তাজউদ্দীনের কাছে সেনা অভ্যুত্থানের প্রস্তাব দিয়েছিলেন জিয়া!


১. সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে বঙ্গবন্ধুকে ক্যান্টনমেন্টে বন্দী করার প্রস্তাব নিয়ে জেনারেল জিয়াউর রহমান গিয়েছিলেন তাজউদ্দীন আহমদের কাছে! মুজিব সরকারকে এভাবে ক্ষমতাচ্যুত করতে তাজউদ্দীন আহমদের সমর্থন চেয়েছিলেন জিয়া! তাজউদ্দীন আহমদ প্রস্তাব নাকচ করে বলেছিলেন, এসব জঘন্য ব্যাপারে আমাকে জড়াবেন না। এর মধ্যে আমি নেই। সুমহান মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা রাখার জন্য বিদেশি বন্ধুদের সঙ্গে স্বাধীনতা সম্মাননা পদকপ্রাপ্ত ভারতের প্রবীণ সাংবাদিক সুখরঞ্জন দাসগুপ্তের পঁচাত্তর-উত্তর লেখা গ্রন্থ 'মুজিব হত্যার ষড়যন্ত্র'-এর ৩২ পৃষ্ঠায় এমন তথ্য ঠাঁই পেয়েছে। বইটি পশ্চিমবঙ্গের প্রভাবশালী বাংলা দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকার আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি. '৭৮ সালের আগস্ট মাসে প্রথম প্রকাশ করে। বইটি তখন বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করা হয়। সম্প্রতি ভারতের লোকসভা নির্বাচন কাভার করতে দিলি্ল-কলকাতা সফরকালে বইটি আমার হাতে আসে। একইসঙ্গে দেখা হয় প্রবীণ সাংবাদিক সুখরঞ্জন দাসগুপ্তের সঙ্গেও। সুখরঞ্জন দাসগুপ্ত আনন্দবাজার পত্রিকার প্রতিনিধি হিসেবে বঙ্গবন্ধু হত্যার তিন দিন পর সাংবাদিক বরুণ সেনগুপ্ত এবং অপর দুজন সহকর্মীর সঙ্গে ঢাকায় আসার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু জরুরি অবস্থাকালে ওই রাতে গোয়েন্দা পুলিশ তাদের চারজনের বাড়িতে হানা দিয়ে আন্তর্জাতিক পাসপোর্ট কেড়ে নিয়ে যায়। তার ভাষায়- সেনাশাসকরা যেমন ভিসা দেয়নি ঢাকা আসতে তেমনি তাদের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী সংবাদ সংগ্রহে বার বার বাধা দিয়েছেন। বইটিতে কিছু একটি ঘটতে যাচ্ছে এই আশঙ্কা থেকে সবাই বঙ্গবন্ধুকে অবহিত করলেও জাতির এই মহান নেতা কারও কথায়ই আমল দেননি। তাজউদ্দীনের কথায়ও না। বঙ্গবন্ধু বিশ্বাস করেছিলেন মোশতাক, জিয়াসহ সবাইকে। তাকে কেউ মারবে এমনটি তিনি ভাবতেই পারতেন না। অতি বিশ্বাস আর আস্থার চড়া মূল্য দিতে হয়েছিল পরিবার-পরিজনসহ নিজের জীবন দিয়ে! সুখরঞ্জন দাসগুপ্ত বলেছেন, ১৯৭৫ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত তিনি ঢাকায় আনন্দবাজার পত্রিকার ব্যুরো চিফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সেই সময়ে বঙ্গবন্ধু সরকারের মন্ত্রী ও সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা বেড়েছিল। মুক্তিযুদ্ধকালেই কলকাতাতে সম্পর্কের সূচনা ঘটেছিল। জাতীয় নেতা ও স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী শহীদ তাজউদ্দীনের মুখ থেকে শোনা কথাকেই তিনি বইয়ে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। তার ভাষায় সেই সময় বইটি ব্যাপক কাটতি পেলেও সেনাশাসক জিয়াউর রহমান বাংলাদেশে তা নিষিদ্ধ করেন। ২. সুখরঞ্জন দাসগুপ্ত লিখেছেন, ১৯৭৫ সালের এপ্রিলের এক সকালবেলা। আগের দিন ভারতের কৃষি ও সেচ মন্ত্রী জগজীবন রাম ঢাকা সফরে আসেন। ফারাক্কা চুক্তিতে সই করেন। আলোচনা ও চুক্তির বিষয় সম্পর্কে খবর সংগ্রহের জন্য কয়েকজন ভারতীয় সাংবাদিক যখন সরকারি দফতরে গেলেন দেখলেন তারা ইতিমধ্যে সরকারের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছেন। তার ভাষায়_ 'কিছুকাল আগেও আমাদের সাদরে ডেকে কথা বলত ওরা। হঠাৎ হাওয়া বদলে গেছে। দূর পশ্চিমের কিছু বিদেশি সাংবাদিককে সাদরে বরণ করার জন্য যেন লাল কার্পেট বিছানো। আর আমরা হয়ে পড়েছি অবাঞ্ছিত আগন্তুক। পরদিন সকালেই গেলাম তাজউদ্দীনের কাছে। হাতে আমার বিদ্যাসাগর রচনাবলীর একটি খণ্ড। দুই খণ্ড আগেই তাকে দিয়েছিলাম। তিনি আমাকে বিদ্যাসাগর রচনাবলী সংগ্রহ করে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। এবার তৃতীয় খণ্ড নিয়ে গেলাম। আমাকে দেখেই তাজউদ্দীন বললেন, জরুরি কথা আছে, বসুন। সেখানে উপস্থিত অন্যদের চলে যেতে বললেন। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। তার কণ্ঠস্বরে পরিবর্তন মনে হলো। বলতে শুরু করলেন, গত চার-পাঁচ মাস আমি ঘর থেকে এক পা বেরুইনি। একটা ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র দানা বেঁধে উঠছে। জানতে চাইলাম কী ধরনের ষড়যন্ত্র? তিনি বললেন, কী রকম? হত্যা! হত্যার ষড়যন্ত্র! আমি শিউরে উঠি। প্রশ্ন করি_ কারা এই ষড়যন্ত্র করছে? নাম জানতে পারি? তাজউদ্দীন গম্ভীরভাবে বললেন, কী হবে আর নাম শুনে! তারা সব শেখ সাহেবের বিশ্বস্ত লোক। শেখ সাহেব তা জানেন? জানার তো কথা। তাজ গোড়া থেকে ব্যাপারটা বলতে থাকেন। ক'দিন আগে এক রাত্রে মেজর জেনারেল জিয়া দেখা করতে আসে। সে প্রস্তাব দিল, সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে মুজিবকে ক্ষমতাচ্যুত করা হবে। তার পরে তাকে আটক রাখা হবে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে। এ ব্যাপারে সে তাজউদ্দীনের সমর্থন চায়। তিনি সাফ জানিয়ে দেন এর মধ্যে তিনি নেই। তাজউদ্দীন বললেন, নিজের থেকে যে জিয়া আসেনি আমার কাছে, তা বেশ বুঝতে পারলাম। ওকে পাঠানো হয়েছিল, এ রকম একটা প্রস্তাবে আমার কী প্রতিক্রিয়া হয় তা বুঝতে। আমি অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই জিয়ার কথাটা জানিয়ে দেই মুজিবকে। মুজিব কী বললেন? তাজউদ্দীনের জবাব, আমি বুঝতে পারলাম না মুজিব আমাকে বিশ্বাস করলেন কি না। যা হোক, আমি কিছুদিনের জন্য অন্তত রাজনীতি থেকে দূরে থাকতে চাই। আমার এক ভাই পাশের ঘরে গুরুতর অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী। তা নিয়েও আমাকে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। তা ছাড়া দেশের যা পরিস্থিতি এখন তা অত্যন্ত দূষিত। ভারতবিরোধী মনোভাব চরমে পৌঁছেছে। যে সাম্প্রদায়িক শক্তি মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি জান্তার লেজুড়বৃত্তি করেছে তারাই আজ প্রশাসনের মাথায় চড়ে বসছে। এই অবস্থায় ভারত সরকার আর ভারতের জনগণের সামনে আমি কোন মুখে দাঁড়াব? আপনি জানেন, আমাদের সেই সংগ্রামের দিনে আপনাদের সরকার আর জনগণ কী না করেছে আমাদের জন্য। আজ সেই পরম বন্ধু ভারতের বিরুদ্ধে কদর্য মিথ্যা প্রচার চালানো হচ্ছে। এসবের পিছনে একটা উদ্দেশ্য রয়েছে, আমি জানি। তাই আমি দূরে সরে থাকতে চাই। সুখরঞ্জন দাসগুপ্তের মন্তব্য ছিল, তা তো থাকলেন, কিন্তু আপনি যে সাংঘাতিক ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত দিচ্ছেন। তাজউদ্দীন বললেন, হ্যাঁ, সাংঘাতিক ষড়যন্ত্র। আমরা সবাই শেষ হয়ে যাব এতে। মানে? মানে আমাদের সবাইকে খতম করার পরিকল্পনা প্রস্তুত। সেকি! আপনাদের কিছু করবার নেই ষড়যন্ত্র বানচাল করতে? কিছু করুন একটা। সুখরঞ্জন দাসগুপ্তের ভাষায়, করব? তাজউদ্দীনের দীর্ঘশ্বাস পড়ল। তিনি আমার দিকে গভীর দৃষ্টি রেখে বললেন, আপনাকে এসব বলছি, কারণ আমি জানি আপনি আমার বন্ধু। আপনাকে একটা অনুরোধ করছি, কলকাতায় গিয়ে গোলক মজুমদারকে ব্যাপারটা বলবেন দয়া করে। গোলক মজুমদার তখন ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর আইজি। ১৯৭১-এ তাজউদ্দীন যখন বাংলাদেশ থেকে কলকাতায় আসার চেষ্টা করছিলেন তখন ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গোয়েন্দাপ্রধান তাকে সীমান্ত থেকে সাদরে সসম্মানে গ্রহণ করেন। তাকে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেই থেকে এদের সঙ্গে তাজউদ্দীন ও স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের ঘনিষ্ঠতা জন্মায়। সুখরঞ্জন দাসগুপ্তের ভাষায়- তিনি তাজউদ্দীনকে কথা দিলেন তার বার্তা তিনি যথাস্থানে পৌঁছে দেবেন। তাজউদ্দীন আহমদ ষড়যন্ত্রের বিষয়টি তখন তাকে গোড়া থেকে বললেন। তাজউদ্দীনের ভাষায়, ভুট্টোর বাংলাদেশ সফরের পর থেকেই খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের চার-পাঁচজন শয়তান মুজিব সরকারকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্র করে আসছে। এবং বাইরের শক্তি বিশেষের সাহায্যও পাচ্ছে তারা। বাণিজ্যমন্ত্রী মোশতাক জেদ্দা গিয়েছিলেন। সেখানে পাকিস্তানি প্রতিনিধি দলও ওই সময়ে ছিল। সেখানে বসেই ষড়যন্ত্রের ছক পাতা হয়। সেখান থেকে ফিরে আসার পর খন্দকার মোশতাক ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডেভিট ফস্টারের সঙ্গে ঘন ঘন মিলিত হন। তাজউদ্দীন আরও বলেন, আমি অর্থ দফতর ছেড়ে দিলাম। এর পরেই মার্কিন দূতাবাস ব্যাংক থেকে একদিনে তিন কোটি টাকা তুলে নেয়। ষড়যন্ত্রকারীদের হাতে অর্থ এসে গেল অঢেল। তাজউদ্দীনের কথায় কৌতূহলী সুখরঞ্জন দাসগুপ্তের প্রশ্ন ছিল- আমেরিকার কী স্বার্থ থাকতে পারে এতে? তাজউদ্দীনের জবাব ছিল, অনেক স্বার্থ। ইয়াহিয়া এবং ভুট্টো যখন বাংলাদেশে গণহত্যা চালাচ্ছিল তখন একমাত্র আমেরিকাই ওদের সমর্থন করে। এখন তারা তাদের সেই সমর্থনের পিছনকার আসল উদ্দেশ্যটি হাসিল করতে চায়। তাই ষড়যন্ত্রকারীদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। অপরদিকে সৌদি আরব, জর্দান, লিবিয়ার মতো দেশগুলো কোনোক্রমেই 'ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ'কে মানতে পারছে না। বাংলাদেশকে ইসলামী রাষ্ট্র করার জন্য পরোক্ষভাবে তারা চাপ দিয়ে চলেছে। তা হলে তারা নানা সাহায্য দেবে বলে লোভ দেখাচ্ছে। কিন্তু, ১৯৭০ এবং '৭৩-এ যে নির্বাচনে আমরা বিজয়ী হই তাতে ধর্মনিরপেক্ষতাকেই আদর্শরূপে ঘোষণা করি। আজ সে নীতি বর্জনের কথা কিছুতেই উঠতে পারে না। অথচ তারা সেটি চায়। এর সঙ্গে আছে মোশতাক চক্র। খন্দকার মোশতাক কখনো স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ চাননি। সর্বদা তিনি পাকিস্তানি নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছেন। তাজউদ্দীন বলেন, পাকিস্তানি সৈন্যরা কেন অমন করে আমাদের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে জানেন? তার কারণটিও বলছি। আমরা আওয়ামী লীগের পঞ্চপ্রধান একটা পরিকল্পনা করেছিলাম। পাকিস্তানের মধ্যেই নির্বাচনে আমরা ক্ষমতা দখল করতে পারব জানতাম। প্রথম তাই করব। শেখ সাহেব মন্ত্রিসভায় থাকতে চাইবেন না। সৈয়দ নজরুল হবেন প্রধানমন্ত্রী। আমাকে করা হবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। খন্দকার মোশতাককে পার্লামেন্টে স্পিকার করে দেব। তারপর একসময় প্রধানমন্ত্রী রূপে সৈয়দ নজরুল হুকুম করবেন, পূর্ব পাকিস্তান থেকে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী সরিয়ে আনো। আমি সে হুকুম তামিল করব। এই কাজটি যেই হয়ে যাবে তখনই জাতির পিতা হিসেবে মুজিব ঢাকায় জাতীয় সংসদের অধিবেশন ডাকবেন। সেখানে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির প্রস্তাব তুলবেন। সেই প্রস্তাব গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে জন্ম নেবে সার্বভৌম বাংলাদেশ। ভুট্টো এই পরিকল্পনার আভাস পেয়ে যান। মোশতাকই তা ফাঁস করে দেন। আর ২৫ মার্চ পাক সেনারা ঝাঁপিয়ে পড়ে আমাদের ওপর। তাজউদ্দীন বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রত্যেকটি পরিকল্পনা সাবোটাজ করার চেষ্টা করে মোশতাক চক্র। এসব কথা আপনি মুজিবকে বলেননি কেন? তাজউদ্দীন বললেন, তিনি শুনতেই চান না। আবার চেষ্টা করে দেখুন না, উদ্বিঘ্নভাবে বলি। জবাবে তাজউদ্দীন বলেন, আমি চাই না যে মুজিব আর আমার মধ্যে কোনো রকম ভুল বোঝাবুঝি এবং তিক্ততার সৃষ্টি হোক। মাত্র কদিন আগে মুজিব আমাকে ফোন করে তার বাড়িতে ডাকেন। বলেন, তোমার সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে। আমি তাকে বিনয়ের সঙ্গে বলেছি, বঙ্গবন্ধু, আমি জানি আপনি আমায় ভালোবাসেন। কিন্তু আপনার পরিবারের লোক আমায় পছন্দ করে না। এই অবস্থায় আপনার ওখানে আমার যাওয়াটা ঠিক হবে না। আপনি পারিবারিক অশান্তিতে পড়বেন। আমি তা চাই না। শেখ সাহেব তখন একটু কী ভেবে ওই ফোনেই আমাকে বললেন, তুমি বাকশালের ভার নাও। আমি চাই তুমি সাধারণ সম্পাদক হও। তাজউদ্দীনের ভাষায়_ আমি তাতেও রাজি হইনি। আমি বঙ্গবন্ধুকে সালাম জানিয়ে বলি, সক্রিয় রাজনীতি থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমাকে মাফ করবেন। একটু থামলেন তাজউদ্দীন। তারপর আবার বলতে শুরু করলেন, আসলে একদিকে যেমন সিআইএ তাদের ডলারের থলে নিয়ে দালাল কিনতে নেমেছে, আরেকদিকে তেমনি নেমে পড়েছে রুশ চক্র। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি আর ন্যাপ (মোজাফফর) তো রুশ রুবল পাচ্ছেই ঢাকার রুশ দূতাবাসের মারফত। ভারত ছাড়া পৃথিবীর বৃহৎ শক্তির ১১টিই চাইছে বাংলাদেশকে দ্বিতীয় ভিয়েতনাম বানাতে। এবং তাদের চক্রান্তে জড়িয়ে পড়েছে এই দেশ। তাই আমি নিজেকে সরিয়ে নিয়েছি। ৩. সুখরঞ্জন দাসগুপ্তের ভাষায়- সেদিন তাজউদ্দীন আহমদ বারবার বলতে লাগলেন, সব স্বপ্ন শেষ হয়ে যাচ্ছে। সার্বভৌম স্বাধীন বাংলাদেশের যারা রূপকার তারা সব নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। আমি বিচলিত বোধ করি। বুঝতে পারছি না এ রকম একটা পরিস্থিতিতে কী করা উচিত। জিজ্ঞেস করলাম, ভারত সরকার কি জানে ব্যাপারটা? তাজউদ্দীন বললেন, জানা উচিত। ভারতের হাইকমিশনের কূটনীতিকরা নিশ্চয়ই চোখ-কান বুজে নেই। আমি আরেকটি বিষয় পরিষ্কার হতে চাই। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা মানে মার্কিন কূটনীতির পরাজয়। তারা এ জন্য প্রতিশোধ নিতে চাইতে পারে। কিন্তু রাশিয়ার কী স্বার্থ আছে এতে? তাজউদ্দীনের জবাব ছিল, এটা নেহাত ওদের ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বিতা। দুই দেশেরই গুপ্ত চক্র বাংলাদেশে তৎপর রয়েছে। আমাদের মধ্যে এমন লোক রয়েছে যাদের যে কোনোভাবে কেনা যায়। তাদের বিন্দুমাত্র দেশপ্রেম নেই। না হলে যে মার্কিন অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পাকিস্তানি সৈন্য আমাদের ভাই-বোনদের নির্বিচারে হত্যা করেছে সেই মার্কিন দূতাবাসে ককটেল পার্টিতে যেতে পারত না ওই লোকগুলো। ওরা ইসলামের ধার ধারে না। অথচ, সর্বদা ইসলাম ইসলাম বলে সাম্প্রদায়িক জিগির তুলছে। তাজউদ্দীন আহমদ বললেন, ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে (বর্তমানে রূপসী বাংলা) বেশ কয়েক মাস গুরভানভ নামে এক রুশ নাগরিককে দেখেছি। লোকটি প্রায়ই আসত। বাংলা বলে অনর্গল। পরে শুনলাম, সে রুশ গোয়েন্দা চক্র কেজিবি'র উচ্চপদস্থ অফিসার। এই উপমহাদেশের গুপ্তচর জালের দেখাশোনার দায়িত্ব তার। আমাদের রুশপন্থি নেতারা তাকে খুব খাতির করেন দেখি। দেশের লোকই যদি বিদেশি গোয়েন্দা চক্রের দালালি করে তাহলে মুজিব কী করতে পারে বলুন। ৪. তাজউদ্দীনের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার পর সুখরঞ্জন দাসগুপ্ত যান শহীদ কামরুজ্জামানের বাসভবনে। তার ভাষায়, আমাকে দেখেই তিনি বললেন, জর্দা কই? ভালো জর্দা দিয়ে পান খাওয়া ছিল কামরুজ্জামানের অন্যতম বিলাসিতা। যখনই ঢাকা গেছি তার জন্য জর্দা নিয়ে যেতাম এক কৌটো। এবারও এনেছি কিন্তু সঙ্গে নেই। হেসে বললাম, পাবেন, হোটেলে রয়েছে জর্দা। তারপর শুরু করি আসল কথা। তিনি বললেন, আগে বলুন কার কার সঙ্গে দেখা হয়েছে আপনার? কী পেলেন শুনি? আপনিই বলুন না কী হাল এখানকার? মুখে বিষণ্ন হাসি নিয়ে কামরুজ্জামান বললেন, খুব খারাপ। খারাপটা কী বলুন না? তিনি বললেন, খন্দকার মোশতাক এক দারুণ ষড়যন্ত্র করেছে। এর বেশি বলব না। বাকিটা চেষ্টা করলেই জানতে পারবেন। শীঘ্রই কলকাতা যাচ্ছি। সুযোগ হলে সেখানে হয়তো সব বলতে পারব। রাতে জাহানারা ইমামের এলিফ্যান্ট রোডের বাড়িতে এক পার্টিতে গেলাম আমন্ত্রিত হয়ে। সেখানে কয়েকজন সেনা কর্মকর্তাও ছিলেন। এদের মধ্যে মেজর ডালিম (বঙ্গবন্ধু হত্যায় অভিযুক্ত পলাতক খুনি) অন্যতম। তথ্য দফতরের মহাপরিচালক এম আর আখতার মুকুল, বিবিসির সংবাদদাতা শ্যামল লোধ প্রমুখ। মুজিব সরকারের ব্যর্থতার প্রসঙ্গ আলোচনায় এলো। সেখানে মেজর ডালিম স্পষ্ট বললেন, মুজিবের হাত থেকে দেশ বাঁচাতে একমাত্র উপায় সামরিক শাসন কায়েম। সুখরঞ্জনের ভাষায়, ঢাকায় তখন ভারতবিরোধী হাওয়া চলছে প্রবলভাবে। আমি বেশি মুখ খুললাম না। আখতারই আমাকে আড়ালে ডেকে চুপ থাকতে পরামর্শ দেন। আলোচনার ধারাটাও তিনি ঘুরিয়ে দিতে চাইলেন। কিন্তু ব্যর্থ হলেন। হোটেলে ফেরার পথে আখতার জানতে চাইলেন, কিছু বুঝতে পারলেন আজ? শুধু বললাম, কী আর বুঝবার আছে? পরদিন সকালে গেলাম আবদুল গাফফার চৌধুরীর কাছে। নির্ভীক লেখনির কারণে আইয়ুব খান তাকে কারারুদ্ধ করেছিল। তিনি বললেন, কী আর বলব, স্ত্রীকে নিয়ে বাইরে চলে যাচ্ছি। কেন? তার উত্তর, স্ত্রী গুরুতর অসুস্থ। তার চিকিৎসার জন্য বাইরে যেতে হচ্ছে। শেখ সাহেব আমাকে সাহায্য করেছেন। তার পরেই তিনি আসল কথাটা বললেন। বোধহয় চিরদিনের মতো ঢাকা থেকে বিদায় নিচ্ছি। মানে? আমি আরও স্পষ্ট উত্তর চাই। তিনি বললেন, মানে আর এখানে থাকা সম্ভব নয়। একটি পশ্চিমা দূতাবাস এখানে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটানোর জন্য তৎপর হয়ে উঠেছে। আর তাতে মদদ দিচ্ছে মুজিবেরই ঘনিষ্ঠ মহল। বন্ধুদের অনুরোধে পরে গেলাম বাণিজ্যমন্ত্রী খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে ���থা বলতে। তিনি আমায় জড়িয়ে ধরলেন। কলকাতার খবর কী বলুন? একাত্তরে মোশতাক কলকাতায় আমার বাসার কাছাকাছি ছিলেন। প্রায় প্রত্যেক দিন সকালে আমাদের দেখা-সাক্ষাৎ হতো। সব সময় তার অভিযোগ ছিল, কলকাতার কাগজগুলো তাজউদ্দীন আর নজরুলের কথাই প্রচার করছে বেশি। তিনি স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের বিদেশ মন্ত্রী হলেও তার কথা লেখা হচ্ছে না। সেদিন তিনি আমাকে বললেন, বাণিজ্যমন্ত্রী হিসেবে চান বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে বাণিজ্যিক লেনদেনের আরও উন্নতি হোক। এই তো কলকাতাকে মাছ দেওয়ার জন্য তিনি চেষ্টা করছিলেন কিন্তু হলো না। মুজিবই পিছিয়ে দিলেন। একজন বাইরের সাংবাদিকের কাছে এভাবে মুজিবের বিরুদ্ধে কী করে বলতে পারলেন তিনি, বুঝলাম না। বাংলাদেশের সবাই জানে মুজিব-তাজউদ্দীনের সম্পর্কে ফাটল ধরিয়েছেন খন্দকার মোশতাক। মুজিব পরিবারের সদস্যদের সাহায্যেই। কলকাতা ফিরে গোলক মজুমদারকে সব কথা জানালাম। আমাদের পত্রিকায় বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে দু'টো বড় লেখা দিলাম। লেখা দুটি পড়ে ঢাকা থেকে ট্রাঙ্ককলে দুজন মন্ত্রী অভিনন্দন জানান। তারা হয়তো আশা করেছিলেন এবার সবার টনক নড়বে। দুষ্ট চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে তারা বাঁচবেন। কিন্তু হায় তা হলো না। আমার সঙ্গে কথা বলার পর গোলক মজুমদার ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর ডিরেক্টর জেনারেল অশ্বীনি কুমারকে এক গোপন রিপোর্টে সব জানালেন। সে রিপোর্টের কপি আমি দেখেছি। তাতে বাংলাদেশে যে একটা বিশ্রী কাণ্ড ঘটতে যাচ্ছে সে কথা বলা ছিল। সেখানকার ফৌজি তৎপরতা বৃদ্ধির কথা ও গোলক মজুমদারের রিপোর্ট দিল্লি পৌঁছানোর কদিনের মধ্যেই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের বিশেষ সচিব রুস্তমজি কলকাতায় হাজির হলেন। আমার সঙ্গে দেখা করে জানতে চান, তাজউদ্দীন ঢাকায় আমাকে কী বলেছেন? সব শুনে রুস্তমজি দিলি্ল চলে গেলেন। ভাবলাম কিছু একটা হবে। ইতিমধ্যে ভারতের ওপর নেমে এলো ইমার্জেন্সির যবনিকা। এতে অনেক কিছুর মতো বাংলাদেশ সম্পর্কে লেখাও নিষিদ্ধ হলো। মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায় দিলি্লর সেন্সর বোর্ডকে বোঝালেন, বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছু লিখলে তার মন্ত্রিসভায় যে পাঁচজন মুসলমান সদস্য রয়েছেন তারা নাকি অসন্তুষ্ট হবেন। ফলে বিদেশ মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ সম্পর্কিত যুগ্ম সচিব জে সি আজমানি খবরের কাগজের ওপর এক নোটিস জারি করে দিলেন যে, বাংলাদেশ সম্পর্কে কোনো কথা ছাপা চলবে না। এর যথার্থ কারণটা দুর্বোধ্য। এমনকি ভারতের বিদেশ মন্ত্রণালয়ের জয়েন্ট সেক্রেটারি এবং সরকারি মুখপাত্র এ এন ডি হাকসার পর্যন্ত আমাদের সামনে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন, কেন এমন নিষেধাজ্ঞা হলো! বাংলাদেশের ব্যাপারে একরকম প্রেস ব্লাক আউট হলো। আর সেই ব্লাক আউটের অন্ধকারই বোধহয় সবচেয়ে বেশি কাজে লাগল কুচক্রীদের। সৌজন্যে: বাংলাদেশ প্রতিদিন

SUMMARY

654-1.jpg