বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন ও কিছু কথা...


শেখ মুজিবুর রহমান ‘যতদিন রবে পদ্মা যমুনা/গৌরী মেঘনা বহমান,/ততদিন রবে কীর্তি তোমার/ শেখ মুজিবুর রহমান।’ আজ স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, হাজার বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৯৪তম জন্মবার্ষিকী ও জাতীয় শিশু দিবস ১৭ মার্চ। জাতির জনক ১৯২০ সনের এই দিনে গোপালগঞ্জের অজ পাড়া গাঁ টুঙ্গিপাড়ায় শেখ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। খোকা নামের সেই শিশুটি পরবর্তীতে হয়ে ওঠেন নির্যাতিত-নিপীড়িত বাঙালীর মুক্তির দিশারী। গভীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, আত্মত্যাগ এবং জনগণের প্রতি মমত্ববোধের কারণে পরিণত বয়সে হয়ে ওঠেন বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা। এক রাজনৈতিক সংগ্রামবহুল জীবনের অধিকারী এই নেতা বিশ্ব ইতিহাসে ঠাঁই করে নেন স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার হিসেবে। শেখ মুজিবুর র��মান, স্ত্রী ও তার তিন সন্তান মহান এ নেতার জন্মদিনে জাতীয় শিশু দিবস হিসেবে উদ্যাপন করে পুরো জাতি। আজীবন সংগ্রামী এই মহান নেতার যখন জন্ম হয় তখন ছিল ব্রিটিশ রাজত্বের শেষ অধ্যায়।
শেখ মুজিবুর রহমান
গ্রামের স্কুলে তার লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয়। ছোটবেলা থেকেই স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন তিনি। আর এর ফলশ্রুতিতে কিশোর বয়সেই বঙ্গবন্ধু সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে অষ্টম শ্রেনীতে অধ্যয়নকালে তৎকালীন ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যোগদানের কারণে বঙ্গবন্ধু প্রথমবারের মতো গ্রেফতার হয়ে কারাবরণ করেন। এরপর থেকে শুরু হয় তার বিপ্লবের জীবন। গোপালগঞ্জ মিশন স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করার পর তিনি কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। এ সময়েই হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা একে ফজলুল হকসহ তৎকালীন প্রথম সারির রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সান্নিধ্য লাভ করেন বঙ্গবন্ধু।
শেখ মুজিবুর র��মান, স্ত্রী ও তার তিন সন্তান
বাবা মায়ের সাথে শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৭ সনের পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের জন্ম হওয়ার পর এক মুহুর্ত তিনি থেমে থাকেননি। পশ্চিম পাকিস্তানীদের নির্যাতনের খড়গ্ রুখতে প্রস্তুতি নিতে থাকেন। সহকর্মীদের নিয়ে ১৯৪৮ সনে গঠন করেন ছাত্রলীগ। এরপর ১৯৪৯ সনের ২৩ জুন তৎকালীন ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল ‘আওয়ামী মুসলীম লীগ’ থেকে মুসলীম শব্দটি বাদ দিয়ে আওয়ামীলীগ নামকরণ করা হয়। বঙ্গবন্ধু ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী। তখনকার তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের নামকরণে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী প্রথমবারের মতো আঁতকে ওঠে। এরপর থেকে কখনও ভাষার জন্য, কখনও স্বাধিকারের জন্য চলতে থাকে আন্দোলন। এসবের আড়ালে গড়ে ওঠে স্বাধীনতার আন্দোলন। ৪৭ এর দেশ বিভাগ ও স্বাধীনতা আন্দোলন, ’৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান পেরিয়ে ’৭০ সনের নির্বাচনে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি বাঙালীর অবিসাংবাদিত নেতায় পরিণত হন। আমাদের মহান মুক্তি সংগ্রামের প্রতিটি অধ্যায়ে বঙ্গবন্ধুর নাম তাই চিরভাস্বর হয়ে আছে। বাংলা, বাঙালী ও বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক কালজয়ী অধ্যায়। এই দেশ ও এই ভূখন্ডে যতদিন থাকবে, পদ্মা-মেঘনা-যমুনায় যতদিন স্রোতধারা বহমান থাকবে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারিত হবে এর সর্বত্রই, সবখানে। বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু এক অবিচ্ছেদ অধ্যায়। পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশের অবস্থান চিত্রায়িত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর কারণেই। বিশ্বসভায় বাঙালী জাতির সগর্ব উপস্থিতিই স্মরণ করিয়ে দেয় বঙ্গবন্ধুকে। এ অবিভাজ্য অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি নেই। তাই তো কবি লিখেছেন: ‘যতদিন রবে পদ্মা যমুনা/গৌরী মেঘনা বহমান,/ততদিন রবে কীর্তি তোমার/শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন এক আত্মত্যাগী মহান নেতা। পিতা-মাতার কাছে বঙ্গবন্ধু ছিলেন তাঁদের প্রিয় ‘খোকা।’ সংগ্রামী জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে তার অনুপ্রেরণার উৎস ছিলেন সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। আর এই দেশের ভুখন্ড থেকে শুরু করে তাপক্লিষ্ট, কুলি-কামিন, মজুর, কৃষাণ-কৃষাণী, জেলে-বাওয়ালী, বঞ্চিত শ্রেণীর মানুষেরা ছিল তার রাজনীতির অবলম্বন। এদের জন্যই তিনি লড়েছেন। শৈশব থেকে আমৃত্যু দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে কাজ করেছেন তিনি। জাতি-বর্ণ, বিভেদ-বৈষম্য তাঁর কাছে ছিল না। এ জন্যই তিনি বাঙালী জাতির জনক এবং বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন।
বাবা মায়ের সাথে শেখ মুজিবুর রহমান
লাইব্রেরিতে পড়ার টেবিলে শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৮ সন থেকে ’৫২-এর মহান ভাষা আন্দোলন, ’৬২-এর শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৬-এর ঐতিহাসিক ৬ দফা, স্বায়ত্তশাসনের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে, কথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধু কারারুদ্ধ হন। ’৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর দেয়া ৬ দফার পক্ষে অকুণ্ঠ সমর্থন জানায় বাঙালী জাতি। এতে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামীলীগ পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলের লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাঙালীর এই নির্বাচনে বিজয়কে মেনে নেয়নি। সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আওয়ামীলীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে তারা নানা ষড়যন্ত্র শুরু করে। আর অপেক্ষা নয়, ’৭১-এর মার্চ মাসে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নজিরবিহীন অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু বর্জকণ্ঠে ঘোষণা করেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বঙ্গবন্ধুর এই ঐতিহাসিক ভাষণে সাড়া দিয়ে সেদিন গোটা বাঙালী জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ’ ৭১-এর ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে নিরস্ত্র বাঙালীর ওপর আক্রমণ শুরু করলে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক বাসভবন থেকে ওয়্যারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এ ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কারাগারে আটক রেখে পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী তার প্রথম বিচার শুরু করে। ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে বীর বাঙালী ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় ছিনিয়ে নেয়। জন্ম হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। ’
লাইব্রেরিতে পড়ার টেবিলে শেখ মুজিবুর রহমান
শেখ মুজিবুর রহমান ৭২-এর ১০ জানুয়ারি বিশ্ব নেতৃবৃন্দের চাপে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করে তিনি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন। দেশে ফিরেই তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে মনোনিবেশ করেন। কিন্তু তিনি সেই সুযোগ বেশিদিন পাননি। ১৯৭৫ সনে জাতির অর্থনৈতিক মুক্তি তথা একটি শোষণমুক্ত ও সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনের লক্ষ্যে তিনি জাতীয় কর্মসূচী ঘোষণা করেন। এর কিছুদিনের মধ্যেই ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট কালরাতে নেমকহারাম ঘাতকদের তপ্ত বুলেটে সপরিবারে নিহত হন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ এই বাঙালী। আর আমরা কোটি বাঙ্গালী হারালাম আমাদের প্রানপ্রিয় মহান এই নেতাকে। যার অপূরনীয় ক্ষতি আজো বয়ে বেরাচ্ছি। হয়তো এই ক্ষতি বাঙালী জাতীকে বয়ে বেড়াতে হবে আজন্মকা‍ল।
শেখ মুজিবুর রহমান

SUMMARY

659-1.jpg