পাভেল হায়দার চৌধুরী
ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। মুক্তিকামী বাঙালি জাতিকে মুক্তির বাণী শোনানোর দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে বিশাল জনসমুদ্রে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতিকে শোনান ১৮ মিনিটের মুক্তির বাণী। এই দিনে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এই মহান নেতা বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো, ইনশাআল্লাহ!’ বঙ্গবন্ধুর ১৮ মিনিটের এই ভাষণ আজ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেছে।
বিভিন্ন বিশিষ্ট ব্যক্তি ও রাজনৈতিক নেতাদের লেখা ও স্মৃতিচারণায় উঠে এসেছে ভাষণের আগের ও পরের বিভিন্ন ঘটনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইতিহাসবিদ ড. মুনতাসীর মামুন ‘বঙ্গবন্ধু কীভাবে আমাদের স্বাধীনতা এনেছিলেন’ গ্রন্থে লিখেছেন, ৭ মার্চের ভাষণের পরে ওই রাতেই বঙ্গবন্ধু পরিবারের সকল সদস্যকে সঙ্গে নিয়ে খাবার খেতে বসেন।
খাবার টেবিলে তিনি বলেন, ‘এখন থেকে একসঙ্গে দু’বেলা একত্রে খাবো’। ঐতিহাসিক ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ভাষণ শেষে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাতে পুরো পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে খাবার খেতে বসে এ মন্তব্য করেন। এ সময় বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, শেখ হাসিনা, ড. ওয়াজেদ মিয়া, শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রেহানা, শেখ রাসেল উপস্থিত ছিলেন।
বঙ্গবন্ধু গম্ভীর কণ্ঠে আরও বললেন, ‘আমার যা বলার ছিল আজকের জনসভায় তা প্রকাশ্যে বলে ফেলেছি। সরকার এখন আমাকে যেকোনও মুহূর্তে গ্রেফতার করতে পারে। সেজন্য আজ থেকে তোমরা প্রতিদিন দু’বেলা আমার সঙ্গে খাবে।’ সেদিন থেকে ২৫ মার্চ রাত পর্যন্ত প্রতিদিন বঙ্গবন্ধু পুরো পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে খেয়েছেন।
তেমনি ভাষণের আগে ৭ মার্চ সকাল ও আগের দিন ৬ মার্চ সারাদিন ও রাতে কী পরিস্থিতি ছিল ঐতিহাসিক ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাড়িটিতে সে সম্পর্কে কথা বলেন বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠজন ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য তোফায়েল আহমেদ। এই নিয়ে বিভিন্ন বক্তব্যে কথা বলেছেন তারই কন্যা শেখ হাসিনাও। তার কিছু অংশ তুলে ধরা হলো। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ সকাল থেকেই ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে ভিড় জমাতে শুরু করেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা।
তোফায়েল আহমেদ বলেন, আন্দোলন এবং মানুষের আকাঙ্ক্ষা বিবেচনায় নিয়েই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ৩ মার্চ পল্টনে আয়োজিত ছাত্র সমাবেশে দেওয়া বক্তব্যে ৭ মার্চ ভাষণ দেওয়ার ঘোষণা দেন। এরই মধ্যে একদিকে আন্দোলনের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেওয়ার ব্যাপারে চাপ ছিল। সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণার দাবিতে ছাত্রনেতাদের একটা অংশ চাপ তৈরি করছিল। অন্যদিকে, আলোচনার পথ খোলা রাখা হয়েছিল। ফলে শেখ মুজিব ছাত্রনেতা থেকে শুরু করে জাতীয় নেতা পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলেন।
তোফায়েল আহমেদ জানান, ৭ই মার্চ সকাল থেকেই ঢাকায় ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে ছিল আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা এবং ছাত্রনেতাদের ভিড়। দুপুর ২টার দিকে আব্দুর রাজ্জাক এবং আমি (তোফায়েল আহমেদ)-সহ তরুণ নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে বঙ্গবন্ধু তাঁর বাড়ি থেকে রওনা হয়েছিলেন জনসভার উদ্দেশে। তিনি বলেন, ৬ই মার্চ রাতে সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং তাজউদ্দীন আহমেদসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ কয়েকজন নেতার সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন। তোফায়েল বলেন, ভাষণ দিতে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় শেখ মুজিবকে তাঁর স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব বলেছিলেন,‘তুমি যা বিশ্বাস করো, তুমি তাই বলবে।’
জনসভাস্থলে গিয়ে বিশাল জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু যা বিশ্বাস করতেন, তাই বলেছেন। আজ সেই ভাষণ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেছে।
বঙ্গবন্ধুর জামাতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী ড. এমএ ওয়াজেদ মিয়া তার স্মৃতিকথায় লেখেন, ‘ঐদিন বঙ্গবন্ধু তার বাসভবনের লাইব্রেরি কক্ষে তাজউদ্দীন আহমদ, এএইচএম কামরুজ্জামান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমেদ, ড. কামাল হোসেনসহ আরও কয়েকজনকে নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে অংশ নেন। ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকের পর বঙ্গবন্ধু সবাইকে বলেন, ছাত্র-জনতার দাবির সঙ্গে তিনি একমত পোষণ করেছেন এবং বিকেলে রেসকোর্সে চার দফা দাবি পেশ করা হবে।
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন রাজনৈতিক সভায় বক্তব্যে বলেন, বাবা (শেখ মুজিবুর রহমান) যখন পায়চারি করেন তখন মা (শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব) বাবার পাশে মোড়ায় বসে পরামর্শ দেন, তুমি যা বিশ্বাস করো, তাই বলবে। ৭ মার্চের ভাষণ তিনি নিজের চিন্তা থেকেই দিয়েছিলেন। ভাষণটি লিখিত ছিল না।