১. মাঝে মাঝেই আমার মনে হয় আমাদের কত বড় সৌভাগ্য যে বাংলাদেশের মাটিতে বঙ্গবন্ধুর মতো একজন মানুষের জন্ম হয়েছিল। ঠিক সেই সময়টিতে দরকার হয়েছিল তখন যদি তাঁর মতো একজন মানুষের জন্ম না হত তাহলে কী হত? তাহলে কি বাঙালিরা নিজের একটা দেশের স্বপ্ন দেখতে পারত? সেই দেশের জন্যে যুদ্ধ করতে পারত? অকাতরে প্রাণ দিতে পারত? যদি আমরা নিজের একটি দেশ না পেতাম, এখনও পাকিস্তান নামের সেই বিদঘুটে দেশটির অংশ হিসেবে থাকতাম তাহলে আমাদের কী হত, সেই কথা চিন্তা করে আমি আতঙ্কে শিউরে শিউরে উঠি। এই মানুষটিকে পঁচাত্তরে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল। পৃথিবীর অনেক দেশেই অনেক মহামানবকে নিজের দেশ কিংবা দেশের মানুষের জন্যে প্রাণ দিতে হয়েছে কিন্তু বঙ্গবন্ধুর বিষয়টি ছিল অবিশ্বাস্য। তাঁকে সপরিবারে হত্যা করেই হত্যাকারীরা দাায়িত্ব শেষ করেনি, এই দেশের ইতিহাস থেকে তাঁর চিহ্ন মুছে দেওয়ার জন্যে একুশটি বছর এমন কোনো কাজ নেই যেটি করা হয়নি। যে মানুষটির কারণে আমরা আমাদের দেশটি পেয়েছি সেই দেশের রেডিও টেলিভিশনে কোনোদিন তাঁর নাম পর্যন্ত উচ্চারিত হয়নি। আমার মনে আছে প্রথমবার আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর আমি আমার স্ত্রীকে বলেছিলাম, “চল আমরা একটা টেলিভিশন কিনে আনি, এখন নিশ্চয়ই বঙ্গবন্ধুকে টেলিভিশনে দেখাবে।” শুধুমাত্র তাঁকে দেখার জন্যে আমরা একটা টেলিভিশন কিনে এনেছিলাম! আমরা আমাদের চোখের সামনে বাংলাদেশকে জন্ম নিতে দেখেছি, আমরা এই দেশের ইতিহাসের সাক্ষী, ইতিহাসের অংশ। আমাদের চোখের সামনে বঙ্গবন্ধু ধীরে ধীরে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেছিলেন। শৈশব কৈশোরে তাঁর সবকিছুর গুরুত্ব সবসময় বুঝতে পারিনি, এখন বড় হয়ে যখন পিছনে ফিরে তাকাই কখনও বিস্মিত হই, কখনও রোমাঞ্চিত হই, কখনও হতচকিত হয়ে যাই। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে একজন মানুষ হিসেবে অনুভব করার অবিশ্বাস্য ঘটনাটি ঘটেছে ২০১২ সালে, যখন তাঁর নিজের হাতে লেখা ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইটি হাতে পেয়েছি। আমি যখন নেলসন ম্যান্ডেলার আত্মজীবনীটি পড়ছিলাম তখন আমার বার বার মনে হয়েছিল, বছরের হিসেবে আমাদের বঙ্গবন্ধু তো নেলসন ম্যান্ডেলা থেকে খুব একটা কম সময় জেলে ছিলেন না, অবদান হিসেবে তাঁর অবদান তো নেলসন ম্যান্ডেলা থেকে কোনো অংশে কম নয়, তাহলে তিনি কেন তাঁর মতো করে নিজের আত্মজীবনী লিখে গেলেন না, আমরা কেন সেটি পড়ে রোমঞ্চিত হবার সুযোগ পেলাম না। তাই শেষ পর্যন্ত যখন বঙ্গবন্ধুর নিজ হাতে লেখা আবিষ্কৃত হল, সেটি প্রকাশিত হল আমার আনন্দের সীমা ছিল না। শিশু-কিশোরেরা যেভাবে রুদ্ধশ্বাসে ডিটেকটিভ বই পড়ে আমি ঠিক সেভাবে রুদ্ধশ্বাসে বঙ্গবন্ধু আত্মজীবনীটি পড়েছি। আমি মনে করি এই বইটি আমাদের দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি বই। যারা দেশকে ভালোবাসে তাদের সবাইকে এই বইটি পড়তে হবে। যারা রাজনীতি করে তাদেরকে এই বই পড়তে হবে। যারা রাজনীতি করতে চায় তাদেরকে এই বই পড়তে হবে। যারা দেশ শাসন করে তাদেরকে এই বই পড়তে হবে। যারা দেশ শাসন করতে চায় তাদেরকেও এই বই পড়তে হবে। এই বইটি পড়লেই শুধুমাত্র একজন মানুষ বুঝতে পারবে কীভাবে একজন মানুষ একটি জাতি হয়ে উঠে, একটি জাতি কীভাবে দেশ হয়ে উঠে। বইটিতে অসংখ্য বিষয় আছে, যেমন ধরা যাক বাঙালিদের কথা। তিনি বাঙালিদের কীভাবে দেখেছেন? বইয়ের অনেক জায়গায় তাদের কথা লেখা আছে। আমার পছন্দের একটা অংশ যখন তাদেরকে পাকিস্তানিদের সাথে তুলনা করেছেন (পৃষ্ঠা ২১৪)–
প্রকৃতির সাথে মানুষের মনেরও একটা সম্বন্ধ আছে। বালুর দেশের মানুষের মনও বালুর মত উড়ে বেড়ায়। আর পলিমাটির বাংলার মানুষের মন ঐ রকমই নরম, ঐ রকমই সবুজ। প্রকৃতির অকৃপণ সৌন্দর্যে আমাদের জন্ম, সৌন্দর্যই আমরা ভালবাসি।
বাঙালির চরিত্রের নিখুঁত ব্যাখ্যাও করেছেন অন্য জায়গায় (পৃষ্ঠা ৪৭)–
আমাদের বাঙালির মধ্যে দুইটা দিক আছে। একটা হল আমরা মুসলমান, আর একটা হল আমরা বাঙালি। পরশ্রীকাতরতা এবং বিশ্বসঘাতকতা আমাদের রক্তের মধ্যে রয়েছে। বোধহয় দুনিয়ার কোনো ভাষাতেই এই কথাটা পাওয়া যাবে না, ‘পরশ্রীকাতরতা’। পরের শ্রী দেখে যে কাতর হয়, তাকে ‘পরশ্রীকাতর’ বলে। ঈর্ষা, দ্বেষ সকল ভাষাতেই পাবেন, সকল জাতির মধ্যেই কিছু কিছু আছে, কিন্তু বাঙালিদের মধ্যে আছে পরশ্রীকাতরতা। ভাই ভাইয়ের উন্নতি দেখলে খুশি হয় না। এই জন্যই বাঙালি জাতির সকল রকম গুণ থাকা সত্ত্বেও জীবনভর অন্যের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে।…. যুগ যুগ ধরে এরা শোষিত হয়েছে নিজের দোষে। নিজেকে এরা চেনে না, আর যতদিন চিনবে না এবং বুঝবে না ততদিন এদর মুক্তি আসবে না।
বাঙালিদের নিয়ে এর চাইতে খাঁটি মূল্যায়ন আমার চোখে আর কখনও পড়েনি! এই বাঙালিদের জন্যে তাঁর বুকে ছিল গভীর ভালোবাসা। নির্বাচনের সময় একবার হেঁটে হেঁটে প্রচারণার কাজ চালাচ্ছেন, তখন এক হতদরিদ্র বৃদ্ধা মহিলার সাথে দেখা। বঙ্গবন্ধুকে দেখার জন্যে কয়েক ঘণ্টা থেকে দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁকে ধরে নিজের কুঁড়েঘরে নিয়ে এক বাটি দুধ, একটা পান আর চার আনা পয়সা দিয়েছেন, বলেছেন, খাও বাবা, আর পয়সা কয়টা তুমি নেও, আমার তো কিছু নেই। বঙ্গবন্ধু সেই পয়সা না নিয়ে উল্টো তাকে সাহায্য করার চেষ্টা করেছিলেন, লাভ হয়নি। সেই হতদরিদ্র মহিলার বাড়ি থেকে বের হবার পর, বঙ্গবন্ধু লিখছেন (পৃষ্ঠা ২৫৬)–
নীরবে আমার চক্ষু দিয়ে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়েছিল, যখন তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসি। সেইদিনই আমি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, ‘মানুষরে ধোঁকা আমি দিতে পারব না।
আমরা সবাই জানি বঙ্গবন্ধু তাঁর এই প্রতিজ্ঞা কখনও ভঙ্গ করেননি। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ এই পুরো বইটার একটা বড় অংশ হচ্ছে কীভাবে বঙ্গবন্ধু মুসলিম লীগের গুণ্ডা আর পুলিশের নির্যাতন সহ্য করছেন, জেল খাটছেন, পাকিস্তানের জন্যে আন্দোলন করেছেন। কিন্তু দেশবিভাগের পরপরই খুব দ্রুত মুসলিম লীগের উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে গেছেন। আর এই মুসলিম লীগ সরকার তাঁর উপর নির্যাতন করছে, বিনা বিচারে দিনের পর দিন জেলখানায় আটকে রেখেছে। এক জায়গায় বর্ণনা আছে মাওলানা ভাসানিকে নিয়ে শোভাযাত্রা করছেন, তখন পুলিশ আক্রমণ করেছে। বঙ্গবন্ধু লিখছেন (পৃষ্ঠা ১৩২)–
আমার উপর অনেক আঘাত পড়ল। একসময় প্রায় বেহুঁশ হয়ে এক পাশের নদর্মায় পড়ে গেলাম।…. আমার পা দিয়ে খুব রক্ত পড়ছিল। কেউ বলে গুলি লেগেছে, কেউ বলে গ্যাসের ডাইরেক্ট আঘাত, কেউ বলে কেটে গেছে পড়ে যেয়ে।
তারপর কীভাবে তাঁকে ধরাধরি করে পার্টির অফিসে নিয়ে যাওয়া হল তার বর্ণনা আছে। সেখানে একটু চিকিৎসা করে বেদনায় কষ্ট পাচ্ছিলেন বলে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হল। কিন্তু গভীর রাতে পুলিশ এল তাদের গ্রেপ্তার করতে। মাওলানা ভাসানি খবর দিয়েছিলেন যেন কোনোভাবে গ্রেপ্তার না হন, তাই লিখছেন,
আমার শরীরে ভীষণ বেদনা, জ্বর উঠেছে, নড়তে পারছি না। কী করি! তবুও উঠতে হল এবং কী করে ভাগব তা ভাবছিলাম।… তিনতলায় আমরা থাকি, পাশেই একটা দোতলা বাড়ি ছিল। তিন তলা থেকে দোতলায় লাফিয়ে পড়তে হবে। দুই দালানের ভিতর ফারাকও আছে। নিচে পড়লে শেষ হয়ে যাব। তবুও লাফ দিয়ে পড়লাম।
আমরা হলিউডের ছবিতে এরকম দৃশ্য দেখে অবিশ্বাসের হাসি হেসে থাকি। কিন্তু এটা হলিউডের ছবি নয়, বঙ্গবন্ধুর নিজের জীবনের ঘটনা, নিজের হাতে লেখা! একবার পাকিস্তান থেকে দিল্লি হয়ে বঙ্গবন্ধু পূর্ব বাংলায় ফিরে আসছেন, তিনি জানেন তাকে গ্রেপ্তার করা হবে, তিনিও প্রস্তুত আছেন, তাঁর ভাষায় (পৃষ্ঠা ১৪৫)–
আমিও প্রস্তুত আছি, তবে ধরা পড়ার পূর্বে একবার বাবা, মা, ভাইবোন, ছেলেমেয়েদের সাথে দেখা করতে চাই।
কারণ (পৃষ্ঠা ১৪৬)–
কয়েক মাস পূর্বে আমার বড় ছেলে কামালের জন্ম হয়েছে, ভাল করে দেখতেও পারি নাই ওকে। হাচিনা তো আমাকে পেলে ছাড়তেই চায় না।
(এই বইয়ে শেখ হাসিনাকে বঙ্গবন্ধু সবসময় হাচিনা লিখেছেন) এরপর পুলিশের চোখে ধূলা দেওয়ার জন্যে ট্রেনে, স্টেশনে কী করেছেন তার চমকপ্রদ বর্ণনা আছে। সবচেয়ে বিচিত্র বর্ণনা হচ্ছে জাহাজে ওঠার অংশটুকু। বঙ্গবন্ধুর ভাষায় (পৃষ্ঠা ১৪৬)–
সকল যাত্রী নেমে যাওয়ার পরে আমার পাঞ্জাবি খুলে বিছানার মধ্যে শুয়েছিলাম। লুঙ্গি পরা ছিল, লুঙ্গিটা একটু উপরে উঠিয়ে বেঁধে নিলাম। বিছানাটা ঘাড়ে, আর সুটকেসটা হাতে নিয়ে নেমে পড়লাম। কুলিদের মত ছুটতে লাগলাম, জাহাজ ঘাটের দিকে। গোয়েন্দা বিভাগের লোক তো আছেই। চিনতে পারল না।
বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার এড়িয়ে শেষ পর্যন্ত বাড়ি পৌঁছাতে পেরেছিলেন। অল্প কিছুদিন স্ত্রী-পুত্র-কন্যার সাথে কাটাতে পেরেছিলেন। যখন যাবার সময় হয়েছে তখন লিখছেন (পৃষ্ঠা ১৬৪)–
ছেলেমেয়েদের জন্য যেন একটু বেশি মায়া হয়ে উঠেছিল। ওদের ছেড়ে যেতে মন চায় না, তবুও তো যেতে হবে। দেশসেবায় নেমেছি, দয়া-মায়া করে লাভ কী? দেশকে ও দেশের মানুষকে ভালোবাসলে ত্যাগ তো করতেই হবে এবং সে ত্যাগ চরম ত্যাগও হতে পারে।
বঙ্গবন্ধু যখন এই বাক্যটি লিখেছিলেন তখন কি তিনি জানতেন তাঁর জন্যে একদিন এটি কত বড় একটি সত্য হয়ে দাঁড়াবে! জেলখানায় থাকতে থাকতে তাঁর ছেলেমেয়েরা বড় হয়ে গেছে, অনেক কষ্টে একবার ছাড়া পেয়ে বাড়ি এসে সকালবেলা বিছানায় বসে স্ত্রীর সাথে গল্প করছেন, তার ছেলেমেয়ে নিচে বসে খেলছে। বঙ্গবন্ধু লিখছেন (পৃষ্ঠা ২০৯)–
হাচু মাঝে মাঝে খেলা ফেলে আমার কাছে আসে আর ‘আব্বা’, ‘আব্বা’ বলে ডাকে। কামাল চেয়ে থাকে। একসময় কামাল হাচিনাকে বলছে, ‘হাচু আপা, হাচু আপা, তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি।
বঙ্গবন্ধু তখন বিছানা থেকে নেমে ছেলেকে কোলে নিয়ে বললেন, “আমি তো তোমারও আব্বা।” তাঁর ছেলে তাঁকে চেনে না, তাই কাছে আসতে চাইত না। এই প্রথমবার বাবার গলা ধরে পড়ে রইল। লেখক সাহিত্যিকেরা বানিয়ে বানিয়ে কত কী লিখে পাঠকদের মন দুর্বল করে ফেলে, কিন্তু এ রকম সত্যি ঘটনা কি তারা লিখতে পারবে? ভাষা আন্দোলনের সময় বঙ্গবন্ধু জেলে, দুই বছর থেকে বেশি সময় বিনা বিচারে জেলে আটকা পড়ে আছেন, তখন ঠিক করলেন মুক্তির জন্যে আমরণ অনশন করবেন। খবর পেয়ে কর্তৃপক্ষ তাঁকে এবং তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মীকে ফরিদপুর জেলে পাঠিয়ে দিয়েছে। অনশন শুরু করার দুইদিনের ভেতর খুব শরীর খারাপ হলে তাঁদের হাসপাতালে পাঠানো হল। চারদিন পর তাঁদের নাক দিয়ে জোর করে খাওয়াতে শুরু করল। বঙ্গবন্ধুর নাকে ঘা হয়ে গেছে, রক্ত আসে, যন্ত্রণায় ছটফট করেন। যখন বুঝতে পারলেন আর বেশিদিন বাঁচবেন না, গোপনে কয়েক টুকরা কাগজ আনিয়ে বাবা, স্ত্রী এবং তাঁর দুই রাজনৈতিক নেতা সোহরাওয়ার্দী এবং মাওলানা ভাসানিকে চিঠি লিখলেন; কারণ তখন বুঝে গেছেন কয়েকদিন পর আর লেখার শক্তি থাকবে না। বঙ্গবন্ধু অনশনে কীভাবে ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়েছেন তার বর্ণনা দিয়েছেন। চিঠি চারটি ঠিক জায়গায় পৌছানোর ব্যবস্থা করেছেন। লিখছেন (পৃষ্ঠা ২০৪)–
আমাদের অবস্থা এমন পর্যায়ে এসেছে যে, যে কোনো মুহূর্তে মৃত্যুর শান্তিছায়ায় চিরদিনের জন্যে স্থান পেতে পারি। সিভিল সার্জন সাহেব দিনের মধ্যে পাঁচ সাতবার আমাদের দেখতে আসেন। ২৫ তারিখ সকালে যখন আমাকে তিনি পরীক্ষা করছিলেন হঠাৎ দেখলাম তার মুখ গম্ভীর হয়ে গেছে। তিনি কোনো কথা না বলে, মুখ কালো করে বেরিয়ে গেলেন। আমি বুঝলাম আমার দিন ফুরিয়ে গেছে।… ডেপুটি জেলর সাহেব বললেন, ‘কাউকে খবর দিতে হবে কি না? আপনার ছেলেমেয়ে ও স্ত্রী কোথায়? আপনার আব্বার কাছে কোনো টেলিগ্রাম করবেন?’ বললাম, ‘দরকার নাই। আর তাদের কষ্ট দিতে চাই না।’ আমি আশা ছেড়ে দিয়েছি, হাত-পা অবশ হয়ে আসছিল।
এভাবে আরও দুদিন কেটে গিয়েছে। বঙ্গবন্ধু লিখছেন (পৃষ্ঠা ২০৫)–
২৭ তারিখ রাত আটটার সময় আমরা দুইজন চুপচাপ শুয়ে আছি। কারও সাথে কথা বলার ইচ্ছাও নাই, শক্তিও নাই। দুইজনই শুয়ে শুয়ে কয়েদির সাহায্যে ওজু করে খোদার কাছে মাপ চেয়ে নিয়েছি।
বঙ্গবন্ধু মৃত্যুর জন্যে পুরোপুরি প্রস্তুতি নিয়েছিলেন কিছু শেষ পর্যন্ত অনশনে তাঁকে মৃত্যুবরণ করতে হয়নি, এই জীবন-বাজি ধরা আন্দোলনের কাছে সরকার মাথা নত করে তাদের মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিল। পুরো বইটিতে এরকম অসংখ্য ঘটনার বর্ণনা আছে। কীভাবে একেবারে শূন্য থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে একটা রাজনৈতিক দল গড়ে তুলেছেন তার নিখুঁত বর্ণনা আছে। ষড়যন্ত্র, সাম্প্রদায়িকতা, বাধা বিপত্তি, ভয়ংকর অর্থকষ্ট, পুলিশের নির্যাতন, বিশ্বাসঘাতকতা সবকিছুকে সামাল দিয়ে কীভাবে একটা রাজনৈতিক দল গড়ে তুলতে হয় সেটি এর চাইতে সুন্দর করে আর কোনো বইয়ে লেখা আছে বলে আমার জানা নেই। মাঝে মাঝে যে হাস্যরস বা কৌতুক নেই তা নয়। রাতের বেলা নৌকা করে যাচ্ছেন, বঙ্গবন্ধু ঘুমিয়ে আছেন, তখন ডাকাত পড়েছে। এলাকার সবাই বঙ্গবন্ধুকে চেনে, তাঁকে ভালোবাসে, ডাকাতেরা যখন জানতে পারল নৌকায় বঙ্গবন্ধু শুয়ে আছেন তারা ডাকা না করেই মাঝিকে এক ঘা দিয়ে বলল, ‘শালা, আগে বলতে পার নাই শেখ সাহেব নৌকায়’। ঘুম থেকে উঠে ঘটনাটা শুনে বঙ্গবন্ধু বললেন, (পৃষ্ঠা ১২৫)–
বোধ হয় ডাকাতরা আমাকে ওদের দলের একজন বলে ধরে নিয়েছে!
আরেকবার জনসভায় মাওলানা ভাসানিকে নিয়ে বক্তৃতা করতে গিয়েছেন, পুলিশ তখন ১৪৪ ধারা জারি করে দিয়েছে, কেউ আর বক্তৃতা করতে পারবে না। বঙ্গবন্ধু তেজস্বী মানুষ, বললেন (পৃষ্ঠা ১২৮)–
’মানি না ১৪৪ ধারা, আমি বক্তৃতা করব।’ মাওলানা সাহেব দাঁড়িয়ে বললেন– ‘১৪৪ ধারা জারি হয়েছে। আমাদের সভা করতে দেবে না। আমি বক্তৃতা করতে চাই না, তবে আসুন আপনারা মোনাজাত করুন, আল্লাহ আমিন।’ মাওলানা সাহেব মোনাজাত শুরু করলেন। মাইক্রোফোন সামনেই আছে। আধা ঘণ্টা চিৎকার করে মোনাজাত করলেন, কিছুই বাকি রাখলেন না, যা বলার সবই বলে ফেললেন। পুলিশ অফিসার ও সেপাইরা হাত তুলে মোনাজাত করতে লাগল। আধা ঘণ্টা মোনাজাতে পুরা বক্তৃতা করে মাওলানা সাহেব সভা শেষ করলেন। পুলিশ ও মুসলিম লীগওয়ালারা বেওকুফ হয়ে গেল!
পুরো দৃশ্যটা কল্পনা করে এতদিন পরেও আমরা হেসে কুটি কুটি হই। ২. এই অসাধারণ বইটি সম্পর্কে লিখে শেষ করার কোনো সুযোগ নেই। তারপরও আমি বই থেকে নানা বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর কিছু কথা তুলে দিই। যেহেতু তিনি আপাদমস্তক রাজনীতিবিদ, তাই তার রাজনীতি নিয়ে কথাগুলো সবচেয়ে সুন্দর। রাজনীতিটা কখনও দলবাজি হিসেবে দেখেননি। লিখেছেন (পৃষ্ঠা ২৩৯)–
ম্যানিফেস্টো বা পোষণাপত্র না থাকলে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান চলতে পারে না।
আমলাতন্ত্র দুই চোখে দেখতে পারতেন না, তাই বলেছেন (পৃষ্ঠা ২৩৫)–
রাজনৈতিক দল ছাড়া গণতন্ত্র সফল হতে পারে না।
আবার একই সাথে অযোগ্য রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে এভাবে সতর্ক করেছেন (পৃষ্ঠা ২৭৩)–
অযোগ্য নেতৃত্ব, নীতিহীন নেতা ও কাপুরুষ রাজনীতিবিদদের সাথে কোনোদিন একসাথে হয়ে দেশের কোনো কাজে নামতে নেই।
বামপন্থী রাজনীতি সম্পর্কে বলেছেন, (পৃষ্ঠা ২৩৪)–
আমি নিজে কমিউনিস্ট নই। তবে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বিশ্বাস করি না।
আমাদের দেশে বামপন্থী রাজনীতি কেন কখনও বেশি সুবিধে করতে পারেনি বঙ্গবন্ধু সেটি অর্ধশত বছরেরও আগে বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর বামপন্থী বন্ধুদের উল্লেখ করে বলেছেন, (পৃষ্ঠা ১০৯)–
জনসাধারণ চলছে পায়ে হেঁটে, আর আপনারা আদর্শ নিয়ে উড়োজাহাজে চলছেন। জনসাধারণ আপনাদের কথা বুঝতেও পারবে না, আর সাথেও চলবে না। যতটুকু হজম করতে পারে ততটুকু জনসাধারণের কাছে পেশ করা উচিত।
অতিপ্রগতিবাদীদের সম্পর্কেও তাঁর কথাটা তখনও সত্যি ছিল, এখনও সত্যি! বঙ্গবন্ধু বলেছেন (পৃষ্ঠা ২৪৫)–
অতি প্রগতিবাদীদের কথা আলাদা। তারা মুখে চায় ঐক্য। কিন্তু দেশের জাতীয় নেতাদের জনগণের সামনে হেয় প্রতিপন্ন করতে এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলি যাতে জনগণের আস্থা হারিয়ে ফেলে, চেষ্টা করে সেজন্যে!
তবে বঙ্গবন্ধুর কাছে রাজনীতির বিষয়টি ছিল খুবই স্পষ্ট, সেটি ছিল একটা মহৎ কাজ। বার বার বলেছেন (পৃষ্ঠা ১২৮)–
যে কোনো মহৎ কাজ করতে হলে ত্যাগ ও সাধনার প্রয়োজন। যারা জীবনে ত্যাগ করতে প্রস্তুত নয় তারা জীবনে কোনো ভাল কাজ করতে পারে নাই।
রাজনীতি করে তাঁর জীবনে এক ধরনের পূর্ণতা এসেছিল, কারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগকে পুরোপুরি ধরাশায়ী করে লিখছেন (পৃষ্ঠা ২৫৭)–
আমার ধারণা হয়েছিল মানুষকে ভালবাসালে মানুষও ভালবাসে। যদি সামান্য ত্যাগ স্বীকার করেন, তবে জনসাধারণ আপনার জন্যে জীবন দিতেও পারে।
বঙ্গবন্ধু মানুষের ভালোবাসা পেয়েছিলেন, একবার নয় বার বার। ৩. এই লেখার শুরুতে আমি বলেছিলাম ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইটি সবার পড়া উচিত, যারা দেশ চালাচ্ছে তাদেরও। আমার কেন জানি মনে হয় যারা দেশ চালাচ্ছেন তাদের সবাই এই বইটি পড়েননি, কিংবা তার চাইতেও দুঃখের ব্যাপার হয়তো বইটি পড়েছেন কিন্তু বঙ্গবন্ধুর কথাগুলো বিশ্বাস করেননি। আমার এরকম মনে হওয়ার কারণ হচ্ছে এই বইয়ে সবচেয়ে বেশিশীবার যে কথাটি লেখা হয়েছে সেটি হচ্ছে (পৃষ্ঠা ১২৬)–
শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকলে গণতন্ত্র চলতে পারে না।
কিংবা (পৃষ্ঠা ১২০)–
বিরোধী দল সৃষ্টি করতে না পারলে এ দেশে একনায়কত্ব চলবে।
শক্তিশালী বিরোধী দল দূরে থাকুক আমরা কি এই দেশে কোনো বিরোধী দল দেখতে পাচ্ছি? দেশে আসলে কোনো বিরোধী দল নেই, একটা গৃহপালিত বিরোধী দল আছে, তাদের থাকা না থাকাতে কিছু আসা যায় না। জামায়াতে ইসলামীর সাথে রাজনীতি করে এবং বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার করে বলে আমি মনে করি এই দেশে বিএনপির রাজনীতি করার কোনো নৈতিক অধিকার নেই। এখন বাকি আছে সংবাদমাধ্যম। যতই দিন যাচ্ছে আমরা দেখছি সংবাদমাধ্যমকে কেমন জানি গলা টিপে ধরা হচ্ছে। মন্ত্রীরা কারণে অকারণে আজকাল সাংবাদিকদের গালাগাল করেন, ভয়ভীতি দেখান। গণজাগরণ মঞ্জ যখন আওয়ামী লীগের সমালোচনা করল তখন তাদেরকেও দুই টুকরো করে দেওয়া হল। পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে বলে আমি যখন চেঁচামেচি করছিলাম তখন আমাকে নানাভাবে উপদেশ দেওয়া হয়েছিল, আমি যেন সরকারকে বিপদে না ফেলি। বঙ্গবন্ধু বার বার বলেছেন সরকারকে ঠিক রাখতে হলে একটা শক্তিশালী বিরোধী দল দরকার। আমি এই দেশে তাই একটা বিরোধী দল খুঁজে বেড়াই। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের একটা বিরোধী দল। সেটি কোথায়? লেখক ও অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।