‘রাজনীতির কবি’র অমর কবিতা


মো. জাকির হোসেন 
কলামের শিরোনামটি অন্যের কাছ থেকে নেওয়া। ‘রাজনীতির কবি’ উপাধিটি বিশ্বখ্যাত সাময়িকী নিউজউইক, আর অমর কবিতা শব্দযুগল কবি নির্মলেন্দু গুণের কাছ থেকে ধার করা। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের ওপর প্রতিবেদন তৈরি করতে গিয়ে নিউজউইক পত্রিকা তাদের নিবন্ধ ‘দ্য পয়েট অব পলিটিক্স’-এ লিখেছিলো,‘৭ই মার্চের ভাষণ কেবল একটি ভাষণ নয়, একটি অনন্য কবিতা’। আর কবি নির্মলেন্দু গুণ বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের ওপর ‘স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো’ শিরোনামের কবিতায় লিখেছেন, ‘অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন/ তখন পলকে দারুণ ঝলকে তরীতে উঠিল জল/ হৃদয়ে লাগিল দোলা, জনসমুদ্রে জাগিল জোয়ার/ সকল দুয়ার খোলা। কে রোধে তাঁহার বজ্রকণ্ঠ বাণী/ গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তাঁর অমর-কবিতাখানি/ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম,/এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
মৃত্যুর কয়েক দশক পর ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি’র বিশ্বব্যাপী জরিপে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে অভিষিক্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণ পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণসমূহের একটি হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হয়েছে।  জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেস্কো ৭ মার্চের ভাষণকে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রামান্য ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ায় এটি এখন মানবজাতির অভিন্ন সম্পদে পরিণত হয়েছে।
বিখ্যাত ইতিহাসবিদ জ্যাকব এফ ফিল্ড বিশ্বের সবচেয়ে উদ্দীপক ও অনুপ্রেরণীয় বক্তব্যগুলো একত্রিত করে, ‘We Shall Fight on the Beaches: The Speeches That Inspired History’ শিরোনামে একটি সংকলন প্রকাশ করেছেন। এ সংকলনে সিসেরো থেকে উইনস্টন চার্চিল এবং আব্রাহাম লিংকন থেকে মাও সে তুংয়ের ভাষণের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর যুগোত্তীর্ণ এ ভাষণ সেই সময় থেকে বিশ্বব্যাপী দিকনির্দেশনামূলক ভাষণ হিসাবে প্রশংসিত ও আলোচিত হয়ে আসছে। দক্ষিণ আফ্রিকার অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছেন, ‘৭ই মার্চের ভাষণ আসলে স্বাধীনতার মূল দলিল’। গ্রেট ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ ৭ই মার্চের ভাষণ মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেছেন,‘পৃথিবীর ইতিহাসে যতদিন পরাধীনতা থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রাম থাকবে, ততদিন শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণটি মুক্তিকামী মানুষের মনে চিরজাগরুক থাকবে। এ ভাষণ শুধু বাংলাদেশের মানুষের জন্য নয়, সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের অনুপ্রেরণা’।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের কথা যখন চিন্তা করি তখন আপনা-আপনিই একটি বিষয় আমার মনে চলে আসে, সৃষ্টিকর্তা বুঝি বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশের জন্য বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে প্রেরণ করেছেন। মহান প্রভু বাংলার স্বাধীনতা বিষয়ে তাঁর পরিকল্পনা বঙ্গবন্ধুর মাধ্যমে বাস্তবায়ন করেছেন। সৃষ্টিকর্তা বোধ করি বঙ্গবন্ধুর মস্তিষ্ক আর হৃদয়ে ভাষণখানি মুদ্রণ করে দিয়েছিলেন। তাই ভয়ানক চাপ আর টান টান উত্তেজনার মধ্যেও অলিখিত ভাষণ হওয়া সত্ত্বেও কোথাও থমকে যাননি বঙ্গবন্ধু। অনেকেই আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গে প্রদত্ত ভাষণের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণকে তুলনা করেন। কিন্তু আব্রাহাম লিংকনের প্রদত্ত ভাষণটি ছিল পূর্বপরিকল্পিত ও লিখিত ভাষণ, আর বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি ছিল তাৎক্ষণিক এবং অলিখিত। তারচেয়েও বড় কথা, কী ভয়ঙ্কর চাপের মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে এ ভাষণটি দিতে হয়েছিলো তা চিন্তা করলেও গা শিউরে ওঠে। মার্চের শুরু থেকেই নানা ঘটনা পরম্পরায় এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিলো যে, সারা দেশে প্রত্যাশা দেখা দিয়েছিল ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন। স্বাধীনতার চেয়ে কম কোনও কিছুই গ্রহণযোগ্য হবে না। আন্দোলনের মূল চালিকাশক্তি তরুণরা ইতোমধ্যে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে ফেলেছেন। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর ওপর দায়িত্ব এসে পড়েছিল এমন কিছু না বলা, যা পাকিস্তানি পক্ষকে তখনই অজুহাত দেবে অপ্রস্তুত জনগণের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার। স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুর ওপর চাপ যখন তুঙ্গে তখন ৬ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করেন তিনি যেন এমন কোনও পদক্ষেপ না নেন, যাতে আর প্রত্যাবর্তনের কোনও পথ না থাকে। একই দিন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঘোষণা দেন যে, আগামী ২৫ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে। অন্যদিকে পাকিস্তানে নিযুক্ত তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফারল্যান্ড বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেন এবং হুমকি দেন,‘মার্কিন সরকার পাকিস্তান ভাঙা সহ্য করবে না’। এতকিছুর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর জন্য আরেকটি দুশ্চিন্তার বিষয় ছিল আন্দোলন ও জনগণকে চাঙ্গা রাখা। এরূপ পরিস্থিতিতে ভারসাম্য বজায় রাখা কঠিনতম সিদ্ধান্ত ছিল।

এত ভয়ানক চাপের মধ্যে থেকেও বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি যে কারণে জগদ্বিখ্যাত হলো, তা হলো –

এক. ৭ই মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাঙালির সংগ্রামের ইতিহাস থেকে শুরু করে সংগ্রামের রূপরেখা, মানুষের করণীয়, যুদ্ধের কৌশল, গরিব মানুষের যাতে কষ্ট না হয় সে জন্য দিকনির্দেশনা, আন্দোলনে শত্রু বাহিনীর অনুপ্রবেশ বিষয়ে জনগণকে সাবধান করা এবং পৃথিবীর ইতিহাসে স্বাধীনতার একটি নজিরবিহীন ঘোষণা তিনি ওই সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় উল্লেখ করেছেন।

দুই. বঙ্গবন্ধু জানতেন কিছু পাকিস্তানপন্থী দালাল বাদে সমগ্র বাঙালি স্বাধীনতার ঘোষণা শোনার জন্য ইস্পাত কঠিন দৃঢ় ঐক্যবদ্ধ। বঙ্গবন্ধু যখন মঞ্চে ওঠেন, আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে ধ্বনিত হতে থাকে, বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো-বাংলাদেশ স্বাধীন করো, শেখ মুজিবের পথ ধরো-বাংলাদেশ স্বাধীন করো। এ অবস্থায় স্বাধীনতার ঘোষণা না দিলে জনমনে হতাশা সৃষ্টি হলে আন্দোলন ক্ষতিগ্রস্ত হতে বাধ্য। অন্যদিকে পাকিস্তানিদের হামলে পড়ার বিপদ পাশেই ওঁৎ পেতে আছে। একটু ভুল হলেই শত সহস্র মানুষের মৃত্যু অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে। বঙ্গবন্ধু তাই বেছে নিলেন বাঙালিকে আবেগের চূড়ায় নিয়ে যাওয়ার, যেখান থেকে সম্মোহিত জনতা কেবল তাঁর ইশারায় পরিচালিত হবে। বঙ্গবন্ধু তাই বক্তৃতার সূচনা করলেন ‘ভাইয়েরা আমার, আজ-দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন, আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু  দুঃখের বিষয়, আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়। কী অন্যায় করেছিলাম?’

আবেগকে আরও একধাপ উসকে দিতে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘দুঃখের বিষয় আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, ২৩ বছরের করুণ ইতিহাস, বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস, ২৩ বছরের ইতিহাস মুমূর্ষু নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস, বাংলার ইতিহাস এ দেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস’। আবেগের এ আবহকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিতে বঙ্গবন্ধু শুদ্ধ বাংলার পাশাপাশি আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার করেন। তিনি একদিকে বলেছেন, ‘কর্মচারীরা যেয়ে বেতন নিয়ে আসবেন’, ‘এরপরে যদি বেতন দেওয়া না হয়’ আবার প্রাণের মমতায় আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার করে বলেছেন, ‘যাতে মানুষ তাদের মায়না-পত্র নেবার পারে’ ‘হুকুম দেবার নাও পারি’, ‘ওই শহীদের রক্তের ওপর পাড়া দিয়ে’, ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবা না’।

উপস্থিত মানুষের মধ্যে আবেগ যখন টগবগ করে ফুটছে তখনই বঙ্গবন্ধু সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণার বিকল্প হিসেবে একটি সমান্তরাল রাষ্ট্রের ঘোষণা করলেন, ‘ভায়েরা আমার, ২৫ তারিখে অ্যাসেম্বলি কল করেছে। রক্তের দাগ শুকায় নাই। আমি ১০ তারিখে বলে দিয়েছি, ওই শহীদের রক্তের ওপর পাড়া দিয়ে আরটিসিতে মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারে না। অ্যাসেম্বলি কল করেছেন, আমার দাবি মানতে হবে। প্রথম, সামরিক আইন-মার্শাল ল’ উইথড্র করতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত নিতে হবে। যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে। আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপর বিবেচনা করে দেখবো, আমরা অ্যাসেম্বলিতে বসতে পারবো কি পারবো না। এর পূর্বে অ্যাসেম্বলিতে বসতে আমরা পারি না। আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই। আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দেবার চাই, আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট-কাচারি, আদালত-ফৌজদারি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে’।

তিন. বঙ্গবন্ধু অবগত ছিলেন বিশ্বের ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে স্বাধীনতাকামীদের অদূরদর্শিতার কারণে কীভাবে স্বাধীনতার আন্দোলন বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসবে চিহ্নিত হয়ে ব্যর্থ হয়েছে। তাই তিনি বক্তৃতায় বাংলার ইতিহাস বর্ণনার পাশাপাশি বাঙালিকে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত ও হত্যা-নিপীড়ন-জুলুম সত্ত্বেও পাকিস্তানিদের সাথে বারবার শান্তিপূর্ণ অলোচনার প্রসঙ্গ তুলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এই বার্তাই দিতে চাইলেন যে, বাঙালিরা শান্তির পক্ষে। অন্যদিকে আন্দোলনকে চূড়ায় ধরে রাখতে শান্তিপূর্ণ অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন, যার ফলে পূর্ব পাকিস্তানে কার্যত বঙ্গবন্ধুর শাসন কায়েম হয়ে সবকিছু অচল হয়ে গেলো। বঙ্গবন্ধুর এই দূরদর্শিতার কারণেই মুক্তিযোদ্ধারা বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত হননি, বরং যুদ্ধের সময় ও যুদ্ধ পরবর্তীকালে বিশ্বসমাজ বাঙালি ও বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল।

চার. বঙ্গবন্ধু পুরোপুরি ওয়াকিবহাল ছিলেন যে, একটি জাতি স্বাধীন হলেই সে মুক্ত হয় না। স্বাধীনতা রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক, আর মুক্তি অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক। বঙ্গবন্ধু স্পষ্টতই অনুধাবন করেছিলেন, পাকিস্তান স্বাধীন হলেও তার নাগরিকরা মুক্তির স্বাদ পায়নি। তাই বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে স্বাধীনতা ও মুক্তি দুটো শব্দই সচেতনভাবে ব্যবহার করেছেন। ভাষণে স্বাধীনতার চেয়ে মুক্তি শব্দটা বঙ্গবন্ধু বেশি ব্যবহার করেছেন। হতে পারে এটি গরিব-দুঃখী মানুষের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে বঙ্গবন্ধুর আজন্ম লালিত স্বপ্ন-সাধনার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ কিংবা বিচ্ছিন্নবাদী চিহ্নিত না হতে কৌশলী শব্দ চয়ন অথবা দুটোই। ভাষণের শুরুতে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়’ আবার বক্তৃতার শেষে দু’বার মুক্তি শব্দ ব্যবহার করেছেন, প্রথমত, ‘এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ’ ও দ্বিতীয়ত, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।

শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ও অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শন ম্যাকব্রাইড এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমান বুঝতে পেরেছিলেন, কেবল ভৌগোলিক স্বাধীনতাই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজন মানুষের মুক্তি। সাম্য নিশ্চিতকরণ ও সম্পদের বৈষম্য দূর করার মধ্যেই নিহিত স্বাধীনতার আসল সার্থকতা। আর এ সত্যের প্রকাশ ঘটে ৭ই মার্চের ভাষণে’। পশ্চিমবঙ্গের প্রয়াত সাবেক মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বলেছেন, ‘৭ই মার্চের ভাষণ একটি অনন্য দলিল। এতে একদিকে আছে মুক্তির প্রেরণা অন্যদিকে আছে স্বাধীনতার পরবর্তী কর্মপরিকল্পনা’। ১৯৭১ সালে রয়টার্স তার প্রতিবেদনে বলে, ‘বিশ্বের ইতিহাসে এ রকম আর একটি পরিকল্পিত এবং বিন্যস্ত ভাষণ খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে একই সঙ্গে বিপ্লবের রূপরেখা দেওয়া হয়েছে এবং সঙ্গে সঙ্গে দেশ পরিচালনার দিকনির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে’।

পাঁচ. বঙ্গবন্ধু নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন যুদ্ধ করেই জয় ছিনিয়ে আনতে হবে। তাই তাঁর ভাষণে যুদ্ধের দিকনির্দেশনা দিয়ে বলেছেন, ‘তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইলো, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই দিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু, আমি যদি হুকুম দেবার না-ও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারব। আমরা পানিতে মারবো’।

কিউবার অবিসংবাদিত নেতা ফিদেল ক্যাস্ট্রো বলেছেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণ শুধুমাত্র ভাষণ নয়, এটি একটি অনন্য রণকৌশলের দলিল’। অন্যদিকে, টাইম ম্যাগাজিনের এক বিশ্লেষণে বলা হয়, ‘শেখ মুজিব ৭ই মার্চের ভাষণের মাধ্যমেই আসলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। ওই ভাষণে গেরিলা যুদ্ধের কৌশলও ছিল’।

এএফপি তার বিশ্লেষণে বলেছে, ‘৭ই মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিব আসলে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। তিনি বাঙালিদের যুদ্ধের নির্দেশনাও দিয়ে যান। ওই দিনই আসলে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে’। ওয়াশিংটন পোস্টের এক ভাষ্যে বলা হয়, ‘শেখ মুজিবের ৭ই মার্চের ভাষণই হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার মৌলিক ঘোষণা। পরবর্তীতে স্বাধীনতা যুদ্ধ হয়েছে ওই ভাষণেরই আলোকে’।

ছয়. আন্দোলন-সংগ্রামের দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় বঙ্গবন্ধু বুঝেছেন ষড়যন্ত্রীরা আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করে ভিন্ন পথে পরিচালিত করতে পারে। তাই বক্তৃতার শেষ দিকে তিনি জনতাকে শান্ত এবং অহিংস থাকার উপদেশ দিয়ে বলেছিলেন, ‘মনে রাখবেন, শত্রুবাহিনী ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে। এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি, নন-বেঙ্গলি যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের ওপরে, আমাদের ওপরে, আমাদের যেন বদনাম না হয়’।

সাত. রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর মতদ্বৈধতা ছিল, ব্যক্তিগত বৈরিতা ছিল না, শত্রুতা ছিল না। বঙ্গবন্ধু প্রতিপক্ষ দলের নেতাদের সম্মান করতেন। ৭ই মার্চের ভাষণেও এর প্রতিফলন ঘটে। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে ‘ইয়াহিয়া সাহেব’, ‘ভুট্টো সাহেব’ বলে প্রতিপক্ষের প্রতি তাঁর সহজাত সৌজন্যবোধই প্রকাশ করেছেন।

পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে প্রভাব বিস্তারকারী সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণসমূহের একটি বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ। এটি শুধু বাংলাদেশের মানুষের জন্য নয়, সারা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের অনুপ্রেরণা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার মৌলিক ঘোষণা ৭ই মার্চের ভাষণ। ৭ই মার্চেই আসলে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু ও তাঁর ৭ই মার্চের ভাষণকে বাংলাদেশের কিছু রাজনৈতিক দল স্মরণ, সম্মান ও স্বীকার করে না, অথচ তারা এ দেশ ও দেশের মানুষকে ভালোবাসার দাবি করে। বাংলাদেশ ও বাঙালির সঙ্গে এরচেয়ে বড় মিথ্যা আর প্রতারণা কি হতে পারে?

লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

SUMMARY

714-2.jpg