প্রতিরোধের মার্চ: একটি টপ সিক্রেট চিঠি পেলাম


(স্বাধীনতা-পূর্ব বাংলাদেশে সর্বজ্যেষ্ঠ বাঙালি সামরিক কর্মকর্তা ছিলেন ব্রিগেডিয়ার মাহমুদুর রহমান মজুমদার। তিনি এ সময় চট্টগ্রামে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সেন্টারের (ইবিআরসি) কমান্ড্যান্ট ছিলেন। ব্রিগেডিয়ার মজুমদার পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থিত সামরিক বাহিনী, ইপিআর, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর চাকরিরত ও অবসরপ্রাপ্ত বাঙালি সদস্যদের নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণ করার পরিকল্পনা করেন এবং সেটা অনুমোদনের জন্য কর্নেল ওসমানীর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কাছে পাঠান। তিনি ২৫ মার্চ পর্যন্ত তাঁর পরিকল্পনা বাস্তবায়নের চেষ্টা করেন। বঙ্গবন্ধুর অনুমোদন না পাওয়ায় তা সম্ভব হয়নি। ২৭ মার্চ তাঁকে আটক করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। পুরো নয় মাস পাকিস্তানি সেনারা তাঁকে দফায় দফায় পৈশাচিক নির্যাতন করে। ২০১১ সালের ১৯ ডিসেম্বর ব্রিগেডিয়ার মজুমদার মারা যান। তাঁর নিজ হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি ও রেকর্ড করা বক্তব্য অবলম্বন করে তাঁর জবানীতেই ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চের সেই আক্রমণ পরিকল্পনার কথা সংক্ষেপে জানাচ্ছেন লুৎফুল হক।) পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে ছয় দফা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার জন্য ঢাকায় আসেন। শেখ মুজিবের সঙ্গে কয়েক দফা বৈঠক করেন তিনি। ইয়াহিয়া ছয় দফা মেনে নিতে মৌখিকভাবে রাজি হন। করাচি ফেরার পথে ঢাকা বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘শেখ মুজিবই পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী।’ পাঞ্জাব রেজিমেন্টে তথা পশ্চিম পাকিস্তানে আমার দীর্ঘ ১৮ বছর চাকরির অভিজ্ঞতা থেকে এ কথা বিশ্বাস করতে পারলাম না। ভাবলাম, ২৩ বছর ধরে বাঙালিদের ওপর প্রত্যক্ষভাবে আধিপত্যকারী পশ্চিম পাকিস্তানি আমলা ও সেনা কর্মকর্তারা খাঁটি বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফাভিত্তিক একচ্ছত্র শাসন কক্ষনো মেনে নেবে না! করাচি ফিরে ইয়াহিয়া খান ভুট্টোর আমন্ত্রণে সপারিষদ সিন্ধু প্রদেশের লারকানা শহরে গেলেন। আমার মনে সন্দেহ হলো যে লারকানায় ভুট্টোর রাজকীয় আতিথেয়তার আড়ালে নিশ্চিয়ই বাঙালি ও মুজিববিরোধী কোনো অভিযানের ষড়যন্ত্র হচ্ছে। লে. কর্নেল (পরে মেজর জেনারেল) খলিলুর রহমান এ সময় জিএইচকিউ ট্রেনিং উইংয়ে জিএসও-১ ছিলেন। উনি দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে খুবই আগ্রহী এবং উদ্বিগ্ন ছিলেন। তাঁর সাথে টেলিফোনে প্রায়ই কথাবার্তা হতো। উনি আমাকে বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাধারণত জিএইচকিউতে আসেন না। অথচ লারকানা থেকে ফিরে ইয়াহিয়া খানকে দু-তিন দিন ধরে জিএইচকিউতে দেখতেছি। এখানে জেনারেল হামিদ, পিরজাদা, গুল হাসান এবং ওমরকে নিয়ে রুদ্ধ কামরায় মিটিং করেছেন। নিশ্চয় ওরা কিছু একটা ঘোট পাকাচ্ছে।’ এ অবস্থার মধ্যে একদিন জিএইচকিউ থেকে দীর্ঘ দুই পাতার একটি টপ সিক্রেট চিঠি পেলাম। চিঠি পড়ে মর্মাহত হলাম। চিঠিতে লেখা হয়েছে, আওয়ামী লীগের ছয় দফার ভিত্তিতে প্রতিরক্ষা বাহিনীতে সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব মেনে নিলে বাঙালির প্রাধান্যে এটি একটি তৃতীয় শ্রেণীর সেনাবাহিনীতে পরিণত হবে। বিস্তৃতভাবে এসব কথা বর্ণনার পর উপসংহারে লেখা হয়েছে, এমতাবস্থায় শেখ মুজিবকে কিছুতেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে দেওয়া যায় না।



তাহলে আমরা আর পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে থাকব না, আমরা স্বাধীন হব। প্রয়োজনে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনব—এ ছিল আমার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। আমার একান্ত বিশ্বস্ত চিফ ইন্সট্রাক্টর লে. কর্নেল মুজিবর রহমান চৌধুরীকে আমার অফিসে ডেকে পাঠালাম। তাকে চিঠি পড়তে দিলাম। এ নিয়ে দুজনে আলোচনা করলাম। ঠিক হলো, কর্নেল (অব.) এম এ জি ওসমানীর মাধ্যমে শেখ মুজিবকে যথাশিগগির বিষয়টি অবহিত করতে হবে। ওসমানী সাহেবকে টেলিফোনে সিলেটি ভাষায় কিছু ইঙ্গিত দিয়ে যত শিগগির সম্ভব চট্টগ্রাম শহরে লে. কর্নেল রবের বাসায় গোপনে আসতে বলি। পূর্ব পাকিস্তানে তখন পূর্ব পাকিস্তানি ও পশ্চিম পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনীর শক্তি ও অবস্থানের মৌখিক হিসাব কষতে বসলাম আমরা। দেখা গেল, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ, আনসার মিলে তাৎক্ষণিক স্ট্রাইকিং ফোর্স পশ্চিম পাকিস্তানিদের চেয়ে আমাদের সাত-আট গুণ বেশি। অতএব, স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনার জন্য অবিলম্বে আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। দুই দিন পর ওসমানী সাহেব এলেন। তাঁকে আমি জিএইচকিউ থেকে পাওয়া টপ সিক্রেট চিঠির বিষয়বস্তু জানালাম। বললাম, ইয়াহিয়া, মুজিব, ভুট্টো বৈঠক ও কাঁদা ছোড়াছুড়ি করে একে অন্যকে খেপিয়ে সংসদ অধিবেশন বিলম্বিত করার আড়ালে বাঙালিদের সামরিক বাহিনী দিয়ে দমন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে জিএইচকিউ। পশ্চিম পকিস্তান থেকে রিইনফোর্সমেন্ট আনার আগেই অকস্মাৎ আমাদের আক্রমণ করতে হবে। ওসমানী সাহেব আমাকে সতর্ক করে দিয়ে বললেন, ‘আমি ঢাকায় ফিরে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে টপ সিক্রেট চিঠি ও জিএইচকিউর ডিসিশন সম্বন্ধে বিস্তারিত জানাব। সাবধান! বঙ্গবন্ধুর সরাসরি নির্দেশ বা ইঙ্গিত ছাড়া কোনো সামরিক অভিযানে মোটেই যাবেন না।’ আমি তাঁকে বললাম, ‘আপনি শেখ সাহেবকে ভালো করে বোঝাবেন। এ-ও বলবেন যে পাকিস্তানের ব্যাপারে আর্মির ডিসিশনই সব সময় ফাইনাল হয়। আমি মনে করি, আর অপেক্ষা না করে আমাদের অ্যাকশনে যাওয়া উচিত।’ উনি বললেন, ‘ঠিক আছে, আমি গিয়ে বুঝায়ে বলব। তারপর আপনাকে জানাব।’ আমি ওনাকে বললাম, ‘আমি আপনাকে রিটায়ার্ড বেঙ্গলি পারসনের বয়স অনুযায়ী ঠিকানা দিয়ে লিস্ট পাঠাব। আপনি সেই লিস্ট অনুযায়ী তাদের ডেকে সতর্ক করে দিয়ে বলবেন, যখনই প্রয়োজন হবে তাদের ডাকা হবে। ডাকার সঙ্গে সঙ্গে তারা সবাই চট্টগ্রাম সেন্টারে রিপোর্ট করবে।’ উনি বললেন, ‘ঠিক আছে, পাঠিয়ে দেবেন।’ আমার খুব ইচ্ছা ছিল যে আমি টপ সিক্রেট চিঠিটা ওসমানী সাহেবকে দেখাব। কিন্তু উনি আসার আগে আমাকে খবর দিয়ে আসেন নাই। আসছেন গোপনে। রাতে। অফিস বন্ধ থাকায় কেবিনেট থেকে চিঠিটা আনতে পারলাম না। উনি চলে যাওয়ার পরে আমি কর্নেল চৌধুরীকে ডেকে বললাম, ‘তাড়াতাড়ি রেকর্ড অফিস থেকে বাঙালি সৈনিকদের লিস্টটা বের করেন। যাদের বয়স ৫০ বছর বা ৫২ বছর পর্যন্ত, তাদের ঠিকানাসহ একটা লিস্ট করেন।’ ওসমানী সাহেবের সঙ্গে আমার নিয়মিত যোগাযোগ হতো। ওনাকে আমি সব সময় বলতাম—আর দেরি করবেন না, আর দেরি করবেন না।

কর্নেল চৌধুরী লিস্ট রেডি করলেন। লিস্টটা অনেক বড় হয়ে গেছে, প্রায় ২৫০০ সৈনিক। আমি ক্যাপ্টেন আমিন আহাম্মদ চৌধুরীকে ডাকলাম এবং বললাম, ‘এই লিস্ট নিয়ে তুমি ঢাকায় কর্নেল ওসমানীর কাছে যাবে।’ চট্টগ্রামের এসপি শামসুল হককে টেলিফোন করে বললাম, ‘আমাকে একটা সিভিল গাড়ি দিতে হবে। গাড়িটা ঢাকা যাবে, আবার নিয়ে আসবে।’ শামসুল হক গাড়ি দিল। ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকে আমিনকে দিয়ে লিস্ট পাঠালাম। আমিনকে বললাম, লিস্টটা সরাসরি ওসমানী সাহেবের হাতে দিবা। চট্টগ্রামে ৮ ইস্ট বেঙ্গল আছে। ৮ ইস্ট বেঙ্গল পশ্চিম পাকিস্তানে যাবে বলে হাতিয়ার জমা দিয়েছে। তাদের আবার সশস্ত্র করতে হবে। ৮ বেঙ্গলের উপ-অধিনায়ক জিয়া আমার খুব ঘনিষ্ঠ এবং বিস্বস্ত লোক। আমরা অস্ত্র ইস্যু করার আগে জিয়াকে ডাকলাম। তাকে ২০০ রাইফেল আর ১০টা এলএমজি দিলাম। আমি তাকে বলছিলাম, জানজুয়া (৮ বেঙ্গলের অবাঙালি অধিনায়ক) যদি জিজ্ঞেস করে, তাহলে বলবা, ‘স্যার, আমরা তো এখন যাচ্ছি না। রেঞ্জ প্র্যাকটিস করার জন্য সেন্টার থেকে আমি রিকোয়েস্ট করে এগুলা আনছি।’ আমি এম আর চৌধুরীকে বললাম, জিয়ার সঙ্গে মিলে তার অ্যাডজুটেন্ট ও ক্যাপ্টেন আমিনকে নিয়ে তোমরা একটা অপারেশন প্ল্যান রেডি করো। সেই অপারেশন প্ল্যানের মধ্যে দুইটা জিনিস রেখো। একটা হলো যে আর্মি রিভোল্ট, ওদের বিরুদ্ধে আমরা রিভোল্ট করব। রিভোল্ট করলে আমরা কীভাবে কী করব। আর আরেকটা আমরা নিজেরা ওদের দ্বারা অ্যাটাক্ট হলে কোথায় যেতে হবে, কার কী দায়িত্ব হবে, সেটা বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নাও। ইপিআরের অ্যাডজুটেন্ট ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলামকে তোমাদের সঙ্গে নিও। পশ্চিম পাকিস্তানি অ্যাসিস্ট্যান্ট রেকর্ড অফিসার ক্যাপ্টেন বেগ দিন-রাত সব সময় আমার পিছনে পিছনে থাকত। আমি কর্নেল চৌধুরীকে বললাম, আমাকে তোমাদের সঙ্গে রাখবে না। তোমরা নিজেরা নিজেরা সব করো। আমি তোমাকে ওভার অল অপারেশনের কমান্ডার নিয়োগ করছি। অন্যদের দায়িত্ব বেঁটে দাও। খুব সাবধানে করতে হবে, কারণ দেয়ালেরও কান আছে। এরা প্রথম মিটিংটা করল চট্টগ্রাম স্টেডিয়ামে। কর্নেল চৌধুরী, মেজর জিয়া, ক্যাপ্টেন অলি, ক্যাপ্টেন রফিক, ক্যাপ্টেন আমীন—সবাই মিলে এ বৈঠক করেছে। ফিরে এসে এম আর এ চৌধুরী আমাকে বলল, ‘আমরা মিটিং করেছি। আমরা আবার ডিটেইল মিটিং করব। তারপর ফাইনাল করে আপনাকে দেখাব।’ চৌধুরীকে চট্টগ্রামের বাইরের বিভিন্ন ইউনিটকে আমি সতর্ক রাখতে বলি। তারা রফিককে দায়িত্ব দিল ইপিআর ইউনিটকে খবর দিতে। আর বাকি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দায়িত্ব দিল জিয়াকে। এটা ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে হয়েছে।

এর কিছু পরে যশোরে একটা প্যারেড হয়েছে, ১ বেঙ্গল ছিল। ওখানে যাওয়ার পরে আমি টোকা দিয়ে বুঝতে পারলাম যে তারা ব্যাপারটা জানে। জিয়া তাদের জানিয়েছে। দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক মাসুদ জানে। মাসুদ একদিন বোকার মতো আমাকে একটা মেসেজ পাঠাল, ‘ইনস্ট্রাকশনস রিসিভড’। যখন আমাদের এসব প্রস্তুতি চলছে, জিএইচকিউ থেকে খলিল আমাকে একদিন টেলিফোন করে বলল, ‘আমি খবর পেলাম যে পশ্চিম পাকিস্তানের কয়েকটা রেজিমেন্টকে ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারসহ পূর্ব পাকিস্তানে যাওয়ার জন্য নোটিশ দেওয়া হয়েছে। এ-ও জানতে পারলাম যে দুইটা ব্যাটালিয়নকে প্লেনে আগে পাঠানো হচ্ছে। এরা শিগগিরই চলে যাবে। অন্য ব্যাটালিয়ন পরে আসবে। মনে হচ্ছে অনেক সৈন্য যাচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানে।’ এ খবর শুনে আমি ভয় পেয়ে গেলাম। ওসমানী সাহেবকে ফোন করলাম। বললাম, এখন তো আর অপেক্ষা করা যায় না। আপনি শেখ মুজিবকে বলেন যে পাকিস্তানিরা অনেক সৈন্য পাঠাচ্ছে। এই ফোর্স এলে আমরা দুর্বল হয়ে যাব। ফোর্স পৌঁছার আগেই আমাদের কিছু একটা করতে হবে।’ উনি শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করে আমাকে বললেন, ‘বঙ্গবন্ধু শান্ত থাকতে বলেছেন। পরিস্থিতি তাঁর নিয়ন্ত্রণে আছে।’ ১ মার্চ একটার সময় রেডিওতে শুনলাম যে অধিবেশন মুলতবি। ১ তারিখ বিকেলে শেখ সাহেব মতিঝিলে বিরাট মিটিং করলেন। ২ তারিখ ঢাকায় হরতাল হবে, ৩ তারিখে সারা দেশে হরতাল ও বিক্ষোভ মিছিল হবে। ৩ তারিখ চট্টগ্রামে হঠাৎ আগুন জ্বলে উঠল। আমরা গোলাগুলির শব্দ শুনলাম। শুনতে পেলাম যে বিহারি কলোনি, রেলওয়ে কলোনি, আরও একটা কলোনির হাজার হাজার ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রামে বেলুচ রেজিমেন্ট ছিল হালিশহরে। তারা রেডিও স্টেশন, এমবারকেশন ইউনিট, নন-বেঙ্গলিদের পাহারা দিত। বেলুচ সৈন্যরা মানুষ মারতে আর বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিতে বিহারিদের সাহায্য করেছে। আমি ৪ তারিখ সকালবেলা উঠেই রেলওয়ে কলোনি, পাহাড়তলী কলোনি দেখতে গেলাম। দেখলাম, বহু কাঁচা ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। বেশির ভাগ বাঙালিদের ঘরবাড়ি। অনেক লোক হাসপাতালে ভর্তি, অনেক লোক মারা গেছে। চট্টগ্রামের মহিউদ্দিন (পরে মেয়র) ওখানে ছিল। মহিউদ্দিনও গেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানেও সারি সারি মানুষ। বেশির ভাগ মানুষ আগুনে জ্বলা, কারও কারও গায়ে বুলেটের দাগ। আমার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। মহিউদ্দিন কাঁদো কাঁদো হয়ে আমাকে বলে, ‘স্যার, আমরা এখান কী করি! আমাদের তো ওরা শেষ করে দিয়েছে।’ বললাম, এখন থেকে তোমাকে একবার আক্রমণ করলে তুমি তিনবার আক্রমণ করবা। আমি আছি তোমাদের পিছনে। তাকে সাহস দিলাম। আমার কাছে খবর এল যে প্রায় ১০ হাজার টন অ্যামুনেশন নিয়ে এমভি সোয়াত চট্টগ্রাম পোর্টে আসছে, ডকিং করবে। আমি সঙ্গে সঙ্গে চট্টগ্রাম পোর্টের শ্রমিক সমিতির সভাপতি মান্নান সাহেবকে ডাকলাম। উনাকে বললাম, ‘আপনি এই জাহাজ আনলোডিং করতে দিবেন না।’ উনি বললেন, ‘আপনি কোনো চিন্তা করবেন না, যা লেবার আছে ওদেরকে সরিয়ে দিব।’ আমি যত দিন চট্টগ্রাম ছিলাম অর্থাৎ ২৪ মার্চ পর্যন্ত সোয়াত থেকে অ্যামিউনেশন আনলোড করতে দিইনি। মার্চ মাসের ৫ তারিখ রাত প্রায় একটার সময় আওয়ামী লীগের খন্দকার মোশতাক আহমেদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, জহুর আহমেদ চৌধুরী, এম আর সিদ্দিকী আর মান্নান সাহেব আমার সাথে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউসে দেখা করলেন। মিটিংয়ের ব্যবস্থা আগেই করা ছিল। আমি মিটিংয়ে বললাম যে বর্তমানে সামরিক বাহিনীতে আমাদের সংখ্যা ও শক্তি পশ্চিমাদের চেয়ে প্রায় আট-দশ গুণ বেশি। এই সময় যদি আমরা তাদেরকে নিরস্ত্র করার চেষ্টা করি তাহলে তাদের সহজেই নিরস্ত্র করতে সক্ষম হব। আমার কথা ক্যাপ্টেন মনসুর আলী বুঝতে পারলেন। বললেন, ঢাকা গিয়ে শেখ সাহেবকে বিস্তারিত বলব। এরপর এল ৭ মার্চ। ভেবেছিলাম যে আমাদের আক্রমণের ইঙ্গিত দেওয়া হবে। আমি আশা করেছিলাম যে আমাকে ডাইরেক্টলি কিছু বলা হবে। সেই দিন বিকেল পর্যন্ত আমি ইউনিফর্ম পরে ছিলাম। এমভি সোয়াত থেকে অস্ত্র আনলোড করার জন্য ঢাকা থেকে আমাকে বারবার চাপ দিতে থাকে। আমি ৭ মার্চের পর চট্টগ্রাম বন্দর অকেজো করে ফেলার পরিকল্পনা করি। ক্যাপ্টেন আমীনের মাধ্যমে আমি এম আর সিদ্দিকীর কাছে প্রস্তাব পাঠাই যে তিনি যেন তাঁর একটি জাহাজ মোহনার মুখে ডুবিয়ে দেন। এটা করলে বন্দরে জাহাজ ঢোকা ও বের হওয়া দীর্ঘদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে। তিনি এতে রাজি হন। পরে এ বিষয়ে আমিও এম আর সিদ্দিকীর সাথে কথা বলি। ২১ মার্চ ছিল রোববার, ছুটির দিন। হাঠাৎ টিক্কা খান আমাকে টেলিফোন করে বলল, ‘মজুমদার, চিফ আজকে চট্টগ্রাম সফরে যাবেন। তুমি তাকে প্যারেড গ্রাউন্ডে অভ্যর্থনা জানাবে।’ মনে মনে ভাবলাম, নিশ্চয় কিছু আছে। যাই হোক, বেলা ১১টার সময় আর্মি চিফ জেনারেল হামিদ এবং অ্যাডজুট্যান্ট জেনারেল খোদাদাদ খান হেলিকপ্টার থেকে বের হয়ে আমাকে বলল যে তারা বেলুচ রেজিমেন্টে যাবে। ওখানে গিয়ে দেখি চিফকে রিসিভ করার জন্য বেলুচিরা একেবারে রেডি। কর্নেল ফাতেমির অফিসে বসার আগেই খোদাদাদ আমাকে বলল, ‘মজুমদার তোমার সাথে আমার একটা বিশেষ কথা আছে, চলো আমরা অন্য কামরায় যাই।’ জেনারেল হামিদ কর্নেল ফাতেমির অফিস থেকে বের হয়ে সোজা নেভাল হেডকোয়ার্টার্সে গেল। নেভাল হেডকোয়ার্টার্সে গিয়েও দেখলাম কমোডর মমতাজ চিফকে রিসিভ করার জন্য রেডি আছেন। চিফকে নিয়ে তারা গেল অপারেশন রুমে আর খোদাদাদ আমাকে নিয়ে গেল কমোডর মমতাজের অফিসে। অপারেশন রুমে চিফ এবং কমোডর মমতাজ ১৫-২০ মিনিট আলোচনার পর বের হয়ে আসল। ক্যান্টনমেন্টে ফেরার পথে জেনারেল হামিদ বলল, ‘আমাকে নিয়ে চলো ৮ ইস্ট বেঙ্গলে।’ সেখানে জেনারেল হামিদ আমাদের থেকে সরে গিয়ে জাঞ্জুয়ার সঙ্গে কিছু একটা কানাকানি করল। দুপুরে ওরা চলে গেল ঢাকায়। জেনারেল হামিদ ফিরে যাওয়ার পরপরই আমি এম আর সিদ্দিকী সাহেবকে ডেকে পাঠালাম। বললাম, ‘এখন আমার মনে কোনো সন্দেহ নাই যে তারা আমাদের বিরুদ্ধে বড় রকমের অ্যাকশন নিবে। আপনি এখনই ঢাকা যান। ঢাকা গিয়ে জেনারেল হামিদের ভিজিট এবং বিভিন্ন জায়গায় যাওয়া ও কানাকানি করার বিষয়টি জানান। বঙ্গবন্ধুকে বলবেন যে আমি এক শত ভাগ নিশ্চিত যে তারা শিগগিরই আমাদের উপরে বড় রকমের আক্রমণ করবে। আমাদের এক্ষুণি কিছু করা উচিত, আর সময় নাই।’ এম আর সিদ্দিকী সাহেবকে বিশেষ ব্যবস্থায় ঢাকা গিয়ে প্রথমে ওসমানী সাহেবকে নিয়ে গেলেন শেখ সাহেবের বাসায়। উনি সব শুনে বললেন, ‘মজুমদারকে গিয়ে বলো শান্ত থাকতে। সিচুয়েশন আমার নিয়ন্ত্রণে আছে। যখন প্রয়োজন হবে আমি তাকে ইঙ্গিত দিব।’ ওসমানী সাহেব তাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কীভাবে তাকে আপনি ইঙ্গিত দিবেন?’ শেখ সাহেব বললেন, ‘ঢাকা রেডিওর বাংলা সম্প্রচার যদি বন্ধ হয়ে যায় তাহলে বুঝবে যে আমাদের সংলাপ ভেঙে গেছে।’ ‘আর্মি অফিসারকে ইঙ্গিত দেওয়ার এটা নিয়ম না। আপনি কোনো বিশেষ সংকেত বলে দেন, যেটা উনাকে জানাতে হবে।’ তখন উনি বললেন, ‘আমার মেসেজ টেপ রেকর্ড করে রাখব। একটা রেকর্ড ইপিআরকে দিব, আরেকটা কপি জহুর আহমেদ চৌধুরীকে দিব। সেটা পেলে তার পরে তারা অ্যাকশনে যাবে।’ ২১ তারিখ মাগরিবের পর জিয়াউর রহমান আমার বাসায় আসল। বললাম, ‘আমার কোনো সন্দেহ নাই যে এরা শিগগিরই আমাদের ওপরে আক্রমণ করবে। আমাকে তো ওরা সার্ভিলেন্সে রেখেছে। আমাকে হয়তো ধরে নিয়ে যাবে। দায়িত্বটা তো নিতে হবে কর্নেল এম আর চৌধুরী এবং তোমাকে।’ জিয়াউর রহমান আমাকে বলল, ‘মনে হয় অবস্থা খুব সিরিয়াস। আমাদের একটা কিছু করতে হবে।’ আমি তাকে বললাম, ‘বঙ্গবন্ধুর অনুমতি ছাড়া কিছু করতে যাওয়া ঠিক হবে না। দেশের লোক এইটাকে ভুল বুঝবে।’ সৌজন্যে: প্রথম আলো

SUMMARY

660-1.jpg