নাদীম কাদির
আমি সেই ভাগ্যবানদের মধ্যে একজন যাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করার সৌভাগ্য হয়েছে। সেই দিনের কথা ভাবলে এখনও নিজেকে ধন্য মনে হয়।
সেটা ছিল ১৯৭৪ সাল, বাংলাদেশের স্বাধীনতার আড়াই বছর পরের কথা। সকাল ৯টা নাগাদ হবে, তারিখ অথবা মাস মনে করতে পারি না। ধানমণ্ডি ৩২ নম্বর সড়কে রক্ষীরা আমাদের গাড়ি থামালেন। গাড়িতে আমার মা, আমি আর আমার ভাইবোনরা ছিলেন।
মা ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাওয়া পাস দেখালে রক্ষীরা আমাদের ছেড়ে দিলেন। আমার মা হাসনা হেনা কাদির বেশ আবেগের বশেই তার একমাত্র পাসটা দেখিয়েছিলেন। পরে আমরা এ নিয়ে হাসাহাসিও করেছি।
তারপর সাদা পোশাকের নিরাপত্তা কর্মীরা আবারও আমাদের পথ রোধ করলেন। আমার মা তাদের বললেন, ‘আমি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। আমি হাসনা হেনা কাদির, মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট কর্নেল কাদিরের স্ত্রী।’ আমাদের বাড়িতে ঢুকতে দেওয়া হলো। আমরা একতলার গেস্ট রুমে বসলাম।
এখানে আর একটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর আমরা ভেবেছি তাঁর নিরাপত্তা ব্যবস্থা কতটা দুর্বল হয়ে পড়েছিল। তিনি শুধু রাষ্ট্রপ্রধানই ছিলেন না, ছিলেন জাতির পিতাও। অনেক নিরাপত্তাকর্মী পরে জানিয়েছেন, বঙ্গবন্ধু গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন, কোনও বাঙালির দ্বারা তাঁর কোনও ক্ষতি হতে পারে না। ফলে তিনি কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা পছন্দ করতেন না।
বলা হয়ে থাকে মৃত্যুর আগে তিনি তাঁর হত্যাকারীদের জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘তোরা কী চাস?’ খোলা আগ্নেয়াস্ত্র হাতে আগ্রাসী মানুষগুলোকে দেখেও তিনি ভাবতে পারেননি তারা আসলে তাকে হত্যা করতে এসেছে। এমনই ছিল নিজের মানুষদের প্রতি তাঁর ভালোবাসা আর আস্থা।
আমি আর আমার ভাই নাওয়েদ বঙ্গবন্ধুর ভক্ত হয়েছি তাঁর প্রতি আমাদের বাবার ভালোবাসা দেখে, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বাবার গোপনে দেখা করা, বঙ্গবন্ধুর ডাকে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া- আমাদের বঙ্গবন্ধুর সমর্থক বানিয়েছে। মায়ের শিক্ষা আমাদের এই সমর্থনে যুক্ত করেছে আবেগ ও ভক্তি। রেডিওতে যখন বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের খবর প্রচার হয়, মা কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের এখন কী হবে?’
আমাদের বাবা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন, আমরা প্রতি মুহূর্তে বাবার অনুপস্থিতি অনুভব করতাম। এরপর একই দেশের জন্যে শহীদ হলেন মহান জাতির পিতাও।
যা বলছিলাম, আমরা বঙ্গবন্ধুর দেখা পেলাম, তাঁর হাতে ছিল সেই বিখ্যাত পাইপ, এখন যে বাড়িকে বঙ্গবন্ধু ভবন বলা হয় তার ওপর তলা থেকে তিনি নেমে এলেন। মাকে গণভবনে যেতে বললেন তিনি।
রমনা পার্কের বিপরীতে অবস্থিত পুরানো গণভবনের কিছু কর্মকর্তা মাকে বললেন, বঙ্গবন্ধু অনেক ব্যস্ত, তিনি দেখা করতে পারবেন না। ফলে তাঁর জন্য অপেক্ষা করে কোনও লাভ নেই। মা বললেন, বঙ্গবন্ধু কিছুক্ষণ আগেই তাকে গণভবনে দেখা করতে বলেছেন, সুতরাং তিনি অবশ্যই দেখা করবেন।
মায়ের কথাই সত্যি হলো। প্রায় ৩০ মিনিট অপেক্ষা করার পর এক ভদ্রলোক এসে বললেন, এখানে মিসেস কাদির কে? বঙ্গবন্ধু ভেতরে যেতে বলেছেন। আমরা তাঁর কক্ষে ঢুকতেই তিনি মাকে বললেন, ‘এসো মা, ভেতরে এসো’।
মা তাঁর শহীদ স্বামীর অবর্তমানে সন্তানদের নিয়ে নিজের নিরাপত্তাহীন অবস্থার কথা বলতে বলতে ভেঙে পড়লেন।
বঙ্গবন্ধু আমার বাবার ছবি দেখতে চাইলেন, মা বাবার ছবি দেখালেন।
সে সময় আমি নিতান্তই কিশোর, আমি স্বপ্নেও ভাবিনি তাঁর মতো একজন বিশালদেহী মানুষ আমার বাবার ছবি দেখে এভাবে কান্নায় ভেঙে পড়তে পারেন। তিনি বললেন- ১৯৬৯ সালে বাবা কিভাবে জেনারেল এম এ জি ওসমানীর সাহায্যে গোপনে তাঁর সঙ্গে দেখা করেছিলেন।
আমার ক্রন্দনরত মায়ের মাথায় আশীর্বাদের হাত রেখে সান্ত্বনা দিলেন বঙ্গবন্ধু, ‘তোমার স্বামী ছিলেন এক নির্ভীক মানুষ, তাঁর জন্য গর্ব করো, মা। কেঁদো না।’
আমার বাবা লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম আব্দুল কাদির তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের রাওয়ালপিণ্ডিতে কর্মরত ছিলেন, যুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন।
বঙ্গবন্ধু আমার মায়ের অনুরোধে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিদেশে একটি চাকরির জন্য ড. কামাল হোসেন ও খন্দকার মোশতাক হোসেনকে বলে দেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের কারণে তা হতে পারেনি, কিন্তু তাঁর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এর তিন দশক পর আমাকে লন্ডনে নিয়োগ দেন।
বঙ্গবন্ধু আমাকে আর আমার তিন বছর বয়সী ভাই নওয়াদকে কোলে তুলে নেন, জড়িয়ে ধরে চুমু খান, আমাদের প্রত্যেককে চকলেট খাওয়ার জন্য ৫০০ করে টাকা দেন।
আমরা তাঁকে সালাম করে বিদায় নেওয়ার সময় তিনি মাকে বলেন, ‘কখনও কোনও রকম প্রয়োজন পড়লে আমার কাছে আসবে। মনে রাখবে তুমি একা নও।’
মা কঠিন পৃথিবীকে মোকাবিলা করার সাহস নিয়ে ফিরে এলেন। তখনও আমরা জানতাম না আমরা শিগগির মহান জাতির পিতাকেও হারাতে যাচ্ছি।
তিনি হয়তো শারীরিকভাবে আর আমাদের সঙ্গে নেই। কিন্তু তাঁর প্রেরণা আমাদের মধ্যে রয়েছে যার জোরে আমরা বাংলাদেশকে ‘সোনার বাংলা’র পরিণত করতে পারি।
আপনি চিরদিন আমাদের সঙ্গে রয়েছেন পিতা!
লেখক: সাংবাদিকতায় জাতিসংঘের ড্যাগ হ্যামারসোল্ড স্কলার এবং লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনের প্রেস মিনিস্টার