স্বদেশ রায়
যুদ্ধটা তিনিই শুরু করেছিলেন, তাই স্বাভাবিকই তাঁর ফিরে আসার ভেতর দিয়েই শেষ হয়েছিল যুদ্ধ। এমনভাবে কোনও একক নেতার নেতৃত্বে একটি সংগ্রামের শুরু ও শেষ পৃথিবীই ইতিহাসে দেখা যায় না। এই সংগ্রামের ধাপে ধাপে তিনি যেমন নিজেকে গঠন করেছেন, তেমনি গঠন করেন একটি জাতি ও তার জাতীয়তাবোধ এবং সর্বোপরি একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের আকাঙ্ক্ষা। তাই তো প্লেন থেকে নেমেই তিনি তাঁর স্বাধীন ভূখণ্ডের মাটিতে চুমু খান। মাথায় তুলে নেন সে মাটি।
বঙ্গবন্ধু যখন এই মাটি মাথায় তুলে নেন, তখন তার জন্যে অপেক্ষা করছে কমপক্ষে ১০ লাখ মানুষ। বিদেশি পত্র-পত্রিকা ও নিউজ এজেন্সির নিউজের বর্ণনায় তখন তেজগাঁও এয়ারপোর্ট থেকে রেসকোর্স ময়দান (বর্তমানের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) অবধি জনসমুদ্র। এই বিপুল মানুষ তখন স্লোগান দিয়েছিল তাকে ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করে। আবার ওই মানুষেরা ততক্ষণে তাঁকে পিতার আসনে বসিয়েছেন। তিনি তখন জাতির পিতা। এ কারণে সেদিনের বিশ্ব মিডিয়ার মন্তব্য ও বর্ণনায় আরও দুটো বিষয় ফুটে উঠেছিল। তাদের বর্ণনা এমন ছিল, উপস্থিত প্রতিটি মানুষের মুখ দেখে বোঝা যায়, শেখ মুজিবকে ফিরে পেয়ে তারা যেন সব ফিরে পেয়েছে। গত নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে তারা স্বজন থেকে শুরু করে যা যা হারিয়েছে, শেখ মুজিবকে নিজেদের মাঝে পেয়ে তারা যেন সব ফিরে পেলো। আর তাদের মন্তব্য ছিল, নতুন এ রাষ্ট্রটির সবকিছু পুনর্গঠন করার জন্যে শেখের প্রত্যাবর্তন ছিল অনিবার্য। তাকে ছাড়া নতুন এই রাষ্ট্র ও জাতির কোনও কিছুই গঠন করা সম্ভব নয়। কারণ, তিনিই একমাত্র নেতা যার আহ্বান সবাই আনন্দিত চিত্তে মেনে নেয়।
বঙ্গবন্ধুর ফিরে আসার আগে থেকেই বাংলাদেশে সিভিল প্রশাসন শুরু হয়েছিল ঠিকই কিন্তু ওইভাবে সামরিক প্রশাসন গড়ে উঠতে পারেনি। কারণ, তখন মুজিবনগরে গড়ে ওঠা মুক্তিযোদ্ধাদের ভেতরও কয়েকটি ভাগ ছিল। ছাত্রলীগের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা মুজিববাহিনী ছিল, আবার ছিল দেশের ভেতর গড়ে ওঠা অনেক বাহিনী। মুক্তিযোদ্ধাদের ভেতর মোটা দাগে দুটো শ্রেণি ছিল। এক. পাকিস্তানের নিয়মিত সেনাবাহিনীর সদস্য, যারা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। দুই. ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক, শিক্ষক, চিকিৎসক, সাংবাদিকসহ নানান পেশার মানুষ, যারা মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। মুজিবনগর সরকার সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেষ্টা করেছিল শেষোক্ত যারা সেনাবাহিনী বা কোনও নিয়মিত বাহিনীতে থাকতে চান তাদের নিয়ে মিলিশিয়া বাহিনী গঠন করার। আর এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্যে একটি কমিটি গঠিত হয়েছিল। তবে ওই কমিটির একটির বেশি মিটিং হয়নি। আর সেখানে অনেকেই কোনও মতামত দেননি। তাছাড়া দেশে ফিরে কেউই তাদের অস্ত্রসমর্পণ করেনি। কারণ, সকলের ভেতর দুটো বিষয় কাজ করছিল,হয়তো বঙ্গবন্ধুর জন্যে আবার তাদের যুদ্ধ করার প্রয়োজন হতে পারে। দুই, দেশের ভেতরে আবার তাদের প্রতিবিপ্লবীদের বা স্বাধীনতাবিরোধী কলাবরেটরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার প্রয়োজন হতে পারে। সবকিছু মিলে মুক্তিযোদ্ধারা ছিলেন দ্বিধান্বিত। অন্যদিকে তারা সকলে বঙ্গবন্ধুর ডাকে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন। তাই তারা বঙ্গবন্ধু ছাড়া আর কাউকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, আবার অস্ত্র জমা দেবেন না কোনও পেশায় যাবেন।
বঙ্গবন্ধু ফেরার পরে তিনি শুধু তাঁর আহ্বান দিয়ে ওই মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রসমর্পণ করান। নয় মাস মুক্তিযোদ্ধারা তাদের যে প্রিয় অস্ত্র হাতে প্রিয় জন্মভূমির জন্যে যুদ্ধ করেছিলেন সেই অস্ত্র তারা আনন্দিত মনে সমর্পণ করেন। তিনি কোনও কোনও বিশেষ বাহিনীর এলাকায় গিয়েও তাদের অস্ত্র জমা নেন। সেদিন তাদের অস্ত্র জমা নেওয়ার পরে তাদের আবার যার যার পেশায় পাঠিয়ে দেওয়া কতটা সঠিক হয়েছিল তা এখনও গবেষণার বিষয়। তবে এটা সত্য যে, বিপুল পরিমাণ অস্ত্র জমা নেওয়ার পরে, নিয়মিত বাহিনী দিয়ে সামরিক প্রশাসন গড়ে তোলেন বঙ্গবন্ধু। এবং দেশে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনেন। বাস্তবে কোনও বিপ্লবোত্তর দেশে বঙ্গবন্ধু যত সহজে শৃঙ্খলা ফিরয়ে এনেছিলেন এমনটি বিপ্লবোত্তর দেশে পৃথিবীর অন্য কোনও নেতা পারেননি। শুধু সামিরক প্রশাসনে শৃঙ্খলা আনা নয়, একটি বিপ্লবোত্তর দেশে বঙ্গবন্ধু কোনও কঠোর সরকার গঠন না করে তিনি সংসদীয় গণতন্ত্র’র মতো একটি উদারনৈতিক সিস্টেম চালু করেন। এ ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর বাংলাদেশ একমাত্র উদাহরণ। আমেরিকা ব্রিটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলেও তাদের গণতান্ত্রিক শিক্ষাগুরু ব্রিটেন। তারপরেও তারা কিন্তু ব্রিটেনের মতো উদার সংসদীয় গণতন্ত্র চালু করেনি, তারা প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতি চালু করে।
বঙ্গবন্ধু এই বিপ্লবোত্তরকালে সংসদীয় গণতন্ত্র চালু করা ও নিজে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কারণে বেশ কতগুলো বিষয় বাংলাদেশে দ্রুত সমাধান করা সম্ভব হয়। সংসদীয় গণতন্ত্র চালু করে, একটি উদার ও মুক্ত দেশ হওয়ার ফলে গোটা বিশ্বই বাংলাদেশের বন্ধু হয়। বাংলাদেশকে কোনও একটি বিশেষ ব্লকে যোগ দিতে হয় না। বাংলাদেশ তার উদার পররাষ্ট্রনীতি চালু করতে পারে, সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়। তাছাড়া উদার দেশ হওয়ার কারণে বাংলাদেশের সম্মানও বিশ্বসভায় দ্রুত উচ্চতর হয়। সর্বোপরি নেতা হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান সারা বিশ্বের অনুকরণীয় নেতা হন। তিনি উদার দেশেরও নেতা হন, আবার বিপ্লবের ভেতর দিয়ে গঠিত দেশেরও নেতা হন। দেশের ভেতরও বঙ্গবন্ধু সংসদীয় গণতন্ত্র চালু করে এবং নিজে প্রধানমন্ত্রী হয়ে সিভিল প্রশাসনের ওপর মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনেন দ্রুত। কারণ, এ দেশে মানুষের আস্থা ছিল একমাত্র বঙ্গবন্ধু’র ওপর। তাই তিনি সরকার প্রধান হওয়ার পরে সরকারের ওপর শতভাগ আস্থা ফেরে দেশের মানুষের। অন্যদিকে গণতান্ত্রিক বিশ্বও বিষয়টিতে স্বস্তিবোধ করে বেশি।
এর পাশাপাশি স্বাধীনতার পরপরই অনিবার্য ছিল জাতি-পুনর্গঠন। কারণ, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় দেশের মানুষের ভেতর ক্ষুদ্রতম হলেও একটি বিভক্তি পাকিস্তানিরা সৃষ্টি করতে পেরেছিল কলাবরেটর সৃষ্টি করে। উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র করার ফলে একটি স্বাধীন বিচার বিভাগের অধীনে ওই সব কলাবরেটর নেতাদের যেমন বিচার শুরু করা সম্ভব হয়, তেমনি যারা পরিস্থিতির কারণে কলাবরেটর হয়েছিল বা যাদের অপরাধ কম তাদের ক্ষমা করার সুযোগ পান বঙ্গবন্ধু। এটা বিপ্লবোত্তর কোনও দেশে কখনোই সম্ভব হয় না। ওই ক্ষমার মাধ্যমে যে রিকন্সিলিয়েশন বঙ্গবন্ধু শুরু করেছিলেন তা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে বন্ধ করে দেওয়া হয়। দেশে বিভক্তি বজায় রাখার কালচার ও রাজনীতি শুরু হয়। আজ বা আগামী ভবিষ্যতে যে পুনর্গঠন, যে কোনও বড় নেতা শেষ করতে পারবেন। এমনকি এটা এখন শেখ হাসিনার জন্যে খুবই সহজ কাজ। তার কাজের ধারায় এই ঐক্য ও মিলনের পুনর্গঠন আছে। তবে বঙ্গবন্ধু ফিরে এসেছিলেন বলেই এসব কাজ সহজে শুরু হয়েছিল। অন্যথায় ভিন্ন হতে পারতো ইতিহাস।
লেখক: সাংবাদিকতায় সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদকপ্রাপ্ত