ফাহিম মো. শাকিল
২৬ মার্চ। বাংলাদেশের জনগণের জন্য আজ এমন একটি দিন যে দিনটির জন্য পূর্ব বাংলার লোকজন অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় ছিল। বাংলার সবুজ মাঠে যেন লাল সূর্যটি স্বাধীন বাংলার পতাকা অংকন করে দিয়েছিল আর সেই পতাকার মাঝে ফুটে উঠেছিল বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের মানচিত্র।নদীমাতৃক এই দেশে পানির মাঝেও যেন কল কল ধ্বনিতে বাজছে স্বাধীনতার মন্ত্রধ্বনি। নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ, যুবক, হিন্দু, মুসলিম ও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠী যেন একই স্রোতে পতিত হয়েছিল স্বাধীনতা যুদ্ধে। একথা অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই যে, এদেশের মানুষের মন মানসের গভীর শ্রদ্ধাভাজন অবিস্মরণীয় নেতা যিনি পূর্ব বাংলার জন্য আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য সংগ্রাম করেছেন এবং বাংলা ভাষা ও বাঙালিকে চিরমর্যাদায় মণ্ডিত করেছেন।সেই ব্যক্তি হলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যে বিশেষণে তাকে বিশেষায়িত করা হউক না কেন সব বিশেষণই যেন তার নামের পাশে ছোট হয়ে যায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আর বঙ্গবন্ধু দুটিকে কখনও আলাদা করা যায় না। এটা যেন একই সূত্রে গাঁথা।একটি ছাড়া আরেকটি কল্পনা করাও কঠিন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়সীমা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত হলেও এই নয় মাসের মাঝে কখনো ইতিহাসকে আবদ্ধ করা যাবে না। তেমনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে যাদের অবদান রয়েছে তাদেরকেও ইতিহাসের বাইরে রাখা যাবে না। কারণ ইতিহাস মানুষের হৃদয়ে গাঁথা। ১৯৪৭ সালে একটি উদ্ভট রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল।কারণ দুই অংশের মাঝে সীমান্তরেখাহীন হাজার মাইলের ব্যবধান, ভিন্নতা ভাষা, সাহিত্য সংস্কৃতি, মানসিকতা ও জীবনাচরণের নানা দিকে। সেই সঙ্গে শুরু থেকেই পাকিস্তানি শাসকশ্রেণির বাঙালির ভাষা ও জাতিসত্তার প্রতি অবজ্ঞা যা ক্রমে ক্রমে অর্থনৈতিক মাত্রায় বিস্তার লাভ করে। বিশেষ মাত্রা পায় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বৈষম্যে এবং তা এতই ব্যাপক হয়ে ওঠে যে ‘দুই পাকিস্তান’ ধারণা শিক্ষিত বাঙালির চোখে প্রকট হয়ে ওঠে। তৈরি হয় নানাবিধ দৃষ্টান্ত। তৈরি হতে থাকে মুক্তির চেতনা বাঁধে দানা আন্দোলনের। তাই এক অর্থে নির্দিষ্ট দিন নয় প্রতিদিন প্রতিমুহূর্ত স্বাধীনতার গন্ধে বিভোর হতে থাকে পূর্ব বাংলার মানুষ। পরবর্তীতে ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৫ সনের ন্যাপের ১৪ দফা, ১৯৬৬ সনের পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামীলীগের ৬ দফা, ২৩ জুন ১৯৬৭ সনের সরকারি প্রেসনোটের মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে যে ঐশ্বর্য দান করেছে তাঁর সঙ্গীত আমাদের অনুভূতিকে যে গভীরতা ও তীক্ষ্ণতা দান করেছে এবং যে রবীন্দ্রনাথ আমাদের জাতিসত্তার অংশ হয়েছে তার সঙ্গীতের প্রচার হ্রাস ও বর্জনের সিদ্ধান্ত, ৮ দফা কর্মসূচীর ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ গণআন্দোলনের আহবান, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্ব, ১৯৬৯ এ ছাত্র সমাজের প্রচারপত্রের মাধ্যমে ১১ দফার দাবীতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার আহবান, ১৯৬৯ এর প্রথমভাগে ছাত্রদের উপর লাঠিচার্জ, আসাদুজ্জামানের মৃত্যু, ছাত্রধর্মঘট, দোকানপাট বন্ধ, কালো পতাকা প্রদর্শন, সার্জেন্ট জহুরুল হকের মৃত্যু, ভাসানীর চরমপত্র, ড. সামসুজ্জোহা হত্যা বিষয়গুলো নাড়া দেয় বাঙালির হৃদয়ে। পরের ইতিহাসটা কেবলই বঙ্গবন্ধু। ৩রা মার্চ ঢাকায় জাতীয় সংসদের অধিবেশন ইয়াহিয়া কর্তৃক ঘোষণা যদিও পরবর্তীতে তা বাতিল। সবকিছুই যেন এক কালো অধ্যায় যা বাঙালির উপর চাপিয়ে দেওয়া লক্ষ্যে। পরবর্তীতে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ রেসকোর্স ময়দানে প্রদত্ত শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ যা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত। মূলত অর্থে মুজিবুর রহমানের উক্ত ভাষণের মাধ্যমেই স্বাধীনতার অলিখিত ঘোষণা দেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এরকম ভাষণ খুবই বিরল।অনেকের ধারণা ছিল প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া পূর্বপাকিস্তানে এলে শেখ মুজিবুর রহমান তার সাথে আপোষ করবে। এর পরিপ্রেক্ষিতে পল্টনে দাঁড়িয়ে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ঘোষণা করেন, আগামী ২৫ শে মার্চের মধ্যে এই দাবী মেনে না নিলে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে এক হয়ে বাঙালির স্বাধীনতার জন্য সর্বাত্মক সংগ্রাম শুরু করবেন। পরবর্তীতে ১৫ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান ৩৫টি নির্দেশনাসহ আন্দোলনের নতুন কর্মসূচী ঘোষণা করেন। ইয়াহিয়া মুজিবের দ্বিতীয় দফা আলোচনা শেষ হয় কিন্তু সফলতার মুখ দেখে নি। মুজিবের আত্ম-বিশ্বাসী চেতনা এবং দেশের মানুষের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ পায় তার ৫২তম জন্মদিনের একটি কথায়। তিনি বলেন ‘আমার আবার জন্মদিন কি? মৃত্যু দিবসই বা কি? আমার জীবনই বা কি? মৃত্যুদিন আর জন্মদিন অতি গৌণভাবে এখানে অতিবাহিত হয়। আমার জনগণই আমার জীবন।’ আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে আমরা এমন একজন ব্যক্তিকে পেয়েছিলাম যার জীবন বাজি রেখেছিল আমাদের স্বাধীনতার জন্য।২৩ মার্চ মুজিব ও ভুট্রোর সাথে ইয়াহিয়া খানের বৈঠকে ২৫ মার্চের আহূত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করা হলো, করা হলো পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ভাগ্য বদলের নীলনক্সা। পরের বিষয়টি কারো অজানা নয়। চালানো হলো গণহত্যা। শেখ মুজিবুর রহমানকে বন্দী করে নিয়ে যাওয়া হলো পশ্চিম পাকিস্তানে। এক তারবার্তায় শেখ মুজিবুর রহমান তার স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তাটি প্রেরণ করেন। ২৫ মার্চ রাত্রের শেষ পর্যায়ে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে পাঠ করানো হয়। শুরু হলো লাল সূর্যের জন্য যুদ্ধ। যুদ্ধ যে কেবল স্বাধীনতার জন্য তা নয়। এটা ছিল আমাদের মর্যাদার এবং প্রতিশোধের লড়াই। দীর্ঘ প্রতিক্ষার পর আজ বাংলাদেশ স্বাধীন।