মেহেদী হাসান
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ‘অভ্যুত্থান’ ও হত্যাকাণ্ডের কারণ জানানোর দায়িত্ব পড়ে ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হোসেন আলীর ওপর। খোন্দকার মোশতাক সরকারের নির্দেশে ১৯৭৫ সালের ১৯ আগস্ট রাষ্ট্রদূত সাক্ষাৎ করেন যুক্তরাষ্ট্রের নিকট প্রাচ্যবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলফ্রেড এল আথারটনের সঙ্গে। সে সময় তিনি সরকারের পক্ষে বঙ্গবন্ধু হত্যার কারণ জানানোর পাশাপাশি ব্যক্তিগতভাবে নিজের দুঃখের কথাও জানান। পাশাপাশি তিনি নতুন রাষ্ট্রপতি খোন্দকার মোশতাককে তুলে ধরেন একজন ধার্মিক, সৎ ও স্পষ্টভাষী হিসেবে। মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আথারটন মুজিব হত্যায় যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করেন। পরদিন ২০ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার তারবার্তার মাধ্যমে ঢাকা, নয়াদিল্লি ও ইসলামাবাদে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসকে ওই সাক্ষাৎ ও আলোচনার কথা জানিয়েছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের ওই তারবার্তার সারমর্মে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রদূত আলী অভ্যুত্থানের কারণ তুলে ধরেন এবং মুজিবের মৃত্যুতে ব্যক্তিগতভাবে দুঃখ প্রকাশ করেন। এ ছাড়া তিনি জোটনিরপেক্ষ নীতির আলোকে বৈদেশিক সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়াসহ সব পরাশক্তির সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ার ওপর বাংলাদেশের নতুন সরকারের আগ্রহের কথা জানান। পাকিস্তানের সঙ্গে সম্প্রীতি ও ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়তে বাংলাদেশের নতুন সরকারের আগ্রহের ব্যাপারেও তিনি আলোচনা করেন। আথারটন বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক সহযোগিতাসহ স্বাভাবিক সম্পর্ক অব্যাহত রাখার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের আগ্রহ পুনর্ব্যক্ত করেন।’
সোভিয়েত প্রভাব কমানোর ইঙ্গিত : বাংলাদেশের নতুন সরকারের বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ে আলোচনার সময় রাষ্ট্রদূত হোসেন আলী জাতিসংঘ সনদ ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য পাঁচটি নীতির ওপর ভিত্তি করে পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণে নতুন সরকারের আগ্রহের কথা জানান। জোটনিরপেক্ষ নীতির ওপর গুরুত্ব দিলেও বাংলাদেশ বৃহৎ সব শক্তির সঙ্গে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। রাষ্ট্রদূত আলী এ বিষয়ে বিস্তারিত না বলে মন্তব্য করেছেন, ‘আপনারা এর অর্থ বুঝবেন।’ এরপর বার্তায় মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর মন্তব্য করেছে, ‘আমরা বুঝতে পেরেছি যে তিনি সোভিয়েতের প্রভাব কমবে বোঝাতে ওই প্রসঙ্গ টেনেছেন।’
খোন্দকার মোশতাকের গুণকীর্তন : বার্তার দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, পররাষ্ট্রসচিব ফখরুদ্দিন আহমেদ যে বক্তব্য দিয়েছেন তার সঙ্গে রাষ্ট্রদূত হোসেন আলীর উপস্থাপনার সারমর্ম একই। তারবার্তায় বলা হয়েছে, “মুজিব প্রশাসনের সীমাবদ্ধতার বর্ণনা দিয়ে তিনি (রাষ্ট্রদূত আলী) মুজিব হত্যার প্রয়োজনীয়তায় নিজের দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি একাধিকবার বলেন, ওই মৃত্যুকে ঘিরে ঘটনাপ্রবাহ তিনি জানতেন না। নতুন প্রেসিডেন্ট খোন্দকার মোশতাক আহমেদের সঙ্গে ১৯৭১ সালের দিনগুলোতে কলকাতায় নিবিড় বন্ধুত্বের কথা তুলে ধরে তিনি তাঁকে (মোশতাক) ‘ধার্মিক, সৎ ও অকপট’ হিসেবে অভিহিত করেন।”
পাকিস্তানের সঙ্গে সমস্যা সমাধানের আশা : উপমহাদেশ বিষয়ে রাষ্ট্রদূত হোসেন আলী বলেন, এ অঞ্চলের দেশগুলোর সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়তে নতুন সরকারের আগ্রহ অব্যাহত থাকবে। বিশেষ করে সরকার পাকিস্তানের সঙ্গে সমস্যার কিছু সমাধানে আশাবাদী। ভারতের সঙ্গেও বাংলাদেশ ভালো সম্পর্ক গড়তে চায়। বাংলাদেশ অবশ্যই তার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বজায় রাখবে।
স্বাভাবিক সম্পর্কের আশা যুক্তরাষ্ট্রের : রাষ্ট্রদূত হোসেন আলীর সঙ্গে আলোচনায় মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী আথারটন শেখ মুজিব ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের মৃত্যুতে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি জোর দিয়ে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক অব্যাহত রাখতে চায়।
আথারটন বলেন, উপমহাদেশের দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার বিষয়ে বাংলাদেশের আগ্রহকে যুক্তরাষ্ট্র স্বাগত জানায়। বাংলাদেশ সরকার এ ব্যাপারে যে নোট পাঠিয়েছে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস তাতে সাড়া দিয়েছে। ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতকে স্বাভাবিক যোগাযোগ রাখতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
অর্থনৈতিক সহযোগিতার বিষয়ে রাষ্ট্রদূত হোসেন আলী জানতে চাইলে আথারটন বলেন, এটি অব্যাহত থাকবে। উভয় পক্ষ পিএল-৪৮০ (বিদেশে খাদ্য সাহায্য দিতে যুক্তরাষ্ট্রের আইন) নিয়ে আলোচনা দ্রুত শেষ করার আগ্রহ প্রকাশ করে। আগের সরকার (মুজিব সরকার) পিএল-৪৮০-এর ‘টাইটেল টু’র বিষয়ে আগ্রহী ছিল উল্লেখ করে এটি সম্ভব হতে পারে বলে মন্তব্য করেন রাষ্ট্রদূত হোসেন আলী। জবাবে আথারটন বলেন, তিনি এ বিষয়টি দেখবেন।
তারবার্তার শেষ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রদূত হোসেন আলী জানিয়েছেন যে বাংলাদেশ থেকে পরবর্তী নির্দেশনা না আসা পর্যন্ত তাঁকে বর্তমান পদে দায়িত্ব চালিয়ে যেতে বলা হয়েছে।