আব্দুল কাইয়ুম
খুব সকালে ঘুম ভেঙে গেল। পাশের বাসায় চিৎকার, চেঁচামেচি। সবাই বলছে, গেট বন্ধ করো। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। চমকে উঠলাম। সেদিন ১৫ আগস্ট। ১৯৭৫। সকাল ১০টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানানোর জন্য পুরো বিশ্ববিদ্যালয় প্রস্তুত। ৩২ নম্বরের বাসা থেকে টিএসসির মোড় পর্যন্ত রাজপথের দুই পাশে ফুল হাতে দাঁড়িয়ে নগরবাসী তাঁকে ভালোবাসায় সিক্ত করবেন। প্রতিটি এলাকায় জমায়েত হয়ে মিছিল নিয়ে আসবেন কর্মী-সমর্থক-শুভানুধ্যায়ীরা। এর মধ্যে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের খবরে আমরা হতবিহ্বল হয়ে পড়ি।
যোগাযোগ করলাম সিপিবির (বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি) নেতাদের সঙ্গে। আমি মূলত ঢাকা জেলা কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের পর্যায়ে ছিলাম। পার্টির পক্ষ থেকে ছাত্র-তরুণদের সংগঠিত ও পরিচালনার কিছু দায়িত্ব ছিল আমার। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের মূল নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে কাজ করতাম। ছাত্রনেতাদের অনেকে ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য।
ইতিহাসের এই যুগসন্ধিক্ষণে সিপিবি দ্রুতই বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা জানিয়ে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে তোলার ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেয়। যদিও কিছু সময় লাগবে। কিন্তু লক্ষ্য স্থির রেখে কাজ করে যেতে হবে। দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে। রাজপথে নামতে হবে। সেখানে সামনে থাকবে ছাত্রসমাজ। তার সঙ্গে জনগণ। এটাই ছিল পরিকল্পনা।
এ জন্য আওয়ামী লীগের মূল নেতাদের সঙ্গে নানাভাবে যোগাযোগের চেষ্টা চলতে থাকে। তখন তো নামে বাকশাল থাকলেও সাংগঠনিকভাবে কার্যকর ছিল না। জাতীয় ছাত্রলীগও সেভাবে নেই। তাই সিপিবি উদ্যোগী হয়ে ন্যাপ ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিলিতভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলার কাজ শুরু করে। একই সঙ্গে ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্রলীগের মূল নেতারাও অ্যাকশন প্ল্যান নিয়ে কাজ শুরু করে দেয়।
হত্যাকাণ্ডের আকস্মিকতায় প্রথম দিকে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। তাদের নেতা-কর্মীদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবেই ভয়ভীতি ছিল। কারণ, তাঁরাই তো ছিলেন খুনি চক্রের মূল টার্গেট। কেউ কেউ দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলেন। কিন্তু ক্রমে তাঁরা সংগঠিত হতে থাকেন।
এ সময় সিপিবির সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ ফরহাদ বিশেষ উদ্যোগ নেন। তিনি ন্যাপের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। মোহাম্মদ ফরহাদসহ সিপিবির অন্যান্য কেন্দ্রীয় নেতা আত্মগোপনে থেকে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। ন্যাপের পঙ্কজ ভট্টাচার্য, চৌধুরী হারুনুর রশীদসহ অন্য নেতারা ছিলেন সক্রিয় ভূমিকায়। আওয়ামী লীগের মূল নেতাদের মধ্যে বিশেষ উদ্যোগী ছিলেন প্রধান নেতা জহিরুল কাইয়ুম ও মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিন প্রমুখ। তাঁরা ছিলেন সংসদ সদস্য। জাতীয় চার নেতা এবং তোফায়েল আহমেদ, আবদুর রাজ্জাক প্রমুখ আওয়ামী লীগের মূল নেতারা তখন জেলে আটক। ছাত্রকর্মীদের সংগঠিত করার মূল দায়িত্ব নেন ডাকসুর সাবেক ভিপি ও ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এবং ছাত্রলীগের নেতা ইসমত কাদির গামা, ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন ডাকসুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাহবুব জামান, ছাত্র ইউনিয়ন নেতা নূহ-উল-আলম লেনিন, কাজী আকরাম হোসেন, অজয় দাশগুপ্ত প্রমুখ।
সে সময়ের দিনগুলোতে আওয়ামী লীগ-সিপিবি-ন্যাপের মধ্যে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা ও ধীরে ধীরে ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদ সংগঠিত করা ছিল কঠিন কাজ। সে ক্ষেত্রে বিশেষভাবে আওয়ামী লীগের জহিরুল কাইয়ুম ও বর্তমানের নারী ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকির বাবা, পরবর্তীকালে এরশাদের খুনি বাহিনীর হাতে নিহত শহীদ মোহাম্মদ ময়েজউদ্দিনের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। বিশেষভাবে শিল্পপতি জহিরুল কাইয়ুম বুদ্ধি, পরামর্শ, শ্রম ও আর্থিক সহায়তা দিয়ে দেশে ঐক্যবদ্ধ রাজনৈতিক প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে তুলতে বিশেষ ভূমিকা রাখেন।
সে সময় সন্ধ্যার পর বিভিন্ন গোপন স্থানে আওয়ামী লীগ-সিপিবি-ন্যাপ নেতাদের মাঝেমধ্যে বৈঠক হতো। এ রকমই একটি সভা হয়েছিল কাঁঠালবাগানের এক বাসায়। সে বৈঠকে সিপিবি ও কৃষক সমিতির নেতা সদ্যপ্রয়াত নুরুর রহমানের মোটরসাইকেলের পেছনে বসে জহিরুল কাইয়ুম যোগদান করেন। সেই প্রবীণ বয়সেও তিনি যে এত সক্রিয় ও সাহসী ভূমিকা রেখেছিলেন, তা ভাবলে অবাক হতে হয়।
ওই সময় গোপন যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা ও খুনি চক্রের ভেতরের খবর, ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে যে ক্ষোভের প্রকাশ ঘটছিল, সেসব খবর আদান-প্রদানে আমাদের কয়েকজন কমরেড কাজ করতেন। তাঁদের মাধ্যমে আমাদের যোগাযোগ ছিল নেভি কমান্ডার আবদুর রউফের সঙ্গে। তিনি ছিলেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম ‘আসামি’ ও বীর মুক্তিযোদ্ধা। সিপিবি ও ট্রেড ইউনিয়ন নেতা ডা. ওয়াজেদুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল নন কমিশনড অফিসার মাহবুব উদ্দীন চৌধুরীর। তিনিও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম ‘আসামি’ ছিলেন। তাঁদের সঙ্গে সিপিবি নেতাদের প্রায় সার্বক্ষণিক যোগাযোগ থাকত। তাঁদের কাছ থেকে আমরা ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে সেনা নেতৃত্ব যে চরম ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে এবং তাঁরা যে রুখে দাঁড়ানোর মনোভাব পোষণ করছেন, সেসব বিষয়ে সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে পারতাম। আবার একই সঙ্গে বঙ্গভবনে খুনি চক্রের চিন্তাভাবনা, পরিকল্পনা সম্পর্কেও কিছু খবর পেতাম। এসব খবরাখবর আমাদের প্রতিবাদ-প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তুলতে খুব সাহায্য করেছে। কমান্ডার রউফ ও মাহবুব উদ্দীন—দুজনই এখন প্রয়াত।
মোশতাক ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার চেষ্টা করছিলেন। ১৬ অক্টোবর জাতীয় সংসদের অধিবেশন হয়। এ অধিবেশন বর্জনের আহ্বান জানিয়ে ছাত্রনেতাদের উদ্যোগে একটি লিফলেট সংসদ সদস্যদের মধ্যে বিলি করা হয়। অধিবেশনটি অনুষ্ঠিত হয় তেজগাঁওয়ের সংসদ ভবনে (বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর)। প্রধানত আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ প্রচার চালায়। কিন্তু তাতে খুব বেশি কাজ হয়নি। অনেক সংসদ সদস্য যোগ দেন। কিন্তু তাঁদের অনেকেই মোশতাকের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। বিশেষভাবে বর্তমান আইনমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য আনিসুল হকের বাবা, প্রয়াত আইনজীবী সিরাজুল হকসহ আরও কয়েকজন বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের নিন্দা ও খন্দকার মোশতাকের ক্ষমতা দখলকে অবৈধ বলে সরাসরি ঘোষণা করেন। আবার কেউ কেউ ফারুক-রশিদ খুনি চক্রকে অধিবেশন কক্ষ থেকে বেরিয়ে যেতে চাপ দেন। শেষ পর্যন্ত মোশতাক খুনি চক্রকে বেরিয়ে যেতে বলতে বাধ্য হন।
এ ঘটনায় অন্তত একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে যায় যে মোশতাক চক্রের ভিত নড়বড়ে হতে শুরু করেছে। এর ভিত্তিতে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।
১৮ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খোলার কথা। এই তারিখ টার্গেটে রেখে তার আগের রাতে ছাত্ররা দেয়াল লিখনের উদ্যোগ নেয়। সে সময় প্রতি রাতে কারফিউ। মূল রাস্তায় সেনা টহল চলত। এরপরও অনেক ঝুঁকি নিয়ে রাতে গোপনে দেয়াল লেখা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ভবনের দেয়ালে দেয়ালে লেখা হয় ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’। লেখার মূল দায়িত্বে ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতা ও সিপিবির কর্মী মৃণাল সরকার, কার্তিক চ্যাটার্জি, আবদুল মান্নান খান, নিয়াজ আহমেদসহ আরও অনেকে। তাঁরা সত্যিই এক দুঃসাহসিক কাজ করেন। পরদিন সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে দেয়াল লিখন দেখে সবাই উদ্দীপিত হন। প্রতিবাদের পদধ্বনি শুনতে পান।
সিদ্ধান্ত হয়, ২৯ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্রদের নেতৃত্বে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ মিছিল বের হবে। যাবে ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে। সেটাই হবে প্রথম প্রকাশ্য জন-অংশগ্রহণসমৃদ্ধ আনুষ্ঠানিক শোক ও প্রতিবাদ। এরপর আমরা ধীরে ধীরে আরও কঠোর কর্মসূচির দিকে যাব।
কিন্তু এ জন্য প্রয়োজন ছিল সাধারণ শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদমুখর করে তোলা। তাই ২০ অক্টোবর থেকে বিভিন্ন ক্লাসে ঝটিকা প্রচার চালানোর পরিকল্পনা করা হয়। ছাত্রনেতারা শ্রেণিকক্ষে দু-চার মিনিট কথা বলার জন্য শিক্ষক-অধ্যাপকদের অনুমতি নিয়ে প্রতিবাদ মিছিলে সবাইকে যোগদানের আহ্বান জানাতে থাকেন। এই ঝটিকা প্রচারে অনুকূল সাড়া পাওয়া যায়।
তখন আমরা চিন্তা করি, মিছিলে শুধু শিক্ষার্থীই নয়, শিক্ষক, অভিভাবক, বুদ্ধিজীবীসহ সর্বস্তরের জনসাধারণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হবে। এ জন্য আরও একটু সময়ের প্রয়োজন ছিল। তাই মিছিলের তারিখ পিছিয়ে ৪ নভেম্বর করা হয়।
এই মিছিল সফল করার জন্য ‘কাঁদো বাঙালি কাঁদো’ শিরোনামে একটি ছোট লিফলেট ছাপানো হয়। সামরিক শাসন ও প্রতি রাতে কারফিউর মধ্যে লিফলেট ছাপানো ও বিলি করা ছিল কঠিন কাজ। ঝুঁকি নিয়ে ছাত্রকর্মীরা গোপন প্রেসে লিফলেট ছাপানো শুরু করেন। এই সময় মোহাম্মদপুরে লিফলেটসহ পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন ছাত্র ইউনিয়ন নেতা কাজল ব্যানার্জি (বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক) ও শওকত হোসেন। এজি অফিসে লিফলেট বিলির সময় গ্রেপ্তার হন চামেলীবাগের ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী আবু সিদ্দিক ও শাহ জামাল। তাঁদের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। কিন্তু আমাদের চূড়ান্ত প্রস্তুতির কাজ চলতে থাকে।
এরই মধ্যে ৩ নভেম্বর মাঝরাতে ব্রিগেডিয়ার (পরে মেজর জেনারেল) খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে অভ্যুত্থান ঘটে। সেটা ছিল আমাদের একেবারে অভাবিত। ৪ নভেম্বর খুব সকাল থেকে ঢাকার আকাশে মিগ বিমান চক্কর দিতে থাকে। এ অবস্থায়ও আমরা মিছিলের কর্মসূচি অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নিই।
অবশ্য ক্যান্টনমেন্টের সেনা কর্মকর্তারা মিছিল বন্ধ রাখার অনুরোধ করছিলেন। সেদিন সকালে মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমের সঙ্গে জেনারেল খালেদ মোশাররফের টেলিফোনে কথা হয়। তিনি মিছিল বন্ধ রাখার জন্য বারবার অনুরোধ করেন। কিন্তু সেলিম রাজি হননি, বরং শোক ও প্রতিবাদের মিছিলে তাঁকেও যোগদানের অনুরোধ জানান। শেষ পর্যন্ত তিনি বলেন, তাঁর প্রবীণ বয়সী মা মিছিলে অংশগ্রহণ করবেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনে সংক্ষিপ্ত জমায়েতের পর মিছিল বের হয়। নীলক্ষেতের কাছে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা বাধা দেন। সেলিম তাঁদের বলেন, সকালেই জেনারেল খালেদ মোশাররফের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে। এরপরও পদে পদে বাধা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ছাত্র-জনতার বিশাল মিছিল বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে যায়। কলাবাগানের মোড় থেকে জেনারেল খালেদ মোশাররফের মা মিছিলে যোগ দেন। ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাসার গেট তালাবদ্ধ ছিল। আমরা গেটের সামনে ফুল দিই। শোক জানাই।
এই সময় আমরা জেলখানায় চার জাতীয় নেতাকে নির্মমভাবে হত্যার খবর পাই। শুরু হয় আরেক অধ্যায়।
কিন্তু প্রতিবাদ চলতেই থাকে। পরের বছর ১৫ আগস্ট ৩২ নম্বরের বাসায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দলে দলে শিক্ষার্থীরা বিচ্ছিন্নভাবে গিয়ে ফুল দিয়ে আসেন। অবশ্য পুলিশ পরে বাধা দেয়। কিন্তু শ্রদ্ধা জানানোর মধ্য দিয়ে প্রতিবাদের ধারা চলতে থাকে।
১৯৭৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পালনের জন্য একটি ব্যাপক উদ্যোগ নেওয়া হয়। ছাত্রদের প্রস্তুতি তো ছিলই। আবার আওয়ামী লীগ, সিপিবি ও ন্যাপও উদ্যোগ নেয়। সরকারি ভয়ভীতি উপেক্ষা করে আওয়ামী লীগ নেতা মতিউর রহমানের বাসায় বৈঠকে রাজনৈতিক নেতা, বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবীদের নিয়ে ৩০১ জনের একটি কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির সভাপতি ছিলেন কবি জসীমউদ্দীন এবং আহ্বায়ক খোন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস। অবশ্য সরকারের নির্যাতন ও চাপের কারণে এই কমিটি খুব বেশি তৎপরতা চালাতে পারেনি। তবে অমর একুশের প্রভাতফেরিতে ছাত্র-জনতার অংশগ্রহণ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত।
প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ ধারাবাহিকভাবে অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে সিপিবির উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরের বছর ১৯৭৬ সালের ১৭ মার্চ ছাত্র ইউনিয়ন বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। এ সময় বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষে কমিউনিস্ট পার্টি বঙ্গবন্ধুর ছবিসহ একটি লিফলেট ছাপায়। প্রেস থেকে লিফলেট নিয়ে রিকশায় কর্মীদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার পথে নবাবপুরের বংশাল মোড়ে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন জগন্নাথ হলের ছাত্র ইউনিয়ন নেতা মাখন বড়াল। অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে তাঁর কাছ থেকে কথা বের করার চেষ্টা করে পুলিশ। কিন্তু মাখন বড়াল কারও নাম প্রকাশ করেননি। সেটা ছিল তাঁর দেশপ্রেমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকেই সিপিবি বিভিন্ন নামে অনেক লিফলেট প্রচার করে। মোশতাক ও ফারুক-রশিদ খুনি চক্রের মুখোশ উন্মোচন করার ক্ষেত্রে এগুলো উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। সিপিবির উদ্যোগে প্রকাশিত ‘বিদেশী সংবাদপত্র ও বেতারে বাংলাদেশ’ নামে একটি বুকলেট সে সময় সাড়া জাগায়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে সূচিত পরিবর্তনকে যে মস্কো ভালো চোখে দেখছে না, কর্নেল ফারুক-রশিদ চক্রই যে খুনের পরিকল্পনা ও হত্যাযজ্ঞে নেতৃত্ব দিয়েছিল, যে কথা তাদের জবানিতেই প্রকাশ পায় সানডে টাইমস–এ, সেসব খবর সিপিবির বুকলেট পড়ে মানুষ জানতে পারে।
১৫ মে, ১৯৭৬ তারিখে সিপিবি ‘চক্রান্ত রুখে দাঁড়াও, খুনিদের শাস্তি দাও’ নামে একটি লিফলেট ছাপিয়ে বিলি করে। সেখানে এয়ার মার্শাল তাওয়াবের চক্রান্ত সম্পর্কে লেখা হয়, ‘তাওয়াব, “খুনি মেজরের দল” এবং দেশদ্রোহী আলবদর রাজাকার জামাতে ইসলামীরা লাখো শহীদের রক্তে অর্জিত স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ধ্বংস করে, জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সংগীত বদল করে এই দেশকে আবার ভুট্টোর পাকিস্তানের গোলাম বানাতে চেয়েছিল...।’ লিফলেটে দেশবাসীকে সজাগ থাকার আহ্বান জানানো হয়। ‘দেশপ্রেমিক’দের পক্ষ থেকে এই লিফলেট প্রকাশ করা হয়েছিল।
‘ওদের ক্ষমা নেই’ নামে আরেকটি লিফলেট সিপিবি প্রচার করে। সেখানে কর্নেল ফারুকের দম্ভোক্তি ‘আমিই শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার আদেশ দিয়েছিলাম’ ছাপিয়ে দেশবাসীর কাছে খুনিদের মুখোশ উন্মোচন করে দেওয়া হয়। লিফলেটের শেষ কয়েকটি বাক্য ছিল, ‘কিন্তু পাপকে কি ধামাচাপা দেওয়া যায়? না, তা মানা যায় না। এই জঘন্য খুনি অপরাধী মীরজাফরেদের দল কি পার পেতে পরে? না, তা পারে না। বাংলাদেশের জনগণ মীরজাফরদের ক্ষমা করবে না।’ লিফলেটের সেই কথা আজ সত্য প্রমাণিত হয়েছে। খুনিদের বিচার ও যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করা হয়েছে। অনেকের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। কয়েকজন এখনো বিভিন্ন দেশে পালিয়ে আছে। তাদেরও শাস্তির আওতায় আনা হবে।
শত বাধাবিপত্তির মুখেও সিপিবির উদ্যোগে ‘ইস্পাত’ নামে একটি বুলেটিন অনিয়মিতভাবে বের হতো। এর মূল দায়িত্বে ছিলেন ছাত্রনেতা ও সিপিবি কর্মী মৃণাল সরকার। সম্ভবত তিনটি সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল। ওই বুলেটিনগুলোতে দেশে যে গভীর ষড়যন্ত্র চলছে, দেশকে যে পেছনের দিকে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা চলছে, সে সম্পর্কে দেশবাসীকে সতর্ক করে দেওয়া হতো। ‘ইস্পাত’-এর তৃতীয় সংখ্যায় (জুলাই, ১৯৭৬) তাওয়াবের চক্রান্তের মুখোশ উন্মোচন করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে দেশবাসীকে রুখে দাঁড়ানোর আহ্বান জানানো হয়।
‘রাজবন্দীদের মুক্তি দাও—বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির প্রতি বিশ্বের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের আবেদন’ শিরোনামে আরেকটি সাড়া জাগানো লিফলেট সিপিবি ছাপিয়ে বিলি করে। সেখানে বিশ্বের ৪৭টি দেশের ৬২ জন বিশিষ্ট ব্যক্তির আহ্বান ছাপানো হয়। তাঁদের মধ্যে ছিলেন ফরাসি সিনেটর, ফিনল্যান্ডের সেন্টার পার্টির নেতা, প্যালেস্টাইন শান্তি কমিটির নেতা, পোল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী, সোভিয়েত শান্তি কমিটির নেতাসহ আরও অনেক দেশের জাতীয় রাজনৈতিক নেতারা।
এসব ঘটনা আমাদের ইতিহাস পাল্টে দেওয়ার চক্রান্ত রুখে দিতে প্রাথমিকভাবে বিশেষ অবদান রেখেছে। আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ, সিপিবি ও ন্যাপ বড় ভূমিকা রেখেছিল। পরবর্তীকালে দেশ ধ্বংসের শেষ সীমানা থেকে ফিরে আসতে পেরেছে। স্বাধীন বাংলাদেশ নানা বাধাবিপত্তি পেরিয়ে আজ আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে এগিয়ে চলেছে।
(লেখকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে লেখা)
আব্দুল কাইয়ুম প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক