স্বাধীনতার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুই ছিলেন ‘একক’


মাসুদা ভাট্টি 
বাংলাদেশের রাজনীতির সবচেয়ে দুঃসময়ে বড় হয়ে ওঠা, বিশেষ করে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর যখন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান দেশটিকে একেবারে চর দখলের মতো দখল করে রেখেছেন, হত্যা করছেন একের পর এক মুক্তিযোদ্ধাকে, বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে দেশে ফিরিয়ে আনছেন একাত্তরের ঘাতকদের এবং রাজনৈতিক দল খোলার নামে যখন দেশে চলছে অনৈতিকতার বেসাতি, তখন যে কৈশোর পেরুচ্ছে, তার জীবন খুব স্বাভাবিক হওয়ার কথা নয়। পাঠ্যপুস্তক থেকে মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতার ইতিহাস সম্পূর্ণভাবে মুছে ফেলা হয়েছে। গ্রামে কিংবা মফস্বল শহরে একদল দুর্বৃত্ত স্বৈরশাসকের দেওয়া  সাহস ও অর্থের ওপর ভিত্তি করে দিনের পর দিন চালাচ্ছে অপসংস্কৃতির চর্চা। এ সময় ছাত্র ইউনিয়নের কিছু নিবেদিতপ্রাণ মানুষ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনুষ্ঠান আয়োজন করলেও সেখানে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের অবদান সম্পর্কে কিছু বলার সাহস করেননি। হতে পারে তখন জিয়াউর রহমানের খালকাটা প্রকল্পে তাদের মূল নেতৃত্ব অংশ নিয়েছিল বলে তারাও বঙ্গবন্ধুকে আলোচ্য বিষয় হিসেবে আনার সাহস করেননি। তার মানে হচ্ছে, পুরো আশির দশক বঙ্গবন্ধু ছিলেন নির্বাসনে। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় নেই, আওয়ামী লীগের রাজনীতি ছিন্নবিচ্ছিন্ন এবং কথায় কথায় দলটি ভাঙছে বলে আওয়াজ শোনা যায়, শেখ হাসিনা এসে দলটির নেতৃত্ব গ্রহণের আগ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোনও শব্দই দলটির তৎকালীন নেতৃত্বের মুখ থেকে দেশের মানুষের কর্ণগোচর হয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশ ও বাংলাদেশের সৃষ্টি প্রক্রিয়া নিয়ে দেশটির সামরিক শাসকদের চিন্তা-ভাবনা ভিন্নতর ছিল এবং তাদের হাতে তৈরি রাজনৈতিক দল পরবর্তীকালে সেই একই চিন্তাধারাপ্রসূত উদ্দেশ্য নিয়েই এদেশে রাজনীতি করেছে এবং করছে।
এসব প্রশ্ন এখন কেন তুলছি? আজকে বাংলাদেশে আবারও সেই সামরিক শাসক, বিশেষ করে জিয়া ও খালেদা জিয়া এবং তাদের রাজনৈতিক দোসরদের তোলা প্রশ্নটিই সামনে এসেছে। জিয়াউর রহমান ও পরবর্তীকালে তার স্ত্রীর নেতৃত্বে বিএনপি-জামায়াত মূলত বাংলাদেশের ইতিহাস থেকে বঙ্গবন্ধুকে বাদ দিতে চেয়েছিল এবং এ কথাই প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে কেবল একটি নাম মাত্র, অনেক নামের একটি। যে কারণে বিএনপি-জামায়াতের নেতারা বার বার স্বাধীনতার (মুক্তিযুদ্ধের নয়) ঘোষক হিসেবে জেনারেল জিয়াকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন এবং মুক্তিযুদ্ধকালে ও তার আগে-পরে বার বার ডিগবাজি খাওয়া রেড-মাওলানা খ্যাত মাওলানা ভাসানীকে স্বাধীনতার স্থপতি হিসেবে প্রমাণ করতে চেয়েছেন। যেহেতু মাওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক শক্তিটিকে জিয়াউর রহমান হাইজ্যাক করে নিয়ে নিজের দল বিএনপি গঠন করেছিলেন, সেহেতু তার প্রতি কৃতজ্ঞতাবশত তাকে তাদের নেতা মানতেই পারেন কিন্তু আজ তো একথা প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতায় মাওলানা ভাসানীর অবদান সামান্যই, বরং মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরে তার ভূমিকা যথেষ্ট বিতর্কিত। এমনকি ২০০৬ সালের আগে খালেদা জিয়া ও তার দলের নেতারা বঙ্গবন্ধুর নাম মুখে আনতে চাননি। কিন্তু যখন তারা দেখেছেন, এদেশে রাজনীতি করতে হলে বঙ্গবন্ধুকে বাদ দেওয়া যাবে না, তখন তারা তাকে বঙ্গবন্ধু না বলে ‘মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান’ বলে সম্বোধন করে দায় সেরেছেন। কিন্তু একইসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যেদিন নৃশংসভাবে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল, সেই দিনটিকে খালেদা জিয়া নিজের ভুয়া জন্মদিন বানিয়ে ঘটা করে ঢাউস সাইজের কেক কেটে দিনটিকে উদযাপন করেছেন সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে। তার মানে বঙ্গবন্ধুকে তারা স্বাধীনতার কৃতিত্ব তো দেনইনি বরং তাকে বার বার প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। খালেদা জিয়ার পুত্র তারেক জিয়া লন্ডনে গিয়েও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এবং স্বৈরশাসক জেনারেল জিয়াকে দেশের প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। বার বার বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের পক্ষে ফেলে তার সম্মানহানি করতে চেয়েছেন। অর্থাৎ বিএনপি-জামায়াত তাদের জন্মলগ্ন থেকেই যে বঙ্গবন্ধু-বিরোধিতাকে তাদের মূল রাজনীতি হিসেবে পালন করে এসেছে, এখনও  তাদের সে অবস্থান থেকে এক চুলও সরেনি। বিএনপি-জামায়াতের নেতারা দেশের স্বাধীনতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে ঘোষকতত্ত্ব দাঁড় করিয়েছেন এবং তারপর তাদের মূল টার্গেট হিসেবে বেছে নিয়েছেন বঙ্গবন্ধুকে, কথায় কথায় বঙ্গবন্ধুর ভূমিকাকে বিতর্কিত করতে গিয়ে তারা মূলত এই কথাটিই বলতে চেয়েছেন যে, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা চাননি এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতায় তার কোনও অবদানই নেই।

স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর এখন আবার স্বাধীন বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত একটি পর্যবেক্ষণে এ কথাই বলতে চাইছেন যে, দেশ কারও একক নেতৃত্বে স্বাধীনতা অর্জন করেনি। সাদা চোখে এই বক্তব্য একেবারেই নিরীহ এবং সত্য ভাষণ। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতি তো সাদা-কালো নয়, সাদাকে সাদা কালোকে কালো বলার সংস্কৃতি তো এদেশে এখনও প্রতিষ্ঠা করা যায়নি, করা গেলে আদালতকে প্রথমে একথা বলতে হতো যে, স্বাধীনতার মাত্র চার বছরের মধ্যে জাতির পিতাকে হত্যা এবং তার পর থেকে রাজনৈতিকভাবে তাকে বার বার হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের যে বিকৃতি ঘটানো হয়েছে, তার ফলে বাংলাদেশ একটি অন্ধকার গহ্বরে পতিত হয়েছে। অবৈধ সামরিক শাসনের সমালোচনা আদালতের রায়ে করা হয়েছে, এমনকি স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমানেরও নিন্দা করা হয়েছে নামোল্লেখ না করে কিন্তু তার কর্মফলেই যে বাংলাদেশের রাজনীতির এই ভয়ঙ্কর দুরবস্থা হয়েছে, সেকথা আদালত মনে না করলেও যারা রাজনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, তারা ঠিকই বুঝতে পারেন, যদি নিতান্তই তারা রাজনৈতিকভাবে দেউলিয়া না হয়ে থাকেন। সবচেয়ে বড় কথা হলো, যে কথা এতদিন ধরে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতার জোরে বলে এসেছে, সে কথাই আজ আদালতের মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে, যা আসলে বিএনপি-জামায়াতকে রাজনৈতিকভাবেই এগিয়ে দিচ্ছে, যা এদেশের মানুষের মনের কথা নয়। একজন অখ্যাত মুক্তিযোদ্ধাকেও যদি এই প্রশ্ন করা হয় যে, আপনি কার নেতৃত্বে যুদ্ধে গিয়েছিলেন? তিনি একথা কোনও রকম চিন্তা-ভাবনা ছাড়াই বলবেন যে, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন।

শুধু কি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা একথা বলবেন? আমরা যদি মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে বিদেশি ও বিশেষ করে পাকিস্তান পত্রপত্রিকা, গবেষণাপত্র, এবং পাকিস্তানি জেনারেলদের লেখা বইপত্র পর্যবেক্ষণ করি, তাতে কোথাও একটি বারের জন্য বাঙালির নেতৃত্ব হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া আর কোনও নাম কি পাওয়া যাবে? যদি কেউ বের করতে পারেন, তাহলে আমি আমার এই বক্তব্য প্রত্যাহার করে নেব ক্ষমা চেয়ে। সবচেয়ে বড় কথা, মওলানা ভাসানী সম্পর্কেও পাকিস্তানিদের বইয়ে প্রশংসামূলক বক্তব্য আছে কিন্তু শেখ মুজিবকে নিয়ে কোনও বইয়েই একটি প্রশংসাবাক্য নেই, নিন্দা ছাড়া। পাকিস্তান ভাঙার জন্য এখনও পাকিস্তানিরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকেই ‘গাদ্দার’ বলে গালি দেয়। গড়পড়তা পাকিস্তানিদের কেউই জেনারেল জিয়াউর রহমানের নামটাই জানে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। আর বিদেশি গণমাধ্যমে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা নিয়ে খবর বা বিশ্লেষণে বার বারই বঙ্গবন্ধুর নাম উল্লেখ হয় বাঙালি জাতির স্বাধীনতার স্থপতি হিসেবে, বাঙালি জাতির পিতা হিসেবে। তাজউদ্দিন আহমদসহ জাতীয় নেতৃবৃন্দ, এমনকি খোন্দকার মুশতাক আহমদও মুক্তিযুদ্ধকালে যে সব সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, তারা একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে, তারা আর কেউ নয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একক নেতৃত্বেই মুক্তিযুদ্ধ করছেন। পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি শেখ মুজিব তার অনুপস্থিতিতেই যে একটি জাতির মুক্তিযুদ্ধে এককভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন, সে কথা মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে প্রতিটি গবেষণাপত্রে উল্লেখ আছে। কেবল ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে দেশ যখন স্বৈরশাসকের কবলে পড়ে, তারপর থেকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব নিয়ে যেমন প্রশ্ন তোলা হয়, তেমনই বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসকে নানাভাবে কলুষিত করার দিনও শুরু হয়।

ফলে সর্বোচ্চ আদালতের পর্যবেক্ষণেও  আবার স্বৈরশাসক ও তার সৃষ্ট রাজনৈতিক দলের স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতির বক্তব্যই প্রতিফলিত হয়। বঙ্গবন্ধু নিজে কখনও এই দাবি করেননি যে, তিনি এককভাবে নেতৃত্ব দিয়ে দেশকে স্বাধীন করেছেন, আওয়ামী লীগ বা শেখ হাসিনাও কখনও একথা বলেননি যে, বঙ্গবন্ধু এককভাবে দেশটিকে স্বাধীন করেছেন, কিন্তু একথা তো সত্য যে, বঙ্গবন্ধুর একক নেতৃত্বেই আওয়ামী লীগের বাকি নেতৃবৃন্দ ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে একটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে দেশবাসীকে উদ্বুদ্ধ করেছে এবং বঙ্গবন্ধুর ডাকেই দেশের আপামর মানুষ জীবন দিতে প্রস্তুত ছিল। আজ হঠাৎ কেন কোনও রকম প্রশ্ন ছাড়াই আদালতের পর্যবেক্ষণে ‘একক নেতৃত্বের’ বিষয়টি আনা হলো? তার মানে কি আদালত দেশের সুশীল রাজনীতির মতো বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতার স্থপতি আর জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছেন? দু’জনকে একইসঙ্গে স্বাধীনতা পদক দিয়ে শেখ মুজিব ও জিয়াউর রহমানকে যেমন একই কাতারে নামিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়েছে, তেমনই আদালতও বলতে চাইছেন যে, কারও একক নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হয়নি? এসব প্রশ্ন তোলার কোনও কারণ ছিল না যদি আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এই ‘একক নেতৃত্বের’ বিষয়টি না নিয়ে আসতেন। যেহেতু আদালত বিষয়টি এনেছেন, সেহেতু আদালতের উদ্দেশ্য আর দেশের একদল সুশীল নামধারী ‘বিবেকের চরিত্রে অভিনয় করা বুদ্ধি ব্যবসায়ী’ এবং বঙ্গবন্ধুকে হেয় করায় নিরন্তর চেষ্টারত বিএনপি-জামায়াত চক্রের সঙ্গে আদালতের বক্তব্যকে মিলিয়ে দেখার সুযোগ তৈরি হয়। আদালতই আমাদের সে সুযোগ করে দেন।

আদালতের নিশ্চয়ই এই পর্যবেক্ষণের ব্যাপারে ব্যাখ্যা রয়েছে কিন্তু আবারও বলছি সাদা চোখে আমাদের এটুকুই বুঝতে হচ্ছে যে, হয়তো এই পর্যবেক্ষণের বক্তব্যের পেছনেও নিগূঢ় কোনও রাজনীতি? যে রাজনীতি ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের সমালোচনায় আদালত কঠোর হয়েছেন সেই রাজনীতি কি আদালতকেও ছুঁয়ে দিয়েছে? নাকি এর বাইরেও রয়েছে অন্য কোনও রাজনীতি? যাই হোক না কেন, আমরা সাধারণ মানুষ কিন্তু এ কথাই মানি যে, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব বঙ্গবন্ধুই ‘একক’, তার বাইরে যারাই রয়েছেন, তারা বঙ্গবন্ধুর সহকারী-নেতৃত্ব, এবং এতে বাকিদের কাউকেই খাটো করা হয় না, এমনকি জিয়াউর রহমানকেও না, মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার হিসেবে তার অবদানকেও কোনোভাবেই খাটো করার অবকাশ নেই। কিন্তু তাকে উঁচু করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বকে ‘বহুর’ সঙ্গে মেলালে কি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসকেই বিকৃত করা হয় না?

লেখক: নির্বাহী সম্পাদক, দৈনিক আমাদের অর্থনীতি

SUMMARY

713-1.jpg