বাশার খান
১৯৪২ সাল। এক মহাবিদ্রোহীর বাকরুদ্ধ হয়ে যাওয়ার বছর এটি। দখলদার ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে যিনি কথা বলেছেন অকুতোভয় হয়ে, জেলও খেটেছেন। ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের মাত্র কয়েক বছর আগে লেখনি অস্ত্রের সেই ঝনঝনানি যেন থেমে গেল হঠাৎ করেই।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৯৪২ সালের ১০ জুলাই অকস্মাৎ বাকরুদ্ধ হন। তারপর বেড়ে চলে কবির জিহ্বার আড়ষ্টতা। মাঝেমধ্যে উত্তেজিত হয়ে চেঁচাতেন। কখনো বিমর্ষ, দীপ্তিহীন ও নিস্তেজ হয়ে বিছানায় পড়ে থাকতেন মহাবিদ্রোহী। কলকাতায় কবিকে চিকিৎসার কিছু উদ্যোগ নেয়া হলেও তা ছিল খুবই অপর্যাপ্ত। ফলে ক্রমেই কবির শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে থাকে।
তারপর পেরিয়ে যায় অনেক বছর। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর নজরুলকে বাংলাদেশে আনার উদ্যোগ নেন বাংলা মায়ের আরেক মহাবিদ্রোহী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলা ১৩৮০ সনের ১১ জৈষ্ঠ নজরুলের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে তাকে বাংলাদেশে আনার উদ্যোগ নেয়া হয়। অল্প সময়ের মধ্যে মন্ত্রিসভার বৈঠক ডাকেন বঙ্গবন্ধু। সরকারিভাবে কাজী নজরুল ইসলামকে আনতে ভারত সরকারকে অনুরোধ করার সিদ্ধান্ত নেন। সে দিন বিকেলেই কবিকে দেশে আনার ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু টেলিফোনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে কথা বলেন।
বঙ্গবন্ধুর বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে তৎকালীন মন্ত্রী মতিউর রহমান এবং আওয়ামী লীগের সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক মুস্তাফা মনোয়ারকে ভারতে পাঠানো হয়। সঙ্গে দিয়ে দেন সরকারি অফিসিয়াল পত্র।
এর সাথে নজরুলকে ‘হে কবি’ সম্বোধন করে চিঠি লিখে দিয়ে দেন বঙ্গবন্ধু। চিঠিতে নজরুল ও তার পরিবারের সদস্যদের বাংলাদেশে আসার আমন্ত্রণ জানান। চিঠি লিখে দিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্তদেরকে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আশা করি কবিকে ছাড়া খালি হাতে আসবে না।’
বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামকে সরকারিভাবে বাংলাদেশে আনা হচ্ছে- খবর প্রচারিত হতে থাকে রেডিও এবং টেলিভিশনে। এই খবর পৌঁছার পর ভারতে আলোড়ন সৃষ্টি হয়।
ভারতের দমদম বিমানবন্দর থেকে কলকাতা যাওয়ার সড়কের নাম ‘কবি নজরুল ইসলাম এভিনিউ’। এ পথ দিয়েই যাচ্ছিলেন বঙ্গবন্ধুর প্রতিনিধি মন্ত্রী মতিউর রহমান এবং মুস্তাফা মনোয়ার। রাস্তার দুপাশে কিছু পোস্টার দেখতে পান তারা। তাতে লেখা ‘অসুস্থ কবি নজরুলকে বাংলাদেশে নেওয়া যাবে না।’ কলকাতার কয়েকটি রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এই পোস্টার লাগিয়েছিল। শুধু তাই নয়, কবি অসুস্থ তাই তাকে বাংলাদেশে নেওয়া যাবে না- সংগঠনের কর্তারা এ রকম ডাক্তারি সার্টিফিকেটও যোগাড় করে রাখে। নজরুলকে বাংলাদেশে আনার বিপক্ষে চালাতে থাকে প্রচার-প্রচারণা। এমনকি বিক্ষোভও।
এরই মধ্যে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে কলকাতার মুখ্যমন্ত্রী ব্যারিস্টার সিদ্ধার্থ রায়ের বৈঠক হয়। সেখানকার ‘রাইটার্স ভবনে’ অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে মন্ত্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায় ভারতীয়দের প্রতিবাদের বিষয়টি তুলে ধরেন। তাকে সেদিন খুব চিন্তিত দেখায়।
এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলও চিন্তায় পড়ে যান। যোগাযোগ করেন বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে। সে সময়ের প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব তোফায়েল আহমেদ এবং অন্যতম সচিব প্রয়াত রফিকুল্লাহ চৌধুরী জানান যে, কবি নজরুলকে সঙ্গে করে ঢাকায় নিয়ে যেতে না পারলে বাংলাদেশেও বিক্ষোভ শুরু হতে পারে। কারণ, ইতোমধ্যেই রেডিও এবং সংবাদপত্রে প্রচার করা হয়ে গেছে যে, ‘অমুক সময় কবিকে বহনকারী বিমানটি ঢাকায় অবতরণ করবে’। সুতরাং খবরটি পেয়ে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল উভয় সঙ্কটের পড়েন।
কলকাতায় বিক্ষোভ, অপরদিকে ঢাকায় প্রতিবাদের সম্ভাবনা- এই উভয় সঙ্কটে ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হয় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীর সুসম্পর্ক। এ সম্পর্কের ফলেই নজরুলকে বাংলাদেশে আসতে দিতে রাজি হয় ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। এ নিয়ে আবারও বৈঠক হয় ‘রাইটার্স ভবনে’। তবে শর্ত থাকে যে, কবির অসুস্থতার ব্যাপারে যাবতীয় দায়-দায়িত্ব গ্রহণ এবং একটা সময় পরে কবিকে ভারতে ফিরিয়ে দিতে হবে।
দ্বিতীয় বৈঠকের পরদিন ১৯৭২ সালের ২৪ মে ভোরেই কবিকে বাংলাদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। কলকাতার দমদম বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছিল বাংলাদেশ বিমান। খুব ভোরেই কবিকে বিমানে ওঠানো হয়। এতে অন্যান্যদের মধ্যে সহযোগিতা করেন কবির দুই ছেলে কাজী সব্যসাচী ও কাজী অনিরুদ্ধ। এ সময়ে বিমানবন্দরে দ্রুত ছুটে আসেন কলকাতার ফটো সাংবাদিকরা, কিন্তু পাননি। কারণ ততক্ষণে কবিকে বহনকারী বিমানটি আকাশে উড়ে গেছে। এর প্রতিবাদে বিক্ষোভের পাশাপাশি পরবর্তীতে কলকাতায় বোমা বিস্ফোরণের খবরও পাওয়া যায়।
মাত্র ৩০ মিনিটের মধ্যেই কবিকে বহনকারী বিমানটি ঢাকায় পৌঁছায়। কবিকে অভ্যর্থনা জানাতে ততক্ষণে লোকে-লোকারণ্য পুরো বিমানবন্দর এলাকা। এত মানুষ সেখানে ভীড় জমায় যে বিমানের সিঁড়ি লাগানো অসম্ভব হয়ে পড়েছিলো। ঢাকায় খুব গরম ছিলো সেদিন। বিমানে অপেক্ষামান কবি এর মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়েন। বিমানেই শুরু হয় কবিকে সেবা-শুশ্রূষা। এদিকে কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছিল না অপেক্ষামান হাজার হাজার জনতাকে। বিমানের দরজা খুলে জনতাকে শৃঙ্খলাবদ্ধ হতে অনুরোধ করা হয়। তবুও নজরুল-পাগল বাঙালিকে শান্ত করা যাচ্ছিল না।
অবস্থা বেগতিক দেখে গোপনে কবিকে নামানো হয় বিমানের পিছনের দরজা দিয়ে। কবিকে কোলে করে অ্যাম্বুলেন্সে ওঠানো হয়। বিমানবন্দর থেকে বের করতে শেষপর্যন্ত উত্তর দিকের ফ্লাইং ক্লাবের পথ দিয়ে কবিকে নিয়ে যেতে বাধ্য হয় বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ। এভাবেই বাংলাদেশে প্রবেশ করেন কবি।
দুই মহান বাঙালির সাক্ষাৎ:
কবিকে আনার আগেই বঙ্গবন্ধু কবি পরিবারের জন্য ধানমন্ডিতে ‘কবি ভবন’ নামে একটি বাড়ি বরাদ্দ দিয়ে রাখেন। কবিকে কবি ভবনে আনার সঙ্গে সঙ্গেই ডাক্তার তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। দ্রুত ছুটে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। হাতে ফুলের ডালি। এ সময় ঘটে এক অভাবনীয় ঘটনা। কবি বঙ্গবন্ধুর দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে থাকেন অনেকক্ষণ। কথা বলতে না পারলেও মুখ নাড়ছিলেন কবি। ক্যামেরাবন্দী করা হয় বিখ্যাত সেই মুহূর্ত। প্রত্যক্ষদর্শীরা এই দৃশ্য দেখে অবাক হন। বাংলা ভাষার অন্যতম কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং বিশ্বসেরা রাজনীতির কবি রাষ্ট্রনায়ক শেখ মুজিবুর রহমান একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছেন। এতো দুই মহাবিদ্রোহীর মিলন মেলা। এক বিদ্রোহী রণক্লান্ত এবং বাকশক্তিহীন। আরেক বিদ্রোহী সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রনায়ক। বিছানায় শুয়ে থাকা থেমে যাওয়া আগ্নেগিরির সামনে জ্বলন্ত আগ্নেগিরি দাঁড়ানো।
এক এক করে কবিকে স্বাগত জানাতে আসতে থাকেন মন্ত্রিসভার সদস্যরা। হাজার হাজার মানুষ ফুল হাতে ভীড় জমায় কবি ভবনের আশাপাশে।
এরমধ্যেই কবি পরিবারকে সব ধরণের সুযোগ-সুবিধা দেয়ার নির্দেন দেন বঙ্গবন্ধু। কবি পরিবার খুশি হন। কবির স্বাস্থ্য কিছুটা উন্নতি দিকে যেতে থাকে। কয়েকদিন পর মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী কবিকে দেখতে আসেন। এক সাংবাদিক সম্মেলনে কবিকে স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে রাখার দাবি জানান তিনি।
প্রশ্ন দাঁড়ায়- ভারত সরকার তাতে রাজি হবে কিনা। কবিকে ঢাকায় আনতে গিয়েই তো কত বাধার সম্মুখিন হতে হয়েছিল। এখানেও ত্রাণকর্তা হয়ে উপস্থিত হয়- বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সুসম্পর্ক। ইন্দিরা গান্ধী আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে পুরো বাংলাদেশেরই বোন হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সমর্থন আদায়ে সারা বিশ্ব সফর করেছেন। কোটি কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছেন। অস্ত্র ও সৈন্য দিয়ে প্রত্যক্ষ সাহায্য করেছেন। যে কারনে পরবর্তীতে এই বঙ্গবন্ধু-ইন্দিরা গান্ধী সুসম্পর্কের জোরেই নজরুলকে স্থায়ীভাবে ঢাকায় রাখার পথ সুগম হয় এবং রাখা হয়।
তথ্যসূত্র:
১। বিদ্রোহী কবি ও বঙ্গবন্ধু, দ্বিতীয় সংস্করণ ফেব্রুয়ারি ২০০৯, সম্পাদনা- মো. এরশাদ হোসেন, নজরুল ইন্সটিটিউট, ঢাকা।
২। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য জিজ্ঞাসা, ড. সৌমিত্র শেখর, নতুন সংস্করণ জানুয়ারি ২০১২, অগ্নি পাবলিকেশন্স।
৩। দৈনিক বাংলার বাণী, ২৬ মে ১৯৭৩।
৪। দৈনিক যায়যায় দিন, ২৯ আগস্ট ২০১৪।