বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা, হার মানেনি বাংলাদেশ


মেহেদী হাসান ১৯৭৪ সালের ১৬ মে স্থল সীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষরের আগে মতপার্থক্যের কারণে আলোচনার টেবিল থেকে উঠে গিয়েছিলেন বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এরপর তাঁকে ফেরাতে ছুটে যান ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং। ভারতের প্রত্যাশা ছিল, আরেকটু বেশি জমি পাওয়া। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সাফ কথা, এর চেয়ে বেশি জমি দেওয়ার চুক্তিতে তিনি স্বাক্ষর করবেন না। সেদিনের সেই ঘটনার স্মৃতিচারণা করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সেক্রেটারি ও বর্তমানে জনকণ্ঠের উপদেষ্টা সম্পাদক তোয়াব খান বলেন, সীমান্তচুক্তি নিয়ে আলোচনার সময় ভারত বাংলাদেশের কাছে আরো বেশি জমি চাচ্ছিল। তখন ইন্দিরা গান্ধীকে বঙ্গবন্ধু বলেন, বেনাপোলের ওপার থেকে পাঞ্জাব পর্যন্ত যা জমি আছে সব আপনার; আর বেনাপোল থেকে আমার। আপনি ক্ষমতা থাকলে দখল করে নেন। কিন্তু এর চেয়ে বেশি জমি দেওয়ার কোনো চুক্তিতে স্বাক্ষর আমি করব না। বঙ্গবন্ধুকে ফেরাতে পিছে পিছে ছুটলেন তাঁরা : তোয়াব খান জানান, তাঁরা তখন বিমানের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। চুক্তি হলেই তাঁরা নয়াদিল্লি থেকে রওনা হবেন। কিন্তু এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধু বাড়তি জায়গা দেওয়ার চাপে নতি স্বীকার না করে আলোচনার টেবিল ছেড়ে যান। পেছনে পেছনে ছুটতে থাকেন ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং। হিন্দিতে শরণ সিং বলছিলেন, 'ও তো যা রাহাহে (তিনি তো চলে যাচ্ছেন!)!' ছুটে যান প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীও, বঙ্গবন্ধুকে ফিরিয়ে আনেন। এরপর বঙ্গবন্ধুর কথামতোই চুক্তি হয়। কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, যৌক্তিক হলেও বাস্তবতার দিক দিয়ে এক ইঞ্চি জমি ছাড়াও যেকোনো দেশ বিশেষ করে এ অঞ্চলে ভারতের জন্য কঠিন তা ওই দেশটির নেতারাও জানতেন। তা ছাড়া রাষ্ট্রের সীমানার বিষয়টি ভারতের সংবিধানে উল্লেখ থাকায় এটি আরো কঠিন। এর সঙ্গে কেন্দ্র ও রাজ্যের রাজনৈতিক সমীকরণ, সক্ষমতাসহ অনেক বিষয় জড়িত। স্থলসীমান্ত বাস্তবায়নের জন্য ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে প্রটোকল স্বাক্ষরের পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের সরকার সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েও সফল হয়নি। কাগজে-কলমে চুক্তি হলেও তা বাস্তবায়নের পথে বড় বাধা ছিল সংবিধান। প্রটোকল স্বাক্ষরেও হাসিনার দৃঢ়তা : নাটকীয়তা আছে ২০১১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর স্থল সীমান্ত চুক্তির প্রটোকল স্বাক্ষর নিয়েও। সেদিন সন্ধ্যায় ঢাকায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিংয়ের উপস্থিতিতে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি ও ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণা যে প্রটোকলটি স্বাক্ষর করেছিলেন তা শেষ মুহূর্তে হাতে লিখে সংশোধন করা হয়েছিল। সেদিন ছিটমহল বিনিময়ের জন্য সুস্পষ্ট কোনো সময়সীমা উল্লেখ না করলেও ২০১২ সালের ৩১ মার্চের মধ্যে অপদখলীয় ভূমি বিনিময় প্রক্রিয়া শেষ করতে চেয়েছিল ভারত। সেদিন সেখানে উপস্থিত ছিলেন এমন একজন কূটনীতিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রটোকলে উল্লিখিত একটি সময়সীমা নিয়ে বাংলাদেশের আপত্তি ছিল। ছিটমহল বিনিময়ের জন্য জনগণনাসহ প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি শেষ হওয়ার পরও ভারত বিনিময় প্রক্রিয়া সম্পন্ন শেষ করার কোনো তারিখের কথা প্রটোকলে উল্লেখ না করতে চাওয়ায় বাংলাদেশও অপদখলীয় ভূমি বিনিময়ের ক্ষেত্রে তারিখ উল্লেখ করার ব্যাপারে আপত্তি জানায়। তৎকালীন পররাষ্ট্রসচিব মিজারুল কায়েস ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নজরে আনেন। প্রধানমন্ত্রীও মত দেন, ছিটমহল বিনিময় যেহেতু এখনই হচ্ছে না তাহলে অপদখলীয় ভূমি বিনিময়ের বিষয়টিও একসঙ্গেই হোক। তাড়াহুড়োর তো কিছু নেই। এরপর ভারতও অবস্থান বদলায়। ওই কূটনীতিক জানান, শেষ মুহূর্তে তৎকালীন পররাষ্ট্রসচিব মোহাম্মদ মিজারুল কায়েস প্রটোকলটির তৃতীয় পৃষ্ঠার প্রথম অনুচ্ছেদটি হাতে লিখে সংশোধন করেন। আগে সেখানে লেখা ছিল- 'অপদখলীয় ভূমির সীমান্ত নকশা তৈরি ও প্রতিনিধিদের মাধ্যমে স্বাক্ষরের পর ২০১২ সালের ৩১ মার্চের মধ্যে বিনিময় প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে।' তা সংশোধন করে লেখা হয়েছে- 'অপদখলীয় ভূমির সীমান্ত নকশা তৈরি ও প্রতিনিধিদের মাধ্যমে স্বাক্ষরের পর ছিটমহল বিনিময় প্রক্রিয়ার পাশাপাশি ওই ভূমি বিনিময় প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে।' উল্লেখ্য, ছিটমহল বিনিময়ের ফলে বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে প্রায় ১০ হাজার একর বেশি জমি পাবে। অন্যদিকে অপদখলীয় ভূমি বিনিময়ের ফলে বাংলাদেশ ও ভারত তাদের দখলে থাকা অন্যের জমি ছাড়বে। এতে বাংলাদেশের দখলে থাকা ভারতের কিছু জায়গা ছাড়তে হবে, যা অঙ্কের হিসাবে ভারতের ছেড়ে দেওয়া অপদখলীয় জমির তুলনায় বেশি। ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি স্বাক্ষরের পরপরই বাংলাদেশ তা অনুমোদন করেছিল। এরপর বিশেষ করে ২০১১ সালে প্রটোকল স্বাক্ষরের পর থেকেই চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য ভারতকে প্রত্যাশার চাপে রেখেছে বাংলাদেশ। দুই দেশের সরকারি পর্যায়ে আলোচনা, শীর্ষ বৈঠক এমনকি বেসরকারি পর্যায়েও বারবার প্রশ্ন উঠেছে, ভারত তার আশ্বাস পূরণ করবে কবে? কূটনৈতিক তৎপরতা ছিল সর্বত্র। বন্ধু রাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রতি অঙ্গীকার বিশেষ করে দুই দেশের ছিটমহলবাসীর প্রায় সাত দশকের বন্দিদশা আর বঞ্চনার অবসান ঘটানোকে গুরুত্ব দিয়ে অবশেষে সেই চুক্তি বাস্তবায়ন করছে ভারত। ১৯৭৪ সালের ১৬ মে চুক্তি স্বাক্ষরের ৪০ বছর ১১ মাস ২০ দিন পর গত মঙ্গলবার চুক্তি বাস্তবায়নে ভারতের মোদি সরকারের মন্ত্রিসভায় তা অনুমোদন, পরদিন বুধবার তা সংসদের উচ্চকক্ষ রাজ্যসভায় ও এর পরদিন গতকাল বৃহস্পতিবার তা সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদন হওয়ার ঘটনা শুধু নাটকীয় নয়, নজিরবিহীনও। এ জন্য ভারতের নরেন্দ্র মোদির সরকারকেও নিজ দেশে দলগুলোর মধ্যে ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হয়েছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, ভারত বাংলাদেশের প্রতি তার অঙ্গীকারকে সম্মান করেছে। বাংলাদেশের কূটনৈতিক সাফল্য : স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নে ভারতের সংসদে সংবিধান সংশোধন বিল অনুমোদন হওয়াকে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবে দাবি করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকায় সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পরিদর্শনের সময় সংশ্লিষ্ট সবাইকে অভিনন্দন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'এটা আমাদের একটা বিরাট অর্জন। এটাকে আমরা বড় কূটনৈতিক সাফল্য বলে মনে করি।' শেখ হাসিনা বলেন, '১৯৪৭ থেকে দেশ ভাগের পর এটা সমাধান হয়নি। ১৯৭১ সালের পর আমরা যখন স্বাধীন হলাম তখন বঙ্গবন্ধু এ বিষয়ে উদ্যোগ নিলেন। সব কাজ করে গেলেন।' তিনি বলেন, 'কিন্তু '৭৫-এর পর এ ব্যাপারে আর কোনো সরকার কোনো রকম উদ্যোগই নেয়নি। সমুদ্রসীমা বা সীমান্ত নিয়েও কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।' শেখ হাসিনা আরো বলেন, 'যে যতই বলুক, শুধু গালি দিয়ে গেছে যে দেশ নিয়ে গেলো, দেশ বেচে দিলো। কিন্তু দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রকৃত যে পদক্ষেপ সেটা কেউ নেয়নি। আবার আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় এলো তখন আওয়ামী লীগই উদ্যোগ নিলো '৯৬ সালে।' কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের অতীতে বিভিন্ন সময়ে আস্থার সংকটও কম দায়ী নয়। কয়েক বছর ধরে দুই দেশের সম্পর্ক অত্যন্ত উষ্ণ থাকার সময়ও বাংলাদেশ প্রতিনিয়ত আস্থা ও বিশ্বাসের পরীক্ষা দিয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও জট খুলছিল না ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক জটিলতায়। মনমোহন সিংয়ের সরকার স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নে সংবিধান সংশোধন বিল অনুমোদন করাতে না পারলেও তা বাঁচিয়ে রেখেছিলেন সংসদের উচ্চ কক্ষে। নরেন্দ্র মোদির সরকার এসে দৃঢ় অঙ্গীকার নিয়ে তাতে পূর্ণতা দিলেন। মোদির সফরের সম্ভাবনা জোরদার : সংশ্লিষ্ট কূটনীতিকরা জানিয়েছেন, সংবিধান সংশোধনের পরও স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নে কিছু প্রক্রিয়াগত ধাপ রয়েছে, যা দ্রুতই কার্যকর হবে বলে বাংলাদেশ আশা করছে। এ চুক্তি স্বাক্ষরে সংবিধান সংশোধনের মতো কঠিন কাজ সুসম্পন্ন করে মোদি সরকার বাংলাদেশের প্রতি সম্পর্ক আরো এগিয়ে নেওয়ার এবং নতুন উচ্চতায় পৌঁছানোর আন্তরিক বার্তা দিয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি অতীতে বলেছেন, তিনি বাংলাদেশে খালি হাতে আসতে চান না। স্থল সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের দ্বারপ্রান্তে থাকায় এখন মোদির ঢাকা সফরের জোর প্রস্তুতি শুরু হবে এমনটিই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাঁদের মতে, মোদির ঢাকা সফরেই নিকটতম প্রতিবেশী দুই দেশের সম্পর্কে আরো নতুন মাত্রা আসতে পারে। সৌজন্যে: কালের কণ্ঠ

SUMMARY

635-1.jpg