আশরাফ সিদ্দিকী বিটু
আগস্ট বাঙালির শোকের মাস। ১৫ আগস্ট জাতির সবচেয়ে বেদনাবিধুর দিন, জাতীয় শোক দিবস। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ভোররাতে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। একইসঙ্গে হত্যা করা হয় তার পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়দের। দেশের বাইরে থাকায় বেঁচে যান দুই বোন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম এই হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিনী মহিয়সী নারী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর একমাত্র ভ্রাতা শেখ আবু নাসের, জাতির জনকের জ্যেষ্ঠ পুত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা, বাংলাদেশ ফুটবলের আধুনিকতার স্রষ্টা, আবাহনীর প্রতিষ্ঠাতা ও সাংস্কৃতিক জগতের অন্যতম পুরোধা শেখ কামাল, বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় পুত্র বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গর্বিত বীর সেনানী, বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ জামাল, বঙ্গবন্ধুর আদরের কনিষ্ঠ পুত্র নিষ্পাপ শিশু শেখ রাসেল, শেখ কামালের স্ত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ব্লু’ উপাধিপ্রাপ্ত দেশসেরা অ্যাথলেট সুলতানা কামাল ও শেখ জামালের রোজী জামাল, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ষাটের দশকের ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মণি ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী বেগম আরজু মণি, স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম সংগঠক কৃষক নেতা জাতির জনকের ভগ্নিপতি তার মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, তার ছোট মেয়ে বেবী সেরনিয়াবাত, কনিষ্ঠ পুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত আব্দুল্লাহ বাবু, ভাইয়ের ছেলে শহীদ সেরনিয়াবাত, আব্দুল নঈম খান রিন্টু, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন রক্ষায় এগিয়ে আসা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গর্ব বঙ্গবন্ধুর প্রধান নিরাপত্তা অফিসার কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদ ও কর্তব্যরত অনেক পুলিশ কর্মকর্তা-কর্মচারী।
১৫ আগস্ট সকালেই বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মোশতাক কুচক্রীদের নিয়ে ক্ষমতা দখল করে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন। অথচ রাষ্ট্রপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ১৫ আগস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দেওয়ার কথা ছিল। সুপরিকল্পিত এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে দেশি-বিদেশি আন্তর্জাতিক চক্র জড়িত ছিল, পাশাপাশি সেনা বাহিনীর চাকরিচ্যুত কিছু অফিসারসহ খন্দকার মোশতাক আহমেদ, জিয়াউর রহমান (পরে আর্মি প্রধান ও রাষ্ট্রপ্রধান) ও আরও গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক স্খলিত নেতা জড়িত ছিলেন। ১৫ আগস্টের ধারাবাহিকতায় ঘটে আরেকটি হত্যাকাণ্ড যা মূলত আওয়ামী লীগকে চিরতরে নেতৃত্ব শূন্য করার জন্য, ৩রা নভেম্বর ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করা হয় জাতীয় চার নেতাকে। মূলত খন্দকার মোশতাক তার ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার জন্য তার নির্দেশে তাদের হত্যা করা হয়। তাজউদ্দীন আহমেদ ও সৈয়দ নজুরল ইসলাম ১ নম্বর সেলে ছিলেন। পরের সেলে ছিলেন ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামান। তাদের একসেলে এনে জড়ো করা হয়, রিসালদার মোসলেমউদ্দীন খুব কাছে থেকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে তাদের গুলি করে হত্যা করেন। ১৫ আগস্টের চক্রই জাতীয় চার নেতাকেও হত্যা করে।
১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর শুক্রবার ঘোষিত রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করেন। ‘দ্য বাংলাদেশ গেজেট, পাবলিশড বাই অথিউরিটি’ লেখা অধ্যাদেশটিতে খন্দকার মোশতাকের স্বাক্ষর আছে। মোশতাকের স্বাক্ষরের পর আধ্যাদেশে তৎকালীন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব এম এইচ রহমানের স্বাক্ষর আছে। অধ্যাদেশটিতে দুটি ভাগ আছে। প্রথম অংশে বলা হয়েছে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বলবত আইনের পরিপন্থী যা কিছুই ঘটুক না কেন, এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টসহ কোনও আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনও আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না।
দ্বিতীয় অংশে বলা আছে, রাষ্ট্রপতি উল্লিখিত ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে যাদের প্রত্যয়ন করবেন তাদের দায়মুক্তি দেওয়া হলো। অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে কোনও আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনও আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না।
জেল হত্যার পর গৃহবন্দি থেকে কপালগুণে বেঁচে যাওয়া মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর রাষ্ট্রক্ষমতা নিয়ন্ত্রণকারী হিসেবে আবিভূর্ত হন। তখন বিচারপতি সায়েম রাষ্ট্রপতি ছিলেন। ’৭৬ এর ২৯ এপ্রিল সায়েম জিয়ার কাছে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব হস্তান্তর করেন এবং ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল সায়েম রাষ্ট্রপতির পদ থেকে পদত্যাগ করলে জিয়া রাষ্ট্রপতি হন।
বঙ্গবন্ধু’৭৫-এর ১৫ আগস্ট থেকে ‘৭৯ সালের ৯ এপ্রিল পর্যন্ত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশসহ চার বছরে সামরিক আইনের আওতায় সব অধ্যাদেশ, ঘোষণাকে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে আইনি বৈধতা দেওয়া হয়। সংশোধনীটি পাস হয় ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল। সংসদে উত্থাপিত আইনটির নাম ছিল ‘সংবিধান (পঞ্চম সংশোধনী) আইন, ১৯৭৯’। এটি এখন সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের ১৮ অনুচ্ছেদে সংযুক্ত আছে। এতে বলা হয়েছে, ‘‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হইতে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল তারিখের (উভয় দিনসহ) মধ্যে প্রণীত সব ফরমান, ফরমান আদেশ, সামরিক আইন প্রবিধান, সামরিক আইন আদেশ, অন্যান্য আইন ও ওই মেয়াদের মধ্যে অনুরূপ কোনও ফরমান দ্বারা এই সংবিধানের যে সব সংশোধন, সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন ও বিলোপসাধন করা হইয়াছে, তাহা এবং অনুরূপ কোনও ফরমান, সামরিক আইন প্রবিধান, সামরিক আইন আদেশ বা অন্য কোনও আইন হইতে আহরিত বা আহরিত বলিয়া বিবেচিত ক্ষমতাবলে, অথবা অনুরূপ কোনও ক্ষমতা প্রয়োগ করিতে গিয়া বা অনুরূপ বিবেচনায় কোনও আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রণীত কোনও আদেশ কিংবা প্রদত্ত কোনও দণ্ডাদেশ কার্যকর বা পালন করিবার জন্য উক্ত মেয়াদের মধ্যে কোনো ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রণীত আদেশ, কৃত কাজকর্ম, গৃহীত ব্যবস্থা বা কার্যধারাসমূহ, অথবা প্রণীত, কৃত, বা গৃহীত বলিয়া বিবেচিত আদেশ, কাজকর্ম, ব্যবস্থা বা কার্যধারাসমূহ এতদ্বারা অনুমোদিত ও সমর্থিত হইল এবং ওই সকল আদেশ, কাজকর্ম, ব্যবস্থা বা কার্যধারাসমূহ বৈধভাবে প্রণীত, কৃত বা গৃহীত হইয়াছে বলিয়া ঘোষিত হইল, এবং তত্সম্পর্কে কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা কর্তৃপক্ষের নিকট কোনো কারণেই কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।’’
সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে বৈধতা দেওয়ায় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত অপরাধীরা দায়মুক্তি পেয়ে যায়। মোশতাকের জারি করা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি জিয়াউর রহমানের শাসনামলে বৈধতা দেওয়া না হলে ১৯৭৯ সালের ৯ এপ্রিল সামরিক আইন প্রত্যাহারের সঙ্গে-সঙ্গেই ১৫ আগস্টের খুনিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যেতো। কিন্তু জিয়া তা করেননি। কারণ তিনি নিজেই এই ঘৃণ্য কাপুরুষিত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পরিকল্পনার কথাটি জানতেন জিয়া। ফারুক রহমান ১৫ আগস্টের পাঁচ মাস আগেই তাকে জানায় তখন জিয়া সেনাবাহিনীর উপ-প্রধান ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ২০ মার্চ ফারুক তাদের ষড়যন্ত্রের কথা জানালে জিয়া জবাবে বলেছিলেন, ‘তোমরা করতে চাইলে করতো পারো, কিন্তু আমি তাতে যোগ দিতে পারবো না’। এ প্রসঙ্গে গোলাম মুরশিদ তার ‘মুক্তিযু্দ্ধ ও তার পর’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন, দেশের রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করার প্রায় পাঁচ মাস আগে থেকেই জিয়া জানতেন। কিন্তু সেনাপ্রধান অথবা রাষ্ট্রপতি কাউকেই তিনি এ কথা জানাননি। এটা তার পবিত্র দ্বায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা।
এ নিয়ে কথা বলেছেন মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফস্যুলজ, তিনি বলেছেন, ‘১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পেছনে প্রয়াত জিয়াউর রহমান ছিলেন মূল ছায়া ব্যক্তি’। ভারতের প্রখ্যাত কলামিস্ট কুলদীপ নায়ার জনপ্রিয় ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য ট্রিবিউন’-এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলেছেন, খালেদা জিয়ার স্বামী জেনারেল জিয়াউর রহমান এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে ওয়াকিফহাল ছিলেন। জেনারেল জিয়া তাদের সঙ্গে যোগ দিতে চাননি। জানা যায়, তিনি অভ্যুত্থানকারীদের বলেছিলেন, সফল হলে তিনি তাদের রক্ষা করবেন এবং তিনি তা করেও ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের যেন শাস্তি না হয়, জিয়া তার ব্যবস্থা করেছিলেন।’
জিয়াউর রহমান নিজেও নির্মমভাবে নিহত হন ষড়যন্ত্রকারীদের দ্বারা, তার মৃত্যুর পর বিচারপতি আবদুস সাত্তার, এইচ এম এরশাদ ও ১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এলেও ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি বাতিল বা রহিত করেননি। জিয়াসহ এই সবাই খুনিদের বিচার না করে তাদের বিদেশে পাঠিয়ে চাকরি দিয়েছি এমনকি সংসদ সদস্যও বানানো হয়। ফলে খুনিরা ১৫ আগস্টের হত্যার কথা প্রকাশে ও প্রচারে কোনও দ্বিধাই করেনি বরং ঔদ্ধত্য দেখাতে সক্ষম হয়েছে, দেশে বিদেশে চাকরি ব্যবসা করে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে বিলাস জীবন যাপন করেছে। জিয়া, এরশাদ, খালেদা কেউই ইতিহাসের এ কলঙ্কজনক হত্যাকাণ্ডের বিচার না করে তাদের সরকারগুলো নির্লজ্জর মতো বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বহুভাবে সহযোগিতা করেছে। জিয়া রাষ্ট্রপতি থেকে এসব খুনিদের বিদেশে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোতে চাকরি ও পদোন্নতির ব্যবস্থা করেছিলেন। এমনকি দেশের ভেতরে অভ্যুত্থানের চেষ্টার সঙ্গে এরা জড়িত থাকলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা না নিয়ে বিদেশ পালাতে সাহায্য করেন। এরশাদও তার আমলে এসব বহাল রেখে দূতাবাসগুলোতে খুনিদের পদোন্নতি ও সহযোগিতার ধারা অব্যাহত রাখেন এবং তারা এরশাদের সাহায্যে দেশে ফিরে রাজনৈতিক দল (প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তি ও ফ্রিডম পার্টি) গঠন করে। তাদের সংসদে বসারও সুযোগ করে দেওয়া হয়, খালেদাও এসব ঘৃণ্য খুনিদের সাহায্য সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছিলেন।
উল্লেখ্য, ১৯৭৬ সালের ৮ জুন ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের অভিযুক্ত হত্যাকারী গোষ্ঠীর ১২ জনকে বিশ্বে বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দেওয়া হয়েছিল। তাদের মধ্যে—লে. কর্নেল শরিফুল হককে (ডালিম) চীনে প্রথম সচিব, লে. কর্নেল আজিজ পাশাকে আর্জেন্টিনায় প্রথম সচিব, মেজর এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদকে আলজেরিয়ায় প্রথম সচিব, মেজর বজলুল হুদাকে পাকিস্তানে দ্বিতীয় সচিব, মেজর শাহরিয়ার রশিদকে ইন্দোনেশিয়ায় দ্বিতীয় সচিব, মেজর রাশেদ চৌধুরীকে সৌদি আরবে দ্বিতীয় সচিব, মেজর নূর চৌধুরীকে ইরানে দ্বিতীয় সচিব, মেজর শরিফুল হোসেনকে কুয়েতে দ্বিতীয় সচিব, কর্নেল কিসমত হাশেমকে আবুধাবিতে তৃতীয় সচিব, লে. খায়রুজ্জামানকে মিসরে তৃতীয় সচিব, লে. নাজমুল হোসেনকে কানাডায় তৃতীয় সচিব, লে. আবদুল মাজেদকে সেনেগালে তৃতীয় সচিব হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।
তাদের নিয়োগপত্র ঢাকা থেকে লিবিয়ায় পৌঁছে দিয়েছিলেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন কর্মকর্তা ও পরবর্তীকালে পররাষ্ট্রসচিব শমসের মবিন চৌধুরী (বর্তমানে খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা)। এর আগে ওই বছরের ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে তাদের সঙ্গে আলোচনা-সমঝোতার জন্য ঢাকা থেকে সেসময়কার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নুরুল ইসলাম (শিশু) ঢাকা থেকে লিবিয়া গিয়েছিলেন। ১৯৮০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জিয়াউর রহমানের নির্দেশে খুনিদের বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে (ফরেন সার্ভিস ক্যাডার) অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া হয়। সে সময়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্রে এসব জানা গিয়েছিল। ১২ জন সেনা কর্মকর্তা চাকরিতে যোগ দিতে রাজি হলেও ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের প্রধান দুই হোতা কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান ও কর্নেল খন্দকার আব্দুর রশীদ সরকারের সঙ্গে সমঝোতা ও চাকরি গ্রহণে রাজি না হয়ে লিবিয়ার সদ্যপ্রয়াত প্রেসিডেন্ট কর্নেল গাদ্দাফির দ্বারস্থ হয়ে সুযোগ-সুবিধা নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করে প্রতিষ্ঠা পান। ধারণা করা হয়, তাদের একজন গাদ্দাফির সামরিক বাহিনীর উপদেষ্টাও ছিলেন।
এরশাদ সরকারের আমলেও খুনিরা বিদেশে যাওয়া, ব্যবসা বাণিজ্য চাকরি পদোন্নতি সুবিধা পান। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে আরও জানা যায়, মেজর ডালিমকে বেইজিং থেকে হংকংয়ে চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে তাকে পোল্যান্ডের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স নিয়োগ দেওয়া হলে পোল্যান্ড সরকার তাকে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। পরে তাকে কেনিয়ায় হাইকমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। মেজর নূর তখন ব্রাজিলে চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এর আগে তিনি আলজেরিয়ায় কাউন্সিলর হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন। মেজর রাশেদ চৌধুরী টোকিওতে কাউন্সিলর পদে নিযুক্ত ছিলেন। মেজর এ কে এম মহিউদ্দিন সৌদি আরবের মিশন উপপ্রধান হিসেবে (বেনজির ভুট্টোর সরকারও করাচিতে একই পদে তার নিয়োগ গ্রহণ করেনি), মেজর শরিফুল হোসেন ওমানে চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স এবং লেফটেন্যান্ট খায়রুজ্জামান সে সময় ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরিচালক পদে ছিলেন। শেষোক্ত জন ছাড়া বাকি সবাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মিনিস্টার হিসেবে পদোন্নতি পেয়েছিলেন।
সত্তরের দশকের শেষে রাষ্ট্রপতি জিয়ার শাসনামলে বিদেশে অবস্থানরত খুনি গোষ্ঠীর শরিফুল হক (ডালিম), আজিজ পাশা, বজলুল হুদা ও নূর চৌধুরীসহ এই অভিযুক্তরা ১৯৮০ সালের ১৭ জুন ঢাকা সেনানিবাসে একটি অভ্যুত্থানের চেষ্টা করেছিলেন। সেনাবাহিনী অগ্রিম খবর পেয়ে তা ব্যর্থ করে দেয়। অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়ে গেলে ডালিম, হুদা ও নূর বিদেশে নিজ নিজ কর্মস্থল ত্যাগ করে বিভিন্ন দেশে পালিয়ে যান। আজিজ পাশা তখন ঢাকায় থাকায় গ্রেফতার হন। তিনি রাজসাক্ষী হতে রাজি হন এবং পরে তাকে চাকরিতে পুনর্বহাল করে সরকার কূটনীতিকের দায়িত্ব দিয়ে রোমে পাঠায়। পরবর্তী সময়ে তাকে ঢাকায় পররাষ্ট্র ও অর্থ মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল বলে জানা যায়। পরে ডালিম, হুদা ও নূরকেও বিভিন্ন দেশে আবার কূটনীতিকের দায়িত্বে পুনর্বহাল করা হয় এবং তারা একাধিক পদোন্নতি পান। শুধু অভ্যুত্থান-প্রচেষ্টা নয়, খুনিচক্রের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগও ছিল যে, বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসের দায়িত্ব পালনকালে তারা বহু অনিয়ম, শৃঙ্খলাভঙ্গ ও অর্থ অপচয় করেছেন। শেষ পর্যন্ত ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর শরিফুল হক (ডালিম), আজিজ পাশা, এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ, রাশেদ চৌধুরী ও নূর চৌধুরী—এই ছয় অভিযুক্তকে সরকারি চাকরিবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে চাকরিচ্যুত করা হয়।
শাহরিয়ার রশিদ ও বজলুল হুদার ’৮০ সালের ১৭ জুন অভ্যুত্থান-প্রচেষ্টায় জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়ার পরও তাদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা না নিয়ে এরশাদ সরকারের আমলে ঢাকায় আসতে দেওয়া হয়। তারা ঢাকায় এরশাদ সরকার ও গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক শক্তি (প্রগশ) নামের একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। পরে বজলুল হুদা ফ্রিডম পার্টিতে যোগ দেন। এর পরপরই আমরা দেখি, ১৯৮৫ সালে লে. কর্নেল ফারুক ও লে. কর্নেল রশিদ ‘১৫ আগস্ট বিপ্লবের আদর্শ বাস্তবায়ন’ সংগঠনের নামে ঢাকায় এসে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করেন। ১৯৮৬ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে লে. কর্নেল ফারুক প্রার্থী হন। ১৯৮৭ সালের ৩ আগস্ট হোটেল শেরাটনে সংবাদ সম্মেলন করে কর্নেল ফারুক রহমানকে সভাপতি করে ফ্রিডম পার্টি প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছিলেন কর্নেল রশিদ। ফ্রিডম পার্টির প্রার্থী হিসেবে বজলুল হুদাকে ’৮৮ সালের সংসদ নির্বাচনে মেহেরপুর-২ আসন থেকে সাংসদ নির্বাচিত করা হয়। স্বৈরাচারী এরশাদ গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে একটি সন্ত্রাসী রাজনৈতিক দল হিসেবে ফ্রিডম পার্টিকে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। ফ্রিডম পার্টি গঠনের পরপরই ৭ নভেম্বর লে. কর্নেল রশিদের নির্দেশে ঢাকায় প্রেসক্লাব চত্বরে একটি সভাকে কেন্দ্র করে ফ্রিডম পার্টির ক্যাডাররা পাঁজেরো থেকে প্রকাশ্যে গোলাগুলি করলে এক কিশোরের মৃত্যু হয়েছিল। পরের বছর ১১ ফেব্রুয়ারি ময়মনসিংহে একইভাবে বজলুল হুদা ও তার ক্যাডার বাহিনীর গুলিতে একজন ব্যবসায়ী মারা যান। ওই সময়ের দৈনিক সংবাদপত্রের মাধ্যমে এসব খবর জানা গিয়েছিল। এরপর খালেদা জিয়া তার স্বামীর দেখানো পথ অনুসরণ করে লে. কর্নেল রশিদকে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনে ফ্রিডম পার্টির প্রার্থী হিসেবে কুমিল্লা-৬ আসন থেকে সাংসদ নির্বাচিত করা হয় এবং বিরোধী দলের নেতাও করা হয় রশিদকে।
নানা ষড়যন্ত্রে মাধ্যমে এভাবে দীর্ঘদিন জাতির জনকের হত্যার বিচারের পথ রুদ্ধ করে রাখা হয়। এমনকি কোনও মামলাও করতে দেওয়া হয়নি। শোক দিবস পালন করতে দেওয়া হয়নি আওয়ামী লীগকে, দলের লক্ষ-কোটি নেতাকর্মীদের শোক দিবস পালনে বাধা দেওয়া হয় জিয়া, এরশাদ, খালেদার সময়। যদিও সব বাধা উপেক্ষা করে কোটি কোটি আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী সর্মথক ১৫ আগস্ট শোক দিবস পালন করে আসছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ২১ বছর ক্ষমতায় আসার পর ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস সরকারিভাবে ঘোষণা করে। ১৯৯৮ সালে ৮ আগস্ট এই ঘোষণা করা হয় যে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস পালন ও এ দিবস সরকারি ছুটির দিন। পালনও শুরু হয় যথার্থ মর্যাদার মধ্য দিয়ে কিন্তু পরবর্তী সময়ে বিএনপি জামায়াত ক্ষমতায় এসে ২০০২ সালে ২ আগস্ট তা বাতিল করে দেয়। গত ২৭ জুলাই-২০০৮ তে হাইকোর্টের এক যুগান্তকারী রায়ে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস ও সরকারি ছুটি বহাল রাখার পক্ষে রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৮ সাল থেকে ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদাতবার্ষিকী জাতীয় শোক দিবস রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন ও দিনটি সরকারি ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রক্রিয়া শুরু করতে আইনি বাধা দূর করতে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলের জন্য ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ (রহিতকরণ) বিল, ১৯৯৬ সালে সপ্তম সংসদে উত্থাপন করা হয়। ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর আইনটি সংসদে পাস হয়। ১৪ নভেম্বর রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের পর এটি পরিপূর্ণভাবে আইনে পরিণত হয়। এর মাধ্যমে মোশতাকের জারি করা ও জিয়ার সময় বৈধতা পাওয়া ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি বিলুপ্ত হয়। এরপর ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা দায়ের করা হয় ও আইনি প্রক্রিয়া শুরু হয়। ২ অক্টোবর, ১৯৯৬ সালে ধানমন্ডি থানায় মামলা করেন মামলার বাদী বঙ্গবন্ধুর রেসিডেন্ট পিএ আ ফ ম মুহিতুল ইসলাম। মামলায় অভিযোগ গঠন হয় ’৯৮-এর ৬ এপ্রিল। শুনানির সমাপ্তি হয় ১৩ অক্টোবর, ১৯৯৮ এবং নিম্ন আদালতে রায় ঘোষণা হয় ৮ নভেম্বর, ১৯৯৮। ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল রায় ঘোষণা করে ১৫ জন আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেন। চার আসামি হাইকোর্টে করা আপিল ২০০০ সালের ৩০ মার্চ হাইকোর্টের কার্যতালিকায় রাখা হয়। ২৮ জুন এক দ্বৈত বেঞ্চে শুনানি শুরু হয় এবং ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর সিনিয়র বিচারপতি মো. রুহল আমীন ১০ আসামির ফাঁসির দণ্ড বহাল রাখেন। অন্যদিক কনিষ্ঠ বিচারপতি এ বি এম খায়রুল ১৫ আসামির ফাঁসি বহাল রাখেন। ২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল তৃতীয় বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকার পক্ষে রায় দেন। ২০০১ সালের অক্টোবরে নির্বাচনে বিএনপি জামাত ক্ষমতায় আসে। ওই ৫ বছরে লিভ টু আপিলের কোনও শুনানি হয়নি। বিচারক সংকটের কারণে শুনানি সম্ভব হয়নি বলে সরকার বলে। ফলে বিএনপি জামাত রাজনৈতিক কারণে মামলার নিষ্পত্তি করেনি। ২০০৭ সালে সেনা-সমর্থিত সরকারও বিচারকের সংকট বলে শুনানি অব্যাহত রাখার ব্যবস্থা করেনি। দুই বছর পর ২০০৯ সালে পরে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আপিল বিভাগের বিচারক সংখ্যা ৭ থেকে ১১ তে উন্নীত করা হয়। ফলে ৫ অক্টোবর, ২০০৯ এ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার শুনানি শুরু হয়। ১২ নভেম্বর, ২০০৯ সালে সুপ্রিম কোর্ট আপিল বিভাগে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার শুনানি ২৯ কার্যদিবসে শেষ হয়। ১৯ নভেম্বর, ২০০৯ এ বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার চূড়ান্ত রায়ের তারিখ ঘোষণা ও তৃতীয় বেঞ্চের রায় বহাল রেখে পাঁচ আসামির আপিল খারিজ করা হয় এবং ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়। ২৪ জানুয়ারি, ২০১০ রিভিউ পিটিশনের ওপর শুনানি শুরু হয় যা ২৭ জানুয়ারি, ২০১০ তারিখ পিটিশনের খারিজ করে দিয়ে রায় বহাল। ওই দিনই রাতেই অর্থাৎ ২৭ জানুয়ারি রাত ১২টা ১ মিনিটে থেকে ১২টা ২৫ মিনিটে (অর্থাৎ ২৮ জানুয়ারি ২০১০) ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি বঙ্গবন্ধুর খুনি লে. কর্নেল (অব.) মহিউদ্দিন আহমেদ (আর্টিলারি), লে. কর্নেল (অব.) একেএম মহিউদ্দিন আহমেদ (ল্যান্সার), মেজর (অব.) বজলুল হুদা, লে. কর্নেল (বরখাস্ত) সৈয়দ ফারুক রহমান ও লে. কর্নেল (অব.) সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খানের ফাঁসি কার্যকর হয়। আর অন্যদিকে ৬ আসামি পলাতক রয়েছে। এরা হলো লে. কর্নেল (অব.) খোন্দকার আব্দুর রশিদ, লে. কর্নেল (অব.) শরিফুল হক ডালিম, লে. কর্নেল (অব.) এ এম রাশেদ চৌধুরী, লে. কর্নেল (অব.) এন এইচএমবি নূর চৌধুরী, ক্যাপ্টেন আব্দুল মাজেদ, রিসালদার মোসলেহ উদ্দিন। লে. কর্নেল (অব.) আব্দুল আজিজ পাশা ২০০১ সালে জিম্বাবুইয়েতে মারা যান।
বঙ্গবন্ধুর পলাতক ছয় খুনির চার জনের ব্যাপারে অবস্থান নিশ্চিত নয় সরকার। দু’জনকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। সরকারের মন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খুনিদের ফিরিয়ে আনা হবে। লেফটেন্যান্ট কর্নেল নূর চৌধুরী কানাডায় এবং লে. কর্নেল রাশেদ চৌধুরী যুক্তারাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। সরকারের মন্ত্রীরা বলেছেন, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে তাদের ফিরিয়ে আনতে আইনজীবী নিয়োগের মাধ্যমে আইনি প্রক্রিয়া শুরু করার পাশাপাশি কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চলছে। দুই খুনি সাবেক ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদ ও রিসালদার মোসলেহউদ্দিনকে খুঁজে বের করতে ঢাকা বারবার ভারতের সহায়তা কামনা করেছে। এ বিষয়ে ২০১১ সালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এসএম কৃষ্ণার বাংলাদেশ সফরকালে তার কাছে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফিরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়। পি. চিদাম্বরাম বলেছিলেন, ‘তারা যদি ভারতে থেকে থাকে তাহলে এটা সম্ভব ও দোষী সাব্যস্ত দুই খুনিকে খুঁজে বের করতে নয়াদিল্লি সাহায্যের হাত বাড়াবে। গোয়েন্দাদের ধারণা, খুনিরা বিভিন্ন দেশে পালিয়ে বেড়াচ্ছে এবং অপরাধীরা নিরাপত্তা বেড়াজালে এড়াতে এক দেশ থেকে অন্য দেশে তাদের অবস্থান পরিবর্তন করছে। যদিও ১৯৯৭ সালের সেপ্টেম্বরে পলাতক খুনিদের আটকের ব্যাপারে ইন্টারপোল-এর মাধ্যমে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছিলো। দশ বছর পর মূল আদেশের কার্যকারিতা অবসান হওয়ার কারণে ২০১০ সালের জানুয়ারিতে সরকার ওই পরোয়ানা নবায়ন করে ফলে ইন্টারপোলের রেড অ্যালার্ট এখনও জারি আছে। ৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর আত্মস্বীকৃত খুনিদের দেশে ফিরিয়ে আনতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ওয়ালিউর রহমানকে সমন্বয়কারী করে একটি সেল গঠন করা হয়। সরকার ওই সময় এক প্রজ্ঞাপন জারি করে বিভিন্ন মিশনে দায়িত্ব পালনকারী আত্মস্বীকৃত খুনিদের চাকরিচ্যুত করে। সে সময় থাইল্যান্ডের সঙ্গে প্রত্যর্পণ চুক্তি সইয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশে ফেরত আনা হয়েছিল মেজর (অব.) বজলুল হুদাকে।
উল্লেখ্য, আইনি কাঠামো না থাকলেও যুক্তরাষ্ট্র থেকে অভিযুক্ত মেজর মহিউদ্দিনকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর সরকারের অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠানো হয়। তাই এটাও বিবেচ্য যে শুধু কোনও প্রত্যর্পণ চুক্তি না থাকলেও আলোচনা ও কূটনৈতিক যোগযোগের মাধ্যমে খুনিদের ফিরিয়ে আনা সম্ভব যা আশা ব্যঞ্জক। কানাডায় পালিয়ে থাকা পলাতক নূর চৌধুরীকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য এই সরকার গঠনের পর থেকে দ্বি-পাক্ষিক সমঝোতার চেষ্টা করছে সরকার। তাছাড়া সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হয়েছে। বৈঠকে সব গোয়েন্দাসংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। পলাতক খুনিদের অবস্থান অতিসত্বর সরকারকে জানাতে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রতি নির্দেশ দেওয়া হয়। খুনিদের ছবি আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোল ছাড়াও বিশ্বের প্রতিটি বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন বিভাগে রাখার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে বলা হয়েছে। এ ব্যাপারে কাজ করে যাচ্ছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। আমরাও চাই এইসব প্রক্রিয়া ফলপ্রসূ হোক।
ইতোমধ্যে বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জানা যায় বিদেশে পলাতক বঙ্গবন্ধুর খুনিরা মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করতে তৎপরতা শুরু করেছে। সত্যি উদ্বেগের বিষয়। এছাড়া পলাতক খুনিরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালিয়ে বেড়াচ্ছে, ইতোমধ্যেই আমেরিকা, কানাডা, জার্মানি, থাইল্যান্ড, লিবিয়া, ভারত, পাকিস্তান, ব্রিটেন, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, ইতালি, লেবানন, পোল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, চীন, হংকং ও কেনিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যাতায়াত করেছে, তবে বেশি দিন না থেকে দ্রুতই অবস্থান পরিবর্তন করে চলেছে। এসব দেশে অবস্থান করে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলসহ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর চোখকে ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করছে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পলাতক ৬ খুনির মধ্যে একজন লে. কর্নেল (অব.) এম রাশেদ চৌধুরী। রাশেদ চৌধুরী কোথায় আছে তার অবস্থান সম্পর্কে সর্বশেষ তথ্য হচ্ছে, সে আমেরিকা, কানাডা, থাইল্যান্ড, জার্মানি ও লিবিয়ায় ঘুরে ফিরে বারবার দেশ বদল করছে। অন্য খুনি লে. কর্নেল (অব.) এসএইচএমবি নূর চৌধুরী কানাডায় অবস্থান করলেও মাঝে মধ্যেই পাকিস্তানে যাতায়াত করছে। রিসালদার মোসলেমউদ্দিন ভারত কিংবা পাকিস্তানে থাকার তথ্য আছে। লে. কর্নেল (অব.) ব্রিটেন, লিবিয়া, থাইল্যান্ড, আমেরিকা, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, ইতালি, লেবানন, পোল্যান্ড, সুইজারল্যান্ডে বারবার অবস্থান বদল করে চলেছে। মেজর (অব) শরিফুল হক ডালিম ব্রিটেন, থাইল্যান্ড, আমেরিকা, লিবিয়া, চীন, হংকং ও কেনিয়ায় ঘুরেফিরে অবস্থান করার তথ্য আছে। ভারত অথবা পাকিস্তানে আত্মগোপন করে আছে ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল মাজেদ।
বিদেশের প্রায় ১৭ দেশে ঘুরে ফিরে আত্মগোপন করে চলেছে খুনিরা। খুনিরা যেখানেই গেছে সেখানে বসে নানাভাবে বাংলাদেশে বিরুদ্ধে, দেশের গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে, মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে। দেশের ক্ষতি করতে চেয়েছে। যেকোনও মূল্যে এদের দেশে ফিরিয়ে এনে মৃত্যুদণ্ডের রায় কার্যকর করে জাতিকে পুরো কলঙ্কমুক্ত করতে হবে নতুবা এসব স্বঘোষিত খুনি আরেকটা ১৫ আগস্ট ঘটানোর অপচেষ্টা করতে পারে। দেশের গণতন্ত্র অব্যাহত রাখতে এই ঘৃণ্য, দেশবিরোধী, পলাতক খুনিদের এ সরকারের মেয়াদেই ফিরিয়ে এনে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হোক। চির নির্মূল হোক সব অপশক্তি।
শোককে শক্তিতে পরিণত করে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এই বাংলাদেশকে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশে পরিণত করতে সব অপশক্তিকে নির্মূল করতে হবে এবং উন্নয়নের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে হবে।
জাতির পিতা আমাদের অমিত প্রেরণার উৎস। চিরকালের শক্তি। তিনি অমর অবিনশ্বর। জাতির পিতার আদর্শই আমাদের আদর্শ। আমরা অপশক্তিকে পরাজিত করে আদর্শের পথে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবই।
তথ্যসূত্র:
আওয়ামী লীগের দলীয় ওয়েব সাইট, www.albd.org
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: জীবন ও রাজনীতি, দ্বিতীয় খন্ড।
বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক,
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা, মামলার রায় ও রায় কার্যকরের তথ্য ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসের জাতীয় দৈনিক সমূহ ও দলীয় ওয়েব সাইট।
বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা।
“মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর” ; গোলাম মুরশিদ।
www.bangabandhu.net