মানুষকে আপন করার জাদুকর ছিলেন বঙ্গবন্ধু


ড. কামাল হোসেন
তিনি বললেন, ‘আমরা কী ধরনের সরকার গঠন করব? আমাকে যদি বলো, আমি পার্টি নিয়ে থাকতে চাই। সরকার গঠন করুক আমার দলের অন্য নেতারা। আমি সবাইকে নিয়ে ঐক্য করা এবং বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর স্বীকৃতি আদায়ে রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে আলোচনা করতে চাই।’ আমি বললাম, এটা ঠিকই আছে। সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশের আরেক নাম হলো শেখ মুজিব। সুতরাং আপনি রাষ্ট্রপ্রধান, অন্ততপক্ষে প্রধানমন্ত্রী না হলে সমস্যা হবে।

মুসলিম লীগে তরুণ যাঁরা ছিলেন কি মুজিব ভাই, কি তাজউদ্দীন ভাই, এঁরা বেরিয়ে এসে আওয়ামী মুসলিম লীগ (পরে আওয়ামী লীগ) গঠন করলেন। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি কমান্ডোদের বলেছিলেন, আমরা আওয়ামী লীগ গঠনের মাধ্যমে সংগ্রাম করেছিলাম কৃষকের পক্ষে, অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে এবং প্রকৃত অর্থে গণতন্ত্রের পক্ষে। পাকিস্তানে আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। আমাদের দল ক্ষমতায় থাকলে আমরা সবকিছু করতাম জনগণের জন্য, সমাজ পরিবর্তনের জন্য এবং সর্বোপরি গরিব মানুষের জন্য একটি বৈষম্যমুক্ত সমাজ নির্মাণের জন্য। কিন্তু আমরা ২৪ বছরে দেখলাম, আমাদের নির্বাচনই করতে ��েয়া হয়নি। তারা মন দিয়ে বঙ্গবন্ধুর কথা শুনছিল। পরে বলল, এগুলো তো আমাদের কেউ বলেনি। আরো বলল, হুকুম দেন। আমরা জেনারেলদের মেরে ফেলব। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে থেকে দেখলাম, তার মধ্যে পরকে আপন করার এক অসাধারণ গুণ ছিল।
 
তারপর শুরু হলো আমাদের ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ কথা দিয়েছিল, তাড়াতাড়ি আমাদের ফেরার ব্যবস্থা করবে। পাকিস্তানের তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আজিজ আহমেদ এসে বলল, ইরান, তুরস্ক হয়ে আপনাদের ফেরার ব্যবস্থা করছি। আমরা বললাম, সরাসরি আমাদের নেবে না কেন? তিনি বললেন, ভারতের ওপর দিয়ে তো আমাদের প্লেন যাবে না। আমি তাঁকে বললাম, জাতিসংঘ কিংবা রেডক্রসের প্লেন তো যেতে পারে। তখন তিনি বললেন, আমরা চাই, আমাদের প্লেনেই আপনাদের পৌঁছে দেবো। বঙ্গবন্ধু বললেন, ইরান কিংবা তুরস্ক নিয়ে গেলে আমাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে। বলো যে, জেনেভার মতো নিরপেক্ষ একটা জায়গায় নিতে। তখন আজিজ সাহেব বললেন, লন্ডনে নিলে কেমন হয়? বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন, মেনে নাও এটা। আমি বললাম, তাহলে লন্ডনে আমাদের যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। লন্ডনে আমরা ৮ তারিখে পৌঁছেছি। বলা হয়েছে, প্লেনে নেয়া হবে, তবে প্লেন ল্যান্ড করার ১ ঘণ্টা আগে জানানো হবে ব্রিটিশ সরকারকে। যথারীতি আমরা নামি লন্ডনে। নিয়ে যাচ্ছে আমাদের ভিআইপি রুমে। দেখি যে, ওখানে ছয় ফুট লম্বা একজন পুলিশের লোক দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি এক ধাপ আগ বাড়িয়ে স্যালুট করে বঙ্গবন্ধুকে বলছেন, স্যার, আমরা আপনার জন্য প্রার্থনা করছিলাম। এ ঘটনাটা বলছি এ কারণে যে, আমাদের স্বাধীনতা, মুক্তিসংগ্রাম ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি পৃথিবীর মানুষের অন্তর থেকে সমর্থন ছিল। আমরা রুমে ঢুকলে ওখানকার কর্মকর্তারা আমাকে টেলিফোন ধরিয়ে দিলেন। ওপার থেকে বলছে, এখানে কি শেখ মুজিবুর রহমান আছেন? আমি নিজে পরিচয় দিয়ে বললাম, হ্যাঁ, আছেন। ওপার থেকে বলছে, তাঁকে জানিয়ে দাও, ব্রিটিশ সরকার বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে বরণ করবে, থাকার ব্যবস্থা করবে এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী দেখা করবে। বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন, তাকে বাংলাদেশের প্রতিনিধি আবু সাইদ চৌধুরীর নম্বর দিতে বলো। আমি তাঁর কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, আবু সাইদ চৌধুরী গতকালই চলে গেছেন। আমি বললাম, এর পরিবর্তে কে আছে, তার নম্বর দাও। পরে তিনি আমাকে বাংলাদেশের হাইকমিশনারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা রেজাউল করিমের নম্বর দিলেন। আমি তাঁকে ফোন করি। তিনি শুনেই কেঁদে ফেললেন। বললেন, আমি এক্ষুনি আসছি। তিনি আসতে আসতে ওই লোকটিও চলে এলেন। আমাদের গাড়িতে তুললেন, রেজাউল করিম সাহেবও উঠলেন। লোকটি বঙ্গবন্ধুকে বললেন, আপনাকে ক্লারিজ হোটেলে (লন্ডনে তখন এটি ছিল এক নম্বর হোটেল) নিয়ে যাব। বঙ্গবন্ধু আমাকে লোকটিকে বলতে বলল, এমন দামি হোটেলে নয়। রাসেল স্কয়ারে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে একটা সাধারণ হোটেলে আমাদের থাকার ব্যবস্থা যেন করে। ওখানে আমাদের লোকজন আছে। তাদের আসতে যাতে সুবিধা হয়। এটা শুনে তিনি হেসে ফেললেন। তিনি বললেন, স্যার, রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে আমরা আপনাকে নিচ্ছি। সব কথা আমরা মেনে নিচ্ছি। এ কথা মেনে নেয়া যাবে না। কারণ রাষ্ট্রপ্রধানের জন্য যে বিশেষ হোটেল আছে, সেখানে তাঁদের ব্যাপক নিরাপত্তা আছে। বললেন, সেখানেই আপনার সঙ্গে প্রবাসী বাঙালিদের দেখা করার ব্যবস্থা করব। পরে ওখানে বঙ্গবন্ধুর থাকার ব্যবস্থা হলো। দেখা গেল, সেখানে শত শত বাঙালি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে আসতে লাগল। এটা খুব কঠিন কাজ ছিল। কারণ এত লোক তো হোটেল কর্তৃপক্ষ জীবনে দেখেনি। তারা বলছে, এখানে নিরাপত্তার সমস্যা হবে। আমাকে বলছে, আপনি আমাদের সঙ্গে গেটে দাঁড়ান। আপনি দেখে দেখে ঢুকতে দেবেন। তখন আমার কাজ হয়ে গেল সামনে দাঁড়িয়ে লোক সরিয়ে দেয়া। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রথমে দেখা করতে এলেন হ্যারল্ড উইলসন (ব্রিটিশ পার্লামেন্টের বিরোধী দলের নেতা, পরে প্রধানমন্ত্রী), এরপর বেগম আবু সাইদ চৌধুরী, এরপর ডেভিড ফ্রস্ট (বিখ্যাত সাংবাদিক)। ওঁরা খবর দিলেন, ওইদিনই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে আসছেন। তার আগেই দুপুরের দিকে প্রেস কনফারেন্স। আমাকে বললেন, এ পয়েন্টে তুমি বক্তৃতার খসড়া তৈরি করো। প্রথমত, আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের অভিনন্দন জানাও। দ্বিতীয়ত, যেসব দেশ আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা কিংবা সমর্থন দিয়েছে, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং যেসব দেশ সমর্থন করেনি অথচ মানুষ সমর্থন দিয়েছে, তাদের প্রতি ধন্যবাদ জানাও। তৃতীয়ত, সব দেশের কাছ থেকে আমাদের স্বাধীনতার স্বীকৃতি চাও এবং চতুর্থত, পুনর্বাসন কিংবা পুনর্গঠনের জন্য সাহায্য চাও। মূলত এ চারটি পয়েন্ট ধরে প্রেস কনফারেন্সের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু বিশ্ববাসীর কাছে তাঁর ভাষণ তুলে ধরেন।
 
বিকেল ৪-৫টার দিকে ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিটে প্রধানমন্ত্রী হিথ সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। তিনি আমাদের খুব গভীর আন্তরিকভাবে গ্রহণ করলেন। তিনি বললেন, আপনাকে জানোনো হয়েছে, আমরা আপনাকে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে সংবর্ধনা দিচ্ছি। আমরা আপনাকে নিয়ে খুব চিন্তা করছিলাম এবং এখন আমাদের মাঝে আপনাকে পেয়ে আনন্দ পাচ্ছি। যত দূর সম্ভব আপনাকে সাহায্য করব। বঙ্গবন্ধু বললেন, তা তো করবেনই। আমরা আপনার দেশের স্বীকৃতি চাই। তিনি বললেন, রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে সংবর্ধনা দিচ্ছি। তবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেবো ইইউর অন্যান্য দেশকে সঙ্গে নিয়ে। এজন্য ১০-১৫ দিন সময় লাগতে পারে। সুতরাং ধরে নেন যে, আপনি স্বীকৃতি পেয়ে যাচ্ছেন। আর পুনর্বাসন কিংবা পুনর্গঠনের জন্যও যা সম্ভব সহযোগিতা করব। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আর কী সাহায্য লাগবে? বঙ্গবন্ধু বললেন, আপনি কি আমাদের প্লেন দিয়ে সাহায্য করবেন? কেননা আমি দ্রুত বাংলাদেশে যেতে চাই। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বললেন, অবশ্যই। হিথ সাহেবও তাত্ক্ষণিকভাবে তাঁর সেক্রেটারিকে বললেন, দেখো, আমার প্লেন ওখানে ব্যবস্থা করা যায় কিনা। আধঘণ্টা পর হিথ সাহেবের সেক্রেটারি এসে বললেন, কাল সকালে আপনার প্লেন রেডি হতে পারে। তাত্ক্ষণিকভাবে বঙ্গবন্ধু সিদ্ধান্ত নিলেন, কাল ৭টায় আমরা রওনা হয়ে যাব। বাংলাদেশ থেকে প্লেন গেলে আমাদের আরো দু’দিন লন্ডনে থাকতে হতো। আর বিভিন্ন জায়গা থেকে অনেক লোকজন আসবে। বঙ্গবন্ধু বললেন, লোকজনের সঙ্গে সাক্ষাত্ নয়, যত দ্রুত বাংলাদেশে যেতে পারি, সেটাই হবে আমাদের অগ্রাধিকার। পরে আমরা দিল্লি থামলাম। দিল্লির দৃশ্যটা আমার এখনো মনে পড়ে। বঙ্গবন্ধুকে তারা এমনভাবে সংবর্ধনা জানালেন, যেন তিনি পরিবারের একজন সদস্য। মিসেস গান্ধীসহ অনেকের চোখে পানি পড়ছে। ওখানে তিনি বাংলায় বক্তৃতা দিলেন। পরে ভারতের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করে আমরা দেশে ফিরে এলাম।

প্লেন থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে একটি ট্রাক এল। সেখানে ছিলেন তাজউদ্দীন ভাই, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতা ও ছাত্রনেতারা। আমরা ট্রাকে উঠলাম। ওপর থেকে দেখলাম, জনসমুদ্র। গাছের ওপরে, ছাদের ওপরে সবখানেই মানুষে ঠাসা। নামতে নামতে আমাকে বঙ্গবন্ধু দুটি বিষয় বললেন। তিনি বললেন, ‘আমরা কী ধরনের সরকার গঠন করব? আমাকে যদি বলো, আমি পার্টি নিয়ে থাকতে চাই। সরকার গঠন করুক আমার দলের অন্য নেতারা। আমি সবাইকে নিয়ে ঐক্য করা এবং বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর স্বীকৃতি আদায়ে রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে আলোচনা করতে চাই।’ আমি বললাম, এটা ঠিকই আছে। সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশের আরেক নাম হলো শেখ মুজিব। সুতরাং আপনি রাষ্ট্রপ্রধান, অন্ততপক্ষে প্রধানমন্ত্রী না হলে সমস্যা হবে। তিনি বললেন, রাষ্ট্রপতি না প্রধানমন্ত্রী হব? তখন বললাম, ছয় দফার মধ্যে আমরা সংসদীয় ব্যবস্থার কথা বলে আসছি। আপনি রাষ্ট্রপতি হলে সংসদীয় ব্যবস্থা লালন করা কঠিন হবে। কারণ পাকিস্তানের একটা অভিজ্ঞতা ছিল, সব ফাইল চলে যেত জিন্নাহর কাছে। এজন্য সেখানে সংসদীয় ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। আরো বললাম, আপনি যেখানে থাকবেন, সেখানেই সব ক্ষমতা থাকবে। আপনি যদি রাষ্ট্রপতি হয়ে যান, তাহলে সংসদীয় ব্যবস্থা গড়ে উঠবে না। তিনি বললেন, হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছ। তিনি নামলেন। পরে ১০ জানুয়ারির সেই ঐতিহাসিক ভাষণ দিলেন। এখানে একটি বিষয় উল্লেখযোগ্য। পাকিস্তানে থাকাকালে ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে সম্পর্ক রাখার ব্যাপারে পীড়াপীড়ি করছিল। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ঢাকায় যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি এর উত্তর দেবো। বঙ্গবন্ধু ভাষণে বলেছিলেন, ‘ভুট্টো, তুমি তো আমাকে বলেছিলে কিছু সম্পর্ক রাখার ব্যাপারে। আমি আজ এখানে এসে দেখেছি, শুনেছি, বুঝেছি কী ধরনের আক্রমণ চালানো হয়েছে, গণহত্যা হয়েছে। এরপরও দেখো, আমাদের দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক হোক, এটা আমি চাই। কিন্তু সেটা হবে দুই রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে। তোমাদের দেশের মানুষ ভালো থাকুক, এটা চাই। এছাড়া অন্য কোনো ভিত্তিতে আমাদের সম্পর্ক হবে না।’

লেখক :সংবিধান প্রণেতা ও রাজনীতিবিদ

SUMMARY

620-1.jpeg