(সাপ্তাহিক ‘সাপ্তাহিক’) - লিখেছেন- অঘোর মণ্ডল। বত্রিশ নম্বরটা কী? হোল্ডিং নাকি রোড? প্রশ্নকর্তাকে খুব সহজেই বলা যেত- রোড নম্বর। কিন্তু মার্চের শেষ সপ্তাহে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বিদেশি সাংবাদিক বন্ধুকে বললাম; ওটা রোডও না হোল্ডিংও না! ওটা আসলে বাংলাদেশের ঠিকানা! বিস্ময়মেশানো চাহনি নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ভদ্রলোক বললেন, সেটা কী রকম! বুঝলাম, বাংলাদেশকে চিনলেও বাংলাদেশের ইতিহাস সম্পর্কে খুব একটা জানা নেই তার। না জানাটা অবশ্য দোষের কিছু না। তবে তাকে জানাতে যাওয়াও একটা স্পর্শকাতর বিষয় মনে হচ্ছিল। কারণ যে দেশের পাসপোর্ট নিয়ে তিনি ঢাকায় এসেছেন ওয়ার্ল্ড টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট কাভার করতে, তেতাল্লিশ বছর আগে ঢাকায় আসতে তাদের পাসপোর্টের দরকার পড়ত না। তাই বয়সের দিক থেকে হাফ সেঞ্চুরির কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রলোককে একাত্তরে ফিরিয়ে নিয়ে বিব্রত অবস্থায় ফেলতে চাইনি। আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থার হয়ে এর আগেও বার কয়েক ঢাকা ঘুরে গেছেন তিনি ক্রিকেটের সৌজন্যে। এবারও তা-ই। কিন্তু এবার অফিস ঢাকায় তার ঠিকানা করে দিয়েছিল ধানমন্ডিতে একটা গেস্ট হাউস। সে কারণেই ওই বত্রিশ নম্বরের পাশ দিয়ে যাতায়াত। বত্রিশ নিয়ে তার কৌতূহল। আর তার সেই কৌতূহল মেটাতে গিয়ে নিছক রসিকতা করে বলা নয়; বত্রিশ নম্বরই হচ্ছে বাংলাদেশের ঠিকানা। মিরপুর রোডের যে জায়গাটায় এসে বত্রিশ মিলে গেছে; সেখানে ঢাকা সিটি করপোরেশন রোডের যে নম্বরপ্লেট দিয়েছে, সেটা এগার। ভদ্রলোক-কে সেটা দেখিয়ে বললাম, এটা হচ্ছে রোড নম্বর। কিন্তু এই রোড নম্বর কেউ জানে কি না সন্দেহ! কিন্তু বত্রিশ নম্বর বললে রিক্সাওয়ালাও জানবে। আর ধানমন্ডি বত্রিশ বলতে কোন বাড়িটা, তাও তাদের জানা। তাই এটাই বাংলাদেশের ঠিকানা। তার জন্য এখন আর এই বাড়ির ইতিহাস জানার দরকার পড়ে না মানুষের। দরকার পড়ে না ষাটের দশকের গোড়ার দিকে ইটের পরে ইট গেঁথে কীভাবে তৈরি হয়েছিল সাদামাটা এই বাড়িটা। আজ যেটা বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর। সেই বঙ্গবন্ধু জাদুঘর দেখে গেস্ট হাউসে ফেরার পথে বন্ধু সাংবাদিক জিজ্ঞাসা করেছিলেন; এটাতো বঙ্গবন্ধুর বাড়ি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন কোথায় থাকেন? বললাম, প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন- গণভবনে। পরক্ষণেই প্রশ্ন: যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন না, তখন? বললাম সুধাসদন। সেটাও ধানমন্ডিতে। প্রধানমন্ত্রীর স্বামীর রেখে যাওয়া বাড়ি। পাঁচ নম্বর রোডের সেই বাড়িটাও রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেখলেন ভদ্রলোক। দেখে টেখে একটা কথাই বললেন, ভেরি সিম্পল! কথাটা শুনে বন্ধু সাংবাদিককে বললাম, হ্যাঁ, ভেরি সিম্পল! আর এটাই হচ্ছে বঙ্গবন্ধু আর বঙ্গবন্ধু পরিবারের জীবনযাত্রার নমুনা। এরপর বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামালের হাতে গড়া আবাহনী ক্লাবটা দেখলেন। সেখানেও ঝকঝকে তকতকে ভাব নেই। খুব সাদামাটা মানের একটা প্রতিকৃতি শেখ কামালের। আবাহনী ক্লাব দেখে ফেরার পথে সাতমসজিদ রোডে একটা বিশাল আধুনিক বিল্ডিং দেখিয়ে তাকে বললাম, এটা ছিল বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর বাড়ি! ‘ছিল! তাহলে এখন কাদের?’ খুব দ্রুত প্রশ্নটা করলেন তিনি। বাড়ির গায়ের নেমপ্লেট দেখিয়ে বললাম, এটা এখন আর বাড়ি নেই। এটা বাণিজ্যিক-আবাসিক ভবনের মিশেল। তবে এখানেও একটা জাদুঘরের মতো আছে। জাদুঘর শব্দটা শুনেই তার প্রশ্ন, এটাও বঙ্গবন্ধুর আরেকটা বাড়ি কি না! হাসতে হাসতে তাকে বললাম, বলা যেতেই পারে এটাও বঙ্গবন্ধুর বাড়ি। এই বাড়ির মধ্যে যে জাদুঘর আছে সেখানেও বঙ্গবন্ধু আছেন। বঙ্গবন্ধুর অনেক স্মৃতি এই বাড়িতেও। তবে বাড়িটা বঙ্গবন্ধুর না। বাড়িটা বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী এবং বঙ্গবন্ধুর সহযোদ্ধা তাজউদ্দীন আহমদের। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তাকেও জেলখানায় হত্যা করা হয়েছিল। ‘কেন!’ প্রশ্নটা করেই ফেললেন বিদেশি সাংবাদিক বন্ধু। উত্তর দিতে গিয়ে একটা কথাই বলতে হলো, বঙ্গবন্ধুকে যারা মেরেছিল, তারা জানত, বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে যে লোকটা মুক্তিযুদ্ধ পরিচাল��ায় নেতৃত্ব দিলেন, দেশ স্বাধীন করে ফেললেন, বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তান থেকে ফিরিয়ে আনতে পারলেন, তিনি বেঁচে থাকা মানে আরেকটা লড়াইয়ের সম্ভাবনা থেকে যায়। যে লড়াই হতো বঙ্গবন্ধুর আদর্শ প্রতিষ্ঠার লড়াই। তাই তাকেও...! ধানমন্ডি দর্শন শেষে আবার মিরপুর রোড ধরেই মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে রওনা দিতে হলো বিদেশি বন্ধু সাংবাদিককে নিয়ে। পথে আরও একবার উঠে এলো বঙ্গবন্ধু পরিবারের গল্প। কারণ, হাতের বাঁয়ে ধানমন্ডি ক্লাবের বিশাল মাঠ। নাম বদলের সংস্কৃতিতে এখন যার নাম- লে. শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব লিমিটেড। শেখ কামালের প্রতিষ্ঠা করা আবাহনী ক্লাব। কিন্তু এই ধানমন্ডি ক্লাব? এটা শেখ জামালের নিজের হাতে গড়া ক্লাব নয়। তবে শেখ জামাল নিজে এখানে ফুটবল খেলেছেন। পুরনো সংগঠকরা সেই সাক্ষী দেবেন। ’৭২ এবং ’৭৩-এ শেখ জামাল আজাদ স্পোর্টিংয়ের হয়ে ফুটবল খেলেছেন। শেখ জামালের সেই আজাদ স্পোর্টিং আজ প্রায় ইতিহাস! হারিয়ে যাওয়ার পথে ঢাকার অন্যতম প্রাচীন এবং ঐতিহ্যবাহী সেই ক্লাবটি। দু’একজন নিবেদিত প্রাণ ক্রীড়া সংগঠক এখনো সেখানে বাতি জ্বালিয়ে রেখেছেন। যেটা প্রায় নিভু নিভু! সেই ক্লাবকে দেখভালের জন্য শেখ জামালের কোনো বন্ধুকে খুঁজে পাওয়া যায় না! অথচ ধানমন্ডি ক্লাবে হঠাৎ শেখ জামালের অনেক বন্ধুর আগমন! আর যে মাঠে খেলে শেখ জামালের মতো অনেকেই ফুটবলার, ধানমন্ডির সেই মাঠে এখন আর কোন কিশোর কিংবা তরুণের প্রবেশাধিকার নেই ফুটবল কিংবা ক্রিকেট ব্যাট হাতে নিয়ে! কারণ, সেটা এখন শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব লিমিটেড! প্রশ্ন উঠছে, ধানমন্ডিবাসীর মাঠ কেন একটা লিমিটেড ক্লাবের মাঠ হয়ে যাবে? আর বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যেদের নামে কেন লিমিডেট ক্লাব হবে? বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের অনুমতি নিয়েই হয়তো শেখ জামালের নাম ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু তারা কি আর একবার একটু ভেবে দেখবেন, বঙ্গবন্ধু কিংবা তার পরিবারের সদস্যদের নামে কি লিমিটেড ক্লাব হতে পারে! বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবারকে কোনো গোষ্ঠীর সংকীর্ণ গণ্ডির মধ্যে আটকে রাখার উদ্দেশ্য আর যা-ই হোক, মহৎ কিছু হতে পারে না। বত্রিশ নম্বর যদি হয় বাংলাদেশের ঠিকানা, তাহলে আট নম্বরের ধানমন্ডি মাঠ, এলাকার সব মানুষের মাঠ। বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদেরই সেটা প্রতিষ্ঠা করে দিতে হবে। কারণ, ধানমন্ডি ক্লাবের সঙ্গে জড়িয়ে দেয়া হয়েছে বঙ্গবন্ধু পরিবারের নামও। সেই নামের যাতে কোনো অমর্যাদা না হয় সেটা নিশ্চিত করার পাশাপাশি এটাও ভেবে দেখা উচিত ওই নামটাকে বিতর্কিত করার জন্যই ধানমন্ডি ক্লাবকে শেখ জামাল লিমিটেড বানানো হয়েছে কিনা। পুনশ্চ: সাইনবোর্ড দিলেই নাম বদলানো যায় না। ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বর রোডকে এগার নম্বর হিসেবে পরিচিত করা যায়নি। যদিও তারও একটা সাইনবোর্ড আছে!