দেশে ফিরে যা বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু


উদিসা ইসলাম 
 
পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দেশে ফিরেই তিনি ঘোষণা দেন, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, স্বাধীন থাকবে। এখনও ষড়যন্ত্র চলছে, কিন্তু একজন বাঙালিও জীবিত থাকা পর্যন্ত বাংলাদেশ স্বাধীন থাকবে।’

সেদিন ঢাকার রাস্তা ছিল জনাকীর্ণ। তৎকালীন দৈনিক বাংলায় ১১ জানুয়ারির প্রধান খবরে দিনটির বর্ণনা করা হয়। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘এয়ারপোর্ট থেকে রেসকোর্স। জনসমুদ্র পেরিয়ে আরেক জনসমুদ্রে আসতে সময় লেগেছে ১৩০ মিনিট। প্রথমে পাইলট কার, তার পেছনে দুটো জিপ, তার পেছনে সাংবাদিকদের ট্রাক, ঠিক পেছনে বঙ্গবন্ধুর সুসজ্জিত ট্রাক। নীল ও লাল রঙেয়ের কাপড়ের ঘের দেওয়া। বঙ্গবন্ধুর পরনে কালো প্যান্ট, কালো কোর্ট। ক্লান্ত দেহ অথচ সজীব মুখ।’

ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে তিনি সবাইকে সতর্ক ও ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান।

দৈনিক বাংলা আরও লিখেছিল, ‘পাকিস্তানের ভুট্টোকে তিনি (বঙ্গবন্ধু) বলে দিয়েছেন, আপনারা সুখে থাকুন, শান্তিতে থাকুন। আমরাও আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে সুখে-শান্তিতে থাকতে বদ্ধপরিকর। ভুট্টো সহেব অনুরোধ করেছিলেন কোনরূপ একটা যোগসূত্র রাখতে। কিন্তু আর নয়।’

 
সমাবেশ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে অংশগ্রহণকারী সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে বঙ্গবন্ধু সালাম জানান। তিনি বলেন, ‘আমি সালাম জানাই মুক্তিবাহিনী, গেরিলাবাহিনী ও কর্মীবাহিনীকে। আমি সালাম জানাই সংগ্রামী শ্রমিক শ্রেণি, কৃষক, বুদ্ধিজীবীদের।’

পথের বর্ণনা দিতে গিয়ে দৈনিক বাংলার ওইদিনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘চারিদিকে অভূতপূর্ব প্রাণ বন্যা। লোকজন  বঙ্গবন্ধুকে দেখার জন্য পাগল হয়ে গেছে। তারা স্লোগান দিচ্ছে, তারা নাচছে, তারা হাত তুলে বঙ্গবন্ধুকে অভিনন্দন  জানাচ্ছে। তারা ফুলের মালা, ফুলের পাপড়ি ছুড়ে দিচ্ছে।’

প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, ‘ওইদিন বেলা ২টা ৩১ মিনিট। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে এমপিএ হাউস পর্যন্ত এসেছে ট্রাকটি। পাশে ঢিবির ওপর পাক বাহিনীর বিমানব্বিংসী কামান। সেখানেই বিজয়ী বাঙালিদের ভিড়। রাস্তার পাশে একজন বৃদ্ধকে দেখতে পেলাম। বয়স কম করে হলেও ৯০ বছর। সঙ্গে একজন বৃদ্ধা মহিলা। আশেপাশে তরুণদের ভিড়। বৃদ্ধা বঙ্গবন্ধুকে এক নজর দেখার জন্য চেষ্টা করছেন। এক তরুণ বৃদ্ধাকে কোলে করে ওপরে তুলে ধরলেন। দেখলাম, বৃদ্ধা আঁচল থেকে একটি ফুল ছুড়ে দিলেন।’

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘ফার্মগেট ও শেরে-বাংলানগর ক্রসিংয়ে বিকাল ৩টায় একজন বৃদ্ধা দুহাত তুলে বঙ্গবন্ধুকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন। দুটি লোক গাঁদা ফুলের মালা হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। তাদের একজনের পরনে লুঙ্গি, ছেড়া গেঞ্জি। অপর লোকটির পরনে পাজামা-পাঞ্জাবি।’

 
ওই প্রতিবেদনে অনেকগুলো পোস্টারের বর্ণনাও দেওয়া আছে। উল্লেখ আছে পোস্টারগুলোতে লেখা, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘যুদ্ধে আমরা লড়েছি, বাংলা স্বাধীন করেছি’, ‘বঙ্গপিতা বঙ্গবন্ধু জিন্দাবাদ, ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী জিন্দাবাদ’, ‘বাংলাদেশ-রুশ মৈত্রী অমর হোক’ এবং ‘জয় বাংলার জয়’।

সেদিন বঙ্গবন্ধুকে সংবর্ধনা জানাতে রাস্তায় ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। তিনি  বলেন, ‘সেই দিন যেন স্বাধীনতা পূর্ণতা পায়। ১৬ ডিসেম্বর ছিল এক রকম আনন্দ। আর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু যখন ফিরলেন তখন সেই উদযাপন অন্যরকম স্বতঃস্ফূর্ততা। রাস্তা সাধারণ মানুষে সয়লাব। এরপর বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ দিয়েছিলেন সেটা ছিল অনন্য। পুরো জাতির আবেগে যে অনুভূতি সেটির প্রতিফলন ছিল ভাষণটি। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর ফিরে আসার মধ্য দিয়ে সবাই একসঙ্গে উদযাপনের সুযোগ পেলো।’

বঙ্গবন্ধুর ফিরে আসার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার আনন্দ পূর্ণতা পেয়েছিল বলে মনে করেন মুক্তিযোদ্ধা রোকেয়া কবীর। তিনি  বলেন, ‘সেদিন অন্যরকম আনন্দে ভেসেছিল দেশবাসী। ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর যে আনন্দ নিয়ে আমাদের বিজয় উদযাপনের কথা ছিল সেটি তাৎক্ষণিকভাবে সম্ভব হয়নি। কেননা, বিজয়ের আগে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয় এবং তাদের লাশ আমরা বিজয়ের দিন থেকে উদ্ধার করতে শুরু করি। অনেককে তো পাওয়াই যায়নি। কিন্তু আমাদের স্বাধীনতার ঘোষক যখন দেশে ফিরছেন বলে জানা গেলো তখন সবার সে কি উচ্ছাস!’
পত্রিকা কৃতজ্ঞতা: ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরাম।

SUMMARY

724-1.jpg