সাগরে শয়ন যার শিশিরে কী ভয় তার


আনিস আলমগীর 
শিরোনামটা নিয়েছি বঙ্গবন্ধুর বই ‘কারাগারের রোজনামচা’ থেকে। মামলার পর মামলা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু ১৯৬৭ সালে ২৫ ফেব্রুয়ারি জেল গেটের সামনে স্থাপিত আফসার উদ্দীন সাহেবের কোর্টে এ সুন্দর কথাটি বলেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ডায়েরি অবলম্বন করে রচিত এ বইটি বের হয়েছে কয়েকদিন হলো। ৩৩২ পৃষ্ঠার বইটি বের করেছে বাংলা একাডেমি আর অর্থায়ন করেছে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়। গ্রন্থস্বত্ব অধিকারী হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান মেমোরিয়েল ট্রাস্ট। প্রচ্ছদে ব্যবহৃত পোট্রেটটি রাসেল কান্তি দাসের। মূল্য নির্ধারণ করেছে চার শত টাকা।
বঙ্গবন্ধুর জীবনের মতো সাদাসিদে একটি বই। বইটি বঙ্গবন্ধুর জীবনীগ্রন্থ নয়। আবার অজীবনীও নয়। বঙ্গবন্ধুর জীবনের দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন জেলখানায়। এ গ্রন্থটি বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে লেখা জেলখানায় হরদিনের কর্মকাণ্ডের দিনলিপি। বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ব্যক্তি। বাংলার ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম মহাপুরুষ। যার জেগে থাকা ঘুমিয়ে পড়া সবই ইতিহাসের অংশ। এই দিনলিপিও ইতিহাসের অংশ। আগামীদিনে ইতিহাসের গবেষণায় ফিরে ফিরে প্রয়োজন হবে এ বইটি।
এ মূল্যবান গ্রন্থের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী এবং বঙ্গবন্ধুর জ্যৈষ্ঠ সন্তান শেখ হাসিনার বিরাট এক ভূমিকা সংযোজন করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর ডায়েরিগুলো হানাদারদের কবল থেকে রক্ষা করার এক কষ্টসাধ্য প্রয়াসের কথা লিপিবদ্ধ করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। এ যেন চেগুয়েভেরার ডায়েরি, ক্যাস্ট্রোর হস্তগত হওয়া আর প্রকাশ করার মতো। ক্যাস্ট্রো চেগুয়েভেরার ডায়েরিকে কিউবার স্কুল কলেজ পাঠ্য পুস্তকের অন্তর্ভূক্ত করেছিলেন।

কিউবার ছাত্ররা এখনও গান গায় ‘আমরা সবাই চে হবো’। মহান ব্যক্তিরা সবাই এক শ্রেণির হয়ে থাকেন। বঙ্গবন্ধুর স্ত্রী বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব যাকে বঙ্গবন্ধু ‘রেনু’ নামে ডাকতেন তিনি এক মহিয়ষী মহিলা। বঙ্গবন্ধুর নিকট আত্মীয় ছিলেন তিনি। অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে দেখেছি তাদের মাঝে বিয়ে হয়েছিলো অপ্রাপ্ত বয়সে। মহাত্মা গান্ধীও তার স্ত্রী কস্তুরা বাইকে বিয়ে করেছিলেন অপ্রাপ্ত বয়সে। তার আত্মজীবনী ‘দ্য স্টোরি অব মাই এক্সপেরিমেন্ট উইথ ট্রুথ’ - এ কথাই তিনি লিখেছেন।

গান্ধীর স্ত্রী কস্তুরা বাই যেমন গান্ধীকে মহাত্মা করে গড়ে তুলতে আর ভারতের জাতির পিতার আসন অলঙ্কৃত করতে তার জীবনটা গন্ধীর পেছনে উৎসর্গ করেছিলেন ঠিক তেমনি বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিবও তিলে তিলে দুঃখ কষ্ট ভোগ করে শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ আর জাতির পিতার আসনে বসাতে অপরিসীম ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন। কস্তুরা বাইয়ের মৃত্যু হয়েছিলো পুনার জেলে। লবন আন্দোলনে যখন ব্রিটিশেরা গান্ধীকে গ্রেফতার করেছিলেন তখন কস্তুরা বাইকেও গ্রেফতার করেছিলো। পুনার জেলে গান্ধীর হাতেই কস্তুরা বাই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। কস্তুরা বাইয়ের শবদেহ যখন পুনার জেল থেকে সৎকারের জন্য বের করা হচ্ছিলো তখন গান্ধী অধরে ছোট শিশুর মতো কেঁদেছিলেন। মানবীয় দুর্বলতার লক্ষন সব মানুষের কাছে একই রকম।

‘কারাগারের রোজনামচা’ বইটি দিনক্ষণ ছাপানো ডাইরিতে লিপিবদ্ধ নয় সাধারণ খাতায় তারিখ উল্লেখ করে করে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন। জেলখানার বাইরের মুদি দোকান থেকে খাতা কিনে ফজিলাতুন্নেসা মুজিব নাকি বঙ্গবন্ধুকে জেলখানায় দিয়ে আসতেন আর লেখার তাগিদও দিতেন। সম্ভবতো তার এ প্রয়াস ছিল তার স্বামীকে চিরকালীন বাংলার মানুষের প্রয়োজনে একজন শ্রেষ্ঠ নেতা হিসেবে প্রতিস্থাপনের উচ্চ-আকাঙ্ক্ষারই প্রকাশ।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন দিব্যদর্শী পুরুষ। তারা স্বামী স্ত্রীর মাঝে অন্তরঙ্গতার অকুণ্ঠ স্পর্শ ছিল কিংবদন্তির মতো। বছরের পর বছর বঙ্গবন্ধু জেলে ছিলেন কিন্তু ফজিলাতুন্নেসা মুজিব তার সংসারটাকে মাথায় করে রেখেছেন তার রাজনৈতিক সংগঠনটাকে নিজের সন্তানের মতো করে লালন করেছেন। সৃষ্টিকর্তার অপার অনুগ্রহ না হলে একজন নারীর মাঝে এত গুণের সমাবেশ কখনও হতে পারে না। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক শত্রুরা পর্যন্ত এই মহিয়সী নারীর গুণের প্রশংসা করতেন।

একজন লোকের ব্যক্তিগত ডায়েরি হলো খুবই গোপনীয় বিষয়। গোপনীয়তার একটা ভয়ঙ্কর বিপদ আছে। কারণ গোপনীয়তা থেকে অসত্যের সূত্রপাত হয়। মহান সাধকের কাছে অসত্য অবাঞ্ছিত। বঙ্গবন্ধুর কন্যারা উদ্যোগ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর গোপন ডায়েরি প্রকাশ করে বঙ্গবন্ধুকে অন্ধকার থেকে সংশয় থেকে মুক্ত করে দিয়েছেন। আসলে বঙ্গবন্ধুর ডায়েরিটা হচ্ছে তার চিন্তা তার জাতি-ভাবনা, তার সংগঠন তার সংগঠনের নেতা কর্মীদের সম্পর্কে তার খোলামেলা সংলাপ। বঙ্গবন্ধুর ডায়েরিতে শত শত তার কর্মী, সহকর্মীর কথা লিপিবদ্ধ আছে যারা তার জেলে থাকা অবস্থায় জেলে যাচ্ছে জেল থেকে বের হচ্ছে। কারও সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু খারাপ ধারণা পোষণ করতেন না। তার কর্মী, সহকর্মী সবাই ছিল তার আপনজন।

২২  মার্চ, ১৯৬৭ সাল ছিল কোরবানীর ঈদের দিন। ঈদের জামায়াতে অনেক নেতা-কর্মীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর দেখা। কত আফসোস করে লিখেছেন ‘মুশতাকের শরীরটা খারাপ হয়ে গেছে’। শাহা মোয়াজ্জেমের জামিন নিয়ে কত ভাবনা। প্রশংসা করি তাদের নামগুলো কেউ যে ডায়েরি থেকে কেটে দেননি। কারণ অনেকে বলেন তারা বঙ্গবন্ধুর হত্যার ঘটনার সঙ্গে জড়িত। আওয়ামী লীগ মুজিবনগর মন্ত্রিসভার কথা বলার সময় মোশতাকের নাম উচ্চারণ করে না। আসলে ঐতিহাসিক সত্যকে যেভাবে পাওয়া যায় সেভাবে বলা উচিৎ। নিজের ইচ্ছা মতো ইতিহাস হয় না। ইতিহাসের গতিপথে সব মনিমানিক্য হয় না। আরও বহু কিছু ইতিহাসের গতি পথ বয়ে চলে আর এসবই ইতিহাসের অংশ। কিছু গৌরবের কিছু অগৌরবের।

শেখ হাসিনা ভূমিকায় বলেছেন- বঙ্গবন্ধুর লেখার ওপর হাত চালাতে তার সাহস হয়নি। যেভাবেই হোক নামগুলো থাকাতে ইতিহাস অক্ষুণ্ন রয়েছে। ইতিহাস অর্ধসত্য হলে ইতিহাসের সমাপ্তি ঘটে। জেলখানায় বঙ্গবন্ধু দলমত নির্বিশেষে সবারই অভিভাবকত্ব করতেন। কে তার দলের কর্মী আর কে তার দলের কর্মী নয়- তার কোনও বাচবিচার তার কাছে ছিল না।

একটি শোনা কথা। মিছির আহাম্মদ ভূঁইয়া নামের একজন বাম নেতা একবার ঢাকা জেলে যাওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা হয়। তার কালো মুখ দেখে বঙ্গবন্ধু নাকি বলেছিলেন- ভূঁইয়া ভয় পেয়েছে নাকি মুখ কালো কেন? তখন ভূঁইয়া বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন- ‘মুজিব ভাই জেলকে ভয় করি না। কিন্তু হঠাৎ করে জেলে আসতে হবে তা চিন্তা করিনি, বুড়া মাকে একলা ফেলে এসেছি কোনও টাকা পয়সা দিয়ে আসিনি’। বঙ্গবন্ধু তার বাড়ির ঠিকানা নিয়েছিলো, জেল থেকেই কোনও কৌশলে মিশির আহাম্মদ ভূইয়ার মার কাছে টাকা পাঠিয়ে ছিলেন। মিছির আহাম্মদ ভূইয়া জানতো না। তার মা যখন জেলে তাকে দেখতে এসেছিলেন তখন তার মা তাকে বলেছিলেন, ‘তোর বন্ধু শেখ মুজিব লোক মারফত আমার কাছে টাকা পাঠিয়েছে’। মিছির আহাম্মদ ভূইয়া আমাকে এ কাহিনি বলার সময় তার ওষ্ঠদয় কেঁপে উঠেছিলো। এই ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।

‘কারাগারের রোজনামচা’ বইটি একজন রাজবন্দির কারাস্মৃতি অবলম্বনে লেখা ডায়েরি। কিন্তু ডায়েরিটা উপন্যাসের মতো। শরৎ বাবুর উপন্যাসকেও হার মানায়। এ বইটা পড়া আরম্ভ করলে তার ইন্দ্রজাল থেকে বেরুনোর উপায় থাকে না। আমার এ পর্যালোচনা অসম্পূর্ণ আরও লিখবো।

লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক

SUMMARY

681-1.jpg