আনিস আলমগীর
১৫ আগস্ট ২০০৭। শেখ হাসিনা তখন নির্জন বন্দিশালায়। সংবাদটি প্রচার হওয়ার পর মুহূর্তেই প্রথম কলটি আসে ভোরের কাগজ সম্পাদক শ্যামল দত্তের কাছ থেকে। ‘একটা অসাধারণ কাজ করেছিস দোস্ত। আমার শরীরের সব লোম খাড়া হয়ে গেছে,’ শ্যামলের কণ্ঠে আন্তরিক ধন্যবাদের ভাষা। ওকে কী বলবো, কথা বলতে পারছিলাম না। পুরো অফিসও স্তব্ধ। উত্তেজনা আর আনন্দ অশ্রু আমার চোখে। এক দুই বছর নয়, ৩২ বছর বাক্সবন্দি ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যাকাণ্ডের নৃশংস এই ফুটেজ। ৩২ নম্বর সড়কের সেই রক্তাক্ত প্রামাণ্য ইতিহাস। এতদিন বঙ্গবন্ধুকে হত্যা মানে সিঁড়িতে পড়ে থাকা তার লাশের সেই স্থির চিত্র। আজ থেকে ভিন্ন ছবি। বঙ্গবন্ধু নয় শুধু, দেখতে পাচ্ছি শেখ কামাল, শেখ জামালের রক্তাক্ত নিথর দেহও। সিঁড়িতে বঙ্গবন্ধুর লাশের পাশে বুট পরা পা দেখা যাচ্ছে হত্যাকারীদের।
তারপর সারাদিন ফোন আর ফোন। বৈশাখী টিভি তখনও তেমন নামকরা চ্যানেল নয়। অনেকে বলতেন দেখা হয় না। কিন্তু সারাদেশ থেকে, বৈশাখীর ল্যান্ডলাইনে যে হারে ফোন আসছিল, হিমশিম খেতে হচ্ছিল টেলিফোন অপরেটরকে। সবার এক কথা প্রায় একই রকম- এতদিন কই ছিল বঙ্গবন্ধুর এই ফুটেজ! কী করে পেলেন আপনারা! ধন্যবাদ অফুরান। মানুষ বৈশাখী সংবাদ দেখে কী দেখে না-হেড অব নিউজ হিসেবে সেই বার্তাটিও পেয়ে যাই ওইদিন।
সেদিন আরেকটা প্রমাণও পাই। আমি এতদিন শুনে আসছিলাম, আওয়ামী লীগের সংগঠন দেশের আনাচে কানাচে। সেদিন বাস্তবে প্রমাণ পেলাম। আওয়ামী লীগের কোনও এক ওয়ার্ড নেতা, সভাপতি পরিচয় দেওয়া লোকটির আবেগ উচ্ছ্বাসের কথা শুনে। বেশিরভাগ ফোন মফস্বল থেকে ছিল। তখন ড. ইউনূস আর ফেরদৌস কোরেশী ছাড়া সবার জন্য নিষিদ্ধ রাজনীতি। গৃহবন্দি জননেত্রী এবং আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা।
হঠাৎ হন্তদন্ত হয়ে আমাদের তখনকার সিইও ম. হামিদ নিউজ রুমে এলেন। তিনি এতক্ষণ অফিসে ছিলেন না। এসেই জবাবদিহি করতে চাইলেন-আমাকে কেন জানাওনি, এতো বড় ঘটনা। আমি শুধু বললাম, আপনাকে জানানো হয়তো আমার উচিত ছিল। কিন্তু এই সময়ে এটি প্রচারের কারণে যদি কোনও বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়, তার দায় যেন আপনি আমার ওপর ছেড়ে দিতে পারেন সে কারণে জানাইনি। যারা প্রশ্ন তুলবে তাদের যাতে সত্য কথাটা বলতে পারেন। সত্যিইতো আপনি কিছুই জানেন না। আর সবচেয়ে বড় কথা, জানালে আপনি প্রচার করতে দিবেন—এমন কোনও নিশ্চয়তা ছিল কি? প্রায় সারাজীবনই বিটিভিতে চাকরি করেছেন উনি, উনাদের পক্ষে এটা প্রচারের সিদ্ধান্ত দেওয়া কঠিন-এটাতো আর সরাসরি ওনাকে বলতে পারছি না। হামিদ সাহেবও কথা বাড়াননি আর।
সাড়ে ১২টার সংবাদে প্রথম প্রচার হলো। তারপর আড়াইটা, সাড়ে চারটা, সাড়ে ছয়টা, রাত সাড়ে আটটা, সাড়ে দশ, সাড়ে ১২টা—সব কয়টা সংবাদে গেল শীর্ষ খবর হিসেবে। ম. হামিদ তাৎক্ষণিক কিছুই বলেননি বটে তবে বিকেলে জানালেন টেলিফোনে ধন্যবাদ পেতে পেতে অস্থির হয়ে গেছেন। উনি বৈশাখীতে সবে জয়েন করেছেন। সবাই ভাবছেন এটা তারই কাজ। তখন উনি উৎফুল্ল। একদিক থেকে তিনি দায়িত্ব এড়াতে পারছেন আমি তাকে না জানিয়ে কাজটা করেছি বলে, আবার প্রশংসাও পাচ্ছেন। আমি বললাম, আপনি করেছেন জানলেও সমস্যা নেই স্যার, সিইও হিসেবে আপনারতো এই প্রশংসা প্রাপ্যই। মুসিবতের দায়িত্ব আমারই থাক।
আসলে উনি কিংবা টিভির মালিক পক্ষ নয়- পুরো অফিসই জানে না কী করে ঘটলো এটি। সব কিছু ছিল চরম গোপনীয়তায়। যদি অসতর্কতায় মিশন ফেল হয়, এই ভয় কাজ করেছিল। শুধু জানতো আমাদের প্রধান ভিডিও এডিটর সাহিল। আর একজনও না। কীভাবে বাস্তবায়ন হবে সেটার একটা পরিকল্পনাও ঠিক করে নিয়েছিলাম আমি আর সাহিল।
সত্যিকার অর্থে পরিকল্পনা আরও সপ্তাহখানেক আগে। বিশ্বস্ত সূত্র থেকে যোগাযোগ। বঙ্গবন্ধু হত্যার সেই ঐতিহাসিক ফুটেজটা আমাকে দিতে চান একজন। আমি রাজি। কিন্তু শুধু আমাকে কেন সে প্রশ্ন করেছিলাম। বলেছে, আস্থা আছে এবং এটাকে নিয়ে আমি বেচা-বিক্রি করবো না। একমাত্র আমিই পারবো সেটা প্রচার করতে ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি ভরসা রাখতে বলেছিলাম এবং দেখা না দেওয়া সোর্স যথাসময়ে ফুটেজও হস্তান্তর করেছে। প্রথম যেদিন সাহিলকে নিয়ে গভীর রাতে প্যানেলে ফুটেজ দেখছিলাম, বলতে পারবো না কতটা ব্যথিত, আবার কতটা গুপ্তধন পাওয়ার মতো উত্তেজিত হয়েছিলাম। নিজের মাঝে কেমন মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়েছিল। সেই ক’দিন আমি ঘুমাতে পারিনি ঠিক মতো। অপেক্ষা, কবে আসবে ১৫ আগস্ট!
১৪ আগস্ট ২০০৭। বঙ্গবন্ধুর ৩২ নম্বর রোড়ের সামনে শ্যুটিং করতে গেলাম। সঙ্গে আমাদের প্রধান ক্যামেরাম্যান আব্দুর রহমান। সকালের দিক ছিল তখন। ধানমণ্ডি থানার পুলিশ এসেছে, সেখানে কোনও প্যান্ডেল করা যাবে না- এই নির্দেশ নিয়ে। প্যান্ডেলের উদ্দেশ্যে আনা বাঁশগুলো সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। কোনও নেতা-কর্মী নেই বললেই চলে। মহিলা আওয়ামী লীগের একজন নেত্রীকে পেলাম, ধানমণ্ডিতে থাকেন। শেখ হাসিনা তখন জেলবন্দি। একমাসও হয়নি, ১৬ জুলাই তাকে বন্দি করা হয়েছে। খালেদা জিয়া তখনও মুক্ত তবে গৃহবন্দির মতোই। শ্যুটিং শেষেও অপেক্ষা রাত গভীর হওয়ার জন্য। এডিট যখন হচ্ছে তখন আমি আর সাহিল শুধু অফিসে। দিনের ফ্রেশ বুলেটিন আমাদের তখন সাড়ে ১০টায়। কোনও কারণে যদি প্রচারের পর বাধা আসে কম সংখ্যক দর্শক দেখতে পাবে মাত্র। সেই চিন্তায় ১৫ আগস্ট সাড়ে ১০টায় নয়, সাড়ে ১২টায় প্রথম প্রচারের সময় নির্ধারণ করি। বাকিটাতো বলেছি।
এই ফুটেজ প্রচারের পর বেশ কয়েটি ঘটনা ঘটে। পরদিনই বিশেষ পাড়া থেকে ডাক আসে দেখা করার জন্য। হাজিরা দিলে জানতে চাওয়া হয় কোথায় পেলাম। উত্তর রেডি করা ছিল। সেটাই বলেছি সামনা সামনি বসে। নাঈমুল ইসলাম খানের সম্পাদিত পত্রিকা ‘আমাদের সময়’ ওয়ান ইলাভেন কালে বিখ্যাত। তারাও জানতে চাইলো বঙ্গবন্ধু হত্যার ৩২ বছর পর ৩২ নম্বরের ঘটনার এই ফুটেজ কীভাবে পেলাম। আমি জানালাম। জানতে চাইলাম কোনও স্থির লাগবে কী? সম্পাদক নাঈম ভাই জানালেন, ফুটেজ থেকে নেওয়া কিছু স্থির চিত্র ইতিমধ্যে তাদের হাতে এসে গেছে। আমি ধরে নিয়েছি ‘বিশেষ জায়গা’ থেকে দেওয়া হয়েছে। আমি পুরো ঘটনাই বললাম সাক্ষাৎকারে। পরদিন প্রথম পাতায় লিড নিউজ আকারে আসলো আমাদের সময় পত্রিকায়। ৩২ নম্বরের সেই ফুটেজ সংগ্রহের কথা।
ঘটেছে আরও অনেক কাহিনী। তবে যে কাহিনী না বললে অসম্পূর্ণ থেকে যায় এই কাহিনী সেটা আজ বলতেই হচ্ছে। ২২ আগস্ট ধানমণ্ডির ২৭ নম্বর রোড়ে কারফিউর মধ্যে থামানো হয়েছিল আমার গাড়ি। বৈশাখীর লোগো লাগানো গাড়ি সেটি। পোশাক পরা সৈনিক নয়, অফিসার চিনেছিলেন এবং কাঁচা কাঠ দিয়ে প্রায় ভেঙে দিয়েছিলেন দুটি পা। সারা ধানমণ্ডি মোহাম্মদপুর ঘুরিয়ে রেখে গিয়েছিলেন মোহাম্মদপুর থানায়। পেটানোর সময় নিজের নাম খচিত ব্যাচটি জামা থেকে খুলে রেখেছিলেন সেই বীরপুরুষ।
এই লেখা শেষ করবো দুটি অভিজ্ঞতা জানিয়ে। এই দেশের মিডিয়া মালিক এবং সাংবাদিকরা সময়ের সঙ্গে চলেন। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মিডিয়ার যে চিত্র ছিল, ২০০৭ সালে শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার করার পরের মিডিয়ার ভূমিকাও সেরকমই ছিল অনেকটা। ২০০৭ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার করেনি কোনও টিভি। একমাত্র বৈশাখীতে দায়িত্ব নিয়ে প্রচারের ব্যবস্থা করেছিলাম। সায় ছিল আমাদের এমডি কে এম শহীদ উল্লাহর।
২০০৭ সালে যখন বঙ্গবন্ধুর ওই দুর্লভ ভিডিও প্রচার করা হয় তখন ১৫ আগস্ট পালনের সংবাদও গুরুত্ব পায়নি সিংহভাগ টিভিতে। রাতারাতি চিত্র পাল্টে যায় ২০০৮ সালের ৭ মার্চ এবং ১৫ আগস্ট। রীতিমতো ‘বঙ্গবন্ধু বঙ্গবন্ধু’ জিকির করতে থাকে তখন তারা। কারণ, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছিল। আর শেখ হাসিনাকে গদিতে রেখে তারাতো এখন বঙ্গবন্ধু জিকিরে শেখ হাসিনাকেও পেছনে ফেলে দিতে চাইছেন। চারিদিকে এখন ‘বঙ্গবন্ধু প্রেমিক’। পোশাকেও বঙ্গবন্ধু।
লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক