তানভীর হোসেন
সমবেদনা জানিয়ে শহীদদের পরিবারে পাঠানো বঙ্গবন্ধুর চিঠিমুক্তিযুদ্ধে শহীদ ও তাদের পরিবারের প্রতি গভীর ভালোবাসা ছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। তাইতো দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই শহীদদের পরিবারে চিঠি পাঠিয়ে সমবেদনা জানান তিনি। আর সেই চিঠি এখনও আগলে রেখেছেন নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লা গঙ্গানগর এলাকার বাসিন্দা মো. আলী হোসেন (৫২)।
জানা যায়, ১৯৭১ সালের ২৯ নভেম্বর পাকহানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা ফতুল্লা থানার প্রত্যন্ত অঞ্চল বক্তাবলীর ২২টি পরগণায় নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায়। যেখানে ১৩৯ জন নিরীহ মানুষ প্রাণ হারান। যাদের একজন আলী হোসেনের বড় ভাই মোহাম্মদ হোসেন। এ ঘটনার পর ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু ওই চিঠি পাঠিয়ে সমবেদনা জানান শহীদ পরিবারের প্রতি।
এ বিষয়ে আলী হোসেন বলেন, স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ১৯৭২ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি চিঠির মাধ্যমে সমবেদনা জানান। এছাড়া প্রত্যেক শহীদ পরিবারকে দুই হাজার টাকা ও আহতদের জন্য পাঁচশ টাকা অনুদান দেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর আর কেউ তাদের খোঁজ নেয়নি। ফলে শহীদ পরিবারের স্বীকৃতিও তারা পাননি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে উল্লেখ ছিল,
প্রিয় ভাই/বোন,
আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে আপনার সুযোগ্য পুত্র/পিতা/স্বামী/মা/স্ত্রী আত্মোৎসর্গ করেছেন। আপনাকে আমি গভীর দুঃখের সাথে জানাচ্ছি আমার আন্তরিক সমবেদনা। আপনার শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতিও রইল আমার প্রাণঢালা সহানুভূতি।
এমন নিঃস্বার্থ মহান দেশ প্রেমিকের পিতা/পুত্র/স্বামী/স্ত্রী হওয়ার গৌরব লাভ করে সত্যি আপনি ধন্য হয়েছেন।
‘প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিল’ থেকে আপনার পরিবারের সাহায্যার্থে আপনার সংশ্লিষ্ট মহাকুমা প্রশাসকের নিকট ২ হাজার টাকার চেক প্রেরিত হল। চেক নম্বর সিএ ০০৫১৬। আমার প্রাণভরা ভালবাসা ও শুভেচ্ছা নিন।
ইতি
শেখ মুজিব।
তৎকালীন ডেপুটি কমান্ডার ও মুক্তিযোদ্ধা তমিজউদ্দিন রিজভী ওই হত্যাযজ্ঞের স্মৃতিচারণ করে বলেন, তারা মুজিব বাহিনীর অংশ হিসেবে প্রশিক্ষণ শেষ করে বক্তাবলী ও এর আশপাশ গ্রামে অবস্থান নেন। ওই সময়ে বক্তাবলী গ্রামে এক থেকে দেড়শ মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। নদীবেষ্টিত দুর্গম চরাঞ্চল হওয়ায় এলাকাটিকে নিরাপদ মনে করতেন মুক্তিযোদ্ধারা। বক্তাবলীতে অবস্থান করে মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন স্থানে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে অপারেশনের পরিকল্পনা করতেন।
তিনি আরও বলেন, ঘটনার দিন তথা ২৯ নভেম্বর ছিল প্রচণ্ড শীত। সকাল থেকেই ঘন কুয়াশায় আচ্ছন্ন ছিল পুরো এলাকা। ভোরের দিকে হঠাৎ করেই পাক বাহিনী গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ঁতে থাকে। অপ্রস্তুত মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা জবাব দেয়। উভয় পক্ষের মধ্যে সম্মুখ যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মুন্সিগঞ্জ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ব্যাটালিয়ন বক্তাবলীতে এসে এখানকার মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যোগ দিলে তাদের শক্তি বৃদ্ধি পায়। পরে তারা একত্রে পাক বাহিনীর সঙ্গে প্রায় চার ঘণ্টা একটানা যুদ্ধ চালায়। এ সময় মুক্তিযোদ্ধারা মোক্তারকান্দি কবরস্থানের সামনে কয়েকজন রাজাকারকে ধরে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়।
তমিজউদ্দিন রিজভী বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের উপুর্যপরি আক্রমণের মুখে পাক হানাদাররা পিছু হঠতে শুরু করে। এ সময় তারা রাজাকার, আল বদর, শামস বাহিনীর পরামর্শে তারা ১৩৯ জন নিরস্ত্র গ্রামবাসীকে ধরে এনে লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে। এতে নিহত হন শাহিদ, ফারুক, অহিদ, মনির, শাহ আলম, রহমতউল্লাহ, শামসুল, আলম, সালামত, খন্দকার, সুফিয়া, আম্বিয়া, খোদেজাসহ ১৩৯ জন। পিছু হটার সময় হানাদার বাহিনী পেট্রোল ও গান পাউডার দিয়ে বুড়িগঙ্গা ও ধলেশ্বরী পার সংলগ্ন বক্তাবলী পরগনার রাজাপুর ডিগ্রীর চর, মুক্তাকান্দি, গঙ্গানগর, রাম নগর, গোপাল নগর, রাধানগরসহ ২২টি গ্রাম পুড়িয়ে দেয়।