আফতাব চৌধুরী
বঙ্গবন্ধু যেমন ছিলেন একজন দেশপ্রেমিক বাঙালি, তেমনি ছিলেন একজন প্রকৃত মুসলমান। বঙ্গবন্ধুর সারা জীবনের কর্মপ্রয়াস ছিল বাংলার জনগণের শোষণ ও মুক্তির অন্বেষণ। তিনি ইসলামের উদারনৈতিক অসাম্প্রদায়িক সাম্য ও মৈত্রীর চিরন্তন ভিত্তিকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন। স্বাধীন বাংলাদেশে ইসলামি অগ্রযাত্রায় বঙ্গবন্ধুর অবদান অবিস্মরণীয়। বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে ইসলামের প্রচার প্রসারে যে অবদান রেখেছেন, তা সমকালীন ইতিহাসে বিরল।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালির আকাঙ্ক্ষাকে নিয়ে তাদের শোষণ, বঞ্চনার বিরুদ্ধে যখন আন্দোলন করছেন, যখন বাঙালির অধিকার আদায়ে জেল–জুলুম নির্যাতন বঙ্গবন্ধুকে দমিয়ে রাখতে পারেনি, পশ্চিমা জান্তা তখন বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ধর্মকে ব্যবহার করেছেন সর্বাগ্রে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে বাংলা ভাষাকে হিন্দুয়ানী ভাষা হিসাবে রূপ দেওয়ার ষড়যন্ত্র করেছে। বাংলার স্বাধিকার আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে একে পাকিস্তান ভাঙা, মুসলমানদের বিরুদ্ধে ভারতের ষড়যন্ত্র বলে প্রচার করেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ভারতের চর ও ইসলামের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছে। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার করে রাজনীতিকে কলুষিত করেছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একজন প্রকৃত মুসলমান হিসেবে ধর্মকে রাজনীতি হতে দূরে রেখে অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠা করেছেন।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে বেতার ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা হচ্ছে, আমরা ইসলামের বিশ্বাসী নই। এ কথার জবাবে আমাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য, আমার লেবাস সর্বস্ব ইসলামে বিশ্বাসী নই। আমরা বিশ্বাসী ইনসাফের ইসলামে। আমাদের ইসলাম হজরত রসুলে করিম (সা.)–এর ইসলাম। যে ইসলাম জগৎবাসীকে শিক্ষা দিয়েছে ন্যায় ও সুবিচারের অমোঘ মন্ত্র। ইসলামের প্রবক্তা সেজে পাকিস্তানের মাটিতে বারবার যারা অন্যায়, অত্যাচার, শোষণ, বঞ্চনার পৃষ্ঠপোষকতা করছে, আমাদের সংগ্রাম সেই মুনাফিকদের বিরুদ্ধে। যে দেশের শতকরা ৯৫ জন মুসলমান, সে দেশে ইসলামবিরোধী আইন পাসের ভাবনা ভাবতে পারে তারাই, ইসলামকে যারা ব্যবহার করে দুনিয়াকে শায়েস্তা করার জন্য।’
সে সময় বঙ্গবন্ধু তাঁর এই অমূল্য বক্তব্যে রাসুল (সা.)–এর ইসলামের সুমহান শিক্ষা, অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার, বঞ্চনা ও শোষণের বিরুদ্ধে ইসলামের আপসহীন অবস্থান, প্রতারণা, প্রবঞ্চনা ও মুনাফেকির বিরুদ্ধে ইসলামের শিক্ষার প্রতি তাঁর দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। সব ধর্মের মানুষের কাছে ইসলামের মূল মর্মবাণী তুলে ধরে অসাম্প্রদায়িক চিন্তা–চেতনার রাজনৈতিক নতুন ধারা সৃষ্টি করে সফলতা লাভ করেন।
বঙ্গবন্ধুহীন বাংলায় তাঁর হাতে গড়া স্বপ্নের এই সোনার বাংলা সে সময়কার পাকিস্তানি জান্তাদের ন্যায় বঙ্গবন্ধুর ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা–অপচেষ্টা করা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। তাঁর ইসলামি চেতনার বৈশিষ্ট্যগুলোকে ভুল ব্যাখ্যা করে তাঁকে খাটো করার হীন চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু বাঙালি তাঁদের প্রাণপ্রিয় নেতার আদর্শ হতে কোনো সময় বিচ্যুত হয়নি বলেই আজ বাংলাদেশ সম্পদে ও উন্নয়নে, শিক্ষা, শিল্পায়নে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এগিয়ে যাচ্ছে।
জানা যায়, বঙ্গবন্ধু ছিলেন বংশ পরম্পরায় বাগদাদের দরবেশ বংশের লোক। তাঁর বাবা–মা সবাই ধার্মিক ছিলেন। তিনি ধর্মকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করাকে ঘৃণা করতেন। তিনি রাষ্ট্রীয়ভাবে সব মানুষের স্ব-স্ব ধর্মের অধিকার নিশ্চিত করার জন্য আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতার উৎসই ছিল রাসুল (সা.)–এর মদিনায় সনদের শিক্ষার অনুসরণে।
‘মদিনা ইহুদি-নাসারা, পৌত্তলিক ও মুসলমান সবাই নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে।’ ইসলামই প্রথম নিরপেক্ষতার বাণী বিশ্বে প্রচার করেছে, ‘তোমার ধর্ম তোমার জন্য, আমার ধর্ম আমার জন্য এবং ধর্মে কোনো জুলুম বা অত্যাচার নেই।’ এ কথা পবিত্র কোরআন ছাড়া আর কোনো ধর্মগ্রন্থ প্রচার করেনি। ধর্মকে বঙ্গবন্ধু শ্রদ্ধা করতেন। কিন্তু ধর্মান্ধতাকে তিনি মনে প্রাণে ঘৃণা করতেন। এ কারণেই তিনি এ দেশের রাজনৈতিক আন্দোলনের গোড়া হতেই ধর্মনিরপেক্ষতাকে প্রাধান্য দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্ম নিরপেক্ষতার স্বীকৃতির মধ্যে তাই এ দেশের জনগণের সুদীর্ঘ তিক্ত অভিজ্ঞতা ও বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ প্রত্যয়ের ফলশ্রুতি ঘটেছে বা তা বাস্তবায়ন করে এ জাতি উন্নত জাতিতে পরিণত হয়েছে।
এ বিষয়ে তিনি বলেন, ধর্মান্ধতাকে আমি ভয় করি। বাংলাদেশের আবির্ভাবে বাধা দিয়েছেন অনেক ধর্মান্ধ ধর্ম দার্শনিক। তাঁরা বাংলাদেশকে বাঙালি জাতীয়তাবাদকে কতটুকু শ্রদ্ধা করতে পারবেন, সে সম্পর্কে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। এদের সম্পর্কে অতীতে যেমন, বর্তমানে এবং ভবিষ্যতেও তেমনি সাবধানতা অবলম্বনের প্রয়োজন আছে।
ইসলামের চর্চা ও গবেষণার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আন্তরিক উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় বায়তুল মোকাররম মসজিদ নিয়ে ১৯৭৫ সালের ২৮ মার্চ প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান এক অধ্যাদেশ জারি করে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেন। মেশকাত শরিফের অনুবাদক হিসাবে সুপরিচিত মাওলানা ফজলুল করিমকে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রথম মহাপরিচালক নিযুক্ত করেন। বঙ্গবন্ধু মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ডকে পুনর্গঠন করেন। জুয়া, হাউজি, মদ প্রভৃতি অসামাজিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ এবং শাস্তির বিধান করেন। ১৯৭২ সালে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্ত বাতাসে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশাল জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমার ফাঁসির হুকুম হয়েছিল, জীবন দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়েছিলাম, আমি বলেছিলাম তোমরা আমাকে মারতে চাও মেরে ফেল। আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান। মুসলমান একবার মরে, বারবার মরে না।’
বঙ্গবন্ধুর ন্যায় মহান নেতা বাঙালির স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করলেও দেশ শাসনের সুযোগ বেশি দিন পাননি। মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে তিনি বাংলাদেশে ইসলামের প্রসার ও কল্যাণে যা করেছেন তা বিশ্বের ইতিহাসে এক বিরল দৃষ্টান্ত। তবু এক শ্রেণির তথাকথিত ধর্মের লেবাসধারী অপপ্রচার চালান এবং ধর্মকে রাজনীতির ভ্রান্ত পথে ব্যবহার করেন। ইসলাম ধর্মকে নিয়ে যারা রাজনীতির ব্যবসা করে, তারা অবশ্যই ঘৃণার পাত্র। ধর্মকে পুঁজি করে রাজনীতির ব্যবসা করলে কী পরিণাম হয়, পাকিস্তান এখন তার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। ধর্মের উদ্ভবের মতোই ধর্ম নিরপেক্ষতাও সামাজিক চাহিদা থেকেই হয়েছে। বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের কল্পনাবিলাস থেকে নয়, এটি একটি আন্তর্জাতিক সামাজিক সত্য। এর ভবিষ্যৎ আন্তর্জাতিক প্রবণতার সঙ্গে গ্রোথিত। সংঘর্ষের মধ্যে দিয়ে ধর্মীয় বিরোধের নিষ্পত্তি অতীতেও হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না। ধর্মের নামে অন্ধবিশ্বাস বা সম্প্রদায়গত সংস্কারকে উসকে দিয়েও সমস্যার সমাধান হবে না। সব ধর্মবিশ্বাসের ওপর শেষ পর্যন্ত নির্ভর করে। আমরা সমাজকে বদলাতে চাই। সমাজ আজ যেখানে আছে, সেখানে ফেলে রাখতে চাই না। ভীরুতা দিয়ে পরিবর্তন করা যায় না। ধর্ম নিরপেক্ষতার জন্যও সাহসের প্রয়োজন (অধ্যাপক আলি আনোয়ার সম্পাদিত, ধর্ম নিরপেক্ষতা, বাংলা একাডেমি-১৯৭৩)।
বঙ্গবন্ধুর এই সৎসাহস ছিল বলেই তিনি একজন প্রকৃত ধার্মিক হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। তিনি কোনো মানুষকে তাঁর ন্যায্য অধিকার হতে বঞ্চিত করেননি। এখানেই একজন ধার্মিক ও সাহসী মুজিবের সার্থকতা। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় আজকে যারা ধর্ম নিয়ে রাজনীতির করেন, জঙ্গিবাদকে আশ্রয়–প্রশ্রয় দিচ্ছেন, তাদের দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বঙ্গবন্ধু বলেছেন, বাংলাদেশে নানা সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস। ধর্ম আলাদা হলেও আমাদের সবার আজ একটাই পরিচয়, আমরা বাঙালি। এখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ বা সংখ্যালঘিষ্ঠ বলে কোনো শ্রেণিবৈষম্য বিচার্য হতে পারে না। আমাদের ধর্ম বা বর্ণ আলাদা হতে পারে না...কিন্তু বাঙালি হিসাবে এ স্বাধীন বাংলার সব নাগরিকের বড় পরিচয়। যার যা ধর্ম, তিনি তা স্বাধীনভাবে পালন করুন। কিন্তু একের সঙ্গে অপরের যেন বিরোধ না ঘটে।
আজ আমরা বলতে চাই, পরস্পর এই ভ্রাতৃত্বের মাধ্যমেই বাঙালি হিসাবে আমাদের পরিচয়। সেই পরিচয়ের মাধ্যমেই আমরা সঠিক পথের ঠিকানা লাভ করতে পারি। এতেই উদার পরমত সহিষ্ণু একটি সমাজ গড়ে উঠবে, যে সমাজ ব্যবস্থার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সারা জীবন কাজ করেছেন। আসুন বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সেই সোনার বাংলা গড়ে তুলতে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করি। কোনো ধর্মীয় ভেদাভেদ নয়। ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্যই হচ্ছে একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা। ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্য বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে বিকশিত হয়েছিল বলেই তিনি বাংলার মানুষের নয়নের মণি। তিনি আপস করেননি বলেই তিনি বাংলাদেশ মৌলবাদের ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রাম করেছেন। শেষ পর্যন্ত নিজের রক্ত দিয়ে তিনি প্রমাণ করে গেছেন, বঙ্গবন্ধু একজন খাঁটি ধার্মিক ও বাঙালি।
আজ নতুন প্রজন্ম ও নবীন রাজনীতিকেরা বঙ্গবন্ধুর প্রকৃত আদর্শকে অনুসরণ করে দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করলে এ দেশে অবশ্যই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলায় পরিণত হবে।