৭ মার্চ থেকে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি আমাদের

উদিসা ইসলাম 


সেদিন দুপুর থেকেই আমরা জড়ো হতে শুরু করি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের আশেপাশে। বঙ্গবন্ধু কি বলবেন সে নিয়ে উৎকণ্ঠা ছিল ষোলআনা। সাড়ে তিনটার কিছু আগে উনি এলেন। উপস্থিত জনতার ঢল আর শ্লোগানে মুখরিত চারপাশ। এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধু যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ আমার সারা জীবনে আমি সেই শিহরণ আর পাইনি। আমরা প্রতীক্ষায় ছিলাম প্রতিরোধ আহ্বানের। আমরা যুদ্ধের আহ্বান পেয়ে গেলাম।

কথাগুলো বলছিলেন আব্দুর রব,তিনি পেশায় একজন ব্যবসায়ী। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন কলেজে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র।

সেখানে উপস্থিত জনতা মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন যারা, তারা বলছেন- এই দিনই সেইদিন যেদিন থেকে ‘স্বাধীনতা’ শব্দটি আমাদের। আব্দুর রব বলেন, ‘যুদ্ধের কথা বলতে গেলে ৭ মার্চের ভাষণ দিয়ে শুরু করতে হয়। এর বাইরে আর কোনও অপশন আছে বলে আমি মনে করি না। আর আমাদের যুদ্ধটা কোনও সেলিব্রেটি ওয়ার ছিল না, আমার মতো সাধারণ শিক্ষার্থীদের যুদ্ধ ছিল।’

সেদিন আসলে মানুষের মনে কোন উদ্যম জেগেছিল প্রশ্নে রব বলেন, ‘আমরাতো একটা দিক নির্দেশনা পেয়েছিলাম ৭ মার্চে। আজকে এসে মনে হয়, সেদিনের সেই বক্তব্যই আমাদেরকে ২৫ মার্চ কালোরাত্রির পরও টিকে থাকতে সহায়তা করেছে।’

১৯৭১ সালের এইদিনে বিকেল ৩টা ২০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত হন। কানায় কানায় পূর্ণ ময়দান, সবার কণ্ঠে শ্লোগান-জয় বাংলা, ‘পদ্মা-মেঘনা- যমুনা, তোমার আমার ঠিকানা’।  মাত্র ১৯ মিনিটের ভাষণে বঙ্গবন্ধু আগামীদিনের পথনির্দেশনা তুলে ধরেছিলেন।

মুক্তিযোদ্ধা ও নারীনেত্রী রোকেয়া কবীর বলেন, ‘‘তখনতো অন্যরকম মনে হয় সবকিছু। স্বাধীন দেশ ছিনিয়ে আনতে লড়াই করতে হবে। বঙ্গবন্ধু সেই নির্দেশনা মার্চের ৭ তারিখেই দিয়েছিলেন। যে বুঝেছিল, সে বুঝেছিল। সেদিন তিনি আমাদের করণীয় পুরো ক্যানভাসে এঁকে দেন। তিনি বলেছিলেন, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।’ এই বাক্যের পর আর কোনও স্বাধীনতার ডাক লাগে? এরপরই দেশের মুক্তিকামী মানুষ ঘরে ঘরে চূড়ান্ত লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে।’’

রোকেয়া কবীর আরও বলেন, ‘১ মার্চ জাতীয় সংসদের বৈঠক বাতিল হওয়ার পর থেকে আমরা সবাই রাস্তায় নেমেছিলাম। আমাদের ততদিনে বোঝা হয়ে গেছে যে, সামনের দিনগুলোতে সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়েই যেতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে ডামি রাইফেল নিয়ে (কাঠের) আমরা প্রতিদিন সকালে প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করি, যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে।’

অভিনেতা ও গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা রাইসুল ইসলাম আসাদ সেদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন,‘সেই দিনই স্বাধীনতা ঘোষণা হয়ে গেছে। আমাদের প্রস্তুত হতে হবে, সেই আহ্বান পৌঁছে গেছে।আমরা ২৫ মার্চের গণহত্যার কথা কল্পনাও করিনি ঠিকই, কিন্তু এমনি এমনি সব মিলে যাবে তেমনটাও তো ভাবতাম না।’  তিনি বলেন, ‘সেই সময় এত গণমাধ্যম ছিল না। তারপরও এত মানুষ হাজির হয়েছিল। কেননা, তারা নেতার কাছে দিক নির্দেশনা চেয়েছিল।’ আসাদ আরও বলেন, ‘১৯৭১ সালের এই দিনে তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানের (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বিশাল জনসমাবেশে দেওয়া ওই ভাষণে বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতা যুদ্ধের চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিতে বলেছিলেন। এটা আমরা ভুলে গেছি। ঠিক তেমনই যেমন আমরা দেখেছি কিভাবে মানুষ যুদ্ধের কয়েকবছর পরেই চোখ উল্টে ফেলেছিল।’ আসাদের কণ্ঠে সেই উত্তেজনা এখনও টের পাওয়া যায়, যখন তিনি ৭ মার্চের দিনটিকে স্মরণ করেন। তিনি বলেন, ‘সেইদিন আমরা নিজেদের স্বাধীন অনুভব করতে শিখলাম। স্বপ্ন দেখার এক ধরনের বাস্তবতার সম্মুখীন আমরা এইদিনেই হয়েছিলাম।’

SUMMARY

699-1.jpg