৭ মার্চের আগের রাত নির্ঘুম কেটেছিল বঙ্গবন্ধুর


এমরান হোসাইন শেখ ও পাভেল হায়দার চৌধুরী 
  
একাত্তরের সাত মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণবঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ আজ ইতিহাসের অংশ। সেই ঐতিহাসিক ভাষণের আগের রাতটি নির্ঘুম কেটেছিল বঙ্গবন্ধুর।  ১৯৭১ সালের ৬ মার্চ গভীর রাত পর্যন্ত রাজনৈতিক সতীর্থদের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন তিনি।  পরদিন রেসকোর্সে কী বলবেন, তা নিয়ে রীতিমতো ‘হোমওয়ার্ক’ করেছিলেন। ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে আগের রাতে দীর্ঘক্ষণ পায়চারি করে, ভাষণের মূল বিষয়গুলো মনের ভেতরে গেঁথে নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। জ্বর থাকলেও গভীর রাত পর্যন্ত বিশ্রাম করেননি। 

৭ মার্চের ভাষণের প্রস্তুতি এবং সেই সময়ের পারিপার্শ্বিক অবস্থার কথা বাংলা ট্রিবিউনের সামনে তুলে ধরেছেন তৎকালীন স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের দুই প্রভাবশালী নেতা তোফায়েল আহমেদ ও আসম আব্দুর রব। 

জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি) সভাপতি আব্দুর রব বলেন, ৬ মার্চ রাতে বক্তব্যের বিষয়বস্তু নিয়ে দীর্ঘ সময় বৈঠক হয়। গভীর রাত পর্যন্ত বৈঠক করেন তৎকালীন ছাত্র-যুব নেতা সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মনি, আব্দুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ। সেই বৈঠকে বঙ্গবন্ধু বলেন, আমার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের হাই কমান্ড গঠিত হয়েছে ৪ মার্চ। চার নেতা বলেন, বক্তব্যের শেষে এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম ও জয় বাংলা বলে বক্তব্য শেষ করবেন। বঙ্গবন্ধু তার বক্তব্য কিছুটা দিয়ে বললেন, দেখ তো সিরাজ, ঠিক হচ্ছে কিনা? 

বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য এই নেতা আরও বলেন, গভীর রাতে সভা শেষ হয়। বঙ্গবন্ধু ওই রাতে জ্বরে আক্রান্ত ছিলেন। ৭ মার্চের ভাষণে কী বলবেন তা মোটামুটি ঠিক হলে বঙ্গবন্ধু বললেন, তোমরা যাও, আমি বিশ্রাম নেব। তারপর আমরা চলে গেলেও তিনি আর ঘুমাননি। ৩২ নম্বরের বাসায় পায়চারি করেন, আর পরের দিনের বক্তব্য আওড়াতে থাকেন। ওই বৈঠকে ঠিক হয়, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম এসব বলার।  একটু এদিক-সেদিক হতে পারে এমন আশঙ্কা থেকে জনসভাস্থলের মঞ্চে বঙ্গবন্ধুর কাছাকাছি থাকার জন্য আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এদিক-সেদিক হলে বঙ্গবন্ধুকে ইশারা দিয়ে শোধরানোর কথা বলা হয় আমাকে।  

ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের নেতা রব বলেন, ‍গুঞ্জন ছিল, ৭ মার্চ জনসভায় হেলিকপ্টার থেকে গুলি বর্ষণ হতে পারে। তাই খসরু, মন্টু, মহিউদ্দিন ও আমি কর্ডন করে বঙ্গবন্ধুকে জনসভাস্থলে নিয়ে যাই। বঙ্গবন্ধু তার স্বভাবসুলভ ভাবে সিঁড়ি বেয়ে মঞ্চে উঠলেন, আমরাও তার সঙ্গে মঞ্চের উপরে উঠলাম। আমরা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ৪ নেতা স্লোগান দিচ্ছিলাম। লাখ-লাখ জনতার করতালি ও স্লোগানে এক অবিস্মরণীয় দৃশ্যের অবতারণা হয় সেখানে। বঙ্গবন্ধুকে পেয়ে উপস্থিত জনতার মাঝে যেন উত্তেজনার ঢেউ বইতে থাকে। স্লোগান দিতে দিতে অনেকেই বঙ্গবন্ধুকে একবার দেখার জন্য লাফিয়ে উঠছিলেন। কেউ কেউ মাটিতে পড়ে জ্ঞান হারাচ্ছিলেন। কিন্তু মাইকে যখন বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে ‘ভায়েরা আমার’ ভেসে আসে, ঠিক তখন পুরো জনসভাস্থলে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করে।  

রব বলতে থাকেন, ছাত্র জনতা স্লোগান ধরে ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’। ‘পাঞ্জাব না বাংলা, বাংলা, বাংলা’। ‘পিন্ডি না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’। ‘জিন্নাহ মিয়ার পাকিস্তান, আজিমপুর গোরস্থান’। এসব স্লোগান দিতে দিতে ছাত্র-জনতাকে লাফ দিয়ে ১০/১২ হাত উপরে উঠে যেতে দেখি। এ দৃশ্য না দেখলে বলে বোঝানো যাবে না। তারপর বঙ্গবন্ধু প্রায় ২০ মিনিটের ভাষণে পাকিস্তানের ২৩ বছরের শাসনামল, তৎকালীন পরিস্থিতি, আগামী দিনে তিনি না থাকলে কী করতে হবে সেই দিকনির্দেশনা দেন। তার এ বক্তব্য শ্রেষ্ঠ বক্তব্য হিসাবে মূল্যায়ন হয়। ৭ মার্চের ভাষণেই অসহযোগ চলার ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধু।  

সেই ঐতিহাসিক দিনে বঙ্গবন্ধুর পাশে ছিলেন তোফায়েল আহমেদও। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল বলেন, বঙ্গবন্ধু ছিলেন বিচক্ষণ ও দূরদর্শী নেতা। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, কী হতে যাচ্ছে। যে কারণে ৭ মার্চের ভাষণের আগে এ বিষয়ে একটি মানসিক প্রস্তুতি গ্রহণ করে রেখেছিলেন। 

বঙ্গবন্ধুর স্নেহভাজন এই নেতা বলেন, নূরে আলম সিদ্দিকী, শাহজাহান সিরাজ, আসম আব্দুর রব, আব্দুল কুদ্দুস মাখনের নেতৃত্বে গঠিত স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ৩ মার্চ পল্টনে সভা করলো। সেই সভা থেকে বঙ্গবন্ধুকে সর্বাধিনায়ক, জাতির পিতা ইত্যাদি উপাধিতে ভূষিত করা হয়। সেখানে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করা হয়। এর পর ৪, ৫ ও ৬ মার্চ হরতাল চলল। গ্রামেগঞ্জে প্রচণ্ড সংগ্রাম চলে। ৩ মার্চ পল্টনের জনসভায় বঙ্গবন্ধু জানালেন, তিনি ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দেবেন। 

তোফায়েল বলেন, আজ পৃথিবীর ইতিহাসে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ শ্রেষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। এই ভাষণের মধ্য দিয়ে তিনি সমস্ত নিরস্ত্র বাঙালি জাতিকে সশস্ত্র বাঙালি জাতিতে রূপান্তরিত করেছিলেন। তিনি ছিলেন বিচক্ষণ নেতা। যখন মঞ্চে দাঁড়িয়ে ডাক দিলেন ‘ভায়েরা আমার!’ ডাকটা ছিলো হৃদয়ের গভীর থেকে। এটা জনসভা নয়, ছিল জনসমুদ্র। কৃষক এসেছে লাঙ্গলের ফলা নিয়ে, নৌকার মাঝি এসেছে বৈঠা নিয়ে। 

বঙ্গবন্ধুর আস্থাভাজন তোফায়েল আরও বলেন, কত সতর্ক একজন নেতা। শ্রদ্ধেয় ভাবী বঙ্গমাতার কাছে শুনেছি, বঙ্গবন্ধু আগের রাতে অনেক চিন্তা করেছেন ভাষণে কী বলবেন তা নিয়ে। ভাবী তাকে বলেছিলেন ‘সারা জীবন তুমি একটা বিশ্বাস নিয়ে রাজনীতি করেছ। তুমি যেটা বিশ্বাস করো, সেটাই বলবা।’ সত্যিই বঙ্গবন্ধু বিশ্বাসের সঙ্গে আপস করেননি। বিশ্বাসী আত্মা নিয়েই তিনি সেখানে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। 

তিনি বলেন, শুধুমাত্র তার প্রিয় সহকর্মী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও কামরুজ্জামানের সঙ্গে আলোচনা করে ৪টি শর্তারোপের কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, সেনাবাহিনী ব্যারাকে নিয়ে যাও, মার্শাল ল’ প্রত্যাহার করো। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করো এবং গত কয়েক দিনে যেসব লোককে হত্যা করা হয়েছে, সে বিষয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করো। এই ৪টি পয়েন্ট দিয়েই বললেন- আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। যার যা কিছু আছে, তাই দিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে। মনে রেখো, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো। বাংলার মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। তার মানে স্বাধীনতার ঘোষণা করলেন। আবার ৪টি শর্তারোপ করে বিচ্ছিন্নতাবাদী হলেন না। পাকিস্তান ভাঙার দায়িত্ব নিলেন না। তাদের কোর্টে বলটা পাঠিয়ে দিলেন। 

তোফায়েল বলেন, বঙ্গবন্ধু বক্তৃতাটাকে এমনভাবে সাজালেন যে একদিকে স্বাধীনতার ঘোষণাও হলো, অন্যদিকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে আখ্যায়িতও হতে হলো না। অনেকে মনে করেছিলেন, বঙ্গবন্ধু বলবেন আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। অনেক নেতাও আগের দিন তার সঙ্গে দেখা করে স্বাধীনতার কথা বলেছিলেন। জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, আমি জনগণের নেতা, আমি তাদের নেতৃত্ব দেই। তারা আমাকে নেতৃত্ব দেন না। 

তিনি বলেন, আন্দোলনের এক পর্যায়ে মার্চের প্রথম দিন থেকেই উত্তাল হয়ে উঠেছিল ঢাকা। ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে শাজাহান সিরাজ স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেন, বাংলাদেশের পতাকা ওড়ান আসম আব্দুর রব। ওই সমাবেশে জাতীয় সঙ্গীত পর্যন্ত ঠিক করা হয়। কিন্তু মুক্তি আন্দোলনের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার প্রশ্নে সংগ্রামের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত কবে দেবেন, সেই অপেক্ষায় ছিল বাঙালিরা। ৩ মার্চের জনসভায় মহান এই নেতা কোনও বক্তব্য রাখেননি। কিন্তু মানুষের আখাঙ্ক্ষিত বক্তব্য ৭ মার্চ দেবেন বলে ঘোষণা করেছিলেন। 

SUMMARY

676-1.jpg