আবুল মোমেন
১৯৬২ সালে নিজের উচ্চাভিলাষ পূরণের পথে আইয়ুব খান রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অনুমোদন দিলে নতুন কলেবরে আবির্ভূত আওয়ামী লীগের মূল নীতিনির্ধারক হয়ে ওঠেন তরুণ সংগঠক শেখ মুজিব। বয়োবৃদ্ধ নেতা সোহরাওয়ার্দী তখন অসুস্থ এবং কিছুদিনের মধ্যে তাঁর তিরোধানও ঘটে যায়। সেই থেকে শেখ মুজিবের অগ্রযাত্রা। স্বৈরাচারী আইয়ুবের সব বাধা, প্রতিরোধ, চক্রান্ত ও নিষ্ঠুর জুলুম তাঁর নেতৃত্বকে কেবল শাণিত, ভাস্বর করেছে এবং এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী শীর্ষে তুলে দিয়েছে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা হয়ে এই অপ্রতিহত অগ্রযাত্রার শিখর স্পর্শ করলেন নেতা একাত্তরের সাতই মার্চের ভাষণে। তত দিনে তিনি বঙ্গবন্ধু, এক দেশের এক নেতা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনার আবালবৃদ্ধবনিতার অন্তরের ঠিকানা। একাত্তরের পঁচিশে মার্চের মধ্যরাতে গ্রেপ্তার হওয়া পর্যন্ত তিনিই নবজাগ্রত বাঙালি জাতির চালিকা শক্তি, পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে আসন্ন চরম বোঝাপড়ার অবিসংবাদী নেতা, অনুসারীদের ভরসা, জনতার প্রেরণা ও পথপ্রদর্শক।
সাড়ে নয় মাস পর ১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি যখন পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে ঢাকায় ফিরে এলেন, তখন বঙ্গবন্ধু যেমন তাঁর নিজের বহুদিনের লালিত স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নপূরণে অভিভূত, তেমনি সেই স্বপ্ন বাস্তব রূপলাভের ফলে কোটি মানুষের মনে জাগ্রত বহুমাত্রিক স্বপ্ন পূরণের দায় তাঁর কাঁধেই হলো ন্যস্ত। বঙ্গবন্ধু গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়নকে অগ্রাধিকার দিলেন, কোটি শরণার্থীর প্রত্যাবাসনে যেমন, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের বান্ধব ভারতের সেনাবাহিনী প্রত্যাহারেও সময়ক্ষেপণ করেননি, অগ্রাধিকার দিলেন যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনে আর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বন্ধুবলয় তৈরির ওপর। তবে একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক আধুনিক রাষ্ট্র তৈরির স্বপ্ন বাস্তবায়নের কাজটা সহজ ছিল না। মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এবং সেই সময়কার বিশ্ববাস্তবতা তরুণদের একটি অংশের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ার বিপ্লবী স্বপ্ন বুনে দিয়েছিল। আবার যুদ্ধ-পরবর্তী স্বাধীন দেশে শাসনব্যবস্থা পোক্ত হওয়ার আগেই একদল নেমে গিয়েছিল ব্যক্তিস্বার্থ সিদ্ধি ও বেপরোয়া লুটপাটে। অনেকে যুদ্ধের মৌতাত কাটাতে না পেরে সেই উন্মাদনায় সমাজে নানা বিকারের জন্ম দিয়েছিল। তখনকার পরিবেশে বর্ণচোরাদের পক্ষে রাষ্ট্রশক্তিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহারে তেমন অসুবিধাও হয়নি। বলা যায়, ঘরে-বাইরে কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন হয়েছিলেন প্রশাসক বঙ্গবন্ধু। তিনি স্বভাবত সাহসী, আশৈশব সার্থক সংগঠক, যৌবন থেকেই তাঁর নেতৃত্ব আপসহীন, লক্ষ্যভেদী। ফলে স্বাধীনতা-পরবর্তী বাস্তবতায় নেতা মুজিব কখনো অসহায় বোধ করেছেন, কখনো অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু হাল ছাড়ার কোনো উপায়ও ছিল না, আর সেটা তাঁর ধাতেও ছিল না। পথের বাধা দূর করতে রক্ষী বাহিনী গঠন করা হলো, বিশেষ ক্ষমতা আইন পাস হলো, একাত্তরের অপরাধীদের বড় অংশকে সাধারণ ক্ষমা দেওয়া হলো, শেষে সমমনা সব দলকে নিয়ে গঠন করলেন বাকশাল।
তাঁকে ঘিরে ক্ষমতার যে বলয়, তার ভেতরে দৃষ্টি দিলে বোঝা যাবে তাঁর জন্য পরিস্থিতি কতটা জটিল এবং কঠিন ছিল। সামরিক বাহিনীতে মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তান প্রত্যাগতদের বিরোধ বিবদমান দুটি পক্ষ তৈরি করেছিল। আর শাসক বঙ্গবন্ধুর তৎকালীন প্রতিক্রিয়ায় বোঝা যায়, নিজ দলের নেতা-কর্মীদের কর্মকাণ্ড নিয়ে তিনি স্বস্তিতে ছিলেন না। নানা মহল থেকে সমালোচনার কণ্ঠস্বরের জোর এবং বিস্তার উভয়ই বাড়ছিল। জাসদ এবং অন্যান্য কট্টর বামপন্থী দলগুলোর সশস্ত্র চরমপন্থার দিকে ঝোঁক, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রায় যুদ্ধ ঘোষণা এবং সমাজে অস্থিরতা-নৈরাজ্য সৃষ্টির চেষ্টা নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিকে অকার্যকর করে ফেলেছিল। বাকশালের মাধ্যমে এ পরিস্থিতি থেকে বেরোনো যেত কি না, সেটি পরীক্ষা করার সুযোগ আর বঙ্গবন্ধু পাননি।
১৫ আগস্ট ভোররাতে বঙ্গবন্ধু যখন নিজ বাসভবনে সপরিবার নিহত হন, তখন মাত্রই বাকশালের অঙ্গীভূত আওয়ামী লীগের মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীরা তাঁদের নতুন নেতৃত্ব, সাংগঠনিক কাঠামো বা পরিবর্তিত অবস্থার রাজনীতি ইত্যাদি অনুধাবনের কোনো দিগ্দিশা পায়নি। চার শীর্ষ নেতার কারাবন্দিত্ব, অপর এক শীর্ষ নেতার সম্পূর্ণ ভোল বদল এবং সামরিক বাহিনীর চেইন অব কমান্ডের অকার্যকারিতা এবং তার মধ্যে কতিপয়ের দস্যুতা বাকশালভুক্ত দলগুলোর রাজনৈতিক কর্মীদের প্রাথমিক সতর্কতার বারতাই দিয়েছিল। ফলে ইতিহাসের এত বড় হত্যাকাণ্ড ও পালাবদল সত্ত্বেও তাৎক্ষণিকভাবে তার উপযুক্ত রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া-প্রতিরোধ ঘটেনি মাঠপর্যায়ে। বরং তখন দলের অনেক জ্যেষ্ঠ নেতার মুখে যেমন নানা উল্টোপাল্টা কথা শোনা গেছে, তেমনি সাংগঠনিক ক্ষেত্রেও বিভ্রান্ত ও কোন্দল দেখা গেছে। এর মধ্যেও জোহরা তাজউদ্দীনের সাহসী নেতৃত্বের কথা স্মরণ করতে হবে। বিপরীতে জাসদ ছিল সক্রিয়, তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল সামরিক বাহিনীর কিছু জওয়ান এবং দলের ভেতরে আশ্রয় নিয়ে তৎপর ছিল জামায়াতসহ একাত্তরের পরাজিত অনেক শক্তি।
দুই.
১৯৬৬-র জুনে ছয় দফা ঘোষণার পর থেকে আগস্ট ১৯৭৫-এ নিহত হওয়া পর্যন্ত নয় বছর এ দেশের মানুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে একটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ কায়েমের জন্য টানা সংগ্রাম করেছে এবং মুক্তিযুদ্ধ শেষে স্বাধীনতার পর সাংবিধানিক পথে সেই দেশটি গড়ে তোলার সুযোগ পেয়েছিল। মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধুর আকস্মিক নির্মম হত্যাকাল সেই সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেল—প্রাপ্ত সময়টুকু ঠিকভাবে কাজে লাগানো হয়েছিল কি না, সে প্রশ্ন অবশ্য থাকল। পট পরিবর্তনের পর নেপথ্য থেকে দৃশ্যপটে প্রত্যক্ষ ভূমিকায় হাজির হয়ে জেনারেল জিয়া রাষ্ট্রের অভিমুখ পাল্টে দিলেন। আজ মনে হয়, পনেরো আগস্টের হত্যাকারীরা বঙ্গবন্ধুর সম্ভাব্য বংশধরদের নির্মূল করতে চেয়েছিল এই ভেবে যেন তাঁর সঙ্গেই তাঁর ধারার রাজনীতির চির-অবসান ঘটে ও তাদের ধারার রাজনীতি বাধামুক্ত থাকে। মুক্তিযুদ্ধের অর্জন বিসর্জন দিয়ে প্রত্যাখ্যাত পাকিস্তানি ধারার ধর্মান্ধতা ও মুসলিম জাতীয়তার রাজনীতি গ্রহণ করলেন জিয়া। এরপর ধীরে ধীরে স্পষ্ট হলো বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের রাজনীতিতে এক বিভাজনরেখা তৈরি করেছে। পঁচাত্তর-পূর্ববর্তী বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতির মূলধারা ছিল অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক, এটি ক্রমে এক অভূতপূর্ব জাতীয় ঐক্য ও জাতীয় জাগরণ সৃষ্টি করে দেশের স্বাধীনতা সম্ভব করেছিল। আর পঁচাত্তর-পরবর্তী রাজনীতিতে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে পাকিস্তানি কায়দায়, অর্থাৎ সরকারি সব যন্ত্র, দপ্তর, নীতি, আইন ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ধর্মান্ধতা ও মুসলিম জাতীয়তার প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতিকে পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়েছে। ঠিক পাকিস্তানি কায়দায় প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে ভারতপন্থী ও ইসলামবিরোধী আখ্যা দিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি ও বিভাজন সৃষ্টির প্রক্রিয়া জোরদার হয়।
এবারে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত প্রায় দুই দশকের ধারাবাহিক আন্দোলন-সংগ্রাম সত্ত্বেও অধিকাংশ মানুষ দেশের লক্ষ্যাদর্শ সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট অবস্থানে পৌঁছাতে পারেনি। সংগ্রামের ময়দানে উচ্চারিত বক্তব্য অধিকাংশের চিন্তাচেতনাকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়নি। ফলে জিয়াউর রহমানের পক্ষে জামায়াতের পুনরুজ্জীবন, যুদ্ধাপরাধীদের পুনর্বাসন, বঙ্গবন্ধু ও চার জাতীয় নেতার হত্যার বিচার রুদ্ধ করা কিংবা তাঁদের অবদানের অস্বীকৃতি, রাষ্ট্রের নীতিতে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা প্রচলন প্রায় বিনা বাধায় সম্ভব হয়েছিল। আমরা দেখলাম, ভারতবিরোধিতা ও ইসলাম বিপন্ন এমন ধুয়া তোলা রাজনীতি—এমনকি এখনো—মানুষের সমর্থন আদায় করতে সক্ষম। এর ভেতরেও অবশ্যই সমাজের নানা স্তরে, বিশেষত সংস্কৃতিকর্মী, ছাত্রসমাজ, পেশাজীবী সংগঠনসমূহ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন শুরু করেছিল।
সেই থেকে অনেক উত্থানপতন সত্ত্বেও জাতি দ্বিধাবিভক্তই রয়েছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এই দুটি বড় দল দুই ধারার রাজনৈতিক মুখপাত্র হিসেবে গণ্য হলেও ক্ষমতার রাজনীতির খেলায় চেতনার অঙ্গীকার অনড় ও স্থির থাকছে না। আমরা লক্ষ করছি, সামগ্রিকভাবে ধর্মীয় পরিচয় ও ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের দিকে রাজনীতির ঝোঁক বাড়ছে। এর প্রাথমিক কারণ অবশ্যই মুসলিম সমাজে বিজ্ঞান ও যুক্তিভিত্তিক জ্ঞানচর্চার মতো উপযোগী কোনো সংস্কার আন্দোলনের অভাব। তবে অপর কারণটিও বেশ জোরালো, পশ্চিমের যেসব উন্নত দেশ থেকে উদারনৈতিক গণতন্ত্রের ধারণাটি এসেছিল, তাদের এক-এগারোপরবর্তী ভূরাজনৈতিক তৎপরতা সরাসরি সুনির্দিষ্টভাবে কিছু মুসলিম দেশ এবং সাধারণভাবে মুসলিম সমাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, তারা অবমাননা ও চরম নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর প্রতিক্রিয়ায় মুসলিম জাতীয়তাবাদের জঙ্গি-সন্ত্রাসী রূপও আমরা দেখতে পাচ্ছি।
তিন.
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের অভূতপূর্ব অর্জন ছিল ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-দেশনির্বিশেষে প্রায় সব বাঙালিকে জয় বাংলার চেতনায় এক লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ ও এক উদ্দীপনায় জাগিয়ে তোলা—যার কোনো দৃষ্টান্ত আগে দেখা যায়নি। কিন্তু খুব আশ্চর্যের বিষয় হলো, স্বাধীনতার পর ঐক্যের সেই উদ্দীপনা বিসর্জন দিয়েছিল মানুষ—নেতা মুজিবের প্রাণান্ত চেষ্টাও কার্যকর হয়নি।
এ সময় একদিকে রাষ্ট্রের লক্ষ্যাদর্শের পরিকল্পিত ভোল পাল্টানো ও নতুন চরিত্র গ্রহণ আর অন্যদিকে সমাজচেতনার পশ্চাৎপদতা প্রগতির রাজনীতির সামনে কঠিন চ্যালেঞ্জ দাঁড় করিয়েছিল। ১৯৭৫-এর পর থেকে গণতান্ত্রিক রাজনীতি ঘুরপাক খেয়েছে ক্ষমতা পুনরুদ্ধারে বা তার অংশীদার হওয়ার বৃত্তে, সমাজ থেকে জনগণের অধিকার আদায়ে নতুন কোনো ইস্যু বা ধারা তৈরিও সম্ভব হয়নি, সব প্রয়াস ক্রমে মসনদের রাজনীতিতেই বাঁধা পড়েছিল।
দেশের এবং রাজনীতির এই কঠিন সময়ে বুকে ব্যক্তিগত বিপুল শোকের বোঝা নিয়ে শেখ হাসিনা পিতার প্রতিনিধি হিসেবে দল আওয়ামী লীগে ঐক্যের প্রতীকরূপে দেশে ফিরলেও ইতিহাস তাঁর কাঁধে জাতীয় রাজনীতির মূল চরিত্ররূপে নিজেকে নির্মাণের দায়িত্ব অর্পণ করেছিল। জনপ্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের কন্যা হিসেবে শৈশবে বাড়িতেই রাজনীতিতে হাতেখড়ি হয়েছে তাঁর, কলেজে আন্দোলন-সংগ্রামের প্রত্যক্ষÿপরিচয় ঘটেছিল। তবু ১৯৮১-র বাস্তবতায় তাঁর জন্য দলে পিতার সহযাত্রী অভিভাবক গোষ্ঠীর মুখাপেক্ষী হওয়াই ছিল স্বাভাবিক। সম্ভবত ঠেকে ঠেকে অর্জিত অভিজ্ঞতায় তিনি এঁদের পরামর্শের কার্যকারিতা নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। এ বাধা ক্রমে তিনি অতিক্রম করেছেন। কিন্তু স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মাত্র তিন মাসের মাথায় ব্যক্তিগত শোকে নিমজ্জিত অবস্থায় তাঁকে সামরিক শাসক জেনারেল জিয়ার নিহত হওয়ার মতো চরম রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার সম্মুখীন হতে হলো। তখন মাত্রই নিহত জেনারেল-রাষ্ট্রপতির শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র ও গণ-আন্দোলনের সূচনা হচ্ছিল, যার পরিণতি এরশাদের মতোই হতো। তবে আকস্মিক সেনা অভ্যুত্থানে নিহত হওয়ায় সে আন্দোলনও তুঙ্গে ওঠেনি, তাঁর ভাবমূর্তির নেতিকরণেরও অবকাশ মেলেনি। ফলে এ দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতি ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির কোনো শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা ছাড়াই তাঁর সদ্য বিধবা পত্নী দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির অপর প্রধান নেতা হিসেবে জায়গা পেয়ে গেলেন। এ অনেকটাই রূপকথার বাস্তবতার মতো ব্যাপার যেন—মূল চরিত্রের পরিচয়-বিভ্রাট থেকে সাধারণের মনে সত্য নিয়ে বিভ্রান্তি।
কিন্তু ছলনা ও বিভ্রান্তি ক্ষমতার রাজনীতিরই অংশ। যেহেতু মানুষের মনে ভারত-ভীতি আর ইসলামের বিপন্নতার ভয় ঢোকানো সম্ভব হয়েছে, তাই অন্যায় বা ভুল হলেও জনসমর্থনে এর ভূমিকা তো থাকছেই। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ অবশেষে বিরুদ্ধ পক্ষের রাজনীতির মূল দুই গুঁটি নিষ্ক্রিয় করে দেওয়ার পথেই নামল। ১৯৪৯-এ মুসলিম লীগের ওপর হতাশ হয়ে একদিন তরুণ মুজিব, প্রবীণ ভাসানীসহ আরও অনেকে মিলে আওয়াম বা জনগণের মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। তারপর ভাষা আন্দোলন নতুন চেতনার জন্ম দিলে দলের ধর্মভিত্তিক পরিচয়ই যেন বোঝা হয়ে দাঁড়ায়। জন্ম নিল অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক দল আওয়ামী লীগ। এখন প্রতিপক্ষের ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে নিষ্ফল করে দিতে আওয়ামী লীগ ধর্মীয় সংস্কৃতি, পরিচয়কে দলের রাজনীতিতে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে। আবার নয়-এগারোপরবর্তী বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে উদারনৈতিক গণতন্ত্রের প্রবক্তা পশ্চিমের দেশে দেশে ইসলাম ও মুসলিম সমাজ সম্পর্কে যে নেতিবাচক প্রচারণা চলেছে, ইরাক-লিবিয়া-সিরিয়া-আফগানিস্তানসহ বিভিন্ন মুসলিম-অধ্যুষিত দেশে দেশে যে যুদ্ধাবস্থা চালিয়ে ধ্বংস ও মানবিক বিপর্যয় চালানো হচ্ছে, তার প্রতিক্রিয়ায় মুসলিম দেশ ও সমাজে নানা জঙ্গি-সন্ত্রাসী গ্রুপের জন্ম হচ্ছে। এটা ঠেকাতেও শান্ত ও সাম্যের ইসলামকেই তো ব্যবহার করতে হবে। এ-ও যেন আরেক রূপকথার বাস্তবতা—অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল চিন্তাচেতনা ও সংস্কৃতিচর্চার জন্য ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে হবে ধর্মীয় জাতীয়তা ও আরও পশ্চাৎপদ ধর্মান্ধ চিন্তার সঙ্গে আপসকামী রাজনীতিকে।
এই পরিণতির জন্য কেবল আওয়ামী লীগকেই দায়ী করলে ঠিক হবে না, আবার পনেরো আগস্টের দুর্ঘটনা না ঘটলে এমনটা হতো না—এই ভাবনাও হবে জটিল বাস্তবতার সরলীকরণ। এ পরিণতির জন্য বাইরের অর্থাৎ পুঁজিবাদী পশ্চিমের দায় ছাড়াও আমাদের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার দায়ও কম নয়। সনাতন ধর্মীয় চিন্তা ও সংস্কৃতির সঙ্গে রেনেসাঁস থেকে শুরু করে শিল্পবিপ্লবোত্তর সমাজে যেসব ব্যবহারিক পরিবর্তন ঘটেছে সেসবের দর্শন ও চিন্তার সঙ্গে সম্যক পরিচয়, বোঝাপড়া ও সংগতিসাধনের চর্চায় আড়ষ্টতা, ব্যর্থতা সমাজকে অনেক ক্ষেত্রে অকার্যকর করে রেখেছে। এর দায় সমাজের ইসলামি ও সেক্যুলার উভয় ধারার চিন্তাবিদদের। আজ আলেমসহ সবাই বিজ্ঞানের সূত্রে নানা উপকরণ ও প্রযুক্তিতে এবং আধুনিক রাষ্ট্র ও জীবনব্যবস্থায় অভ্যস্ত হলেও এর পেছনের বিজ্ঞান ও নানা বিদ্যার সত্য, দর্শন ও চিন্তাচেতনাকে আমাদের ভাবনায় স্থান দিচ্ছি না। তাতে সমাজটি বহিরঙ্গে সমকালীন ও গতিশীল হলেও অন্তরঙ্গে বয়ে চলেছে চিন্তার অচলায়তন আর স্থবিরতা। সে কারণেই পনেরো আগস্টের মতো ঘটনার অভিঘাতে এক ধাক্কায় আগের সব অগ্রগতি হারিয়ে সমাজমানস রাতারাতি নিঃস্ব হয়ে যেতে পারে। সেদিক থেকে আমাদের সমাজচেতনা এখনো দুর্বল, ভঙ্গুর। অর্থনীতির পাশাপাশি যুগোপযোগী সমাজমানসকে টেকসই করা আজ জরুরি কাজ। স্বাধীনতাকে প্রকৃতই অর্থপূর্ণ আর গণতন্ত্রকে টেকসই করার পথে এই আরব্ধ কাজ সম্পন্ন না করে এগোনোর উপায় নেই। রাজনীতিতে তখনই বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত উত্তরাধিকার তৈরি হবে, যখন কেউ জাতিকে আবারও ঐক্যবদ্ধ ও উদ্দীপ্ত করে এ পথে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হবেন। ইতিহাসের পথ খোলা আছে। কে সেই পথে জাতিকে নিয়ে এগিয়ে যাবেন, নেতৃত্ব দেবেন, তা দেখার জন্য ইতিহাস প্রতীক্ষায় উন্মুখ।
আবুল মোমেন কবি, শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক