেখার নির্দেশ দেই। পরবর্তীতে এই বাড়ির জন্যই জিয়াউর রহমান আমার নামে এই মর্মে মামলা দিয়েছিল যে, এই বাড়ি আমি দখল করেছি। যখন আদালত বিশদে কাগজপত্র বিশ্লেষণ করলো তখন প্রমাণিত হলো যে, বাড়িটি ‘পলিটিক্যাল সেক্রেটারি টু দ্য প্রাইম মিনিস্টার’-এর নামে অ্যালোটেড। ফলে মামলা বাতিল হলো। এইভাবে একের পর এক মামলা দিয়ে আমাকে হেনস্তা করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর পলিটিক্যাল সেক্রেটারি হিসেবে বাড়ি ভাড়া পেতাম। আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর পাশের বাড়ি এখন যেখানে বিশিষ্ট আইনজীবী শাহদীন মালিকের পিতা মালেক সাহেব থাকেন তাঁর বাসায় আমি ভাড়া থাকি। সেই বাড়ির ভাড়া ছিল ছয়’শ টাকা। আনোয়ার হোসেন মঞ্জু বাড়িটা আমাকে ভাড়া নিয়ে দিয়েছিলেন। এই বাড়ির মালিক মালেক সাহেবকে আর্মির লোকেরা এসে চাপ দিয়েছে আমার বিরুদ্ধে এই স্বীকারোক্তি নিতে যে, ‘আপনি বলেন তোফায়েল আহমেদ জোর করে আপনার বাড়িতে ছিলেন।’ তখন মালেক সাহেব উত্তর দিয়েছিলেন, ‘তিনি জোর করে থাকেন নাই। ভাড়া নিয়ে থেকেছেন এবং যেদিন আমি নিজে থাকবো বলে বাড়িটি ফেরৎ চেয়েছি সেদিনই উনি চলে গিয়েছেন।’ জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকার এইরকম ক্ষিপ্ত ছিল আমার ওপর।

এরকম দুঃসহ অবস্থার মধ্যদিয়ে ধীরে ধীরে আমরা সাংগঠনিক তৎপরতা বৃদ্ধি করে সকল ভেদাভেদ ভুলে কেবল দলকেই ধ্যান-জ্ঞান করে, দলীয় ও জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে ১৯৮১ সনে বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার হাতে আওয়ামী লীগের পতাকা তুলে দিয়েছি। তিনি আওয়ামী লীগের সভানেত্রী নির্বাচিত হয়ে দলের সংগ্রামী পতাকা গৌরবের সাথে সমুন্নত রেখেছেন। আওয়ামী লীগের সভানেত্রী হওয়ার পর আমরা তাকে নিয়ে যাত্রা শুরু করে যেখানেই গিয়েছি সেখানেই সর্বস্তরের গণমানুষের সমর্থন পেয়েছি। ব্যাপক গণসমর্থন পাওয়ার ক্ষেত্রে কাজ করেছে সংবিধান ও সত্যের কাছে আমাদের অঙ্গীকার ও দৃঢ় মনোবল। ১৯৯৬-এ বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব লাভ করে স্বাধীনতার চেতনা ও মূল্যবোধ পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেন। প্রথমেই তিনি সংবিধান থেকে কুখ্যাত ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ সুগম করেন। ‘৭৫-এর মর্মন্তুদ ঘটনার পর সামরিক শাসকেরা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের শুধু ক্ষমাই করেনি বিদেশের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে পুনর্বাসিত করেছে। রাজনৈতিক দল গঠন করে নির্বাচন করার সুযোগ করে দিয়ে বাঙালি জাতিকে কলঙ্কিত করেছে। ২০০১-এ খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসে একই কাজ করেছে। ২০০৯-এর নির্বাচনে ভূমিধস বিজয়ের মধ্যদিয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনা রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্বলাভ করেন এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের কাজ সমাপ্ত করে খুনিদের ফাঁসির রায় কার্যকর করেন। খুনিচক্রের যারা এখনও পালিয়ে বেড়াচ্ছে আমরা তাদের দেশে এনে দণ্ডাদেশ কার্যকর করার চেষ্টা করে চলেছি।

আজ ভাবতে কতো ভালো লাগে যে, বঙ্গবন্ধুর অনুসৃত নীতি অনুযায়ী দেশ এগিয়ে যাচ্ছে তাঁরই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। দেশে আজ অনেকগুলো মেগাপ্রোজেক্ট বাস্তবায়িত হওয়ার পথে। যার মধ্যে রয়েছে ১০ বিলিয়ন ডলারের পায়রা সমুদ্রবন্দর, প্রায় ১৩ বিলিয়ন ডলারের রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ প্রকল্প। পদ্মাসেতু ছাড়াও রয়েছে দেশজুড়ে স্পেশাল ইকোনমিক জোন, কর্ণফুলি নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ, ঢাকা মেট্রোরেল প্রকল্প, মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট ইত্যাদি। অতীতে ৭ কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত বাংলাদেশে মানুষের খাদ্যাভাব ছিল, এখন ১৬ কোটি মানুষের দেশে আমরা খাদ্যে উদ্বৃত্ত এবং খাদ্য রফতানিকারক দেশ। একসময় দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল না বললেই চলে, আর এখন ৩০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। রেমিট্যান্স ১৫ বিলিয়ন ডলার। এক্সপোর্ট ছিল মাত্র ৩০০ মিলিয়ন ডলার আজ তা ৩৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। শুরুতে বাজেট ছিল মাত্র ৭৮৭ কোটি টাকা, এখন ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা।

আন্তর্জাতিক বিশ্ব বাংলাদেশ সম্পর্কে বলছে ‘বিস্ময়কর উত্থান বাংলাদেশের’। মাল্টিন্যাশনাল ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাকস্ ভবিষ্যদ্বাণী করেছে, ‘পরবর্তীকালে যে ১১টি দেশ অর্থনৈতিকভাবে দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ তার অন্যতম’। আরেক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান জেপি মরগ্যান, ‘বাংলাদেশ উদীয়মান দ্রুতগতির অর্থনীতি’ বলে অভিহিত করেছে। ইতিমধ্যে আমরা স্বল্পোন্নত দেশ থেকে নিম্ন-মধ্যমআয়ের দেশে উন্নীত হয়েছি এবং ২০২১ সালে স্বাধীনতার ৫০-তম বর্ষপূর্তিতে আমরা বাংলাদেশকে মধ্যমআয়ের দেশে উন্নীত করতে সক্ষম হবো। বঙ্গবন্ধুর যেমন দু’টি লক্ষ্য ছিল- এক: দেশ স্বাধীন করা এবং দুই: অর্থনৈতিকভাবে বাংলাদেশকে সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করা। বঙ্গবন্ধু গর্ব করে বলতেন, ‘আমার বাংলা রূপসী বাংলা, আমার বাংলা সোনার বাংলা’। তিনি বলতেন, ‘ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে বলবো আমি বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলা আমার দেশ’। একইভাবে ২০০৮-এর নির্বাচনের প্রাক্কালে বঙ্গবন্ধু কন্যাও বাংলাদেশের মানুষের জন্য দু’টি লক্ষ্য স্থির করেছেন- এক: ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা এবং  দুই: বাংলাদেশকে মধ্যমআয়ের দেশে রূপান্তরিত করা। ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন আর স্বপ্ন নয়। ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে মোবাইল ও তথ্য-প্রযুক্তির সেবায় দেশের মানুষ ইতিমধ্যে তার সুফল ভোগ করতে শুরু করেছে। অপরদিকে বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের মতে বাংলাদেশ নিম্ন-মধ্যমআয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে এবং ২০২১-এ আমরা পরিপূর্ণভাবে মধ্যমআয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার পথে রয়েছি।

১৯৭১-এ দেশের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৩৯ বছর; একই কালপর্বে ভারতের মানুষের গড় আয়ু ছিল ৫০ বছর; আর ২০১৪-এর হিসাব মতে বর্তমানে ভারতের মানুষের গড় আয়ু ৬৬ বছর, পাকিস্তানের ৬৫ বছর আর বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু ৬৯ বছর। ১৯৭১-এ ৫ বছরের নিচে শিশু মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে বাংলাদেশে ছিল ২২৫ জন; ভারতে ১৬৬ জন। আর এখন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের সময় বাংলাদেশে সেই সংখ্যা নেমে এসেছে ৪৬ জনে আর ভারতে তা ৬৫ জন আর পাকিস্তানে ৭২ জন। আর্থ-সামাজিক সকল ক্ষেত্রেই আমরা এগিয়ে চলেছি। নোবেল লরিয়েট অমর্ত্য সেনের ভাষায়, ‘সামাজিক-অর্থনৈতিক সকল ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে এগিয়ে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে ভারত থেকে এগিয়ে’। গত বছর ডিসেম্বর মাসে কৌশিক বসু এসে বলে গেলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি চমৎকার। বিশেষ করে গ্রামীন অর্থনীতি আন্তর্জাতিক বিশ্বে একটি মডেল’। মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় বিস্মিত জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন বলেছেন, ‘অন্যান্য স্বল্পোন্নত দেশের উচিত বাংলাদেশকে অনুসরণ করা’। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিগত বছরগুলোতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং মাথাপিছু আয় যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে, এই হার অব্যাহত থাকলে সমাজবিজ্ঞানীদের মতে আমরা ২০২১-এর পূর্বেই মধ্যমআয়ের দেশে উন্নীত হবো। সুতরাং সামাজিক জীবনের সকল ক্ষেত্রেই আজ আমরা শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে এগিয়ে চলেছি। শিক্ষার হার বেড়েছে, দারিদ্র্যের হার কমেছে। আন্তর্জাতিক বিশ্বে আমরা যখন যাই তখন আমাদেরকে যারা একদিন তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে বলেছিল, ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’, আজ তারাই বলে বিস্ময়কর উত্থান বাংলাদেশের। বঙ্গবন্ধু যে স্বপ্ন নিয়ে দেশ স্বাধীন করেছিলেন, আজ তাঁর কন্যার নেতৃত্বে বাংলাদেশ সেই গণতান্ত্রিক পথেই এগিয়ে যাচ্ছে এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বাস্তব রূপলাভ করতে চলেছে। আমি গ্রামের ছেলে। গ্রামে যখন যাই তখন মুগ্ধ হই। কারণ গ্রাম এখন শহরের মতো। গ্রামে গ্রামে এখন বৈদ্যুতিক আলো। ঘরে ঘরে টেলিভিশন। মানুষের মুখে হাসি। পায়ে জুতা, গায়ে সুন্দর জামা। সুন্দরভাবে বাংলাদেশের মানুষ চলছে। দুর্ভাগ্য, বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করে দেশে জঙ্গিবাদ সৃষ্টি করতে চাচ্ছে তারা, যারা মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত ও আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে হত্যাকারী অগণতান্ত্রিক শক্তি। কিন্তু আমি দৃঢতার সাথে বলতে পারি কোনও ষড়যন্ত্রই আজকের বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারবে না।

গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অগ্রযাত্রা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বলতেন, ‘গণতন্ত্রকামী জনগণের মনে রাখা দরকার যে, গণতন্ত্রেও একটা নীতিমালা আছে। গণতন্ত্রের দিশারী যারা তাদের গণতন্ত্রের নীতিকে মানতে হয়। খালি গণতন্ত্র ভোগ করবেন আর নীতিমালা মানবেন না, ওটা হবে না, হতে পারে না’। সুতরাং আজকের দিনে দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অগ্রসর করে নেওয়ার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর এই উক্তি দল-মত নির্বিশেষে আমাদের সকলের জন্য অনুসরণীয়। মানুষের জন্য অপার ভালোবাসা আর তাদের কল্যাণে কাজ করাই বঙ্গবন্ধুর মূল ভাবাদর্শ। নিজ চিন্তা ও আদর্শ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘একজন মানুষ হিসেবে সমগ্র মানব জাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসাবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে’। মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর এই দরদ আর অকৃত্রিম ভালোবাসার নিরন্তর প্রতিফলন আমরা দেখি তাঁর কন্যা শেখ হাসিনার নীতি-আদর্শ ও কর্মে।

শোককে শক্তিতে পরিণত করে জনকল্যাণে নিবেদিত থেকে সংবিধান সমুন্নত রেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সফলভাবে দেশ পরিচালনা করছেন। তাঁর সুযোগ্য নেতৃত্বে পরিচালিত হয়ে বাংলাদেশ একদিন উন্নত দেশে রূপান্তরিত হবে, এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বপূর্ণ চেতনা ধারণ করে সমগ্র বিশ্বে পুনরায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
লেখক: আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদ সদস্য

SUMMARY

733-1.jpg