যে দিনের সঙ্গে আমাদের জন্ম জড়িয়ে


সৈয়দ সাফায়েতুল ইসলাম 
অগ্নিশিখা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে পৃথিবী। পৃথিবীর এই ঘুরে বেড়ানোয় আলো-আঁধারের দেখা পায় মানুষেরা। রাতের কালো অন্ধকার কেটে ফুটে ওঠা সূর্যের আলোই জানান দেয় দিনের। আলোকে ঢেকে দিয়ে পশ্চিম আকাশে অন্ধকারে আত্মসমর্পণ করে দিন।
তেমনি এক ঘোর অন্ধকার কেটে ভোরের আলো জানান দিয়েছিলো সূর্য বাংলার আকাশে। সেই দিনটিকে ইতিহাস আমাদের জন্মের সঙ্গে বেঁধে দিয়েছে, দিয়েছে আমাদের নতুন পরিচয়। দিনটি ছিল ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল। বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম সীমান্তের সবুজ এক আম্রকাননেই সেদিন ফুটেছিল বাঙালির ভাগ্যের ফুল। এক নতুন পরিচয়ে সে দিন বাঙালিকে পরিচিত করেছিলেন এই মাটির সূর্য সন্তানেরা। গঠিত হয়েছিল স্বাধীন বাংলার প্রথম সরকার।
ইতিহাসের পথপরিক্রমায় ১৯৫২ সালে ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে স্বপ্নের সূচনা হয়, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে সেই স্বপ্ন বাস্তবরূপ ধারণ করে। ষাটের দশকে জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উপস্থাপন করেন বাঙালির মুক্তি সনদ ৬ দফা। বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা ও ছাত্র সমাজের ১১ দফা ভিত্তিক স্বাধিকার আন্দোলনের পথ বেয়ে সংঘটিত হয় ঊনসত্তর সালে গণঅভ্যুত্থান। যার মাধ্যমে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর চক্রান্তে ১৯৭১ সালের পহেলা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করা হয়। দাবানলের মতো জ্বলে ওঠে বাংলার মানুষ।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান) শোনান তাঁর ঐশী বাণী। অসহযোগ আন্দোলন চালানোর ঘোষণার অন্তরালে ঘোষণা দেন বাঙালির স্বপ্ন বাস্তবায়নের স্বাধীনতা।

অসহযোগ আন্দোলনের মাঝে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালো রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর বর্বরোচিত হামলা চালায়, গ্রেফতার করে বাঙালির আশা-ভরসার একমাত্র ঠিকানা বঙ্গবন্ধুকে। গ্রেফতারের পূর্ব মুহূর্তে বাঙালিকে শত্রুর মোকাবিলা করে বিজয় ছিনিয়ে আনার নির্দেশ দেন স্বাধীনতার মহানায়ক।

২৫ মার্চের ভয়াবহ গণহত্যার সময় আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রধান নেতা তাজউদ্দীন আহমদ নিজ বাসভবন ছেড়ে চলে যান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন গ্রেফতার হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি। ৩০ মার্চ সন্ধ্যায় তাজউদ্দীন আহমদ ফরিদপুর-কুষ্টিয়া পথে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তে পৌঁছান। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে ৩১ মার্চ মেহেরপুর সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে পদার্পণ করেন। গোলক মজুমদারের কাছে সংবাদ পেয়ে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মহাপরিচালক কেএফ রুস্তামজী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করেন। মুক্তিফৌজ গঠনের ব্যাপারে তাজউদ্দীন আহমদ বিএসএফের সাহায্য চাইলে তৎকালীন বিএসএফ প্রধান তাকে বলেন এটি সময়সাপেক্ষ কাজ। এরপর কেএফ রুস্তামজী দিল্লির ঊর্ধ্বতন কর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তাকে জানানো হয় তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে নিয়ে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠকের উদ্দেশ্যে দিল্লি যাওয়ার জন্য। ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বৈঠক শেষে তিনি বাংলাদেশকে সর্বপ্রকার সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিলে তাজউদ্দীন আহমদ আওয়ামী লীগের এমএনএ ও এমপিএদের কুষ্টিয়া জেলার সীমান্তে অধিবেশন আহ্বান করেন। ওই অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে মুক্তিযুদ্ধ ও সরকার পরিচালনার জন্য মন্ত্রিপরিষদ গঠিত হয়। এই মন্ত্রিপরিষদ এবং এমএনএ ও এমপিএরা ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ঘোষণা করেন। সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি এবং বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করা হয় এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন ১১ এপ্রিল বাংলাদেশ বেতারে মন্ত্রিপরিষদ গঠনের ঘোষণা দিয়ে ভাষণ দেন। এরপর ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় হাজার হাজার মানুষের সামনে মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যরা শপথ নেন। দেশি-বিদেশি প্রায় ৫০ জন সাংবাদিকের সামনে বাংলাদেশের ঘোষণাপত্র পাঠ এবং মুক্তিবাহিনীর মার্চপাস্ট অনুষ্ঠিত হয়। সেদিন আম্রকানন লোকেলোকারণ্য হয়ে যায়। আনন্দ-আবেগে উদ্বেলিত শত শত কণ্ঠের ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’ গগনবিদারী স্লোগানে স্লোগানে আম্রকাননের আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। ওই অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী উভয়েই বক্তব্য পেশ করেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তার ভাষণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার প্রেক্ষাপট বর্ণনা করেন। ভাষণের শেষাংশে তিনি বলেন, ‘বিশ্ববাসীর কাছে আমরা আমাদের বক্তব্য পেশ করলাম, বিশ্বের আর কোনও জাতি আমাদের চেয়ে স্বীকৃতির বেশি দাবিদার হতে পারে না। কেননা, আর কোনও জাতি আমাদের চাইতে কঠোরতর সংগ্রাম করেনি। অধিকতর ত্যাগ স্বীকার করেনি। জয় বাংলা।’ শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন আবদুল মান্নান এমএনএ এবং স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী এমএনএ। মুজিবনগরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব প্রদান করেন তৎকালীন ঝিনাইদহ মহকুমার পুলিশ প্রশাসক (এসডিপিও) মাহবুব উদ্দিন আহমদ বীরবিক্রম। 

সেদিন থেকেই বদলে যায় বাঙালির পরিচয়, জন্ম হয় বাঙালির আবাসভূমিতে এক নতুন রাষ্ট্রের– যার নাম বাংলাদেশ। অস্থায়ী সরকারের সফল নেতৃত্বে ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। এ দিন ঘোষিত ঘোষণাপত্রে ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণাকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন ও অনুমোদন করা হয়।

ঘোষণাপত্রে সংবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি ও সৈয়দ নজরুল ইসলামকে প্রজাতন্ত্রের উপ-রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করা হয়। এ ছাড়াও তাজউদ্দীন আহমেদ অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী, খন্দকার মোশতাক আহমেদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ক্যাপ্টেন মুহাম্মদ মনসুর আলী অর্থমন্ত্রী এবং এএইচএম কামারুজ্জামান স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী নিযুক্ত হন।

অপরদিকে, জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী অস্থায়ী সরকারের মুক্তিবাহিনীর প্রধান কমান্ডার এবং মেজর জেনারেল আবদুর রব চিফ অব স্টাফ নিযুক্ত হন।

১১ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ দেশবাসীর উদ্দেশে বেতার ভাষণ দেন, যা আকাশবাণী থেকে একাধিকবার প্রচারিত হয়। তাজউদ্দীনের ভাষণের মধ্যদিয়েই দেশ-বিদেশের মানুষ জানতে পারে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম পরিচালনার লক্ষ্যে একটি আইনানুগ সরকার গঠিত হয়েছে। এরই পথপরিক্রমায় ১৭ এপ্রিল সকালে মুজিবনগরে আনুষ্ঠানিকভাবে শপথগ্রহণের মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

পরের দিন দেশ-বিদেশের পত্র পত্রিকা এবং সংবাদ মাধ্যমে ১৭ এপ্রিল শপথগ্রহণের এই সংবাদ ফলাও করে ছাপা হয়। বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক সূচনা বা আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ হিসেবে এই দিনটির তাৎপর্য ছিল বিশাল।

১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলা গ্রামে মুজিবনগর সরকার শপথগ্রহণ করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে বৈদ্যনাথতলা গ্রামের নামকরণ হয় মুজিবনগর। মুজিবনগর সরকারের কর্মকাণ্ড বাংলাদেশ ভূখণ্ডের বাইরে থেকে পরিচালিত হয়েছিল বলে এ সরকার প্রবাসী মুজিবনগর সরকার হিসেবেও খ্যাত।

লেখক: মেজর জেনারেল (অব.)

SUMMARY

707-1.png