জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনীর কিছু কথা দিয়ে লেখাটি শুরু করছি। বঙ্গবন্ধু অল্প বয়স থেকে রাজনীতি ও অধিকারসচেতন ছিলেন এবং সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেছিলেন। এ ক্ষেত্রে পরিবারের পক্ষ থেকে তিনি পেয়েছিলেন অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতা। রাজনীতি ও নিজের শারীরিক অসুস্থ্থতার কারণে মাঝে লেখাপড়া ব্যাহত হয়েছিল, কিন্তু বন্ধ হয়নি। বাবা শেখ লুৎফুর রহমান একসময় তাঁকে বলেছিলেন, 'রাজনীতি করো ভালো কথা, কিন্তু লেখাপড়া বন্ধ কোরো না।' রাজনীতির প্রতি বাবার উৎসাহ ও লেখাপড়ার প্রতি অনুপ্রেরণা তাঁর এ উক্তি থেকে আমরা অনুধাবন করতে পারি। বঙ্গবন্ধু ছাত্ররাজনীতি ও পরে জাতীয় রাজনীতি করতে গিয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল, কলকাতা, দিল্লিসহ বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের ঘটনা এ বইটিতে উল্লেখ রয়েছে। তাঁর আর্থিক সচ্ছলতা খুব ভালো ছিল না, তবু তাঁর বাবা এবং প্রিয়তমা স্ত্রী তাঁকে সব সময় আর্থিক সহায়তা প্রদান করতেন। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতে কখনো তিনি অসচ্ছলতার পরিচয় দেননি। কোথাও কোথাও না খেয়ে থেকেছেন, কিন্তু মুখ ফুটে বলেননি। বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি তাঁর ছিল শ্রদ্ধা, সম্মান ও আদেশ মানার প্রবণতা। প্রচণ্ড ধৈর্য ও সাহসিকতার পরিচয় দিতেন। একজন ছাত্রনেতা হিসেবে তাঁকে সবাই শ্রদ্ধা ও সম্মান করত। যাঁরা বইটি পড়েছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই জেনে থাকবেন বঙ্গবন্ধু কেমন ছাত্রনেতা ছিলেন। বর্তমান সময়ে এমন ছাত্রনেতা পাওয়া আমরা সহজ মনে করি না। অথচ সময়ের ব্যবধান বড়জোর ষাট বছর। আমরা বঙ্গবন্ধুর সময়ের ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে বর্তমান সময়ের ছাত্ররাজনীতির তুলনা করলে বিরাট পার্থক্য খুঁজে পাই। যে ছাত্ররাজনীতি আগামী দিনের জাতীয় রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনার ভিত, কার্যত সেই রাজনীতি আমরা উপহার দিতে পারছি না। এখনকার কোনো মা-বাবা তাঁদের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেকে আমার বিশ্বাস বলবেন না লেখাপড়ার পাশাপাশি রাজনীতি করতে। বরং উল্টোটাই বলবেন, কোনোক্রমেই যেন রাজনীতিতে না জড়ায়। কেননা মা-বাবা জানেন, বর্তমান ছাত্ররাজনীতি অতীতের মতো নেই। কোনোক্রমে সন্তানটি রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়লে মা-বাবার আতঙ্কে থাকা ছাড়া কোনো পথ থাকে না। এই একটি জায়গায় মা-বাবার ভয় এতটা বেশি, যেখানে পরীক্ষার ফলাফল একটু খারাপ হলেও নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেন। রাজনীতিবিমুখ মা-বাবা কষ্ট করে হলেও ছেলেটিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে না রেখে মেসে কিংবা ভাড়া বাসায় রাখার ব্যবস্থা করেন। সন্তানটিও কলুষিত ছাত্ররাজনীতিতে বীতশ্রদ্ধ হয়ে নিজ থেকে মেস কিংবা অন্য ব্যবস্থায় চার-পাঁচ বছর কোনোভাবে পার করে দেয়। তাদের অভিযোগ, হলে থাকতে হলে কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের অধীনে থাকতে হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে অনেক ছাত্রকে জিজ্ঞেস করে একই ধরনের উত্তর পেয়েছি। এখনকার বেশির ভাগ ছাত্রের চিন্তা, কোনোভাবে লেখাপড়া শেষ করতে পারলেই ভালো। ছাত্ররাজনীতির প্রতি শিক্ষার্থীদের এমন বিমুখতা আমাদের রাজনৈতিক অধিকারগুলোর প্রতি সচেতনতা ও ন্যায়ের প্রতি সমর্থন এবং অন্যায়কে অসমর্থন ও প্রতিরোধ করা থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছে। ফলে কখনো কখনো অন্যায়কে আমরা ন্যায় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হই। আমাদের মধ্যে ভালো-মন্দের বিচার করার পথ রুদ্ধ হয়। নিজেকে নিয়ে এক ধরনের ব্যস্ত থাকার মনোবৃত্তি আমাদের পেয়ে বসে। ভালোভাবে পড়াশোনা করা, পড়াশোনা শেষে ভালো চাকরি পাওয়া কিংবা বিদেশে চলে যাওয়া ও পরবর্তী জীবনের জন্য প্রস্তুত হওয়ার চক্রে আমরা রয়েছি। ফলে মোটা দাগে আমাদের দুটি বড় ক্ষতি হচ্ছে। এক. আমরা বেশি মাত্রায় ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছি এবং অধিকারসচেতনতার কোটা শূন্যে নেমে যাচ্ছে। দুই. যেহেতু ছাত্ররাজনীতি থেকে রাজনৈতিক নেতৃত্ব তৈরি হচ্ছে না, সে ক্ষেত্রে রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে স্থান করে নিচ্ছেন অরাজনৈতিক ব্যক্তিরা। বঙ্গবন্ধুর বাবা এবং তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী যেভাবে তাঁকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করতেন, রাজনীতির প্রতি সেটিও এখনকার সময়ে বিরল। আর্থিক সামর্থ্য থাকলেও এমনটি বর্তমানে পাওয়া দুষ্কর বরং এর উল্টোটাই আমরা লক্ষ করি। ছাত্রনেতা থাকা অবস্থায় বিশাল আর্থিক সম্পদের মালিক হওয়া, বাবার কাছ থেকে টাকা এনে রাজনীতি করার পরিবর্তে উল্টো মা-বাবাকে আর্থিক সহায়তা প্রদান এখন সহজ। হয়তো কোনো কোনো মা-বাবা এর জন্য খুশিও হন। রাজনীতিতে ত্যাগের প্রবণতার বদলে ভোগের চেষ্টা ও প্রবণতা আমাদের পেয়ে বসেছে। কষ্ট ও ত্যাগের এক মহিমা আমরা লক্ষ করি বঙ্গবনু্লর ছাত্ররাজনীতির মধ্যে। দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে, যেমন- গোলাপগঞ্জ থেকে কলকাতা, কলকাতা থেকে দিল্লি, এভাবে বিভিন্ন জায়গায় কখনো নিজে, আবার কখনো বা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীসহ অন্যদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াতে তিনি যে কষ্ট ও ত্যাগের স্বাক্ষর রেখে গেছেন, তা এখনকার সময়ে অসম্ভব। সাদামাটা জীবনযাপন, ধীশক্তি ও নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য তাঁকে খুব অল্প বয়সে রাজনীতিতে বড় পদ পাওয়া এবং ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পর মন্ত্রিত্ব পাওয়া তাঁর নেতৃত্বের গুণাবলির পরিচায়ক। বর্তমান সময়ের ছাত্ররাজনীতির মধ্যে ত্যাগ ও কষ্টের লক্ষণ আমরা কমই দেখতে পাই। এ কথা সত্য যে বঙ্গবন্ধুর সময়ের সঙ্গে বর্তমান সময়ের ছাত্ররাজনীতি কিংবা রাজনীতি একই রকম হবে- এমনটি শতভাগ আশা করা ঠিক নয়। অর্থনীতি, সমাজনীতি ও রাজনীতির মধ্যে সময়ের ব্যবধানসহ বহু বিষয়ে পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। জীবনযাপনের মান থেকে শুরু করে অন্য অনেক ক্ষেত্রে পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে অন্য অনেক পরিবর্তন হলেও মৌলিক ও কাঠামোগত পরিবর্তন আমরা কেন আশা করব? কেন আমরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ থেকে দূরে সরে যাব? আমরা তা পারি না। এখনকার সময়ে এমনটি কি আশা করতে পারি না, যেখানে মা-বাবা তাঁর সন্তানকে সরাসরি ছাত্ররাজনীতিতে সম্পৃক্ত না হতে বললেও এটি হয়তো বলবেন যে, 'তুমি রাজনীতিসচেতন হও, ন্যায়-অন্যায়ের ক্ষেত্রে সঠিক পক্ষ অবলম্বন করো, নিজের এবং অন্যের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হও এবং আদায়ে সোচ্চার ভূমিকা পালন করো।' এটিই আমরা চাই। এমনটি বললেও আমাদের অনেক লাভ হতো। আমরা এক এক করে সচেতন জনগোষ্ঠী তৈরি করতে পারতাম, যা সব ধরনের অন্যায় ও অবিচারের প্রতি এক ধরনের নেতিবাচক ধারা তৈরি করত। (এই পোষ্টটি দৈনিক কালেরকণ্ঠে প্রথম প্রকাশিত হয়েছে)