আজ আপনাদের একটা গল্প শোনাব। এই বিশাল পৃথিবীর ছোট্ট একটা দেশের গল্প। অনেক অনেক দিন আগে দেশটিতে রাক্ষসের খুব উপদ্রব ছিল। রাক্ষসদের অত্যাচারে সাধারণ মানুষের জীবন ছিল ওষ্ঠাগত। লুটপাট, নির্যাতন ও হত্যার মতো ভয়ংকর ও নিষ্ঠুর অনাচার-অত্যাচার এসব ভয়ানক রাক্ষসদের কাছে ছিল ডালভাত। তাদের ভয়ে দেশ ছেড়ে পালাতে লাগল মানুষজন। এমন সময় একজন মানুষ শুধুমাত্র সাহসকে সম্বল করে এগিয়ে এলেন সেই দেশের মানুষজনদের বাঁচাতে। তাঁর নেতৃত্বগুণে একত্রিত হলো দেশের জনগণ। তিনি দেশের এককোণ থেকে অন্যকোণে ছুটে বেড়াতে লাগলেন দেশের মানুষদের সাহস যোগাতে। অবশেষে দেশে যুদ্ধ শুরু হলো। সাহসী সেই মানুষটির নেতৃত্বে একজোট হয়ে দেশের মানুষ লড়তে শুরু করলো ভয়ানক রাক্ষসদের বিরুদ্ধে। সাধারণ মানুষদের বীরত্বের সামনে বেশিদিন টিকতে পারলো না রাক্ষসের দল, যুদ্ধে পরাজিত হলো তারা। দেশে শান্তি ফিরে এলো এবং দেশের জনগণ সেই সাহসী মানুষটিকে তাদের রাজা বানিয়ে সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে লাগল...
...গল্পটি রূপকথা হলে হয়তো এখানেই শেষ হয়ে যেত! কিন্তু গল্পটি রূপকথার পাতা থেকে উঠে আসেনি, এটি একটি সত্যিকারের গল্প! রাজা বেশ ভালোভাবেই তাঁর রাজ্য পরিচালনা করছিলেন। সকলে বেশ সুখেই ছিল। কিন্তু এ সুখ সহ্য হলো না কিছু ক্ষমতালোভী মানুষের। এক কাকডাকা ভোরে সেই ক্ষমতালোভীর দল অতর্কিতে হামলা চালালো রাজার প্রাসাদে। নির্বিচারে নির্দয় রাক্ষসের দল হত্যা করলো রাজা-রানীসহ প্রাসাদে উপস্থিত সকলকে! সৌভাগ্যক্রমে দুই রাজকন্যা প্রাসাদের বাইরে থাকায় বেঁচে গেলেন তাঁরা...। ...এতক্ষণে নিশ্চয়ই অনুমান করে ফেলেছেন, আমি কোন দেশের, কোন রাজার গল্প বলছি? হ্যাঁ, এটা বাংলাদেশেরই গল্প, মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের গল্প। এটি সেই কলঙ্কের গল্প, যার ভার আজও বয়ে বেড়াতে হচ্ছে সমস্ত জাতিকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, এক কলংকিত মুহূর্তে হত্যা করা হয় মুজিব পরিবারের সমস্ত সদস্যদের। মুহুর্মুহু গুলী বর্ষণ করা হয় তাঁদের ওপর। অত্যন্ত নির্দয়ভাবে হত্যা করা তাঁদের সকলকে। সেদিন বঙ্গবন্ধুর সাথে নিহত হন তাঁর সহধর্মিনী বেগম ফজিলাতুননেছা, তাঁদের পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, ছোট্ট শেখ রাসেল, দুই পুত্রবধু সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, বঙ্গবন্ধুর ভাই শেখ নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও তাঁর কন্যা বেবি সেরনিয়াবাত, আরিফ সেরনিয়াবাত, দৌহিত্র সুকান্ত আবদুল্লাহ্ বাবু, ভ্রাতৃষ্পুত্র শহীদ সেরনিয়াবাত, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মণি ও তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মণি, বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা অফিসার কর্ণেল জামিল আহমেদ এবং কিশোর আবদুল নঈম খান রিন্টু। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ রেহানা ও শেখ হাসিনা দেশের বাইরে অবস্থান করায় প্রাণে বেঁচে যান। বেঁচে থাকেন মাতা পিতা পরিবার হারিয়ে অনাথ পরিচয়ে। তবে কেবল তাঁরাই নন, তাঁদের সাথে সাথে অনাথ হয় সমস্ত বাঙালি জাতি। কেননা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন সমস্ত জাতির পিতৃতুল্য। ছিলেন বললে ভুল বলা হবে, আজও আছেন এবং থাকবেনও!
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- এই একটিমাত্র মানুষই বিশ্বাসঘাতকদের বুকে কাঁপন ধরিয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট ছিলেন। জীবিত মানুষটি তো বটেই, তাঁর মৃতদেহটিও ছিল সমান শক্তিশালী! তাই খুব তাড়াহুড়ো করে কবর দেয়া হয় তাঁকে। যে মানুষটি সারাজীবন অন্যের জন্য হৃদয়ের উষ্ণতা বিলিয়ে গিয়েছেন, তাঁর শেষ গোসলে সামান্য গরম পানির ব্যবস্থা পর্যন্ত করা হয়নি! অত্যন্ত অবহেলায় দাফন হয় তাঁর, কাফন হয় রিলিফের কাপড়। এই মহামানবের হত্যার সাথে সাথে হত্যা করা হয় দেশের গণতন্ত্রকেও! দেশে জারি করা হয় সামরিক শাসন। ১৫ আগস্ট বাঙালি জাতির জীবনে চিহ্নিত হয় একটি কলংকময় দিন হিসেবে। যেকোনো বিষয়ের যথাযথ উদাহরণ দিতে গেলে বার বার ফিরে যেতে হয় রবিঠাকুরের কাছে! তাঁর লেখনীতে, "স্বদেশকে একটি বিশেষ ব্যক্তির মধ্যে আমরা উপলব্ধি করিতে চাই। এমন একটি লোক চাই, যিনি আমাদের সমস্ত সমাজের প্রতিমাস্বরূপ হইবেন। তাঁহাকে অবলম্বন করিয়াই আমরা আমাদের বৃহত্ স্বদেশীয় সমাজকে ভক্তি করিব, সেবা করিব। তাঁহার সঙ্গে যোগ রাখিলেই সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তির সঙ্গে আমাদের যোগ রক্ষিত হইবে।" রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন মানুষের খোঁজ করছিলেন, তেমন মানুষের সন্ধান পেয়েছিল বাঙালি জাতি, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত তাঁকে ধরে রাখতে পারেনি! মহান এই মানুষটি ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান! তিনি ছিলেন এমন একজন মানুষ, যাঁকে ঘিরে স্বদেশী স্বপ্ন দানা বেঁধেছিল। তিনি ছিলেন সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্খার প্রতীক। তিনি তাঁর আপন শক্তি ও সহিষ্ণুতার গুণে বাঙালি জাতিকে একজোটে বেঁধেছিলেন আত্মমর্যাদার সুতায়, দেখিয়েছিলেন আত্মপরিচয় ও গৌরবের রাস্তা।
অনেক নেতাই আছেন, যাঁরা জাতীয়তাবোধকে উসকে দিতে পারেন। কিন্তু এই বোধকে লালন করে, পোক্ত করে এবং দেশের প্রত্যেকের চেতনাকে একত্রিত করে মহাকাণ্ড বাঁধাতে পারেন কয়জন? শেখ মুজিবর রহমান তা পেরেছিলেন! তিনি পরাধীনতার গ্লানি মুছে বিশ্ববাসীর সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার এক অভাবনীয় সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছিলেন। আমরা জাতি হিসেবে সে সুযোগটি গ্রহণ করেছিলাম বটে, তবে তাঁর যথাযোগ্য মর্যাদা তাঁকে আমরা দিতে পারিনি। বরং দিয়েছি রক্তমাখা, হৃদয়বিদারক এবং বিতর্কিত মৃত্যু! ১৫ আগস্ট, এই দিনটিকে বাঙালি জাতি পালন করে আসছে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে। যত বাধাই আসুক না কেন, পালিত হবে আরো হাজার বছর! এই পৃথিবীর বুকে যতদিন বাংলাদেশের নাম থাকবে, সাথে জড়িয়ে থাকবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবরের নাম, শ্রদ্ধাভরে স্মরিত হবেন তিনি!