গোলাম মোর্তোজা
বঙ্গবন্ধু, ১৫ আগস্ট এবং বঙ্গ বাহাদুর, এক সঙ্গে দু’টি বিষয় মাথার মধ্যে ঝামেলা করছে। একটির দিকে ঝুঁকতে দিচ্ছে না। গতকাল থেকে লিখতেও পারছি না। বঙ্গবন্ধু ও ১৫ আগস্ট নিয়ে লিখতে গিয়ে ভাবছি, কী লিখব, কী লিখব না। কোন বাক্য, কোন অর্থে লিখব, আর কোন অর্থ করা হবে; ভাবনাগুলো মাথা থেকে বের করে দিতে পারছি না। ১৫ আগস্টকে কেন্দ্র করে একজন মানুষের কথা, প্রচণ্ডভাবে ক্ষিপ্ত করে। সেই ক্ষিপ্ততার ঘটনা এবারও ঘটলো। ক্ষিপ্ততার প্রসঙ্গ দিয়ে শুরু করি।
১. যেকোনও মুক্তিযোদ্ধাকে আমি অন্য যেকারও চেয়ে বেশি শ্রদ্ধা করি। সেটা কাছে দূরে, যেখান থেকেই হোক। মেজর জেনারেল (অব.) এ কে এম শফিউল্লাহ একজন মুক্তিযোদ্ধা, সেক্টর কমান্ডার। এই মুক্তিযোদ্ধাকে বঙ্গবন্ধু সেনা প্রধান করেছিলেন। পছন্দ করতেন বলেই সিনিয়র জিয়াউর রহমানকে বাদ দিয়ে তাকে করেছিলেন। কিন্তু শফিউল্লাহ যে ভীতু এবং অবিশ্বাস্য রকমের স্বার্থপর, তা বঙ্গবন্ধু জানতেন না।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সেনা প্রধান শফিউল্লাহ নির্বিকার থেকেছেন। তার অধীনের সেনাবাহিনীর একটি অংশ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেছে। বলা হয় পুরো হত্যা প্রক্রিয়ার সঙ্গে ৪০০ সেনা সদস্য জড়িত ছিলেন। তখন সেনাবাহিনীর মোট সদস্য সংখ্যা ৫৮ হাজার। ৫৭ হাজার ৬০০ সেনা সদস্য তখন কী করেছিলেন?
সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ কী করেছিলেন? তিনি বঙ্গবন্ধুকে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বলেছিলেন! আর এখন বলছেন, ‘আমার হাত-পা বাঁধা ছিল’। কে বেঁধেছিল আপনার হাত-পা? জাতির জনককে হত্যা করা হচ্ছে, আপনি জানছেন, কিন্তু কিছু করছেন না! আপনার কমান্ডে ৫৭ হাজার ৬০০ সেনা সদস্য! এখন দাবি করছেন আপনার কমান্ড সাফায়াত জামিল শোনেননি, জিয়াউর রহমান শোনেননি, খালেদ মোশাররফ শোনেননি! অধীনস্ত কেউ আপনার নিয়ন্ত্রণে নেই, অথচ আপনি সেনাপ্রধান! নিজে কতটা অযোগ্য-অপদার্থ, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কখনও দেখেছেন?
অনেকে শফিউল্লাহকে বুদ্ধিহীন বা বোকা বলেন। আমি তা মোটেই মনে করি না। বুদ্ধিহীন বা বোকা হলে, সৈনিকদের নিয়ে নিজে ৩২ নম্বর ছুটে যেতেন, যাওয়ার চেষ্টা করতেন। হয় সফল হতেন অথবা নিজেও নিহত হতেন। শফিউল্লাহ চতুর-ধুরন্ধর। তিনি মৃত্যুর ঝুঁকি না নিয়ে নিরাপদে দর্শকের ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি যে বুদ্ধিহীন বেকুব নন, পরবর্তী কর্মকাণ্ডে তার প্রমাণ রয়ে গেছে।
বঙ্গবন্ধুকে যারা হত্যা করেছে, হত্যার যারা বেনিফিসিয়ারি, তাদের থেকে শফিউল্লাহ ততটাই সুবিধা নিয়েছেন, যতটা নেওয়া যায়। ১৯৭৬ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের থেকে রাষ্ট্রদূতের চাকরি নিয়ে বিদেশে চলে গেছেন। বঙ্গবন্ধুর লাশ ৩২ নম্বরে রেখে শফিউল্লাহ আনুগত্য প্রকাশ করেছেন খন্দকার মোশতাকের প্রতি। তার থেকে সুবিধা নিয়েছেন। সুবিধা নিয়েছেন সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান এবং এরশাদ সরকারের থেকেও। জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুনর্বাসন করেছেন। শফিউল্লাহকেও সুবিধা দিয়ে রাষ্ট্রদূত করেছেন। এরশাদ ক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধু হত্যাকারী ফারুক-রশীদদের দেশে নিয়ে এসেছে। তাদের দিয়ে ফ্রিডম পার্টি করিয়েছেন।
ফারুক-রশীদ ঢাকা শহরের মাস্তান-সন্ত্রাসীদের দলে নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হত্যা নির্যাতন করিয়েছেন। সেই এরশাদের সুবিধা নিয়ে শফিউল্লাহ ১৯৯১ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রদূতের চাকরি করেছেন। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের যেমন পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়েছে, শফিউল্লাহকেও পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়েছে। হত্যাকারী এবং শফিউল্লাহর কর্মকাণ্ড একই সূত্রে গাঁথা। হত্যাকারীদের চেয়েও বেশি ঘৃণা প্রাপ্য শফিউল্লাহর। ‘আমার হাত-পা বাঁধা ছিল’-এসব কথা শোনা বা সহ্য করাও অপরাধের পর্যায়ে পড়ে।
২. একটি স্বাধীন দেশের সেনাবাহিনীর একটি অংশ, তার জাতির জনককে হত্যা করতে পারল কিভাবে? সেনাবাহিনীর চরিত্র কেন এমন হয়ে গেল? আগেই বলেছি, তখন সেনাবাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল ৫৮ হাজার। এর মধ্যে ২৮ হাজার ছিল পাকিস্তান প্রত্যাগত। তখন সেনাবাহিনীর অফিসার সংখ্যা ছিল ১৪০০। এর মধ্যে ১১০০ ছিল পাকিস্তান প্রত্যাগত।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানে থাকা সেনা সদস্যরা সবাই বন্দি ছিলেন না। অনেকেই ছিলেন স্বেচ্ছায়, পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। তাদের মধ্যে অন্যতম একজন এরশাদ। রণাঙ্গনে যুদ্ধ করে যারা বাংলাদেশ স্বাধীন করলেন, স্বাধীন বাংলাদেশের সেনাবাহিনীতে তারা হয়ে গেলেন সংখ্যালঘু। ১৪০০ অফিসারের মধ্যে ১১০০ পাকিস্তান প্রত্যাগত!
মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের নিজেদের মধ্যে ঐক্য তো ছিল না। রীতিমতো মানসিকভাবে যুদ্ধাবস্থায় ছিলেন তারা। জিয়া-খালেদ মোশারফ-মঞ্জুরের মধ্যে অদৃশ্য বিরোধ ছিল। সমসাময়িক হওয়ায়, সবাই নিজেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভাবতেন। এই সুযোগটিই নিয়েছিলেন পাকিস্তান প্রত্যাগত এরশাদরা। মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের টানাপড়েনের সম্পর্ক কাজে লাগিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সহজ হয়েছে।
পরবর্তী সময়ে মুক্তিযোদ্ধা অফিসাররাই মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের হত্যা করেছেন। জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে ক্যু’সহ নানা অভিযোগে মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের হত্যা করেছেন। পাকিস্তান ফেরত এরশাদ জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের দায় চাপিয়ে অত্যন্ত অস্বচ্ছ বিচার প্রক্রিয়ায় মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের হত্যা করে, নিজের ক্ষমতায় থাকা নিশ্চিত করেছেন।
৩. আবার বঙ্গবন্ধু ও ১৫ আগস্ট ট্র্যাজেডি প্রসঙ্গে আসি। বঙ্গবন্ধু কত বড় এবং উদার মন-মানসিকতার মানুষ ছিলেন, আমাদের পক্ষে তা মূল্যায়ন করাও কঠিন। কিন্তু ‘বড় মানুষ’, ‘উদারতা’ আর দেশ-প্রশাসন পরিচালনা, এক বিষয় নয়। পাকিস্তান প্রত্যাগত সেনা সদস্যদের যে প্রক্রিয়ায় তিনি বাহিনীতে নিয়ে নিয়েছিলেন, তা যে ঠিক ছিল না, প্রমাণিত হয়েছে। বেসামরিক প্রশাসনে পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করা কর্মকর্তাদেরও বঙ্গবন্ধু পুনর্বাসন করেছিলেন।
বিশাল মানুষ হিসেবে সবাইকে সঙ্গে নিয়ে বঙ্গবন্ধু দেশ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। তার আন্তরিকতা, দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই। বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করতেন, যাদের তিনি সুযোগ দিচ্ছেন, তারা দেশের জন্যে কাজ করবেন। তারা যে দেশের বিরুদ্ধে, বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে পারেন, তা তিনি কল্পনাও করেননি। জীবন দিয়ে তার মূল্য দিতে হয়েছে।
৪. এদেশে ২১ বছর বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করা যায়নি। ৭ মার্চের ভাষণ ছিল অঘোষিতভাবে নিষিদ্ধ। ১৫ আগস্টেও বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করা যেত না। তখন দেশে এত আওয়ামী লীগার ছিল না, আজ যত দেখা যায়। তারা সুসময়ের আওয়ামী লীগার। বিপদের দিনে তাদের কাউকে পাশে পাওয়া যাবে না। যেভাবে পাওয়া যায়নি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের সতর্ক হওয়া জরুরি, সুসময়ের সুবিধাবাদী আওয়ামী লীগারদের বিষয়ে। তারা বঙ্গবন্ধুর নাম ব্যবহার করে অন্যায়-অনিয়ম করছে। ১৫ আগস্ট পালন করার নামে চাঁদাবাজি করছে। এতে মানুষের ভেতরে ক্ষুব্ধতা তৈরি হচ্ছে।
ইতিহাসে প্রমাণিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে চাপা দিয়ে রাখা যায়নি, যাবে না। কেউ তা পারবে না, কোনও দিন পারবে না। নতুন কিছু চাঁদাবাজকে দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করানোর কোনও দরকার নেই। বঙ্গবন্ধু এদেশের মানুষের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। ২১ বছর নিষিদ্ধ করে রাখার কারণে বঙ্গবন্ধু মানুষের কাছে আরও অনিবার্য হয়ে স্থান পেয়েছেন।
৫. বঙ্গবন্ধু যখন বাকশাল করেন, অল্প কিছু মানুষ বিরোধিতা করেছিলেন। কর্নেল ওসমানী তাদের একজন। ওসমানী বক্তৃতা করছেন, ‘...আমরা আইয়ুব খান দেখেছি, ইয়াহিয়া খান দেখেছি, শেখ মুজিবুর রহমান খান দেখতে চাই না’। বঙ্গবন্ধু বসে এই বক্তৃতা শুনছেন, মৃদু হাসছেন, ‘মাই ফ্রেন্ড’ বলে ওসমানীকে কাছে টেনে নিচ্ছেন। বিরোধী রাজনীতিকদের প্রতিও বঙ্গবন্ধুর যে ভালোবাসা-শ্রদ্ধার সম্পর্ক সারাজীবন অক্ষুণ্ন রেখে গেছেন, তা অতুলনীয়।
বিপদ হলো, নতুন আওয়ামী পরিচয়ধারীদের সামনে বঙ্গবন্ধুর এই বিশালত্বের পর্যালোচনা করা যায় না। তারা নিজেরা যেমন ‘ক্ষুদ্র’ বঙ্গবন্ধুকেও তারা ‘ক্ষুদ্র’ হিসেবে দেখতে চান। নিজেরা কূপমণ্ডুক, পরশ্রীকাতর, সবকিছুর মূল্যায়ন তারা সেভাবেই করতে চান।
আজ ১৫ আগস্ট পালন করতে গিয়ে একজন মানুষের ওপরও যেন জুলুম করা না হয়, নজর রাখা জরুরি। বিচিত্র গুণের মানুষ ছিলেন বঙ্গবন্ধু। জীবিত থাকলে তিনি ‘মুজিব ভাই’ নামেই হয়ত জনমানুষের কাছে পরিচিত থাকতেন। হত্যা করেও শেষ পর্যন্ত তাকে দূরে সরিয়ে রাখা যায়নি। বঙ্গবন্ধুকে ধারণ করতে হবে, স্মরণ করতে হবে, বহুমাত্রিক গুণের অধিকারী হিসেবে। দোষ-গুণ মেলানো মানুষ হিসেবে। যার নেতৃত্বে একটি দেশ পেয়েছি, তাকে ‘দেবতা’ বানানো দরকার নেই, কিন্তু ‘অস্বীকার’ যেন না করি। ভালোবাসতে, শ্রদ্ধা করতে যেন কার্পণ্য না করি। রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের সমালোচনা হবে, সমালোচনা করা যেতে পারে বঙ্গবন্ধুরও। কিন্তু জাতির জনককে অপমান-অসম্মান করার অধিকার কারও থাকা উচিত নয়।
লেখক: সম্পাদক, সাপ্তাহিক