চাপের মুখে ছাড়া হয় পাক যুদ্ধাপরাধীদের


মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহলের চাপ শুরু হয়। পাকিস্তানের সে সময়কার দোসর রাষ্ট্রগুলোই মূলত বিভিন্ন ইস্যুতে এ ধরনের নানামুখী চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশকে পাকিস্তানের স্বীকৃতিদানের ইস্যুতে শর্তের নামে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে চাপ আসতে থাকে বাংলাদেশে আটক পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করার। মূলত পাকিস্তানের পীড়াপীড়িতেই তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার বঙ্গবন্ধুকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করে ফেরত পাঠানোর অঙ্গীকারে চাপাচাপি করেন। এর পাশাপাশি একই রকম চাপ সৃষ্টি করে চীন জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্য পদ পাওয়ার প্রশ্নে; পাকিস্তানের অনুরোধে ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগ করে বাংলাদেশের সদস্যপ্রাপ্তি রুদ্ধ করে দেয় তারা। এ ধরনের নানামুখী চাপের মুখেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাধ্য হন পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করে ফেরত পাঠাতে। আর এ কাজে বাধ্য হওয়ার কারণে যুক্তরাষ্ট্রে এক বৈঠকে কিসিঞ্জারের কাছে বঙ্গবন্ধু আক্ষেপও প্রকাশ করেন। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের নথি থেকে এসব তথ্য জানা যায়।   
পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় ১৯৭৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। এর আগে স্বীকৃতি ইস্যুতে তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে ও শেষ পর্যায়ে সরাসরি যোগাযোগের সময় প্রধান বিষয় হয়ে উঠেছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের তারবার্তার জবাবে পাকিস্তান যে বার্তা পাঠিয়েছিল তাতে ‘বাংলাদেশ’ নামটি পর্যন্ত ব্যবহার করা হয়নি। ১৯৭৪ সালে ওআইসি সম্মেলনের আগে ওয়াশিংটনে এক বৈঠকে যুক্তরাষ্ট্রের নিকটপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী জোসেফ জে সিসকো পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারকে জানান, বাংলাদেশ ১৯৫ জন পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীর বিচার না করার বিষয়ে দৃঢ় অঙ্গীকার করলে পাকিস্তান ওআইসি সম্মেলনের আগেই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে চায়।
বাংলাদেশকে পাকিস্তানের স্বীকৃতি না দেওয়ার মতো ঝুলে ছিল জাতিসংঘের সদস্য পদও। পাকিস্তানের অনুরোধে জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্য পদের বিরুদ্ধে ভেটো প্রয়োগ করে চীন। তবে ১৯৭৪ সালে পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার পর চীনও জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্য পদ নিয়ে আর আপত্তি তোলেনি।
মার্কিন নথিতে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার পর ‘ভুলে যাওয়া ও ক্ষমা করা’র নীতি গ্রহণ ও পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচার না করতে বাধ্য হওয়ায় এবং ত্রিপক্ষীয় চুক্তি করার পর তিনি দেশের ভেতরে চাপের মুখে পড়েন। আটকে পড়া পাকিস্তানিদের বিষয়েও তিনি ইসলামাবাদের কাছ থেকে সাড়া পাননি। ১৯৭৩ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিসকো দক্ষিণ এশিয়া সফর করার পর তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হোসেন আলী। সে সময় সিসকো বাংলাদেশের শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় সরকার ও নেতৃত্বের ভূমিকার প্রশংসা করেন। তিনি আশা করেন, আলোচনায় বাংলাদেশ নমনীয় থাকবে। তিনি বিশ্বাস করেন যে পাকিস্তান বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী হবে এবং তা উভয়ের জন্য লাভজনক হবে।
রাষ্ট্রদূত হোসেন আলী বলেন, এ ক্ষেত্রে সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়। পাকিস্তান এখনো বাংলাদেশের অস্তিত্ব স্বীকার করার পর্যায়ে যায়নি। জুলফিকার আলী ভুট্টো যুক্তি তুলে যাচ্ছেন যে যুদ্ধাপরাধের বিচার সম্প্রীতির পথে প্রতিবন্ধক।
রাষ্ট্রদূত বলেন, বাংলাদেশ কেবল ন্যূনতমসংখ্যক পাকিস্তানির বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে। আরো অনেকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছে। তবে বাংলাদেশ সরকার কেবল তাদের বিরুদ্ধেই অভিযোগ এনেছে যাদের বিরুদ্ধে অকাট্য প্রমাণ আছে। জোসেফ জে সিসকো বলেন, অবশ্যই এ বিষয়ে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানকে কাজ করতে হবে। তবে এটি উভয় পক্ষের জন্যই কঠিন বিষয়। নিঃসন্দেহে সে সময় বাড়াবাড়ি হয়েছে। কেউ এটি অস্বীকার করেনি। ভুট্টো নিজেই অনেকবার সেটা স্বীকার করেছেন। শেখ মুজিব মনে করছেন যে তিনি সব মুছে ফেলতে পারবেন না। তবে ভুট্টোরও সমস্যা আছে।
রাষ্ট্রদূত হোসেন আলী বলেন, বিহারিদের প্রশ্নেও পাকিস্তান বাংলাদেশকে সহযোগিতা করছে না।
সিসকো জবাব দেন, এটি আরেকটি সমস্যা যেখানে উভয় পক্ষকে কিছু দিতে ও নিতে হবে।
১৯৭১ সালের ঘটনাবলি ভোলা খুব কঠিন : রাষ্ট্রদূত আলী বলেন, তিনি তাঁর প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের বেশির ভাগ সময় বিদেশে অথবা পশ্চিম পাকিস্তানে কাটিয়েছেন দেশের জন্য কূটনৈতিক সেবা দেওয়ার লক্ষ্যে। নিজেকে সব সময় ভালো পাকিস্তানি মনে করতেন তিনি। তাঁর মতো অনেক বাঙালি কেবল পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংসতার কারণেই আলাদা দেশ চেয়েছেন। তিনি এখনো মনে করেন যে ভালো সম্পর্ক দরকার। তবে ১৯৭১ সালের ঘটনাবলি ভুলে যাওয়া খুব কঠিন। এর জন্য অন্তত এক প্রজন্ম প্রয়োজন। অবশ্যই পাকিস্তানের স্বীকৃতি এ ক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারে।
অচলাবস্থা কাটাতে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে পাকিস্তানের ধরনা : তারিখ উল্লেখ নেই এমন এক মার্কিন নথি থেকে জানা যায়, ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচার না করার অঙ্গীকারের বিনিময়ে পাকিস্তান ১৯৭৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ওআইসি সম্মেলনের আগে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে। এ বিষয়টি বাংলাদেশকে জানানো হয়েছে বলে যুক্তরাষ্ট্রকে জানায় পাকিস্তান।
যুক্তরাষ্ট্র এ ব্যাপারে কিছু করেছে কি না জানতে চান পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার। সিসকো বলেন, ‘তারা (পাকিস্তান) আমাদের মধ্যস্থতা করতে বলেছে।’
সিসকো আরো জানান, বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান- এ তিন দেশেরই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে কিসিঞ্জারের পক্ষ থেকে চিঠি পাঠানোর জন্য মেমো তৈরি করা হয়েছে। কিসিঞ্জার বলেন, ‘আমাদের যা বলা হয়েছে শুধু তাই কেন আমরা করছি না? বাংলাদেশকে আমরা জানাতে পারি যে পাকিস্তান এই বার্তা আপনাদের কাছে পৌঁছে দিতে বলেছে। এভাবেই আমরা গত আগস্ট মাসে অচলাবস্থা ভেঙেছি।’
উল্লেখ্য, ১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিল নয়াদিল্লিতে স্বাক্ষরিত ‘উপমহাদেশে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি’র পঞ্চদশ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ১৯৫ জন যুদ্ধবন্দিকে দিল্লি চুক্তির আওতায় অন্য যুদ্ধবন্দিদের সঙ্গে পাকিস্তানে প্রত্যাবাসন করা যাবে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো অতীতের ভুল ক্ষমা করে দিতে ও ভুলে যেতে বাংলাদেশিদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন বলেছেন, ক্ষমা করে দেওয়ার অংশ হিসেবে বাংলাদেশ সরকার তাদের বিচার না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ওই চুক্তির ত্রয়োদশ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধে ওই ১৯৫ জনের বিচার হওয়া উচিত বলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হোসেন বলেছেন। অন্যদিকে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী আজিজ আহমেদ বলেছেন যে কোনো অপরাধ সংঘটিত হয়ে থাকলে তাঁর সরকার এর নিন্দা জানায় এবং গভীরভাবে দুঃখ প্রকাশ করে।
বাংলাদেশে চীনা প্রভাব বৃদ্ধির আশঙ্কা যুক্তরাষ্ট্রের : ১৯৭৪ সালের ১০ এপ্রিলে আংশিক প্রকাশিত এক নথিতে দেখা যায়, জুলফিকার আলী ভুট্টো বাংলাদেশিদের প্রতি অতীত ভুলে যাওয়া ও ক্ষমা করার আবেদন জানান।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর মন্তব্য করেছে, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সমঝোতার ফলে ভারতসহ ওই তিন দেশের মধ্যে বাণিজ্য, কূটনৈতিক সম্পর্ক, যোগাযোগ শুরু হবে। পাকিস্তানের সঙ্গে সমঝোতা হওয়ায় জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তিতে চীন হয়তো আর বিরোধিতা করবে না। চীন বাংলাদেশের ওপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করবে বলেও আশঙ্কা করা হয়।
বিচার না করতে পারার আক্ষেপ বঙ্গবন্ধুর : ১৯৭৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ওয়াশিংটনে ওয়ালডর্ফ টাওয়ারের স্যুটে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের সঙ্গে আলোচনার সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুদ্ধাপরাধের বিচার করতে না পারায় আক্ষেপ করেছেন। ওই আলোচনাবিষয়ক নথি থেকে এটি জানা যায়।
আলোচনায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বাংলাদেশে থাকতে চায় না এমন ব্যক্তিদের নিয়ে আমার বিশেষ সমস্যা আছে। আমাকে কিছু একটা করতে হবে। ইদি আমিনের (উগান্ডার তৃতীয় প্রেসিডেন্ট) মতো আমারও কি তাদের বহিষ্কার করা উচিত?’
কিসিঞ্জার সেই সময় জানতে চান যে বঙ্গবন্ধু বিহারিদের প্রসঙ্গে বলছেন কি না। বঙ্গবন্ধু তা নিশ্চিত করার পর কিসিঞ্জার বলেন, ‘পাকিস্তান কি তাদের নেবে না? আমরা এ প্রশ্নটি সেখানে তাদের সঙ্গে তুলব। আপনি এ বিষয়ে আরো ব্যাখ্যা করতে পারেন।’
তখন বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘দরকষাকষির মতো কিছুই আমার হাতে নেই। আমি ঝুঁকি নিয়েছি। আত্মসমর্পণের ঠিক আগে তারা আমাদের অধ্যাপক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিকদের হত্যা করেছে। এ বিষয়টি জনগণের কাছে আমার ব্যাখ্যা করতে হবে। আমি কখনো আমার কথার বরখেলাপ করিনি। তবে এবার আমি করলাম। আমি বলেছিলাম, বাংলাদেশের মাটিতে তাদের বিচার হবে। কোনো বিচার হয়নি।’
এর প্রতিক্রিয়ায় কিসিঞ্জার বলেন, ‘বিচারের উদ্যোগ বাদ দেওয়া অত্যন্ত দয়ালু ও রাষ্ট্রনায়কোচিত আচরণ, যাতে আপনি দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্কের জন্য কাজ করতে পারেন। আমি একে স্বাগত জানাব।’
ত্রিপক্ষীয় চুক্তির কারণে জনপ্রিয়তা হারানোর কথা বলেন মুজিব : কিসিঞ্জারকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি যখন পাকিস্তানের কারাগার থেকে বাংলাদেশে ফেরেন, তখন সবার হাতে ছিল অস্ত্র। দেশে সরকার ছিল না।
কিসিঞ্জার ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের ত্রিপক্ষীয় চুক্তির প্রশংসা করে বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রনায়কোচিত ভূমিকার কথা উল্লেখ করেন। এর প্রতিক্রিয়ায় বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘এটি আমাকে কিছুটা অজনপ্রিয় করে তুলেছে। কারণ বুদ্ধিজীবীরা গণহত্যার শিকার হয়েছেন। আমি আপনাকে অনেক নাম বলতে পারব যাঁদের আপনি চিনবেন।’ উল্লেখ্য, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে পাকিস্তান প্রায় চার বছর সময় নিলেও বঙ্গবন্ধু হত্যার পর মোশতাক সরকারকে সবার আগে স্বীকৃতি দেয়।

SUMMARY

641-1.jpeg