মিজানুর রহমান খান
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপরের আলোকচিত্রগুলোর সন্ধান দিয়েছিলেন আমার রুশ বন্ধু গবেষক ও ইতিহাসবেত্তা সভেৎলানা চেরভন্যায়া। বঙ্গবন্ধুর শততম জন্মদিনে এগুলো এভাবে পাঠকদের দেখাতে পেরে আমাদের ভালো লাগছে। আলোকচিত্রে দেখা যাচ্ছে বঙ্গবন্ধু একটি বর্ণাঢ্য পোশাক পরেছেন। এটি মুসলিম অধ্যুষিত উজবেকিস্তানের ঐতিহ্যবাহী পোশাক। উজবেক রীতি অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় অতিথির প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান ও শ্রদ্ধার অন্যতম বহিঃপ্রকাশ এটি।
এই পোশাকটি হয়তো ঢাকাতেও এসে থাকবে, কিন্তু সেটা এলেও তার হদিস করা দুরূহ।
ছবিগুলোতে একজন স্টাইলিশ, কেতাদুরস্ত বঙ্গবন্ধুর অনুপম ব্যক্তিত্ব চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। এগুলো ধারণ করা হয়েছিল আরেকটি মার্চেই, যার এক সপ্তাহ পরই ছিল তাঁর ৫২তম জন্মদিন।
১৯৭২ সালের মার্চের (১-৬) গোড়ায় বঙ্গবন্ধু তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরে গিয়েছিলেন। আমাদের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে এই দেশটির শীর্ষ নেতা ও জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করাই ছিল সফরটির উদ্দেশ্য।
মস্কোতে করতালিমুখরিত পরিবেশে পরিষ্কার বাংলায় বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রীয় সংবর্ধনায় বলেন, ‘আমি আপনাদের এবং সোভিয়েত জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে এসেছি।’ এই ছবিগুলো অবশ্য ধারণ করা হয়েছিল উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসখন্দে। সফরসঙ্গীদের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর তোফায়েল আহমেদও ছিলেন। জিজ্ঞেস করতেই তিনি স্মৃতিচারণা করলেন, কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষ নেতা লিওনেদ ব্রেজনেভ, প্রেসিডেন্ট পোদগর্নি, প্রধানমন্ত্রী কোসিগিন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রে গ্রোমিকো কতটা নিষ্ঠা ও আন্তরিকতায় বঙ্গবন্ধুকে বরণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু মস্কো সফর শেষে লেনিনগ্রাদ (বর্তমান সেন্ট পিটার্সবুর্গ) হয়ে উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসখন্দ হয়ে দেশে ফিরেছিলেন।
সোভিয়েত ইউনিয়নের তখনকার ১৫টি প্রজাতন্ত্রের অন্যতম ছিল উজবেকিস্তান। ভারত-পাকিস্তানের ১৯৬৫ সালের যুদ্ধ শেষে শান্তিচুক্তি সই হয়েছিল উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসখন্দে। বাঙালি রাজনীতিকেরা সেই যুদ্ধবিরতি চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। সেই থেকে তাসখন্দ আমাদের জনপদে একটি পরিচিত নাম।
১৯৬৬ সালে এক প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পে তাসখন্দ বিধ্বস্ত হয়েছিল। এরপর কৃষিপ্রধান অঙ্গরাজ্যটি কী করে পুনরায় ঘুরে দাঁড়িয়েছিল, সেটা দেখতেও হয়তো বঙ্গবন্ধুর স্বাভাবিক আগ্রহ ছিল।
লেনিনগ্রাদ বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে বিদায় জানান কোসিগিন। তবে কোসিগিন তাঁর কৃষিমন্ত্রী ভ্লাদিমির ভ্লাদিমিরোভিচ মাটসেকেভিচকে উজবেকিস্তান সফরে বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী করে দিয়েছিলেন। কৃষিমন্ত্রী ছিলেন একজন প্রবীণ রাজনীতিক। ১৯৫৬ সালেই তিনি সোভিয়েত মন্ত্রিপরিষদের ডেপুটি চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯৯৮ সালে তিনি মারা গেছেন। এত মন্ত্রী থাকতে বঙ্গবন্ধুর সফরসঙ্গী করতে মাটসেকেভিচকেই কেন বেছে নিয়েছিলেন কোসিগিন, তার উত্তর হয়তো এমন, কৃষকদের বাঁচাতে হবে, সেটাই ছিল তাঁর ধ্যানজ্ঞান। মাটসেকেভিচ ছিলেন ইউক্রেনের কৃষক সন্তান। ১৯৬৫ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত সোভিয়েত কৃষিমন্ত্রী ছিলেন তিনি।
বঙ্গবন্ধুর উজবেকিস্তান সফরটির ধারাভাষ্যটি রুশ ভাষায়। কৃষি ও মোবাইল সাংবাদিকতায় রাশিয়া থেকে পিএইচডি ডিগ্রিধারী আমার দুই শুভার্থী যথাক্রমে ড. জয়নাল আবেদীন ও ড. জামিল খান ভাষ্যটি বুঝতে আমাকে সহায়তা করেন।
বঙ্গবন্ধু উজবেকিস্তানে একটি কৃষি খামার পরিদর্শন করেছিলেন। রুশ ভাষ্যকার বলছিলেন, ওই সময় কৃষিতে উন্নতি করার ক্ষেত্রে উজবেকিস্তান সমগ্র সোভিয়েত ইউনিয়নে বিরাট ভূমিকা রাখছিল।
উজবেক শিল্প, সংস্কৃতি ও অর্থনীতি সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু বিস্তারিত ধারণা পান এই সফরে। তাসখন্দের লেনিন জাদুঘরটি বঙ্গবন্ধু ঘুরে ঘুরে দেখেন। জাদুঘরটিতে লেনিনের ব্যবহৃত বিভিন্ন উপকরণ, নথিপত্র ছিল। বঙ্গবন্ধু লেনিন জাদুঘরে রক্ষিত স্মারক বইয়ে লিখেছেন, লেনিন শুধু সোভিয়েত জনগণকেই মুক্তির স্বাদ দেননি। তিনি সারা বিশ্বের শোষিত-বঞ্চিত মানুষেরও মুক্তির পথ প্রদর্শক।
ডেভিড ফ্রস্ট জানতে চেয়েছিলেন, কারা তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছিল? মাও সে তুং, গান্ধীজির সঙ্গে লেনিনের নামটিও বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু।
বঙ্গবন্ধুকে তাসখন্দ বিমানবন্দরে সাদরে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন উজবেকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী। এর আগে লেনিনগ্রাদে কোসিগিনের উপস্থিতিতে রুশ তরুণ-তরুণীরা দুদেশের পতাকা নিয়ে রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়েছিলেন। বিমানবন্দরে এক আকর্ষণীয় কুচকাওয়াজ পরিদর্শন করেন বঙ্গবন্ধু। অভ্যর্থনার একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি ঘটে তাসখন্দে। তাঁর গায়ে ভারী ওভারকোট, মাথায় রুশ টুপি। তবে লেনিনগ্রাদে গলায় ছিল লাল রঙের মাফলার, সেটা তাসখন্দে পাল্টে নেন তিনি। তিনি কতটা স্টাইলিশ, তার কয়েকটি মুহূর্ত ধরা পড়েছে তাঁর আয়েশি ভঙ্গিমার পাইপে তামাক সেবনে। তাসখন্দে লেনিন জাদুঘর পরিদর্শনের সময় তাঁকে ফুলহাতার সাদা শার্টে একটি ভিন্নতর ধূসর রঙের ওভারকোটে দেখা গেছে।
আবার একটু বাদেই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তাঁকে মানানসই আরেকটি ওভারকোটে দেখা যায়। গলার মাফলারেও বদল এসেছে। পুরো উজবেকিস্তান সফরের কয়েকটি মুহূর্তের ওই আলোকচিত্রগুলো একজন ‘বনেদি বঙ্গবন্ধু’কেই মূর্ত করেছে।