সাজ্জাদ সাকিব বাদশা
১৫ আগস্ট ১৯৭৫। এদিন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। শুধু বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারবর্গকে নয়, ‘শেখ’ বংশ থেকে সেসময় উদীয়মান যে রাজনৈতিক নেতৃত্বের আবির্ভাব হতে চলেছিল তাদেরও নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধুর ছোট ভাই শেখ নাসের, বোন জামাই আবদুর রব সেরনিয়াবাত, ভাগিনা শেখ ফজলুল হক মনি প্রমুখ তাদের অন্যতম। পৃথিবীর ইতিহাসে এটি একটি নিকৃষ্টতম ও ভয়াবহ রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। এ হত্যাকাণ্ডটি যেমন ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশে রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক মানচিত্রে বিরাট ও বিরূপ প্রতিফলন- পরিবর্তন ঘটিয়েছে, তেমন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও এ হত্যাকাণ্ডের গুরুত্ব-প্রভাব উল্লেখযোগ্য।
হত্যাকাণ্ডের পর বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘদিনের সহযাত্রী ও হত্যাকাণ্ডের অন্যতম মাস্টারমাইন্ড খন্দকার মোশতাক বঙ্গবন্ধুর রক্তাক্ত, পবিত্র দেহ ফেলে রেখে ১৬ আগস্ট সকালেই নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করে স্বল্প সময়ের মধ্যে এক অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে (দ্য বাংলাদেশ গেজেট, পাবলিশড বাই অতরিটি; ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫) হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের দায়মুক্তি দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে কলঙ্কিত করে। কিছু লোভী মানুষের পরিকল্পনা ও কতিপয় মধ্যম সারির সেনা কর্মকর্তার এই বিপথগামিতাকে দায়মুক্তি দেওয়া এই অধ্যাদেশটিকে ১৯৭৯ সালে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বৈধ ঘোষণা করে সামরিক শাসক জেনারেল জিয়া চূড়ান্তভাবে বাংলাদেশকে পরাজিত ও লজ্জিত করে, যা ১৯৭১ সালে নয় মাসব্যাপী নির্মম অত্যাচার চালানো পাকিস্তানি সেনা শাসকরাও করেনি। বলাই বাহুল্য, জিয়া ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের আরেক প্রধান মাস্টারমাইন্ড। এখানেই শেষ নয়। ৮ জুন ১৯৭৬ এ হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত ১২ জনকে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে নির্মম-নৃশংস এই ঘটনাটিকে তামাশায় পরিণত করা হয়। মামুলি হিসেবে সবার সামনে তুলে ধরা হয়, যা প্রকারান্তরে মানব ইতিহাসের জন্য এক ন্যাক্কারজনক নজির সৃষ্টি করে। মানুষের জন্য পরিচালিত রাজনীতি ও রাষ্ট্রব্যবস্থা মানুষের এক মহান নেতার প্রতি কতোটা অমানবিক ও স্বৈরাচারী হতে পারে তা বিশ্ববাসী বিস্ময়ের সঙ্গে দেখতে পায় পঁচাত্তর পরবর্তী বাংলাদেশে খন্দকার মোশতাক ও জেনারেল জিয়ার শাসনামলে।
পঁচাত্তরের পর অত্যাচার-নির্যাতন, দমন-পীড়ন সহ্য করে ফিনিক্স পাখির মতো জনতার দল আওয়ামী লীগ জনতার রায় নিয়ে ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে পুনরায় রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ সন্তান শেখ হাসিনার নেতৃত্বে। বঙ্গবন্ধুর পারিবারিক ও রাজনৈতিক উত্তরাধিকারকে (জেল হত্যা, ৩ নভেম্বর ১৯৭৫) ধ্বংস করার মাধ্যমে কুচক্র মহল বাংলাদেশ থেকে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের নাম মুছে ফেলার যে অপপ্রয়াস চালিয়েছিল তা ব্যর্থ হয় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে; যিনি পঁচাত্তরে ভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিলেন ঘাতকের বুলেট থেকে। সম্ভবত পিতা ও বাংলাদেশের অস্তিত্বের স্মারক বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারকার্যটি সম্পন্ন করে দেশকে অগ্রযাত্রার কাঙ্ক্ষিত বন্দরে পৌঁছে দেওয়ার জন্যেই শেখ হাসিনার এই আকস্মিক বেঁচে যাওয়া। ১৯৯৬ সালে সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের পরপরই ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ (রহিতকরণ) বিল, ১৯৯৬ সংসদে পাস করার মাধ্যমে পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের বিচারকার্য পরিচালনা করার যাবতীয় প্রতিবন্ধকতা দূর করা হয়। বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন না করে সাধারণ মানুষের প্রাণের স্পন্দন বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার সাধারণ আদালতে সম্পন্ন করার সিন্ধান্ত নেন শেখ হাসিনা। ২ অক্টোবর ১৯৯৬ সালে নিম্ন আদালতে হত্যা মামলা দায়েরের পর দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে হত্যাকারিদের মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করার জনতার রায় ঘোষিত হয় ৮ নভেম্বর ১৯৯৮। এরপর মামলাটি গড়ায় হাইকোর্টে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার পরও বিচারকদের নানামুখী অপতৎপরতায় মামলাটি আবারও পথ হারায় এবং ৩০ এপ্রিল ২০০১ হাইকোর্ট পর্যায়ে মামলাটির সমাপ্তি ঘটে। ২০০১-২০০৬ সময়ে বিদ্যমান বিএনপি-জামায়াত সরকার আপিল বিভাগে বিচারকদের একের পর এক বিব্রত হওয়ার নাটক উপস্থাপনের মাধ্যমে আবারও মামলাটিকে পথহারা করে। ২০০৮ সালে বিপুল গণরায় নিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে মামলাটি সচল হয়। যাবতীয় আইনি প্রক্রিয়া শেষে ২৭ জানুয়ারি ২০১০ রায় কার্যকরের মাধ্যমে হত্যাকাণ্ডের ৩৪ বছর পর এবং মামলা দায়েরের ১৪ বছর পর এক সমুদ্র চোখের জল ও বুকভরা হাহাকারের পর বাংলাদেশ তার পিতা হত্যার প্রতাশিত বিচার পায়। বাংলাদেশ কলঙ্কমুক্ত হয়।
বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারকার্যটি যেন ছোট গল্পের পরিণতি লাভ করতে চলেছে; শেষ হইয়াও হইলো না শেষ। দণ্ডপাপ্ত বেশ কয়কজন খুনি এখনও পলাতক। তারা বিদেশের মাটিতে বসে বাংলাদেশ বিরোধী ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে নির্বিঘ্নে, দম্ভের সহিত। এছাড়া যারা কেবলমাত্র বন্দুকের গুলি চালিয়ে এ হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছে, তারাই কি একমাত্র অবরাধী? বা বিচারের সম্মুখীন হওয়ার, শান্তি পাওয়ার উপযোগী? যারা এ হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপট তৈরি করেছে তারা কি নিষ্পাপ? যারা সমর্থন-সহযোগিতা জুগিয়েছে? বিভিন্ন দফতর-ভবনে বসে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অবদান রেখেছে? মন্ত্রী, এমপি, সংসদে বিরোধী দল, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী করেছে? তারা কি গণনার ভেতর আসবে না? তারা কি দেশ, রাষ্ট্র ও জাতির পিতার সাথে অস্তিত্বের সাথে, প্রগতি ও অগ্রগতির ধারামুখের সাথে বেইমানি করেনি? অপরাধ করেনি? অবশ্যই করেছে। এবং এ কারণে এ নরপশুগুলোরও উপযুক্ত বিচার ও শান্তি নিশ্চিত করতে হবে। কেবলমাত্র বন্দুক দিয়ে গুলি চালানো পাষণ্ডগুলোর বিচার করতেই যেখানে আমাদের ৩৪ বছর সময় লেগেছে, সেখানে বাকিগুলোর বিচার করতে কতোদিন সময় লাগবে? যতদিনই লাগুক না কেন, এদেশের সাধারণ মানুষ, মাটি-ফুল-ফল-বৃক্ষ-পাখি, সমুদ্র-পাহাড়, লাল-সবুজের পতাকা, আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি। নিষ্পাপ শিশু, স্বপ্নময় প্রতিটি প্রজন্ম শত-সহস্র বছর অপেক্ষা করবে তাদের পিতার নির্মম হত্যাকাণ্ডের উপযুক্ত বিচার পাওয়ার আশায়।
বাংলাদেশের ইতিহাসে নির্মম-নৃশংস, মানবতার বিরোধী দুইটি হত্যাকাণ্ড হলো- একাত্তরে বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের দ্বারা নির্বিচারে মানুষ হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট এবং পঁচাত্তরে সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা। এই দুই হত্যাকাণ্ডে জাতি হিসেবে আমাদের লজ্জিত করে, কলঙ্কিত করে। এই লজ্জা ও কলঙ্কের কালিমা জাতির ললাট থেকে দূর করেছেন জাতির জনকের কন্যা শেখ হাসিনা তার অসীম সাহসিকতা দিয়ে। একাত্তরের মানবিধার বিরোধী অপরাধের বিচার এখনও চলমান। আমরা জননেত্রী শেখ হাসিনার ওপর পূর্ণ আস্থা স্থাপন করি। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামিদেরও দেশে ফিরিয়ে এনে দণ্ড কার্যকর করে দেশ ও জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করবেন একমাত্র তিনিই। তার সাহসিকতা ও অসীম নিষ্ঠার প্রতি আমাদের সমর্থন অটুট থাকবে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। জাতীয় শোক দিবস এই শক্তিতেই আমাদের বলীয়ান করে প্রতি বছর।
লেখক: সাবেক সাধারণ সম্পাদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগ ও পরিচালক, সিআরআই।