‘অ্যাই বেয়াদবি করছিস কেন’?

পাভেল হায়দার চৌধুরী 
  
সংগৃহীত‘অ্যাই বেয়াদবি করছিস কেন’?—১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালো রাতে শাহাদাত বরণের ঠিক পূর্বমুহূর্তে ঘাতকদের উদ্দেশে উচ্চস্বরে এ কয়টি শব্দ উচ্চারণ করেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ওই রাতে ঘাতকদের মুখোমুখি হতে ধানমণ্ডির ঐতিহাসিক ৩২ নম্বর বাড়ির দোতলা থেকে সিঁড়ি দিয়ে নিচতলায় নামতে নামতে বঙ্গবন্ধু আরও বলেছিলেন, ‘তোরা কী চাস?’ ১৫ আগস্টের কালো রাতের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, জাতির জনকের ব্যক্তিগত সহকারী আব্দুর রহমান শেখ রমা ভয়াল সেই রাতের স্মৃতিগুলো এভাবে তুলে ধরেন। পঁচাত্তরের ১৫ অগাস্ট, ভোররাতে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রান্ত হওয়ার রাতে যে ঘরে বঙ্গবন্ধু ছিলেন, তার পাশেই বারান্দায় ঘুমিয়েছিলেন আব্দুর রহমান শেখ রমা।
মৃত্যুর আগেও জাতির জনকের উচ্চারণগুলোও সন্তানদের প্রতি পিতৃসুলভ ছিল উল্লেখ করে আব্দুর রহমান শেখ রমা আরও বলেন, ঘাতকের দল বঙ্গবন্ধুর অভিভাবকসুলভ ওই উচ্চারণের মর্মার্থই বুঝল না। তারা সিঁড়ি রুমেই জনকের বুক বিদীর্ণ করে দিল বুলেটের আঘাতে। সিঁড়িতেই বঙ্গবন্ধুর নিথর দেহ পড়ে রইল। শুধু বঙ্গবন্ধুই নন, ঘাতকদের হাত থেকে সেদিন রেহাই পায়নি বঙ্গবন্ধুর আদরের সন্তান ছোট্ট শিশু রাসেলও। তারা বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামালকে দিয়ে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে আর শেষ করে ঐতিহাসিক ওই বাড়িটি সারাদিন যে মাতিয়ে রাখত, সেই শিশু রাসেলকে দিয়ে। ওই দিন ঘাতকের দলকে বঙ্গবন্ধুর অভিভাবকসুলভ উচ্চারণ যেমন থামাতে পারেনি, তেমনি থামাতে পারেনি শিশু রাসেলের আকুতিও।  
সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে  আব্দুর রহমান শেখ রমা আরও বলেন, সেদিন ভোররাতের আগেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার আত্মীয় ও মন্ত্রিসভার সদস্য আবদুর রব সেরনিয়াবাতের হত্যাকাণ্ডের খবর পেয়ে যান। তখন ওপর থেকেই বঙ্গবন্ধু নিচতলায় তার ব্যক্তিগত সহকারী এএফএম মহিতুল ইসলামকে টেলিফোন করে বলেন, সেরনিয়াবাতের বাসায় দুষ্কৃতকারীরা আক্রমণ করেছে। জলদি পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফোন করতে হবে। কিন্তু পুলিশ কন্ট্রোল রুমে ফোন করেও কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া যায়নি।
সেদিন ভোর রাতে বাড়িটির দিকে দক্ষিণ দিক থেকে সরাসরি আক্রমণ শুরু হয়। একটু পরেই বঙ্গবন্ধু তার ঘরের দরজা খুলে বারান্দায় বেরিয়ে আসেন। বেগম মুজিবের কথায় আমি নিচে নেমে মেইন গেটের বাইরে এসে দেখি সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য গুলি করতে করতে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে এগোচ্ছে। তখন আমি বাড়ির ভেতরে ফিরে দেখি, লুঙ্গি আর গেঞ্জি পরা অবস্থাতেই বঙ্গবন্ধু নিচতলায় নামছেন।

৬৯ সাল থেকে ওই পরিবারের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকা রমা আরও বলেন, পরে আমি দ্রুত দোতলায় গিয়ে দেখি, বেগম মুজিব আতঙ্কিত অবস্থায় ছোটাছুটি করছেন। তখন আমি সেখানে দাঁড়িয়ে না থেকে তিনতলায় চলে যাই এবং শেখ কামাল ভাই ও তার স্ত্রী সুলতানা কামালকে ঘুম থেকে ডেকে তুলি। তখন দ্রুত শার্ট-প্যান্ট পরে নিচতলায় নামেন শেখ কামাল। সুলতানা কামাল চলে যান দোতলায়। পরে শেখ জামাল ও তার স্ত্রীকে ঘুম থেকে ডেকে তুললে তারা দ্রুত জামা-কাপড় পরে বেগম মুজিবের কক্ষে যান।

গোলাগুলির মধ্যে অভ্যর্থনা কক্ষে বঙ্গবন্ধুর সামনেই বিভিন্ন জায়গায় ফোন করতে থাকেন মহিতুল ইসলাম। পুলিশ কন্ট্রোল রুম ও গণভবন এক্সচেঞ্জে চেষ্টার এক পর্যায়ে রিসিভার নিয়ে বঙ্গবন্ধু নিজেই বলেন, ‘আমি প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিব বলছি’। বঙ্গবন্ধু তার কথা শেষ করতে পারেননি। ঝাঁক ঝাঁক গুলি জানালার কাচ ভেঙে অফিসের দেয়ালে লাগে। বঙ্গবন্ধু তখন টেবিলের পাশে শুয়ে পড়েন।  এরই মধ্যে গৃহকর্মী আব্দুলকে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে তার পাঞ্জাবি ও চশমা পাঠিয়ে দেন বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব। কিছুক্ষণ পর গুলিবর্ষণ থেমে গেলে বঙ্গবন্ধু উঠে দাঁড়িয়ে আব্দুলের হাত থেকে পাঞ্জাবি আর চশমা নিয়ে পরেন। নিচতলার এই ঘর থেকে বারান্দায় বের হয়ে বঙ্গবন্ধু পাহারায় থাকা সেনা ও পুলিশ সদস্যদের বলেন, ‘এত গুলি হচ্ছে, তোমরা কী করছ?’ এ কথা বলেই বঙ্গবন্ধু ওপরে চলে যান।

বঙ্গবন্ধু ওপরে উঠতে না উঠতেই শেখ কামাল নিচে নেমে বারান্দায় এসে দাঁড়ান। খুনি বজলুল হুদা তখন কামাল ভাইয়ের সঙ্গে কোনও কথা না বলেই পায়ে গুলি করে। সঙ্গে সঙ্গেই নিজেকে বাঁচাতে লাফ দিয়ে ঘরের মধ্যে গিয়ে ঢোকেন শেখ কামাল। বলতে থাকেন, ‘আমি শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামাল।’ এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে শেখ কামালকে লক্ষ করে বজলুল হুদা ব্রাশফায়ার করে। সঙ্গে সঙ্গে নিষ্প্রাণ হয়ে যান শেখ কামাল।

আব্দুর রহমান রমা বলেন, নিচে যে এসব হচ্ছে, তার কিছুটা আঁচ করতে পেরে বঙ্গবন্ধু আবারও বিভিন্ন জায়গায় ফোন করতে থাকেন। এক পর্যায়ে ফোনে তার সামরিক সচিব কর্নেল জামিলউদ্দিনকে পান। তিনি তাকে বলেন, জামিল, তুমি তাড়াতাড়ি আসো। আর্মির লোকরা আমার বাসা অ্যাটাক করেছে। সফিউল্লাহকে ফোর্স পাঠাতে বলো। পরে তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল সফিউল্লাহকেও ফোন করেন বঙ্গবন্ধু। তিনি তাকে বলেন, সফিউল্লাহ তোমার ফোর্স আমার বাড়ি অ্যাটাক করেছে, কামালকে (শেখ কামাল) বোধ হয় মেরে ফেলেছে। তুমি জলদি ফোর্স পাঠাও।

এরপর ঘাতকরা গুলি করতে করতে ওপরে উঠতে থাকে। তারা শেখ জামালের ঘরের বাথরুমে আশ্রয় নেওয়া গৃহকর্মী আব্দুলকে গুলি করে। হাতে ও পেটে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় তিনি সিঁড়ির পাশে গিয়ে হেলান দিয়ে বসে থাকেন। ওইসময় বঙ্গবন্ধুর ঘরে তিনি ছাড়াও ছিলেন বেগম মুজিব, শেখ জামাল, শেখ রাসেল, সুলতানা কামাল, রোজী জামাল। ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুর ঘরের বাইরে অবস্থান নেয়।

বঙ্গবন্ধু হত্যার দায়ে যে মামলা করা হয়, তার দ্বিতীয় সাক্ষী এই রমা আরও বলেন, গোলাগুলি থামলে বঙ্গবন্ধু দরজা খুলে বেরিয়ে আসলেই ঘাতকরা তাকে ঘিরে ধরে। মেজর মহিউদ্দিন ও তার সঙ্গের সৈন্যরা সিঁড়ি দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে নিচে নিয়ে যেতে থাকে। ঘাতকদের উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘তোরা কী চাস? কোথায় নিয়ে যাবি আমাকে?’

এ সময় নিচতলা ও দোতলায় সিঁড়ির মাঝামাঝি অবস্থান নেয় বজলুল হুদা ও নূর। বঙ্গবন্ধুকে নিচে নিয়ে আসার সময় নূর কিছু একটা বললে মহিউদ্দিন সরে দাঁড়ায়। সঙ্গে সঙ্গে বজলুল হুদা ও নূর তাদের স্টেনগান দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে গুলি করে নিস্তেজ করে দেয়।

রামা বলেন, দোতলায় হত্যাযজ্ঞ শেষে রাসেল এবং আমাকে যখন নিচে নিয়ে আসা হয়। তখন রাসেল বলছিল, ‘ভাইয়া, আমাকে মারবে না তো’? এ রকম শিশুকে নিশ্চয়ই খুনিরা মারবে না—এই আশায় মুহিতুল ইসলাম তাকে জড়িয়ে ধরে বলছিলেন, ‘না, ভাইয়া, তোমাকে মারবে না’। পরে রাসেল বলে, ‘আমি মায়ের কাছে যাব’।

পরে এক হাবিলদার শেখ রাসেলকে তার হাত ধরে দোতলায় নিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর দোতলায় গুলি এবং সেখান থেকে কান্নাকাটির আওয়াজ পাওয়া যায়। আর ওই হাবিলদার নিচে গেটের কাছে এসে মেজর আজিজ পাশাকে বলে, ‘স্যার, সব শেষ।’ এর আগে আজিজ পাশা এবং রিসালদার মোসলেমউদ্দিন বঙ্গবন্ধুর বেডরুমে বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, শেখ জামাল, শেখ জামালের স্ত্রী ও শেখ কামালের স্ত্রীকে হত্যা করে।

SUMMARY

670-1.jpg